শিক্ষক-রাজনীতি-মেধাবিকাশ ও মেধাবিনাশের তীর্থভূমি! by সুলতানা মোসতাফা
এবার বিলেতের মাটি স্পর্শ করার প্রায় পরক্ষণ থেকে আজ অবধি ক্রমাগত যে প্রশ্নটির সম্মুখীন হচ্ছি, তা হচ্ছে, ‘আসলে বিষয়টি কী?’ ম্যানচেস্টারের বাংলাদেশি ব্যবসায়ী এবং শিক্ষক সম্প্রদায়, কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশি শিক্ষার্থী, হার্টফোর্ডশায়ারের সুশীল সমাজের বাংলাদেশি প্রতিনিধি, লন্ডনের খেটে খাওয়া বাংলাদেশি—সবাই উৎসুক
হয়ে জানতে চান, আসলেই বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কী ঘটছে? শিক্ষক-রাজনীতি প্রকৃতপক্ষেই আত্মঘাতী অবস্থার জন্ম দিচ্ছে কি না। তাদের এই ঔৎসুক্যের সূত্র হলো, বিগত কয়েক মাসে প্রথম আলোয় প্রকাশিত গোলাম মুরশিদ, সৌরভ সিকদার ও শাহাদুজ্জামানের লেখা কয়েকটি কলাম। আমার এই লেখাটি তাঁদের লেখার আলোকে আমার দৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরার কিছুটা ক্ষুদ্র প্রয়াস বলা চলে।
জনাব মুরশিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং আচরণ তুলে ধরেছেন, তা সংখ্যাগরিষ্ঠ তো নয়ই, সার্বিক বিচারে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষকও এর আওতায় পড়েন না, অথচ তিনি ক্ষুদ্র অংশকে এর আওতাবহির্ভূত বলেছেন—এটি আপত্তিকর। এখন মূল প্রশ্নটি হলো, এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশটিই বিশ্ববিদ্যালয়কে পচনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে কি না? এ ক্ষেত্রে আমি তাঁর সঙ্গে একমত, ‘ছাত্র আর শিক্ষকদের রাজনীতির ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চরম সর্বনাশের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।’
এবার আসা যাক সৌরভ সিকদারের বক্তব্যে, ‘আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে? পাস করে তারা কোথায় যায়? আমাদের দেশের দক্ষ ও শিক্ষিত জনবলের যে চাহিদা...তার পুরোটাই আসে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।’ এটি হলো সত্যের এক পীঠ। সত্যের অন্য পীঠে দেখি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ও অতি মেধাবীদের গন্তব্য শেষের অবস্থান। ১. এদের একটি ক্ষুদ্রতর অংশ তাদের যোগ্য ও কাঙ্ক্ষিত অবস্থানে পৌঁছাতে পারে। ২. এদের বৃহত্তম অংশটি তাদের যোগ্যতা, বিপুল কর্মোদ্যম, অপার অনুসন্ধিৎসা, অমিত সম্ভাবনা ও সৃজনশীলতা নিয়েও ছিটকে পড়ে তাদের যোগ্য স্থান থেকে। তাদের সব সম্ভাবনা মুখ থুবড়ে পড়ে দশটা-পাঁচটার কলম পেষার আবর্তে বা ক্ষুদ্রঋণ আদায়ের লক্ষ্যে গ্রহীতাদের পেছনে ঘোরাঘুরি কিংবা সওদাগরি অফিসের চার দেয়ালের গণ্ডিতে, যেখানে তাদের অর্জিত জ্ঞান, দক্ষতা ও সৃজনশীলতার স্ফুরণ ঘটানোর কোনো সুযোগ নেই ৩. এদের একটি অংশ দীর্ঘদিন বেকারত্বের অভিশাপে দগ্ধ হতে থাকে, যা তাদের প্রায়ই মাদকাসক্তি বা অপরাধজগতের দিকে ঠেলে দেয়, অনেকে বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ, বিপর্যস্ত হয় পুরো পরিবার। ৪. অতি মেধাবীদের অধিকাংশই শিকার হয় ব্রেন ড্রেন বা মেধা পাচারের। এরা তাদের যোগ্যতার স্বীকৃতিস্বরূপ বিদেশে পাড়ি জমায় বুকের ভেতরে এক পাশে প্রিয় স্বদেশের ছবি ও অন্য পাশে নিজের অর্জিত শিক্ষা ও জ্ঞানকে কাজে লাগানোর সুযোগ ও সাফল্যের ছবি নিয়ে। ক্রমেই স্বদেশের ছবি, স্বদেশপ্রেম তাদের কাছে ম্লান হতে থাকে। যারা বা সাহস করে দেশে ফিরে আসে দেশকে কিছু দেওয়ার উদগ্র বাসনায়, তারা ক্রমাগত শিকার হতে থাকে পঙ্কিল রাজনীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও পারিপার্শ্বিক বৈরী অবস্থার। দরিদ্র দেশের দরিদ্রতর জনগণের শ্রম ও ঘামে ভেজা করের টাকায় মানুষ হওয়া এসব মেধাবী সন্তান একধরনের গ্লানি ও অপরাধবোধ নিয়ে, শেকড় উপড়ানোর মর্মবেদনা নিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয় বিদেশের নিরাপদ ভূমিতে প্রবাসী/অভিবাসী হিসেবে। তাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ‘দেশ’ থেকে যায় কাগজে-কলমে ‘কান্ট্রি অব অরিজিন’ হিসেবে। এসব মেধাবীর সাফল্যগাথা আমরা জানতে পারি বিদেশি গণমাধ্যমে। দেশ হারাতে থাকে তার সূর্যসন্তানদের আর দেশবাসী হারাতে থাকে তাদের ভাগ্য উন্নয়নের প্রাপ্য অধিকার ও সুযোগ।
এবার দেখি দক্ষ ও শিক্ষিত জনবলের চাহিদা মেটাচ্ছে কারা? ক্ষুদ্র অংশ বাদে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেধাবী ও অতি মেধাবীদের জায়গাগুলো দখল করে আছে তুলনামূলকভাবে কম যোগ্যতাসম্পন্ন সেই সব সাবেক শিক্ষার্থী, যারা কোনো না কোনোভাবে ‘রাজনীতির আশীর্বাদপুষ্ট’। তারা মূলত উচ্চ যোগ্যতার অধিকারীদের চেয়ারে বসে রাজা-উজির মারে এবং পরিশ্রমী ও কর্মঠ সহকর্মীদের পা টেনে নিচে নামানোর চেষ্টায় রত থাকে। এটি কেবল ব্যক্তিগত ঈর্ষাপরায়ণতার কারণেই নয়, বরং দক্ষ সহকর্মীটি এগিয়ে গেলে তার অযোগ্যতা যে প্রকট হয়ে ধরা দেবে—এ আশঙ্কায়। বস্তুত আজ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘রাইট পারসন ইজ নট ইন দ্য রাইট প্লেস’। এরাই দেশের উন্নয়নের চাকাকে সামনের দিকে নয়, উল্টো দিকে ঘোরানোয় ভূমিকা রাখে। এ পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় লেজুড়বৃত্তির শিক্ষক-রাজনীতিও বহুলাংশে দায়ী। শুধু অন্য মতাবলম্বী শিক্ষকের অধীনে গবেষণা করার অপরাধে সব দিক থেকে যোগ্যতম, ফ্যাকাল্টি ফার্স্ট ছাত্রটি কি নিয়োগ বোর্ড কর্তৃক বাতিল হয়ে যায়নি? চারটি প্রথম শ্রেণী/বিভাগ, বিলেতের পিএইচডি, ডজন দুই আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রবন্ধ/প্রকাশনা থাকার পরও সেই প্রার্থীকে তুলনামূলকভাবে খারাপ রেজাল্ট, পিএইচডিবিহীন, স্থানীয় জার্নালে প্রকাশিত গণ্ডা দেড়েক প্রবন্ধ প্রকাশ করা দলীয় রাজনীতির আশীর্বাদপুষ্ট প্রার্থীর কাছে পদোন্নতি বা বৃত্তির মনোনয়নের ক্ষেত্রে হেরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা কি আমাদের নেই? আমাদের কি সেই অভিজ্ঞতা নেই যে এমফিল থেকে পিএইচডিতে স্থানান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম শর্ত পূরণ না করেও কেবল প্রভাবশালী শিক্ষকের অধীনে গবেষণা করার সুবাদে এক্সপার্টদের মতামতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, তাদের প্রবল আপত্তির মুখেও গবেষণাকর্মটিকে পিএইচডিতে স্থানান্তরের? ক্ষেত্রবিশেষে এর খেসারত দিতে হয় প্রতিবাদকারী শিক্ষককে।
এর পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ও পরিশ্রমী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা স্রোতের বিপরীতে চলার চেষ্টা করেন যদি কখনো ‘নিরপেক্ষতার’ শিকেয় তাঁদের ভাগ্য ছেঁড়ে, এই প্রত্যাশায়; বিশ্ববিদ্যালয়কে তার হারানো মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার প্রত্যাশায়। এমন শিক্ষকেরা এখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ বলেই বিশ্ববিদ্যালয় এত বিপর্যয়ের মধ্যেও টিকে আছে।
জনাব মুরশিদ ‘উজ্জ্বল ব্যতিক্রম’ শিক্ষক, লেখক, গবেষক হিসেবে কয়েকজন জ্ঞানতাপসের নাম উল্লেখ করেছেন, যা প্রশংসনীয় কিন্তু ভাবতে কষ্ট হয় তার ক্যারিয়ারের ভিত তৈরি হয়েছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখানে কি তিনি কোনো জ্ঞানী, নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক, লেখক, গবেষক খুঁজে পাননি? সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষকদের প্রতিভূ, নিষ্ঠাবান শিক্ষক প্রফেসর অরুণ কুমার বসাকের ঠিকানা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিভাগে বা গবেষণাগারে, এটি সর্বজনবিদিত। গবেষক হিসেবে ড. মঞ্জুর হোসেনের সমতুল্য হাতে গোনা কয়জন শিক্ষক আছেন দেশে? শত প্রতিকূলতার মধ্যেও ড. মঞ্জুর তাঁর গবেষণা চালিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছেন, কিন্তু অনেকেই ছিটকে পড়তে বাধ্য হন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. মাহতাব আলীর মৌমাছি গবেষণার বিষয়টি হয়তো প্রাসঙ্গিক। ড. আলী ১৯৯০-৯৪ পর্যন্ত ইংল্যান্ডে মৌমাছি ও মধু চাষসংক্রান্ত গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৯৪ সালে দেশে ফিরে একক প্রচেষ্টায় গবেষণা চালিয়ে যান। ২০০১ সালে বিভাগের সহযোগিতায় গবেষণাটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। ‘মৌচাষ’ বিষয়টি পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তৃত অঞ্চলে মৌ-খামার স্থাপিত হয়, শিক্ষার্থীরা সেখানে গবেষণার সুযোগ পায়। ড. আলী বিদেশ থেকে কিছু যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি আনান এবং এর আদলে দেশেই কিছু সরঞ্জাম তৈরি করা হয়। আগে যেখানে একটি বাক্স থেকে ঊর্ধ্বে ১৫-২০ কেজি মধু আহরণ সম্ভব হতো, নতুন প্রযুক্তি প্রয়োগের ফলে বাক্সপ্রতি মধুর পরিমাণ দাঁড়ায় ১০০ কেজি। দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে মৌমাছির জন্য ক্ষতিকর মাকড় ‘ভেরোয়া’ দমন সম্পূর্ণরূপে সফল হয়। এই মৌ-খামারকে কেন্দ্র করে ‘কমিউনিটি অ্যাপিকালচার’ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আক্ষরিক অর্থে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া—প্রায় প্রতিটি অঞ্চল থেকেই মৌচাষিরা এতে সম্পৃক্ত হন। কিছু সন্ত্রাসী ‘ভেজাল মধু’ এই অভিযোগ তুলে মৌ-খামারে হামলা করে তা ভেঙে তছনছ করে দেয়। এর মোকাবিলায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভূমিকা কী ছিল? না, এর কোনো প্রতিকার হয়নি, মৌ-খামার রক্ষায় কোনো সহায়তা দেওয়া হয়নি, উপরন্তু বিস্ময়করভাবে ড. আলীকে ডেকে নিয়ে জানানো হয়, অপ্রিয় পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য তিনি যেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৌ-খামারটি সরিয়ে নেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কমিউনিটি অ্যাপিকালচারের কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া অসম্ভব। নিমিষেই দীর্ঘদিনের গবেষণালব্ধ প্রকল্পটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভের মাত্র তিন বছরের মধ্যেই বিলীন হয়ে যায়। মৌচাষিরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। আর এত বড় বিপর্যয়ের পর ড. আলীকে শিকার হতে হয় হূদেরাগের। এটি কি কেবলই ব্যক্তিগত ঈর্ষাপরায়ণতা?
আমি আগেই বলেছি, মুষ্টিমেয় শিক্ষক দলীয় লেজুড়বৃত্তিমূলক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়কে পচনের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর তৎপরতাই যথেষ্ট, যার শিকার অগণিত শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। যে প্রজাপতির ডানা ভেঙে দেওয়া হয়েছে, সে-ই জানে, জীবনে সে কতটুকু হারাল। সে-ই জানে, সে আর কখনোই উঠে দাঁড়াতে পারবে না, জানে চিরতরেই কেড়ে নেওয়া হয়েছে তার পাখার রং ও চাঞ্চল্য। এভাবেই মুছে যাচ্ছে হাজার শিক্ষার্থীর জীবনের রং, তাদের প্রাণচাঞ্চল্য।
এখনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেটুকু জীবনের রং ও আশার বৈভব রয়েছে, তা সেসব শিক্ষকের জন্যই, যাঁরা জনাব মুরশিদের উক্তিটির মতোই বিশ্বাস করেন এবং নিজেদের জীবনে তার প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করেন—‘শিক্ষকতা এমন একটি পেশা, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে খানিকটা আত্মত্যাগ, জ্ঞানের সাধনা এবং ছাত্রদের শেখানোর আগ্রহ। প্লেইন লিভিং অ্যান্ড হাই থিংকিং...।’ এরাই স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও সুযোগ থাকার পরও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে যান কেবল এর প্রতি, এর শিক্ষার্থীদের প্রতি মমত্ব ও দায়বদ্ধতার বোধ থেকেই। এঁরা বিশ্বাস করেন, দুঃসময় একদিন কেটে যাবেই, কেননা সামনে আসছে আপসহীন, রুখে দাঁড়ানো প্রজন্ম, তা যত ক্ষুদ্র আকারেই হোক না কেন।
সুলতানা মোসতাফা: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে গবেষণারত।
sultanamk@yahoo.co.uk
জনাব মুরশিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং আচরণ তুলে ধরেছেন, তা সংখ্যাগরিষ্ঠ তো নয়ই, সার্বিক বিচারে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ শিক্ষকও এর আওতায় পড়েন না, অথচ তিনি ক্ষুদ্র অংশকে এর আওতাবহির্ভূত বলেছেন—এটি আপত্তিকর। এখন মূল প্রশ্নটি হলো, এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশটিই বিশ্ববিদ্যালয়কে পচনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে কি না? এ ক্ষেত্রে আমি তাঁর সঙ্গে একমত, ‘ছাত্র আর শিক্ষকদের রাজনীতির ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চরম সর্বনাশের পথে এগিয়ে যাচ্ছে।’
এবার আসা যাক সৌরভ সিকদারের বক্তব্যে, ‘আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা পড়তে আসে? পাস করে তারা কোথায় যায়? আমাদের দেশের দক্ষ ও শিক্ষিত জনবলের যে চাহিদা...তার পুরোটাই আসে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।’ এটি হলো সত্যের এক পীঠ। সত্যের অন্য পীঠে দেখি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ও অতি মেধাবীদের গন্তব্য শেষের অবস্থান। ১. এদের একটি ক্ষুদ্রতর অংশ তাদের যোগ্য ও কাঙ্ক্ষিত অবস্থানে পৌঁছাতে পারে। ২. এদের বৃহত্তম অংশটি তাদের যোগ্যতা, বিপুল কর্মোদ্যম, অপার অনুসন্ধিৎসা, অমিত সম্ভাবনা ও সৃজনশীলতা নিয়েও ছিটকে পড়ে তাদের যোগ্য স্থান থেকে। তাদের সব সম্ভাবনা মুখ থুবড়ে পড়ে দশটা-পাঁচটার কলম পেষার আবর্তে বা ক্ষুদ্রঋণ আদায়ের লক্ষ্যে গ্রহীতাদের পেছনে ঘোরাঘুরি কিংবা সওদাগরি অফিসের চার দেয়ালের গণ্ডিতে, যেখানে তাদের অর্জিত জ্ঞান, দক্ষতা ও সৃজনশীলতার স্ফুরণ ঘটানোর কোনো সুযোগ নেই ৩. এদের একটি অংশ দীর্ঘদিন বেকারত্বের অভিশাপে দগ্ধ হতে থাকে, যা তাদের প্রায়ই মাদকাসক্তি বা অপরাধজগতের দিকে ঠেলে দেয়, অনেকে বেছে নেয় আত্মহত্যার পথ, বিপর্যস্ত হয় পুরো পরিবার। ৪. অতি মেধাবীদের অধিকাংশই শিকার হয় ব্রেন ড্রেন বা মেধা পাচারের। এরা তাদের যোগ্যতার স্বীকৃতিস্বরূপ বিদেশে পাড়ি জমায় বুকের ভেতরে এক পাশে প্রিয় স্বদেশের ছবি ও অন্য পাশে নিজের অর্জিত শিক্ষা ও জ্ঞানকে কাজে লাগানোর সুযোগ ও সাফল্যের ছবি নিয়ে। ক্রমেই স্বদেশের ছবি, স্বদেশপ্রেম তাদের কাছে ম্লান হতে থাকে। যারা বা সাহস করে দেশে ফিরে আসে দেশকে কিছু দেওয়ার উদগ্র বাসনায়, তারা ক্রমাগত শিকার হতে থাকে পঙ্কিল রাজনীতি, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও পারিপার্শ্বিক বৈরী অবস্থার। দরিদ্র দেশের দরিদ্রতর জনগণের শ্রম ও ঘামে ভেজা করের টাকায় মানুষ হওয়া এসব মেধাবী সন্তান একধরনের গ্লানি ও অপরাধবোধ নিয়ে, শেকড় উপড়ানোর মর্মবেদনা নিয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হয় বিদেশের নিরাপদ ভূমিতে প্রবাসী/অভিবাসী হিসেবে। তাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ‘দেশ’ থেকে যায় কাগজে-কলমে ‘কান্ট্রি অব অরিজিন’ হিসেবে। এসব মেধাবীর সাফল্যগাথা আমরা জানতে পারি বিদেশি গণমাধ্যমে। দেশ হারাতে থাকে তার সূর্যসন্তানদের আর দেশবাসী হারাতে থাকে তাদের ভাগ্য উন্নয়নের প্রাপ্য অধিকার ও সুযোগ।
এবার দেখি দক্ষ ও শিক্ষিত জনবলের চাহিদা মেটাচ্ছে কারা? ক্ষুদ্র অংশ বাদে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেধাবী ও অতি মেধাবীদের জায়গাগুলো দখল করে আছে তুলনামূলকভাবে কম যোগ্যতাসম্পন্ন সেই সব সাবেক শিক্ষার্থী, যারা কোনো না কোনোভাবে ‘রাজনীতির আশীর্বাদপুষ্ট’। তারা মূলত উচ্চ যোগ্যতার অধিকারীদের চেয়ারে বসে রাজা-উজির মারে এবং পরিশ্রমী ও কর্মঠ সহকর্মীদের পা টেনে নিচে নামানোর চেষ্টায় রত থাকে। এটি কেবল ব্যক্তিগত ঈর্ষাপরায়ণতার কারণেই নয়, বরং দক্ষ সহকর্মীটি এগিয়ে গেলে তার অযোগ্যতা যে প্রকট হয়ে ধরা দেবে—এ আশঙ্কায়। বস্তুত আজ অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘রাইট পারসন ইজ নট ইন দ্য রাইট প্লেস’। এরাই দেশের উন্নয়নের চাকাকে সামনের দিকে নয়, উল্টো দিকে ঘোরানোয় ভূমিকা রাখে। এ পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় লেজুড়বৃত্তির শিক্ষক-রাজনীতিও বহুলাংশে দায়ী। শুধু অন্য মতাবলম্বী শিক্ষকের অধীনে গবেষণা করার অপরাধে সব দিক থেকে যোগ্যতম, ফ্যাকাল্টি ফার্স্ট ছাত্রটি কি নিয়োগ বোর্ড কর্তৃক বাতিল হয়ে যায়নি? চারটি প্রথম শ্রেণী/বিভাগ, বিলেতের পিএইচডি, ডজন দুই আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রবন্ধ/প্রকাশনা থাকার পরও সেই প্রার্থীকে তুলনামূলকভাবে খারাপ রেজাল্ট, পিএইচডিবিহীন, স্থানীয় জার্নালে প্রকাশিত গণ্ডা দেড়েক প্রবন্ধ প্রকাশ করা দলীয় রাজনীতির আশীর্বাদপুষ্ট প্রার্থীর কাছে পদোন্নতি বা বৃত্তির মনোনয়নের ক্ষেত্রে হেরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা কি আমাদের নেই? আমাদের কি সেই অভিজ্ঞতা নেই যে এমফিল থেকে পিএইচডিতে স্থানান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় ন্যূনতম শর্ত পূরণ না করেও কেবল প্রভাবশালী শিক্ষকের অধীনে গবেষণা করার সুবাদে এক্সপার্টদের মতামতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, তাদের প্রবল আপত্তির মুখেও গবেষণাকর্মটিকে পিএইচডিতে স্থানান্তরের? ক্ষেত্রবিশেষে এর খেসারত দিতে হয় প্রতিবাদকারী শিক্ষককে।
এর পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ও পরিশ্রমী শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা স্রোতের বিপরীতে চলার চেষ্টা করেন যদি কখনো ‘নিরপেক্ষতার’ শিকেয় তাঁদের ভাগ্য ছেঁড়ে, এই প্রত্যাশায়; বিশ্ববিদ্যালয়কে তার হারানো মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার প্রত্যাশায়। এমন শিক্ষকেরা এখনো সংখ্যাগরিষ্ঠ বলেই বিশ্ববিদ্যালয় এত বিপর্যয়ের মধ্যেও টিকে আছে।
জনাব মুরশিদ ‘উজ্জ্বল ব্যতিক্রম’ শিক্ষক, লেখক, গবেষক হিসেবে কয়েকজন জ্ঞানতাপসের নাম উল্লেখ করেছেন, যা প্রশংসনীয় কিন্তু ভাবতে কষ্ট হয় তার ক্যারিয়ারের ভিত তৈরি হয়েছিল যে বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেখানে কি তিনি কোনো জ্ঞানী, নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক, লেখক, গবেষক খুঁজে পাননি? সংখ্যাগরিষ্ঠ শিক্ষকদের প্রতিভূ, নিষ্ঠাবান শিক্ষক প্রফেসর অরুণ কুমার বসাকের ঠিকানা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত বিভাগে বা গবেষণাগারে, এটি সর্বজনবিদিত। গবেষক হিসেবে ড. মঞ্জুর হোসেনের সমতুল্য হাতে গোনা কয়জন শিক্ষক আছেন দেশে? শত প্রতিকূলতার মধ্যেও ড. মঞ্জুর তাঁর গবেষণা চালিয়ে যেতে সক্ষম হচ্ছেন, কিন্তু অনেকেই ছিটকে পড়তে বাধ্য হন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ড. মাহতাব আলীর মৌমাছি গবেষণার বিষয়টি হয়তো প্রাসঙ্গিক। ড. আলী ১৯৯০-৯৪ পর্যন্ত ইংল্যান্ডে মৌমাছি ও মধু চাষসংক্রান্ত গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৯৪ সালে দেশে ফিরে একক প্রচেষ্টায় গবেষণা চালিয়ে যান। ২০০১ সালে বিভাগের সহযোগিতায় গবেষণাটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। ‘মৌচাষ’ বিষয়টি পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্তৃত অঞ্চলে মৌ-খামার স্থাপিত হয়, শিক্ষার্থীরা সেখানে গবেষণার সুযোগ পায়। ড. আলী বিদেশ থেকে কিছু যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি আনান এবং এর আদলে দেশেই কিছু সরঞ্জাম তৈরি করা হয়। আগে যেখানে একটি বাক্স থেকে ঊর্ধ্বে ১৫-২০ কেজি মধু আহরণ সম্ভব হতো, নতুন প্রযুক্তি প্রয়োগের ফলে বাক্সপ্রতি মধুর পরিমাণ দাঁড়ায় ১০০ কেজি। দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে মৌমাছির জন্য ক্ষতিকর মাকড় ‘ভেরোয়া’ দমন সম্পূর্ণরূপে সফল হয়। এই মৌ-খামারকে কেন্দ্র করে ‘কমিউনিটি অ্যাপিকালচার’ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আক্ষরিক অর্থে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া—প্রায় প্রতিটি অঞ্চল থেকেই মৌচাষিরা এতে সম্পৃক্ত হন। কিছু সন্ত্রাসী ‘ভেজাল মধু’ এই অভিযোগ তুলে মৌ-খামারে হামলা করে তা ভেঙে তছনছ করে দেয়। এর মোকাবিলায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের ভূমিকা কী ছিল? না, এর কোনো প্রতিকার হয়নি, মৌ-খামার রক্ষায় কোনো সহায়তা দেওয়া হয়নি, উপরন্তু বিস্ময়করভাবে ড. আলীকে ডেকে নিয়ে জানানো হয়, অপ্রিয় পরিস্থিতি এড়ানোর জন্য তিনি যেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৌ-খামারটি সরিয়ে নেন। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কমিউনিটি অ্যাপিকালচারের কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া অসম্ভব। নিমিষেই দীর্ঘদিনের গবেষণালব্ধ প্রকল্পটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভের মাত্র তিন বছরের মধ্যেই বিলীন হয়ে যায়। মৌচাষিরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। আর এত বড় বিপর্যয়ের পর ড. আলীকে শিকার হতে হয় হূদেরাগের। এটি কি কেবলই ব্যক্তিগত ঈর্ষাপরায়ণতা?
আমি আগেই বলেছি, মুষ্টিমেয় শিক্ষক দলীয় লেজুড়বৃত্তিমূলক রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত, সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়কে পচনের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর তৎপরতাই যথেষ্ট, যার শিকার অগণিত শিক্ষার্থী ও শিক্ষক। যে প্রজাপতির ডানা ভেঙে দেওয়া হয়েছে, সে-ই জানে, জীবনে সে কতটুকু হারাল। সে-ই জানে, সে আর কখনোই উঠে দাঁড়াতে পারবে না, জানে চিরতরেই কেড়ে নেওয়া হয়েছে তার পাখার রং ও চাঞ্চল্য। এভাবেই মুছে যাচ্ছে হাজার শিক্ষার্থীর জীবনের রং, তাদের প্রাণচাঞ্চল্য।
এখনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেটুকু জীবনের রং ও আশার বৈভব রয়েছে, তা সেসব শিক্ষকের জন্যই, যাঁরা জনাব মুরশিদের উক্তিটির মতোই বিশ্বাস করেন এবং নিজেদের জীবনে তার প্রতিফলন ঘটানোর চেষ্টা করেন—‘শিক্ষকতা এমন একটি পেশা, যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে খানিকটা আত্মত্যাগ, জ্ঞানের সাধনা এবং ছাত্রদের শেখানোর আগ্রহ। প্লেইন লিভিং অ্যান্ড হাই থিংকিং...।’ এরাই স্বাচ্ছন্দ্যময় জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও সুযোগ থাকার পরও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে যান কেবল এর প্রতি, এর শিক্ষার্থীদের প্রতি মমত্ব ও দায়বদ্ধতার বোধ থেকেই। এঁরা বিশ্বাস করেন, দুঃসময় একদিন কেটে যাবেই, কেননা সামনে আসছে আপসহীন, রুখে দাঁড়ানো প্রজন্ম, তা যত ক্ষুদ্র আকারেই হোক না কেন।
সুলতানা মোসতাফা: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে গবেষণারত।
sultanamk@yahoo.co.uk
No comments