দিল্লির চিঠি-ভুল থেকে শিক্ষা নেয়নি ভারত by কুলদীপ নায়ার

সম্প্রতি পুলিশের সঙ্গে ‘এনকাউন্টারে’ দুজন মাওবাদী নিহত হওয়ার ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বললেন, ‘পুলিশ ভারতের নাগরিকদের “এনকাউন্টারে” গুলি করে মারতে চায় না।’ এ দেশের নাগরিকসমাজ সুপ্রিম কোর্টের এই মন্তব্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না—এটা আমার কাছে অদ্ভুত লেগেছে।


বলপ্রয়োগের মাধ্যমে অসন্তোষ দমন করা সম্ভব—এই বিশ্বাসে সরকার কেন অটল? আমি মনে করি সহিংস পন্থায় কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। মাওবাদী ও নকশালপন্থীরা সশস্ত্র পথ বেছে নিয়ে নিজেদের আন্দোলনের মর্যাদাহানি ঘটাচ্ছে। এবং এটাও সত্য, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসও যথারীতি চলছে।
নকশালপন্থীদের ভারতে ‘সবচেয়ে গুরুতর অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা-হুমকি’ হিসেবে দেখানো হচ্ছে; রাষ্ট্র তাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ মাত্রায় শক্তি প্রয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দণ্ডকারণ্য এলাকা। ১৯৫৮ সালে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু দণ্ডকারণ্য ডেভেলপমেন্ট অথরিটি প্রতিষ্ঠার সময় ওই এলাকার জন্য একটি বিশেষ পুনর্বাসন কর্মসূচির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি কখনোই পূরণ করা হয়নি।
১৯৬০-এর দশকে পশ্চিমবঙ্গের নকশালবাড়ী, অন্ধ্র প্রদেশের শ্রীকাকুলাম প্রভৃতি অঞ্চলে প্রথম শুরু হয় সশস্ত্র আন্দোলন। ১৯৮০-এর দশকে এসে অন্ধ্র প্রদেশের কিছু গ্রুপ মধ্যপ্রদেশের প্রত্যন্ত বস্তার অঞ্চলে সরে গিয়ে ঘাঁটি গড়ে তোলে। ওই অঞ্চলে তাদের উপস্থিতির ফলে পাটোয়ারি-হাওলাদার-দফাদারদের শোষণ-নির্যাতনের শিকার সাধারণ আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে কিছুটা স্বস্তি দেখা দেয়। বস্তার অঞ্চলে ভাষাগত সমস্যা নকশালপন্থীদের ঘাঁটি সংহত করার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছিল। অন্যরা স্থানীয় আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভাষাগত সমস্যার মুখোমুখি হতো। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের জাতীয় নীতিমালা চাপা পড়ে যায় হিন্দি ভাষায় শিক্ষাদানের বাধ্যতামূলক নির্দেশনার ফলে। তাই বহিরাগতদের সঙ্গে জনসাধারণের যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় কিছু মধ্যস্বত্বভোগী বা বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত অল্প কিছু মানুষ। এই পরিস্থিতিতে নকশালপন্থীরা সেই অঞ্চলের আদিবাসীদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ স্থাপন করে। তারা আদিবাসী যুবকদের নিজেদের কর্মী বাহিনী হিসেবে গ্রহণ করা শুরু করে, তাদের মধ্যে নানামুখী ভাবনাচিন্তা ও তথ্য সরবরাহ করে। এই ক্ষেত্রটিতে নকশালপন্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বী আর কেউ ছিল না। ১৯৩০-এর দশক থেকে যে আবুঝামর এলাকাকে সাধারণ প্রশাসনের দৃষ্টিসীমার বাইরে রাখা হয়েছিল, যেখানে বাইরের লোকজনকে ঢুকতে দেওয়া হতো না, সেটাই হয়ে ওঠে নকশালপন্থীদের সবচেয়ে প্রিয় এলাকা। এভাবে নকশালপন্থীরা বস্তার অঞ্চলের একটি অংশে নিজেদের শক্ত ঘাঁটিগুলো সংহত করে একটি ‘মুক্তাঞ্চল’ গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছে।
অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার হুমকি মোকাবিলার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে রাষ্ট্র ওই অঞ্চলে সেনাবাহিনী ছাড়া আর সব বাহিনীর সম্ভাব্য সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করেছে। শত শত গ্রাম হয় জনশূন্য হয়ে গেছে, নয় আবদ্ধ শিবিরে পরিণত হয়েছে। অনেক মানুষ পাশের রাজ্যগুলোয় পালিয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্র ও নকশালপন্থীদের মধ্যে সংলাপের সম্ভাবনা নেই। অন্ধ্র প্রদেশের অভিজ্ঞতা এক বিপর্যয়ের অভিজ্ঞতা।
আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলোর প্রকৃত সমস্যা সম্পর্কে শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গিতেই সমস্যা আছে। সে কারণে তাঁরা প্রথম থেকেই ভুল করেছেন। উন্নয়নের নামে একজন আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন আদিবাসী নাগরিককে সবচেয়ে অপমানজনক যে বিষয়টি হজম করতে হয়েছে, তা হলো, সরকারি কর্তৃপক্ষ ও অন্যরা তাঁদের অভিহিত করেছে ‘দরিদ্র’ বলে। এটা করা হয় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে, যাতে করে রাজনীতিক, সরকারি কর্মকর্তা ও অভিজাত সম্প্রদায়ের মানুষ দেখাতে পারেন, তাঁরা আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলোর শুভাকাঙ্ক্ষী। নির্মম সত্যটা হলো, আদিবাসীরা দরিদ্র নয়, বরং তাদের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
আদিবাসীদের উত্তরাধিকার থেকে বিচ্ছিন্ন ও বঞ্চিত করার প্রক্রিয়া শুরু হয় ১৯৭৪ সালে আদিবাসী এলাকাগুলোতে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে মদ বিক্রি বন্ধ এবং ১৯৭৬ সালে আদিবাসী ও বনমন্ত্রীদের সম্মেলনে স্বল্প পরিমাণ বনজ সম্পদের মালিকানার স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে। এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ও প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা ওই দশকের শেষ নাগাদ বিস্মৃতিতে চলে যায়। কিন্তু ভাগ্যান্বেষী মানুষ দলে দলে ছুটে যায় আদিবাসী এলাকাগুলোতে, যেভাবে আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় সোনা পাওয়ার পর ছুটে গিয়েছিল লাখ লাখ মানুষ।
ভারতের আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলোর নিজ নিজ এলাকা আছে। নিজেদের প্রাচীন রীতিনীতি ও ঐতিহ্য অনুসারে তারা তাদের সব কাজকর্ম করে থাকে একটি ‘গ্রামীণ প্রজাতন্ত্রের’ সদস্যদের মতো। রাষ্ট্র ব্যক্তিগত মালিকানার মডেল কার্যকর করলেও ভূমি এখন পর্যন্ত কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়। অনেক সম্প্রদায়ের মধ্যে, বিশেষত উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পত্তির সামাজিক মালিকানা ও ব্যক্তিগত ব্যবহারের রীতি আজও চালু আছে।
একজন আদিবাসী মানুষ বাস করে বর্তমানে, ভবিষ্যৎ নিয়ে তার কোনো চিন্তা নেই। অনেক আদিবাসী ভাষায় ক্রিয়াপদের কালে ভবিষ্যৎ কাল বলে কিছু নেই। তাদের অর্থনীতি জীবনযাপনের অর্থনীতি, উদ্বৃত্ত জমানো বা মুনাফা সৃষ্টির অর্থনীতি নয়। তারা একান্তভাবে নির্ভরশীল বনজ আর জলজ সম্পদের ওপর, যা মা প্রকৃতি তাদের উদার হাতে দান করেছে। একজন মানুষ কথা দিয়ে কথা রাখে এবং এ জন্য সে গর্ব বোধ করে। একজন নাগা গোত্রধানের কথা স্মরণ করা যেতে পারে, যিনি একটা আদালতে হাজির হয়েছিলেন। তাঁকে একজন উকিল জেরা করছিলেন বলে রাগ করে তিনি আদালত থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, আর কখনোই আদালতের কাছে বিচার চাইতে আসবেন না। সত্যিই তিনি আর কখনো আদালতে আসেননি।
আদিবাসীদের এলাকাগুলোয় বেশ কয়েকবার অভিযান চালিয়ে ব্যর্থ হয়ে ব্রিটিশরা আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলোর স্বাধীনচেতা মানসিকতার পরিচয় পেয়েছিল এবং তাদের মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। তারা পুরো সম্প্রদায়ের মানুষের মুখোমুখি দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছিল। এটা একটা অসত্য কথা যে ব্রিটিশরা আদিবাসী এলাকাগুলো জয় করেছিল। ব্রিটিশদের কর্তৃত্ব মেনে নিতে জনগণের অস্বীকৃতিই ছিল আদিবাসী এলাকাগুলোর বড় বড় বিদ্রোহের মূলে।
সংবিধান গ্রহণের মধ্য দিয়ে আদিবাসী এলাকাগুলোর আইনব্যবস্থায় কিছু গুণগত পরিবর্তন আসে। ১৯৫০ সালের সংবিধানের পঞ্চম তফসিলে বিভিন্ন রাজ্যের কিছু পরিত্যক্ত ও আংশিক পরিত্যক্ত এলাকা এবং দেশীয় রাজ্যকে তফসিলি এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। কিন্তু পরিহাসের বিষয়, তফসিলি এলাকাগুলোর একটি প্রায়-আদর্শ কাঠামো বস্তুত অকার্যকর হয়ে পড়ে ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর সংবিধান গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে।
বস্তারের কথাই ধরা যাক, বিরোধ নিষ্পত্তির ঐতিহ্যগত ব্যবস্থা সেখানে এতই শক্তিশালী ও ব্যাপক যে পুরো জেলাটির প্রতি থানায় গড়ে প্রতি দুই বছরে একটি করে বিরোধ এভাবে নিষ্পত্তি করা হয়। কিন্তু এভাবে বিরোধ-নিষ্পত্তি আইন দ্বারা অনুমোদিত নয়। সুতরাং গ্রাম পরিষদগুলোর পুরো কর্মপ্রণালিই হচ্ছে আইন লঙ্ঘন করে, বিশেষত জামিন-অযোগ্য মামলাগুলোর ক্ষেত্রে। ঐতিহ্যগত পন্থায় বিরোধ নিষ্পত্তি হলে এবং সব পক্ষ তা মেনে নিলেও গ্রাম পরিষদের যেকোনো সদস্যের বিরুদ্ধে পুলিশ আইনি পদক্ষেপ নিতে পারে।
এত কিছু সত্ত্বেও সরকার বস্তার অঞ্চলের কিছু গ্রামের ব্যাপারে এই নোটিশ তুলে নিয়েছে যে তাদের ক্ষেত্রে ১৯৬৬ সালের পঞ্চায়েত (এক্সেনশান টু শিডিউলড এরিয়াজ) আইন প্রযোজ্য হবে না। এই আইনটি বিশেষভাবে প্রণয়ন করা হয়েছিল আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলোকে নিজেদের ভূমির ওপর নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অধিকার দেওয়ার লক্ষ্যে। রাষ্ট্র তার নিজের ভুলগুলো থেকে এ পর্যন্ত কোনো শিক্ষা নেয়নি।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতের সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.