অরণ্যে রোদন-বাংলাদেশ যদি চলতে চায় by আনিসুল হক
বাংলাদেশটা কি চলছে নাকি থেমে আছে? কথাটা আলংকারিক অর্থে নয়, বলতে চাইছি বাস্তব অর্থে। বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থার হালটা কী? চলছে নিশ্চয়ই। নইলে তো সবকিছু থেমে যেত, বাজারে চাল-ডাল কিছুই মিলত না, পদ্মার ইলিশের পিঠে রুপোলি আলো ফেলতে পারত না কারওয়ান বাজারের রোদ,
আর মহেশখালীর অজপাড়াগাঁর মুদির দোকানে মিলত না মিনিপ্যাক শ্যাম্পু। কিন্তু সেই চলাটা কতটা ভালোভাবে চলা? নিজের অফিসকক্ষে বসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি নজরুল ইসলাম এভিনিউয়ের দিকে। কই, চলছে না তো। সবকিছু থেমে আছে। বেশির ভাগ ব্যক্তিমালিকাধীন গাড়ি, আমরা যেসবকে বলি প্রাইভেট কার, সেসবই রাস্তার বেশির ভাগটা জুড়ে; ডেইলি স্টার-এ খবর বেরিয়েছে, ঢাকার রাস্তার ৭০ শতাংশ জুড়ে থাকে এসব গাড়ি, অথচ গাড়িতে মাত্র ৪ শতাংশ যাত্রী চলাচল করে। সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ, ৬২ শতাংশ চলে হেঁটে, এর পরে আছে রিকশাযাত্রীর সংখ্যা, ১৩ শতাংশ, তারপর বাস, ১০ শতাংশ। ৪ শতাংশ যাত্রীর জন্য রাস্তার ৭০ শতাংশ ছেড়ে দিয়েছি আমরা, অথচ সবচেয়ে বেশি জায়গা দাবি করে পথচারীরা, তারাই সংখ্যায় বেশি। দিল্লির বিজ্ঞান ও পরিবেশ কেন্দ্র ও বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম পরিচালিত গবেষণাপত্রের সূত্র ধরে ২৩ জানুয়ারির ডেইলি স্টার-এ বেরিয়েছে এই খবর। এই গবেষণাপত্রের সুপারিশ হলো, ঢাকার রাস্তায় বাসে ভ্রমণকারীদের সংখ্যা বাড়ানো, আর প্রাইভেট কার নিরুৎসাহিত করা।
তবে আরেকটা খবর বেরিয়েছে একই দিনের ডেইলি স্টার-এ। বাংলাদেশ রেলওয়ে ঢাকার নিয়মিত যাত্রীদের ভোগান্তি কমানোর জন্য ২৫টা নতুন সেবা কর্মসূচি চালু করতে যাচ্ছে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ নতুন ট্রেনসেবা উদ্বোধন করতে গিয়ে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন জানিয়েছেন, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-জয়দেবপুর, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ নতুন নতুন ট্রেন সার্ভিস চালু করা হবে। আগামী বছর নাগাদ সেসব চলতে শুরু করলে ঢাকার রাস্তার ওপরে চাপ কমবে, মানুষের জন্য চলাচল খানিকটা সহজ হবে।
যানজট যে কেবল ঢাকায় হচ্ছে, তা নয়, সারা দেশের সব শহরেই যানজট লেগে আছে, কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর কথা, যেটা সবাই জানি, কিন্তু প্রায় কেউই যা নিয়ে আলোচনা করছি না, আমাদের মহাসড়কগুলোতেও যানজট লেগে আছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজট না থাকলে যেখানে পাঁচ ঘণ্টায় ভ্রমণ করা সম্ভব, সেখানে ওই পথটুকু পাড়ি দিতে কতক্ষণ লাগবে, তা কেউ বলতে পারে না। ওই মহাসড়কে একটা ট্রাক উল্টে থাকলেই যানজট লেগে যায় কয়েক মাইল লম্বা, সবকিছু থেমে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। একই ঘটনা ঘটে ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল যাওয়ার পথে, বঙ্গবন্ধু সেতু অভিমুখী মহাসড়কে, যা কিনা গোটা উত্তরবঙ্গ আর দক্ষিণবঙ্গের অনেকাংশ যুক্ত রাখে রাজধানীর সঙ্গে। চন্দ্রায় কিংবা করোটিয়ায় কিংবা মির্জাপুরের কোথাও একটা সড়ক দুর্ঘটনা ঘটল কি সবকিছু অচল। আর ঈদের আগে-পরে এই রাস্তাগুলোয় যাত্রীরা আটকে থাকেন দিনের পর দিন, অনেকেই ঈদের নামাজ পড়েন মহাসড়কের পাশে।
এ কারণেই প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশটা কি আসলে চলছে?
বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থাকে আমরা বানিয়ে তুলেছি সড়কনির্ভর। এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, দেশের মোট যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের ৭০ শতাংশ চালিত হচ্ছে সড়কপথে। অথচ ঐতিহ্যগতভাবে এ দেশের প্রধান যোগাযোগের মাধ্যম ছিল নৌপথ। এটাই সবচেয়ে সস্তা। এর পরেই আসে রেলের কথা। রেল যোগাযোগ অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব, জ্বালানিসাশ্রয়ী ও কম ব্যয়বহুল। স্বাধীনতার পর আমাদের সড়কপথ অনেক প্রসারিত হয়েছে, কিন্তু সেই তুলনায় রেলপথ বাড়েনি বললেই চলে। বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থাকে সড়কনির্ভর করার ফলটা দাঁড়িয়েছে, আমাদের আকাশ-বাতাসকে আমরা করে ফেলেছি দূষিত, জ্বালানি খাতে টাকা গুনতে হচ্ছে কাঁড়ি কাঁড়ি, কখন কোথায় বের হয়ে কবে, কোথায় পৌঁছাব আমরা জানি না। আমাদের দরিদ্র দেশের সরকারের পক্ষে সড়ক বানিয়ে দেওয়াটা আপাতত সহজ, কারণ এরপর বাস কিংবা গাড়ির দায়িত্ব আর সরকারকে নিতে হয় না। বেসরকারি খাত বাস-ট্রাক নামিয়ে নিজেদের মতো করে বাকিটা চালিয়ে নেয়।
কিন্তু আমাদের যোগাযোগব্যবস্থা হওয়া উচিত রেলভিত্তিক। আমাদের জোর দেওয়া উচিত নৌ-যোগাযোগ আর রেল-যোগাযোগের ওপরে। আমেরিকায় মোটরগাড়ির নির্মাতাদের চাপে যোগাযোগব্যবস্থাকে সড়কনির্ভর করা হয়। ওরা তখন হয়তো ভেবেছিল ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা, একটা গাড়ি একজন নাগরিককে দেয় চলাচলের স্বাধীনতা আর রেলগাড়িতে চলাচল অনেকটাই রেল কোম্পানির ওপরে নির্ভরশীল করে তোলে, হয়তো ব্যাপারটার মধ্যে একটা সাম্যবাদী গন্ধ ছিল। সেই ভুল এখন ওরা টের পাচ্ছে হাড়ে হাড়ে। নির্বাচনের আগে বারাক ওবামা বলেছিলেন, ‘রেল খুবই দক্ষ একটা যোগাযোগের মাধ্যম, এটা আমাদের মহাসড়কগুলোকে যানজট থেকে বাঁচাতে পারে। নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব, জ্বালানিসাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য যোগাযোগব্যবস্থার প্রাণ হলো রেল। যেটা হতে পারে আমাদের পরিবহন সমস্যা ও জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যার সমাধান। কাজেই আমরা যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে রেলব্যবস্থাকে উন্নত করার জন্য তহবিল বরাদ্দে মোটেও সময়ক্ষেপণ করতে পারি না।’ একটা মালবাহী রেল একটা ট্রাকের চেয়ে তিন থেকে ছয় গুণ বেশি সাশ্রয়ী, ১২ গুণ পর্যন্ত পরিবেশবান্ধব, একটা ট্রেন এক হাজার ১০০টি গাড়ির সমান মাল বহন করতে পারে।
আমরা আমাদের সড়কগুলোকে মৃত্যুফাঁদে পরিণত করেছি। ২০০৯ সালে এ দেশে প্রায় চার হাজার জন মারা গেছে সড়ক দুর্ঘটনায়। আহত যে কত হয়েছে, কে তার সুমার রাখে। এক হিসাবে বলা হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর আমাদের আর্থিক ক্ষতি হয় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান শিকার কিন্তু পথচারীরা। আমাদের মহাসড়কগুলো তো আসলে নামেই মহাসড়ক, এতে রিকশা, সাইকেল, মোটরসাইকেল, বেবিট্যাক্সি, গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি সবই চলে, আর মহাসড়কের দুই পাশেই গড়ে ওঠে দোকানপাট, হাটবাজার। ফলে এই মৃত্যু রোধ করাও খুব কঠিন। বাংলাদেশ যখন অর্থনৈতিক দিক থেকে যথেষ্ট সচ্ছল হয়ে উঠবে, তখন হয়তো আমরা এমন মহাসড়ক নির্মাণ করতে পারব, যাতে স্থানীয় যানবাহন বা পথচারীরা উঠতে পারবে না, কিন্তু আপাতত এই চিন্তা একটা আকাশকুসুম স্বপ্ন মাত্র।
এসব সমস্যার সমাধান হতে পারে আমাদের যোগাযোগব্যবস্থাকে রেলভিত্তিক করে গড়ে তোলা। আমাদের নৌপথগুলোকে নিরাপদ আর আধুনিক করে গড়ে তোলা। সে জন্য দরকার একটা মহাপরিকল্পনা। আমাদের দরকার একটা জাতীয় যোগাযোগ ও পরিবহন নীতি।
সড়কনির্ভর যোগাযোগ আমাদের সমস্যার সমাধান নয়। সড়কের নিয়ম হলো, যতই তুমি রাস্তাঘাট বানাও না কেন, গাড়ির সংখ্যা সব সময়ই রাস্তার ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি হবে। একটা শহরে রাস্তা থাকার কথা শহরের আয়তনের ২৫ শতাংশ, ঢাকায় সেটা আছে ৯ শতাংশের মতো, এই রাস্তার আবার বেশির ভাগটা দোকানপাট, নির্মাণসামগ্রী আর গাড়ি পার্কিং দিয়ে ঢাকা থাকে। আমরা রাস্তার সংখ্যা যতই বাড়াই না কেন, আমাদের ট্রাফিক ব্যবস্থাকে সহজ করতে পারব না। এ দেশে মানুষের হাতে টাকা এলেই সে প্রথমে যে কাজটা করে, তা হলো একটা গাড়ি কেনা। এটা কেবল তার শ্রেণী-উত্তরণ ঘটায়, তা-ই না, এটা তাকে নিরাপত্তা দেয়। হয়তো তার চলাচলের দক্ষতাও বাড়ায়। কারণ একটাই—আমাদের গণপরিবহন ব্যবস্থা নেই। আমাদের অবশ্যই গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সে ক্ষেত্রে সড়কনির্ভরতার স্থলে আমাদের রেলভিত্তিক যোগাযোগের দিকে যেতেই হবে।
এটা কি সুস্থতার লক্ষণ যে দেশের হূৎপিণ্ড চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে সারা দেশে মালামাল পরিবহনের জন্য আমাদের প্রধান নির্ভরতা সড়কের ওপরে? আমরা নির্ভর করেছি সেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপরে, যা কারণে-অকারণে প্রায়ই বন্ধ থাকে। আমরা কেন ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে রেলগাড়িতে করে চার ঘণ্টায় যেতে পারব না? কেন ঢাকা থেকে খুলনা বা রংপুরে ট্রেন যাবে না ছয় ঘণ্টা বা তারও কম সময়ে?
আমরা যদি সড়কনির্ভরতা কমিয়ে আমাদের যোগাযোগব্যবস্থায় রেল ও নৌপথকে গুরুত্ব দিই, তাহলে আমরা কম খরচে বেশি মালামাল ও যাত্রী পরিবহন করতে পারব, আর আমরা কার্বন নিঃসরণ কম করে আমাদের যোগাযোগব্যবস্থাকে সবুজ বা পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তুলতে পারব। আমরা পৃথিবীকে বলতে পারব, দেখো, তোমাদের পাপে পৃথিবীতে যে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে, আমরা তার প্রধান শিকার বটে, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা আমাদের দেশটাকে সবুজ করেই রেখেছি। আমাদের কাছ থেকে শেখো। আর যানজট সমস্যার সমাধানও হলো রেল-যোগাযোগকে আধুনিক সময়োপযোগী করা আর ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা। তবে যা-ই করা হোক না কেন, তা করতে হবে বিশেষজ্ঞ গবেষণা দ্বারা প্রণীত একটা মহাপরিকল্পনা অনুসারে, সুসমন্বিতভাবে। কোনো নেতার মনে হলো, এখানে একটা উড়ালসেতু চাই, কোনো স্বার্থান্বেষী মহল তদবির করল কোথাও একটা প্রকল্প গ্রহণ করতে আর অমনি আমরা লেগে পড়লাম উদ্বোধনের পাথর বসাতে, তা যেন না হয়। দুর্নীতিগ্রস্ত এ দেশে একটা প্রকল্প মানেই তো পুকুরচুরির নতুন পথ উন্মোচিত করা। মহলবিশেষের স্বার্থে নয়, পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে দেশের স্বার্থে, মানুষের কল্যাণে।
শুরুর প্রশ্নে ফিরে আসি আবারও। বাংলাদেশটা কি চলছে, নাকি থেমে আছে? ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন, বাংলাদেশটা কি চলবে, নাকি থেমে যাবে যানজটে? বাংলাদেশকে যদি চলতে হয়, তাহলে রেলগাড়িতেই চলতে হবে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন, ও তার ঘুম ভাঙাইনু রে... অচল ছিল, সচল হয়ে ছুটেছে ওই জগৎজয়ে— নির্ভয়ে আজ দুই হাতে তার রাশ বাগাইনু রে\’ অচলকে সচল করতে হলে রেলের কাছেই আমাদের যেতে হবে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
তবে আরেকটা খবর বেরিয়েছে একই দিনের ডেইলি স্টার-এ। বাংলাদেশ রেলওয়ে ঢাকার নিয়মিত যাত্রীদের ভোগান্তি কমানোর জন্য ২৫টা নতুন সেবা কর্মসূচি চালু করতে যাচ্ছে। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ নতুন ট্রেনসেবা উদ্বোধন করতে গিয়ে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন জানিয়েছেন, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-জয়দেবপুর, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ নতুন নতুন ট্রেন সার্ভিস চালু করা হবে। আগামী বছর নাগাদ সেসব চলতে শুরু করলে ঢাকার রাস্তার ওপরে চাপ কমবে, মানুষের জন্য চলাচল খানিকটা সহজ হবে।
যানজট যে কেবল ঢাকায় হচ্ছে, তা নয়, সারা দেশের সব শহরেই যানজট লেগে আছে, কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর কথা, যেটা সবাই জানি, কিন্তু প্রায় কেউই যা নিয়ে আলোচনা করছি না, আমাদের মহাসড়কগুলোতেও যানজট লেগে আছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানজট না থাকলে যেখানে পাঁচ ঘণ্টায় ভ্রমণ করা সম্ভব, সেখানে ওই পথটুকু পাড়ি দিতে কতক্ষণ লাগবে, তা কেউ বলতে পারে না। ওই মহাসড়কে একটা ট্রাক উল্টে থাকলেই যানজট লেগে যায় কয়েক মাইল লম্বা, সবকিছু থেমে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। একই ঘটনা ঘটে ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল যাওয়ার পথে, বঙ্গবন্ধু সেতু অভিমুখী মহাসড়কে, যা কিনা গোটা উত্তরবঙ্গ আর দক্ষিণবঙ্গের অনেকাংশ যুক্ত রাখে রাজধানীর সঙ্গে। চন্দ্রায় কিংবা করোটিয়ায় কিংবা মির্জাপুরের কোথাও একটা সড়ক দুর্ঘটনা ঘটল কি সবকিছু অচল। আর ঈদের আগে-পরে এই রাস্তাগুলোয় যাত্রীরা আটকে থাকেন দিনের পর দিন, অনেকেই ঈদের নামাজ পড়েন মহাসড়কের পাশে।
এ কারণেই প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশটা কি আসলে চলছে?
বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থাকে আমরা বানিয়ে তুলেছি সড়কনির্ভর। এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, দেশের মোট যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের ৭০ শতাংশ চালিত হচ্ছে সড়কপথে। অথচ ঐতিহ্যগতভাবে এ দেশের প্রধান যোগাযোগের মাধ্যম ছিল নৌপথ। এটাই সবচেয়ে সস্তা। এর পরেই আসে রেলের কথা। রেল যোগাযোগ অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব, জ্বালানিসাশ্রয়ী ও কম ব্যয়বহুল। স্বাধীনতার পর আমাদের সড়কপথ অনেক প্রসারিত হয়েছে, কিন্তু সেই তুলনায় রেলপথ বাড়েনি বললেই চলে। বাংলাদেশের যোগাযোগব্যবস্থাকে সড়কনির্ভর করার ফলটা দাঁড়িয়েছে, আমাদের আকাশ-বাতাসকে আমরা করে ফেলেছি দূষিত, জ্বালানি খাতে টাকা গুনতে হচ্ছে কাঁড়ি কাঁড়ি, কখন কোথায় বের হয়ে কবে, কোথায় পৌঁছাব আমরা জানি না। আমাদের দরিদ্র দেশের সরকারের পক্ষে সড়ক বানিয়ে দেওয়াটা আপাতত সহজ, কারণ এরপর বাস কিংবা গাড়ির দায়িত্ব আর সরকারকে নিতে হয় না। বেসরকারি খাত বাস-ট্রাক নামিয়ে নিজেদের মতো করে বাকিটা চালিয়ে নেয়।
কিন্তু আমাদের যোগাযোগব্যবস্থা হওয়া উচিত রেলভিত্তিক। আমাদের জোর দেওয়া উচিত নৌ-যোগাযোগ আর রেল-যোগাযোগের ওপরে। আমেরিকায় মোটরগাড়ির নির্মাতাদের চাপে যোগাযোগব্যবস্থাকে সড়কনির্ভর করা হয়। ওরা তখন হয়তো ভেবেছিল ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা, একটা গাড়ি একজন নাগরিককে দেয় চলাচলের স্বাধীনতা আর রেলগাড়িতে চলাচল অনেকটাই রেল কোম্পানির ওপরে নির্ভরশীল করে তোলে, হয়তো ব্যাপারটার মধ্যে একটা সাম্যবাদী গন্ধ ছিল। সেই ভুল এখন ওরা টের পাচ্ছে হাড়ে হাড়ে। নির্বাচনের আগে বারাক ওবামা বলেছিলেন, ‘রেল খুবই দক্ষ একটা যোগাযোগের মাধ্যম, এটা আমাদের মহাসড়কগুলোকে যানজট থেকে বাঁচাতে পারে। নিরাপদ, পরিবেশবান্ধব, জ্বালানিসাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য যোগাযোগব্যবস্থার প্রাণ হলো রেল। যেটা হতে পারে আমাদের পরিবহন সমস্যা ও জলবায়ু পরিবর্তন সমস্যার সমাধান। কাজেই আমরা যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে রেলব্যবস্থাকে উন্নত করার জন্য তহবিল বরাদ্দে মোটেও সময়ক্ষেপণ করতে পারি না।’ একটা মালবাহী রেল একটা ট্রাকের চেয়ে তিন থেকে ছয় গুণ বেশি সাশ্রয়ী, ১২ গুণ পর্যন্ত পরিবেশবান্ধব, একটা ট্রেন এক হাজার ১০০টি গাড়ির সমান মাল বহন করতে পারে।
আমরা আমাদের সড়কগুলোকে মৃত্যুফাঁদে পরিণত করেছি। ২০০৯ সালে এ দেশে প্রায় চার হাজার জন মারা গেছে সড়ক দুর্ঘটনায়। আহত যে কত হয়েছে, কে তার সুমার রাখে। এক হিসাবে বলা হচ্ছে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর আমাদের আর্থিক ক্ষতি হয় পাঁচ হাজার কোটি টাকা। আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান শিকার কিন্তু পথচারীরা। আমাদের মহাসড়কগুলো তো আসলে নামেই মহাসড়ক, এতে রিকশা, সাইকেল, মোটরসাইকেল, বেবিট্যাক্সি, গরুর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি সবই চলে, আর মহাসড়কের দুই পাশেই গড়ে ওঠে দোকানপাট, হাটবাজার। ফলে এই মৃত্যু রোধ করাও খুব কঠিন। বাংলাদেশ যখন অর্থনৈতিক দিক থেকে যথেষ্ট সচ্ছল হয়ে উঠবে, তখন হয়তো আমরা এমন মহাসড়ক নির্মাণ করতে পারব, যাতে স্থানীয় যানবাহন বা পথচারীরা উঠতে পারবে না, কিন্তু আপাতত এই চিন্তা একটা আকাশকুসুম স্বপ্ন মাত্র।
এসব সমস্যার সমাধান হতে পারে আমাদের যোগাযোগব্যবস্থাকে রেলভিত্তিক করে গড়ে তোলা। আমাদের নৌপথগুলোকে নিরাপদ আর আধুনিক করে গড়ে তোলা। সে জন্য দরকার একটা মহাপরিকল্পনা। আমাদের দরকার একটা জাতীয় যোগাযোগ ও পরিবহন নীতি।
সড়কনির্ভর যোগাযোগ আমাদের সমস্যার সমাধান নয়। সড়কের নিয়ম হলো, যতই তুমি রাস্তাঘাট বানাও না কেন, গাড়ির সংখ্যা সব সময়ই রাস্তার ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি হবে। একটা শহরে রাস্তা থাকার কথা শহরের আয়তনের ২৫ শতাংশ, ঢাকায় সেটা আছে ৯ শতাংশের মতো, এই রাস্তার আবার বেশির ভাগটা দোকানপাট, নির্মাণসামগ্রী আর গাড়ি পার্কিং দিয়ে ঢাকা থাকে। আমরা রাস্তার সংখ্যা যতই বাড়াই না কেন, আমাদের ট্রাফিক ব্যবস্থাকে সহজ করতে পারব না। এ দেশে মানুষের হাতে টাকা এলেই সে প্রথমে যে কাজটা করে, তা হলো একটা গাড়ি কেনা। এটা কেবল তার শ্রেণী-উত্তরণ ঘটায়, তা-ই না, এটা তাকে নিরাপত্তা দেয়। হয়তো তার চলাচলের দক্ষতাও বাড়ায়। কারণ একটাই—আমাদের গণপরিবহন ব্যবস্থা নেই। আমাদের অবশ্যই গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সে ক্ষেত্রে সড়কনির্ভরতার স্থলে আমাদের রেলভিত্তিক যোগাযোগের দিকে যেতেই হবে।
এটা কি সুস্থতার লক্ষণ যে দেশের হূৎপিণ্ড চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর থেকে সারা দেশে মালামাল পরিবহনের জন্য আমাদের প্রধান নির্ভরতা সড়কের ওপরে? আমরা নির্ভর করেছি সেই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ওপরে, যা কারণে-অকারণে প্রায়ই বন্ধ থাকে। আমরা কেন ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে রেলগাড়িতে করে চার ঘণ্টায় যেতে পারব না? কেন ঢাকা থেকে খুলনা বা রংপুরে ট্রেন যাবে না ছয় ঘণ্টা বা তারও কম সময়ে?
আমরা যদি সড়কনির্ভরতা কমিয়ে আমাদের যোগাযোগব্যবস্থায় রেল ও নৌপথকে গুরুত্ব দিই, তাহলে আমরা কম খরচে বেশি মালামাল ও যাত্রী পরিবহন করতে পারব, আর আমরা কার্বন নিঃসরণ কম করে আমাদের যোগাযোগব্যবস্থাকে সবুজ বা পরিবেশবান্ধব করে গড়ে তুলতে পারব। আমরা পৃথিবীকে বলতে পারব, দেখো, তোমাদের পাপে পৃথিবীতে যে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে, আমরা তার প্রধান শিকার বটে, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা আমাদের দেশটাকে সবুজ করেই রেখেছি। আমাদের কাছ থেকে শেখো। আর যানজট সমস্যার সমাধানও হলো রেল-যোগাযোগকে আধুনিক সময়োপযোগী করা আর ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলা। তবে যা-ই করা হোক না কেন, তা করতে হবে বিশেষজ্ঞ গবেষণা দ্বারা প্রণীত একটা মহাপরিকল্পনা অনুসারে, সুসমন্বিতভাবে। কোনো নেতার মনে হলো, এখানে একটা উড়ালসেতু চাই, কোনো স্বার্থান্বেষী মহল তদবির করল কোথাও একটা প্রকল্প গ্রহণ করতে আর অমনি আমরা লেগে পড়লাম উদ্বোধনের পাথর বসাতে, তা যেন না হয়। দুর্নীতিগ্রস্ত এ দেশে একটা প্রকল্প মানেই তো পুকুরচুরির নতুন পথ উন্মোচিত করা। মহলবিশেষের স্বার্থে নয়, পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে দেশের স্বার্থে, মানুষের কল্যাণে।
শুরুর প্রশ্নে ফিরে আসি আবারও। বাংলাদেশটা কি চলছে, নাকি থেমে আছে? ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন, বাংলাদেশটা কি চলবে, নাকি থেমে যাবে যানজটে? বাংলাদেশকে যদি চলতে হয়, তাহলে রেলগাড়িতেই চলতে হবে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘কঠিন লোহা কঠিন ঘুমে ছিল অচেতন, ও তার ঘুম ভাঙাইনু রে... অচল ছিল, সচল হয়ে ছুটেছে ওই জগৎজয়ে— নির্ভয়ে আজ দুই হাতে তার রাশ বাগাইনু রে\’ অচলকে সচল করতে হলে রেলের কাছেই আমাদের যেতে হবে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments