অতিপ্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়া by শেখ রোকন

প্রাকৃতিক সপ্তাশ্চর্য নির্বাচন প্রক্রিয়া, এর উদ্দেশ্য এবং নির্বাচিত হলে বাংলাদেশের লাভালাভ নিয়ে মৃদু হলেও কিছুটা সন্দেহ কিন্তু গোড়া থেকেই ছিল। যেমন সেভেন ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশনের মূল অফিস সুইজারল্যান্ডে হলেও এর ওয়েবসাইটে কেন অফিসের ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায় না।


এর আগের পর্যায়ে ওই সংস্থার পক্ষে নতুন সপ্তাশ্চর্য নির্বাচন প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগীদের ভোটের হিসাব কেন প্রকাশ করা হয়নি। একটি সর্বজনীন নির্বাচন প্রক্রিয়ার আয়-ব্যয়ের রিপোর্ট কেন এখনও গোপন। ইউনেস্কো কেন ওই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ততা প্রত্যাহার করেছিল ইত্যাদি। এসব আন্তর্জাতিক বিবেচনা। আমাদের প্রেক্ষিতে বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারের বদলে সুন্দরবনের এগিয়ে থাকা ঠিক স্বাভাবিক বলে মেনে নেওয়া কঠিন। সুন্দরবন নিঃসন্দেহে অনন্য, আমাদের অমূল্য সম্পদ; বিশ্বের বৃহত্তম প্রাকৃতিক গরান বন। কিন্তু প্রশ্ন যখন পর্যটনের তখন সুন্দরবন জনপ্রিয়তার দিক থেকে কক্সবাজারের চেয়ে এগিয়ে থাকবে_ এ বিষয়টি কেমন যেন খটকা তৈরি করে। সমালোচকরা বলছেন, সুন্দরবনকে বেছে নেওয়া হয়েছে দুই দেশের ভোট আকৃষ্ট করার জন্য।
আবার এমন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। টিকে থাকা ২৮টি স্থানের মধ্যে ব্রাজিলের আমাজান বনভূমিও রয়েছে। বন, সাগর, দ্বীপ, নদী, মরুভূমি প্রভৃতি প্রকৃতি শ্রেণীতে যদি চূড়ান্ত সাতটি নির্বাচিত হয়, সুন্দরবন কি যে কোনো বিবেচনাতেই আমাজানের সঙ্গে তুল্য? ধরা যাক নির্বাচিত হলো, তাহলে সুন্দরবনের লাভ কী? পর্যটন বাড়তে পারে। সুন্দরবনের স্পর্শকাতর প্রতিবেশের জন্য বিপুল পর্যটন কতটা স্বাস্থ্যকর?
এহ বাহ্য। সম্প্রতি আরও গুরুতর অভিযোগ উঠেছে সেভেন ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশনের বিরুদ্ধে। আগে বলা হতো একটি ই-মেইল অ্যাকাউন্ট থেকে একবারই ভোট প্রদান করা যাবে। ইউনেস্কো যদিও নতুন সপ্তাশ্চর্য নির্বাচন প্রক্রিয়া নিয়ে আপত্তি তুলেছিল যে শুধু ইন্টারনেট বা সেলফোন ব্যবহারকারীদের ভোটে কোনো বৈশ্বিক ঐতিহ্য চূড়ান্ত হতে পারে না, ওই পদ্ধতির ভোটাভুটি তাও খানিকটা গ্রহণযোগ্য। এরপরও আমাদের মনে আছে, প্রাথমিক পর্যায়ে ই-মেইল ভোটাভুটিতে 'অনিয়ম' করা হয়েছে অভিযোগ তুলে কক্সবাজার ও সুন্দরবনকে তালিকা থেকে বাদ দিয়েছিল সেভেন ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশন। কিন্তু এখন তারাই বলছে, সেলফোনের মাধ্যমে এসএমএস করে নিজের পছন্দের প্রাকৃতিক স্থানের পক্ষে যত খুশি ভোট দেওয়া যাবে! তার মানে, কেউ চাইলেই বিপুল অর্থ খরচ করে নিজের দেশকে জিতিয়ে নিতে পারবে। এটা জোচ্চুরি ছাড়া কী!
সেভেন ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশন কেবল ইউনেস্কো নয়, ইতিমধ্যে বিশ্বের আরও অন্যান্য দেশে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। মালদ্বীপ সরকার ইতিমধ্যে এ প্রতিযোগিতা থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করেছে। সেখানকার পর্যটন মন্ত্রণালয় এই প্রতিযোগিতার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিয়ে আশ্বস্ত নয়। ইন্দোনেশিয়াও একইভাবে নিজেদের প্রত্যাহার করেছে।
মুশকিল হচ্ছে, সুন্দরবন দুই দেশের অংশ হলেও বাংলাদেশ একাই এই প্রতিযোগিতা নিয়ে যতটা তৎপর হয়েছে, তা প্রায় নজিরবিহীন। আমাদের টুরিজম বোর্ড সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পক্ষকে যুক্ত করে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে হুলস্থূল সৃষ্টি করেছে। ইতিমধ্যে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ই-মেইল ও সেলফোনে ভোট দিয়েছেন এবং অন্যদের ভোট দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। আমাদের বন ও পরিবেশমন্ত্রী এই প্রচারাভিযানের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বলেছেন, পাঁচ কোটি মোবাইল ফোন গ্রাহক যদি ২০টি করে এসএমএস পাঠায়, তাহলে বাংলাদেশ একশ' কোটি ভোট পাবে। ভালো কথা; কিন্তু একশ' কোটি ভোট দিতে গিয়ে নাগরিকের কত টাকা চলে যাবে?
সংবাদমাধ্যম সূত্রে জানা যাচ্ছে, সুন্দরবনকে দেওয়া প্রতি এসএমএসে ৬৮ পয়সা দেওয়া হচ্ছে সেই ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশনকে। বাকি অর্থ কার ঘরে যাচ্ছে? দুইশ' কোটি টাকায় ই-মেইল ও সেলফোনে শ্রাদ্ধের বদলে সুন্দরবন সুরক্ষা কিংবা কক্সবাজারের পর্যটন উন্নয়নে এই অর্থ কি খরচ হতে পারত না? সাধারণ নাগরিক তো 'হুজুগে বাঙালি' বলে আগে থেকেই পরিচিত; আমাদের নীতিনির্ধারকরা কেন এসব দিক না ভেবেই সেভেন ওয়ান্ডার্সের পেছনে ছুটলেন?
সবচেয়ে বড় কথা, সুন্দরবন ইতিমধ্যেই ইউনেস্কো ঘোষিত 'বিশ্ব ঐতিহ্যস্থল'। তারপরও ব্যক্তিগত একই উদ্যোগের স্বীকৃতি কেন জরুরি হয়ে পড়ল?
skrokon@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.