পাকিস্তান-সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে ‘পাকিস্তানি কায়দার’ সমাধান দরকার by হামিদ মির
সালমান তাসিরকে নিয়ে লেখা আমার জন্য বেশ কষ্টসাধ্য। একসময় তিনি আমার ভালো বন্ধু ছিলেন এবং পরে আবার তিনিই আমার ভয়ংকর শত্রু হয়ে ওঠেন। গভর্নর হিসেবে অনেক টিভি অনুষ্ঠানে তিনি আমার বিরুদ্ধে বলেছেন। ২০০৭ সালের ৩ নভেম্বর জরুরি অবস্থা জারির পর স্বৈরশাসক পারভেজ মোশাররফের সঙ্গে যোগ দেওয়ায় আমি তাঁর বিরুদ্ধে গত কয়েক বছর অনেক লিখেছি।
আমি পাকিস্তানের পদচ্যুত প্রধান বিচারপতির পক্ষে ছিলাম। প্রথমদিকে পারভেজ মোশাররফ এবং পরে প্রেসিডেন্ট জারদারিকে সাহায্য করে সালমান তাসির পদচ্যুত বিচারকদের পুনর্বহাল প্রক্রিয়া বন্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি সাবেক স্বৈরশাসককে পাঁচ বছরের জন্য প্রেসিডেন্ট হিসেবে গ্রহণ করতে জারদারিকে চাপ দেবেন, এ প্রত্যাশায় মোশাররফ ২০০৮ সালের মে মাসে তাঁকে পাঞ্জাবের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ দেন।
মোশাররফের ধারণা ভুল ছিল। শেষ পর্যন্ত জারদারিই মোশাররফকে পদত্যাগ করতে চাপ দিয়েছেন এবং তাসিরের সহায়তায় প্রেসিডেন্ট পদে বসেছেন।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই জারদারি আমার সঙ্গে তাসিরের সাক্ষাৎকারের আয়োজন করেন এবং মতপার্থক্য ভুলে যেতে বলেন। কারণ, জারদারি জানতেন, আমাদের মধ্যে গত ২০ বছরের (১৯৮৭-২০০৭) বন্ধুত্ব ছিল। দুর্ভাগ্যবশত, জারদারি তাঁর গভর্নর ও একজন সাংবাদিকের মধ্যে অবিশ্বাস দূর করতে ব্যর্থ হন। আমরা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে বিব্রত করেছি। পরবর্তী দুই বছর আমরা অনেকবার একে অন্যের বিরুদ্ধে বলেছি, বিশেষ করে, পদচ্যুত বিচারকদের পুনর্বহাল আন্দোলন দমাতে জারদারি যখন পাঞ্জাবে গভর্নরের (কেন্দ্রীয়) শাসন চাপিয়ে দিলেন। জারদারি ও সালমান তাসির ওই আন্দোলন দমাতে ব্যর্থ হন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁরা বিচারকদের পুনর্বহালে বাধ্য হন। এরপর প্রেসিডেন্ট জারদারি ও সালমান তাসিরের সঙ্গে আমার বিরোধের অবসান ঘটে।
গত বছরের বন্যার সময়, তাসির মহানুভবতার পরিচয় দেন এবং আমার সঙ্গে তাঁর আবার বন্ধুত্ব হয়। তিনি আমাকে মুলতানের বন্যাক্রান্ত এলাকায় দেখেছিলেন এবং তাঁর মিডিয়া উপদেষ্টা ফারুক শাহকে দিয়ে পুনর্গঠন-সংক্রান্ত একটি বার্তা পাঠান আমাকে। আমি ওই প্রস্তাব গ্রহণ করি। কারণ, বন্যাদুর্গত মানুষকে সহায়তায় পাঞ্জাবের গভর্নর যে তাঁর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, এটা দেখে আমি অভিভূত হই। অনেক বছর পর আমরা একসঙ্গে চা খাই। নৌকায় করে বন্যাক্রান্ত এলাকা পরিদর্শনের জন্য তিনি আমার প্রশংসা করেন। আবার বন্যাদুর্গত মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা দেখে আমি তাঁর প্রশংসা করি। তাসির অনেক কিছুই আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। আমি তাঁর কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘দুঃখ প্রকাশ করার প্রয়োজন নেই। বন্যার খবর প্রচার করে তুমি আমার মন জয় করে নিয়েছ। আমরা লাহোরে আবার দেখা করব, একসঙ্গে একটা দারুণ বিকেল কাটাব এবং আমি তোমার কাছে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করব।’ তিনি হাসলেন। লাহোরে আবার দেখা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমি তাঁকে বিদায় জানাই।
তাসির হত্যার মাত্র এক দিন আগে আমি লাহোরে ছিলাম এবং তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম। আমাকে জানানো হলো, গভর্নর সাহেব ইসলামাবাদে আছেন। পরের দিন আমি ইসলামাবাদে যাই এবং শেষ বিকেলের দিকে আমার সহকর্মী রানা জাওয়াদ আমাকে জানান, সালমান তাসির রাজধানীতে আমার প্রিয় রেস্টুরেন্টের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আমি হতভম্ব হয়ে যাই। কিন্তু মনে মনে হাসলাম। আমি রানাকে বলেছিলাম, ‘তাসিরকে মারা এত সহজ নয়, তিনি বেঁচে যাবেন।’ পরে আমি জানতে পারি, পুলিশের একজন কমান্ডো তাসিরকে ২৭টিরও বেশি গুলি করেছে। ওই পুলিশ কমান্ডো তাসিরের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। কারণ, তিনি দেশটিতে ব্লাসফেমি (ধর্ম অবমাননা) আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। একটি আইনের সমালোচনা করার জন্য কাউকে হত্যা করার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।
একই দিন বিকেলে তাসিরের হত্যাকারীর সমর্থনে আমি লিখিত বার্তা পেতে শুরু করি। আমার অস্বস্তি বোধ হয়। অনেক ধর্মীয় নেতা সালমান তাসিরের হত্যাকাণ্ডে নিন্দা জানাতে অস্বীকৃতি জানান। আমি এটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, দেশটির সবচেয়ে বড় ধর্মীয় দলের প্রধানের কাছ থেকে নিন্দা আদায় করে নেব। জামিয়াতে উলেমা ইসলামের (জেইউআই) প্রধান মওলানা ফজলুর রেহমান ওই দিন সৌদি আরবে ছিলেন। আমার টিভি শোতে আমি তাঁর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করি এবং জিজ্ঞেস করি, ‘আপনি কি সালমান তাসিরের হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করবেন?’ মওলানা সাহেব আমার প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করায় আমি বিস্মিত হই। এ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানানোর মানসিকতা তাঁর ছিল না। কিন্তু আমি আবার একই প্রশ্ন করি তাঁকে। অবশেষে মওলানা সালমান তাসিরের হত্যায় নিন্দা জানান।
পাঁচ শতাধিক ধর্মীয় নেতা এ হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করে একটি বিবৃতি দিয়েছেন এবং ঘোষণা করেন, কোনো মুসলমানেরই সালমান তাসিরের জানাজায় অংশগ্রহণ করা উচিত নয়। কারণ, প্রয়াত এই গভর্নর ব্লাসফেমি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত খ্রিষ্টান এক নারীকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। এ বিবৃতিটি এসেছিল তালেবানবিরোধী বারেলভি গোষ্ঠীর কাছ থেকে। গভর্নর হাউসের ইমামসহ লাহোরের শীর্ষস্থানীয় ধর্মীয় বুদ্ধিজীবীরাও জানাজা পড়াতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। বারেলভি গোষ্ঠীর উলেমারা এ ব্যাপারে অত্যন্ত কট্টর অবস্থান নিয়েছিলেন। অন্যদিকে কিছু ইংরেজি পত্রিকা ঘোষণা দেয়, সালমান তাসিরের হত্যার প্রধান কারণ ব্লাসফেমি আইন। এটাও ছিল একটা উগ্র অবস্থান। একটি জনপ্রিয় টিভি টক শোর উপস্থাপকের জন্য এটা ছিল একটা কঠিন পরিস্থিতি। আমি আরেকটি ঝুঁকি গ্রহণ করি। তাসিরের দাফনের দিনে আমি আরেকজন খ্যাতিমান ইসলামি বুদ্ধিজীবীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। মুফতি মুনেবুর রেহমান সরাসরি আমার টিভি টক শোতে অংশ নিয়ে তাসিরের পরিবারের প্রতি শোক প্রকাশ করেন। পাঁচ বছর আগে টিভি টক শোতে ইসলামি চিন্তাবিদদের মধ্যে তিনিই প্রথম তালেবানের আত্মঘাতী বোমা হামলার প্রকাশ্য বিরোধিতা করেন। মুফতি মুনেবুরও ব্লাসফেমি আইনের ব্যাপারে সালমান তাসিরের মতের বিরোধিতা করেন। কিন্তু কখনোই তাসিরের হত্যাকে সমর্থন দেননি। মুফতি মুনেবুরের ওই বিবৃতির পর আমি উৎফুল্ল হই। অন্ততপক্ষে ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে কোনো একজন প্রকাশ্যে সালমান তাসিরের হত্যার বিরোধিতা করলেন।
আমি মনে করি, সালমান তাসিরকে ভুলভাবে তুলে ধরা হয়েছিল। তাঁর ছেলে আতিশ এক লেখায় তাসিরকে ইহুদি ও হিন্দুদের শত্রু হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। কারণ, সালমান তাসির ১৯৮০ সালে শিখ ধর্মাবলম্বী স্ত্রী তাভলিন সিংকে ত্যাগ করেন। প্রথম স্ত্রী ইয়াসমিন সেহগালের সঙ্গে বিয়ে টিকিয়ে রাখতেই তাসির তাভলিনকে ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু ইয়াসমিন যখন জানতে পারেন, এক শিখ নারীর ঘরে তাসিরের এক সন্তান আছে, তখন তিনি তাসিরের কাছে তালাক দাবি করেন। ইয়াসমিনকে তালাক দেওয়ার পর তিনি আমানাকে বিয়ে করেন। তাসির ব্যক্তিগত জীবনে পশ্চিমা জীবনধারা অনুসরণ করতেন। কিন্তু আতিশ তাসির ভুলভাবে তাঁর বাবাকে হিন্দু ও ইহুদি বিদ্বেষী হিসেবে অভিযুক্ত করেন। সালমান তাসিরের হত্যাকারীরও তাসির সম্পর্কে ভুল ধারণা ছিল। ওই ঘাতক পাঞ্জাবের গভর্নরকে হত্যা করেছে ইসলামের একজন শত্রু হিসেবে।
আতিশ তাসির এবং হত্যাকারী পুলিশ কমান্ডো মালিক মুমতাজ কাদরি দুটি উগ্রধারার প্রতিনিধিত্ব করেন। একজন হলেন উদার উগ্রবাদী, যিনি তাঁর বাবার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ এনেছেন। অন্যজন হলেন ধর্মীয় উগ্রবাদী। আমি নিশ্চিত যে এই উভয় উগ্রবাদী আমাদের মূল্যবোধের জন্য খুবই বিপজ্জনক।
আমি অবশ্যই বলব, সালমান তাসিরের মৃত্যুর জন্য ক্ষমতাসীন পাকিস্তান পিপলস পার্টিরও দায় আছে। যখন তাসির ব্লাসফেমি আইনের সমালোচনা করেছিলেন, প্রেসিডেন্ট জারদারিসহ তাঁর দলের নেতারা কখনো তাঁর পক্ষে অবস্থান নেননি। আইনমন্ত্রী বাবর আওয়ান বলেছেন, ব্লাসফেমি আইনে কোনো পরিবর্তন আনার চেষ্টা সহ্য করা হবে না। তাসিরের মতামত ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রও পাকিস্তানের কাছে ব্লাসফেমি আইন বিলোপের দাবি করছে। সাধারণ পাকিস্তানিরা অবশ্য নিজেদের ঘরোয়া ব্যাপারে মার্কিন হস্তক্ষেপ পছন্দ করে না। এ কারণে ডানপন্থী অনেক দল তাসিরকে আমেরিকার চর হিসেবে ঘোষণা করেছিল। আমরা এ বিতর্ককে ভারতের বিনায়েক সেন ও অরুন্ধতী রায়ের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। তাঁরা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার মুখোমুখি। কারণ, তাঁরা সালমান তাসিরের মতো স্পষ্টভাষী এবং ডানপন্থীদের ঘৃণার শিকার।
পাকিস্তানের সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। আমি মনে করি, হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে ব্লাসফেমি আইনে দণ্ডপ্রাপ্ত দরিদ্র খ্রিষ্টান নারীর মামলায় মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর অবশ্যই লড়াই করা উচিত। ক্ষমা ঘোষণার জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের প্রতি তাদের চাপ প্রয়োগ করা উচিত নয়। কারণ, ভবিষ্যতে এটা আমাদের সমাজে বিভক্তি সৃষ্টি করবে। আমাদের অবশ্যই আইনের শাসনের মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। ধর্মীয় দলগুলো ব্লাসফেমি আইনের সমর্থনে ৯ জানুয়ারি করাচির রাজপথে শক্তি প্রদর্শন করেছে। সুন্নি ও শিয়া চিন্তাবিদেরা কখনোই সালমান তাসিরের হত্যার নিন্দা করেননি। তাঁরাও ব্লাসফেমি আইন রক্ষায় এক জোট।
দুর্ভাগ্যজনক হলো, উদারপন্থী দলগুলোর মধ্যে কোনো ঐক্য নেই। সালমান তাসিরকে গভর্নর হাউস থেকে সরিয়ে তাঁর চেয়ার দখল করার জন্য ক্ষমতাসীন পিপিপির কিছু নেতা এ বিতর্ককে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিলেন। এমনকি তাঁরা তাসিরকে ক্ষমা চাওয়ার জন্য চাপ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এখন পিপিপির সেই নেতারা নওয়াজ শরিফের ওপর সালমান তাসির হত্যার দায় চাপানোর চেষ্টা করছেন; এটা নোংরা রাজনীতি। উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে আমাদের ঐক্য দরকার। সব ধরনের উগ্রবাদকে পরাজিত করতে আমাদের দরকার তাসিরের মনোবল ও সাহস।
সালমান তাসির আমার কাছে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ না করেই চলে গেলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যু পাকিস্তানে সহনশীলতার শক্তিতে নতুন জীবন দিয়েছে এবং এই শক্তিই উগ্রবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে। আমি নিশ্চিত, আমরা অবশ্যই তাদের পরাজিত করব। সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমাদের ‘পাকিস্তানি কায়দার’ একটি সমাধান দরকার। যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সমাধান আমাদের পুরোপুরি ধ্বংস করবে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ সাইফুল সামিন
হামিদ মির: নির্বাহী সম্পাদক, জিয়ো টিভি, ইসলামাবাদ, পাকিস্তান।
মোশাররফের ধারণা ভুল ছিল। শেষ পর্যন্ত জারদারিই মোশাররফকে পদত্যাগ করতে চাপ দিয়েছেন এবং তাসিরের সহায়তায় প্রেসিডেন্ট পদে বসেছেন।
প্রেসিডেন্ট হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই জারদারি আমার সঙ্গে তাসিরের সাক্ষাৎকারের আয়োজন করেন এবং মতপার্থক্য ভুলে যেতে বলেন। কারণ, জারদারি জানতেন, আমাদের মধ্যে গত ২০ বছরের (১৯৮৭-২০০৭) বন্ধুত্ব ছিল। দুর্ভাগ্যবশত, জারদারি তাঁর গভর্নর ও একজন সাংবাদিকের মধ্যে অবিশ্বাস দূর করতে ব্যর্থ হন। আমরা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে বিব্রত করেছি। পরবর্তী দুই বছর আমরা অনেকবার একে অন্যের বিরুদ্ধে বলেছি, বিশেষ করে, পদচ্যুত বিচারকদের পুনর্বহাল আন্দোলন দমাতে জারদারি যখন পাঞ্জাবে গভর্নরের (কেন্দ্রীয়) শাসন চাপিয়ে দিলেন। জারদারি ও সালমান তাসির ওই আন্দোলন দমাতে ব্যর্থ হন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁরা বিচারকদের পুনর্বহালে বাধ্য হন। এরপর প্রেসিডেন্ট জারদারি ও সালমান তাসিরের সঙ্গে আমার বিরোধের অবসান ঘটে।
গত বছরের বন্যার সময়, তাসির মহানুভবতার পরিচয় দেন এবং আমার সঙ্গে তাঁর আবার বন্ধুত্ব হয়। তিনি আমাকে মুলতানের বন্যাক্রান্ত এলাকায় দেখেছিলেন এবং তাঁর মিডিয়া উপদেষ্টা ফারুক শাহকে দিয়ে পুনর্গঠন-সংক্রান্ত একটি বার্তা পাঠান আমাকে। আমি ওই প্রস্তাব গ্রহণ করি। কারণ, বন্যাদুর্গত মানুষকে সহায়তায় পাঞ্জাবের গভর্নর যে তাঁর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন, এটা দেখে আমি অভিভূত হই। অনেক বছর পর আমরা একসঙ্গে চা খাই। নৌকায় করে বন্যাক্রান্ত এলাকা পরিদর্শনের জন্য তিনি আমার প্রশংসা করেন। আবার বন্যাদুর্গত মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা দেখে আমি তাঁর প্রশংসা করি। তাসির অনেক কিছুই আলোচনা করতে চেয়েছিলেন। আমি তাঁর কাছে দুঃখ প্রকাশ করতে চেয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘দুঃখ প্রকাশ করার প্রয়োজন নেই। বন্যার খবর প্রচার করে তুমি আমার মন জয় করে নিয়েছ। আমরা লাহোরে আবার দেখা করব, একসঙ্গে একটা দারুণ বিকেল কাটাব এবং আমি তোমার কাছে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করব।’ তিনি হাসলেন। লাহোরে আবার দেখা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমি তাঁকে বিদায় জানাই।
তাসির হত্যার মাত্র এক দিন আগে আমি লাহোরে ছিলাম এবং তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছিলাম। আমাকে জানানো হলো, গভর্নর সাহেব ইসলামাবাদে আছেন। পরের দিন আমি ইসলামাবাদে যাই এবং শেষ বিকেলের দিকে আমার সহকর্মী রানা জাওয়াদ আমাকে জানান, সালমান তাসির রাজধানীতে আমার প্রিয় রেস্টুরেন্টের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। আমি হতভম্ব হয়ে যাই। কিন্তু মনে মনে হাসলাম। আমি রানাকে বলেছিলাম, ‘তাসিরকে মারা এত সহজ নয়, তিনি বেঁচে যাবেন।’ পরে আমি জানতে পারি, পুলিশের একজন কমান্ডো তাসিরকে ২৭টিরও বেশি গুলি করেছে। ওই পুলিশ কমান্ডো তাসিরের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। কারণ, তিনি দেশটিতে ব্লাসফেমি (ধর্ম অবমাননা) আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। একটি আইনের সমালোচনা করার জন্য কাউকে হত্যা করার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না।
একই দিন বিকেলে তাসিরের হত্যাকারীর সমর্থনে আমি লিখিত বার্তা পেতে শুরু করি। আমার অস্বস্তি বোধ হয়। অনেক ধর্মীয় নেতা সালমান তাসিরের হত্যাকাণ্ডে নিন্দা জানাতে অস্বীকৃতি জানান। আমি এটাকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলাম এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, দেশটির সবচেয়ে বড় ধর্মীয় দলের প্রধানের কাছ থেকে নিন্দা আদায় করে নেব। জামিয়াতে উলেমা ইসলামের (জেইউআই) প্রধান মওলানা ফজলুর রেহমান ওই দিন সৌদি আরবে ছিলেন। আমার টিভি শোতে আমি তাঁর সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করি এবং জিজ্ঞেস করি, ‘আপনি কি সালমান তাসিরের হত্যাকাণ্ডের নিন্দা করবেন?’ মওলানা সাহেব আমার প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করায় আমি বিস্মিত হই। এ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানানোর মানসিকতা তাঁর ছিল না। কিন্তু আমি আবার একই প্রশ্ন করি তাঁকে। অবশেষে মওলানা সালমান তাসিরের হত্যায় নিন্দা জানান।
পাঁচ শতাধিক ধর্মীয় নেতা এ হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করে একটি বিবৃতি দিয়েছেন এবং ঘোষণা করেন, কোনো মুসলমানেরই সালমান তাসিরের জানাজায় অংশগ্রহণ করা উচিত নয়। কারণ, প্রয়াত এই গভর্নর ব্লাসফেমি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত খ্রিষ্টান এক নারীকে মুক্ত করার চেষ্টা করেছিলেন। এ বিবৃতিটি এসেছিল তালেবানবিরোধী বারেলভি গোষ্ঠীর কাছ থেকে। গভর্নর হাউসের ইমামসহ লাহোরের শীর্ষস্থানীয় ধর্মীয় বুদ্ধিজীবীরাও জানাজা পড়াতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। বারেলভি গোষ্ঠীর উলেমারা এ ব্যাপারে অত্যন্ত কট্টর অবস্থান নিয়েছিলেন। অন্যদিকে কিছু ইংরেজি পত্রিকা ঘোষণা দেয়, সালমান তাসিরের হত্যার প্রধান কারণ ব্লাসফেমি আইন। এটাও ছিল একটা উগ্র অবস্থান। একটি জনপ্রিয় টিভি টক শোর উপস্থাপকের জন্য এটা ছিল একটা কঠিন পরিস্থিতি। আমি আরেকটি ঝুঁকি গ্রহণ করি। তাসিরের দাফনের দিনে আমি আরেকজন খ্যাতিমান ইসলামি বুদ্ধিজীবীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করি। মুফতি মুনেবুর রেহমান সরাসরি আমার টিভি টক শোতে অংশ নিয়ে তাসিরের পরিবারের প্রতি শোক প্রকাশ করেন। পাঁচ বছর আগে টিভি টক শোতে ইসলামি চিন্তাবিদদের মধ্যে তিনিই প্রথম তালেবানের আত্মঘাতী বোমা হামলার প্রকাশ্য বিরোধিতা করেন। মুফতি মুনেবুরও ব্লাসফেমি আইনের ব্যাপারে সালমান তাসিরের মতের বিরোধিতা করেন। কিন্তু কখনোই তাসিরের হত্যাকে সমর্থন দেননি। মুফতি মুনেবুরের ওই বিবৃতির পর আমি উৎফুল্ল হই। অন্ততপক্ষে ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে কোনো একজন প্রকাশ্যে সালমান তাসিরের হত্যার বিরোধিতা করলেন।
আমি মনে করি, সালমান তাসিরকে ভুলভাবে তুলে ধরা হয়েছিল। তাঁর ছেলে আতিশ এক লেখায় তাসিরকে ইহুদি ও হিন্দুদের শত্রু হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। কারণ, সালমান তাসির ১৯৮০ সালে শিখ ধর্মাবলম্বী স্ত্রী তাভলিন সিংকে ত্যাগ করেন। প্রথম স্ত্রী ইয়াসমিন সেহগালের সঙ্গে বিয়ে টিকিয়ে রাখতেই তাসির তাভলিনকে ত্যাগ করেছিলেন। কিন্তু ইয়াসমিন যখন জানতে পারেন, এক শিখ নারীর ঘরে তাসিরের এক সন্তান আছে, তখন তিনি তাসিরের কাছে তালাক দাবি করেন। ইয়াসমিনকে তালাক দেওয়ার পর তিনি আমানাকে বিয়ে করেন। তাসির ব্যক্তিগত জীবনে পশ্চিমা জীবনধারা অনুসরণ করতেন। কিন্তু আতিশ তাসির ভুলভাবে তাঁর বাবাকে হিন্দু ও ইহুদি বিদ্বেষী হিসেবে অভিযুক্ত করেন। সালমান তাসিরের হত্যাকারীরও তাসির সম্পর্কে ভুল ধারণা ছিল। ওই ঘাতক পাঞ্জাবের গভর্নরকে হত্যা করেছে ইসলামের একজন শত্রু হিসেবে।
আতিশ তাসির এবং হত্যাকারী পুলিশ কমান্ডো মালিক মুমতাজ কাদরি দুটি উগ্রধারার প্রতিনিধিত্ব করেন। একজন হলেন উদার উগ্রবাদী, যিনি তাঁর বাবার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ এনেছেন। অন্যজন হলেন ধর্মীয় উগ্রবাদী। আমি নিশ্চিত যে এই উভয় উগ্রবাদী আমাদের মূল্যবোধের জন্য খুবই বিপজ্জনক।
আমি অবশ্যই বলব, সালমান তাসিরের মৃত্যুর জন্য ক্ষমতাসীন পাকিস্তান পিপলস পার্টিরও দায় আছে। যখন তাসির ব্লাসফেমি আইনের সমালোচনা করেছিলেন, প্রেসিডেন্ট জারদারিসহ তাঁর দলের নেতারা কখনো তাঁর পক্ষে অবস্থান নেননি। আইনমন্ত্রী বাবর আওয়ান বলেছেন, ব্লাসফেমি আইনে কোনো পরিবর্তন আনার চেষ্টা সহ্য করা হবে না। তাসিরের মতামত ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রও পাকিস্তানের কাছে ব্লাসফেমি আইন বিলোপের দাবি করছে। সাধারণ পাকিস্তানিরা অবশ্য নিজেদের ঘরোয়া ব্যাপারে মার্কিন হস্তক্ষেপ পছন্দ করে না। এ কারণে ডানপন্থী অনেক দল তাসিরকে আমেরিকার চর হিসেবে ঘোষণা করেছিল। আমরা এ বিতর্ককে ভারতের বিনায়েক সেন ও অরুন্ধতী রায়ের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। তাঁরা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার মুখোমুখি। কারণ, তাঁরা সালমান তাসিরের মতো স্পষ্টভাষী এবং ডানপন্থীদের ঘৃণার শিকার।
পাকিস্তানের সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। আমি মনে করি, হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে ব্লাসফেমি আইনে দণ্ডপ্রাপ্ত দরিদ্র খ্রিষ্টান নারীর মামলায় মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর অবশ্যই লড়াই করা উচিত। ক্ষমা ঘোষণার জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের প্রতি তাদের চাপ প্রয়োগ করা উচিত নয়। কারণ, ভবিষ্যতে এটা আমাদের সমাজে বিভক্তি সৃষ্টি করবে। আমাদের অবশ্যই আইনের শাসনের মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। ধর্মীয় দলগুলো ব্লাসফেমি আইনের সমর্থনে ৯ জানুয়ারি করাচির রাজপথে শক্তি প্রদর্শন করেছে। সুন্নি ও শিয়া চিন্তাবিদেরা কখনোই সালমান তাসিরের হত্যার নিন্দা করেননি। তাঁরাও ব্লাসফেমি আইন রক্ষায় এক জোট।
দুর্ভাগ্যজনক হলো, উদারপন্থী দলগুলোর মধ্যে কোনো ঐক্য নেই। সালমান তাসিরকে গভর্নর হাউস থেকে সরিয়ে তাঁর চেয়ার দখল করার জন্য ক্ষমতাসীন পিপিপির কিছু নেতা এ বিতর্ককে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছিলেন। এমনকি তাঁরা তাসিরকে ক্ষমা চাওয়ার জন্য চাপ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এখন পিপিপির সেই নেতারা নওয়াজ শরিফের ওপর সালমান তাসির হত্যার দায় চাপানোর চেষ্টা করছেন; এটা নোংরা রাজনীতি। উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে আমাদের ঐক্য দরকার। সব ধরনের উগ্রবাদকে পরাজিত করতে আমাদের দরকার তাসিরের মনোবল ও সাহস।
সালমান তাসির আমার কাছে আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ না করেই চলে গেলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যু পাকিস্তানে সহনশীলতার শক্তিতে নতুন জীবন দিয়েছে এবং এই শক্তিই উগ্রবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে। আমি নিশ্চিত, আমরা অবশ্যই তাদের পরাজিত করব। সন্ত্রাসবাদ ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আমাদের ‘পাকিস্তানি কায়দার’ একটি সমাধান দরকার। যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া সমাধান আমাদের পুরোপুরি ধ্বংস করবে।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ সাইফুল সামিন
হামিদ মির: নির্বাহী সম্পাদক, জিয়ো টিভি, ইসলামাবাদ, পাকিস্তান।
No comments