সমকালীন প্রসঙ্গ-ক্ষতি কিন্তু ক্ষমতাসীন দলেরই by বদিউর রহমান

রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান একজন সম্মানিত ব্যক্তি। দু-বছইর‌্যা তত্ত্বাবধায়কের আমলে অর্থাৎ সেনা-নির্দেশিত গত তত্ত্বাবধায়কের আমলে শেখ হাসিনা কারাবন্দি থাকাকালে তিনি যে মমতা ও প্রজ্ঞা দিয়ে আওয়ামী লীগকে ধরে রেখেছিলেন, তা প্রশংসনীয় এবং অনবদ্য নজিরও বটে আমরা যারা অন্তত বাল্যশিক্ষা পড়েছি ছোট থাকতে এবং তারপর হুজুরদের কাছে মক্তবে কিছুটা হলেও ধর্মশিক্ষা নিয়েছি, তারা জানি যে ক্ষমা মহত্ত্বের লক্ষণ।


আমরাও ক্ষমাশীল হওয়ার চেষ্টা করে থাকি। অনেক সময় গায়ে কামড় দিলেও মশাটাকে ক্ষমা করে দিই, মারি না। কখনও কখনও পিঁপড়াকেও ছেড়ে দিই। সন্ত্রাসী কেউ আমাদের দু'একটা চড়-থাপ্পড় দিলেও আমরা তাদের ক্ষমা করে দিই, অযথা ঝামেলা করে নিজের সম্মান নষ্টের কী দরকার। কোনো জনপ্রতিনিধি কিংবা সাংসদ মারধর করলে তো তাকে ক্ষমা করে দিতেই হয়, তিনি যে আমাদের ভোটেই নির্বাচিত সাংসদ। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, ব্যাটা পাঁজি কোথাকার, প্রতিকারের ক্ষমতা নেই, দুর্বল ব্যাটা, বাহাদুরি করিস ক্ষমা করার! আমি এটা মানতে নারাজ। মশা ও পিঁপড়া কি আমার চেয়ে শক্তিমান? মশা আর পিঁপড়াকে যদি ক্ষমা করতে পারি তাহলে সন্ত্রাসী, মস্তান আর সাংসদকে কেন পারব না? আমার মহত্ত্ব তো আমি জানি, অন্যের বিবেচনায় আমার অত ভাবলে চলবে কেন।
কিন্তু রাষ্ট্রীয় রীতিনীতিই আলাদা। এখানে বিচারের পরও একজনকে ক্ষমা করে দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ভাবটা হলো, বিচার করার প্রয়োজন ছিল বিচার করা হয়েছে; বিচারকের একটা রায় দেওয়ার কথা ছিল, রায় দেওয়া হয়েছে। এখন যদি তার পরও ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি শাস্তি বা দণ্ড মওকুফ করে দেন, তবে তাও রাষ্ট্রীয় আইনের বলেই হয়েছে, এতে নাকি দোষের কিছু নেই। অবশ্যই দোষের কিছু নেই, তবে তা আইনি দৃষ্টিতে, বিবেকের অনুশাসনে নয়; তা ন্যায় প্রতিষ্ঠার সুষম ভিত্তিতে নয়। এই যে আমার চোখের সামনেই দেখছি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৯ নং অনুচ্ছেদ। ছাপানো অক্ষরে পরিষ্কারভাবে লেখা রয়েছে "৪৯। কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রদত্ত যে কোনো দণ্ডের মার্জনা, বিলম্বন ও বিরাম মঞ্জুর করিবার এবং যে কোনো দণ্ড মওকুফ, স্থগিত বা হ্রাস করিবার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকিবে।" রাষ্ট্রপতির এ সাংবিধানিক ক্ষমতাকে সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের মার্জিনে আবার 'ক্ষমা প্রদর্শনের অধিকার'রূপে দেখানো হয়েছে, যা সংবিধানের অনুচ্ছেদওয়ারি সূচিপত্রেও উলি্লখিত। তাহলে যা রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, তা-ই তার অধিকার। কিন্তু আমার কাছে ক্ষমতা ও অধিকার এক মনে হয় না। অধিকার অনেক বড় কিছু, ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত এবং প্রয়োগে বেশ নিয়মকানুন ও শর্ত থেকে যায়। তাহলে ইংরেজি ভার্সনে কী ভাবে ৪৯ অনুচ্ছেদ লেখা আছে দেখা যাক। ্তু৪৯. ঞযব ঢ়ৎবংরফবহঃ ংযধষষ যধাব ঢ়ড়বিৎ ঃড় মৎধহঃ ঢ়ধৎফড়হং, ৎবঢ়ৎরবাবং ধহফ ৎবংঢ়রঃবং ধহফ ঃড় ৎবসরঃ, ংঁংঢ়বহফ ড়ৎ পড়সসঁঃব ধহু ংবহঃবহপব ঢ়ধংংবফ নু ধহু পড়ঁৎঃ, ঃৎরনঁহধষ ড়ৎ ড়ঃযবৎ ধঁঃযড়ৎরঃু্থ এখানে মার্জিনে লেখা হয়েছে চৎবৎড়মধঃরাব ড়ভ সবৎপু. বাংলায় অধিকার আর ইংরেজিতে প্রিরোগেটিভ অবশ্যই অধিকারের বহুল স্বীকৃত ইংরেজি তরজমা ৎরমযঃং-কে বোঝায় না। কিন্তু সাংবিধানিকভাবেই বাংলা প্রাধান্য পায়, কেননা সংবিধানের ৩ নং অনুচ্ছেদে 'প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা' বলা হয়েছে। আবার ১৫৩(২) অনুচ্ছেদে সংবিধানের বাংলায় নির্ভরযোগ্য পাঠ এবং ইংরেজিতে অনূদিত নির্ভরযোগ্য অনুমোদিত পাঠ_ উভয়কেই নির্ভরযোগ্য বলে গণপরিষদের স্পিকার সার্টিফিকেট প্রদান করবেন মর্মে উল্লেখ রয়েছে। অনুচ্ছেদ ১৫৩(২) ও ১৫৩(৩) : ১৫৩(২)_ 'বাংলায় এ সংবিধানের একটি নির্ভরযোগ্য পাঠ ও ইংরেজিতে অনূদিত একটি নির্ভরযোগ্য অনুমোদিত পাঠ থাকিবে এবং উভয় পাঠ নির্ভরযোগ্য বলিয়া গণপরিষদের স্পিকার সার্টিফিকেট প্রদান করিবেন। ১৫৩(৩) অনুচ্ছেদের (২) দফা অনুযায়ী সার্টিফিকেটযুক্ত কোনো পাঠ এ সংবিধানের বিধানাবলির চূড়ান্ত প্রমাণ বলিয়া গণ্য হইবে। তবে শর্ত থাকে যে, বাংলা ও ইংরেজি পাঠের মধ্যে বিরোধের ক্ষেত্রে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাইবে।' সাংবিধানিক ক্ষমতায় বাংলা পাঠ প্রাধান্য পেলেও ৪৯ অনুচ্ছেদের মার্জিনে বা সংবিধানের সূচিপত্রে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা প্রদর্শনের অধিকাররূপে যে শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে তা অধিকাররূপে গ্রহণযোগ্য নয়, তা অনুচ্ছেদের ভেতরে লেখা ক্ষমতা মাত্র। ইংরেজি পাঠ ও বাংলা পাঠের মধ্যে অনুচ্ছেদটির মার্জিনে বাংলায় অধিকার আর ইংরেজিতে প্রিরোগেটিভ_ এ দুটোর কোনোটিই গ্রহণযোগ্য নয়। ভেতরের মূল বক্তব্যে ইংরেজিতেও পাওয়ার বলা হয়েছে। অতএব বাংলা পাঠ ও ইংরেজি পাঠের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই, উভয়টিতেই বিষয়টাকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা হিসেবে দেখানো হয়েছে। এ বিশ্লেষণ থেকে তার ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতা অনস্বীকার্য, যদিও তা অধিকার বা প্রিরোগেটিভ কোনোটাই নয়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ক্ষমতা থাকলেই কি তা প্রয়োগ করতে হবে? করলেও তা কখন, কোন ক্ষেত্রে, কোন বিবেচনায় করতে হবে? আমার তো মনে হয়, দণ্ড মওকুফের ক্ষমতা একটা আলঙ্কারিক ক্ষমতা, রাষ্ট্রের এক নম্বর ব্যক্তি হিসেবে রাষ্ট্রপতিকে সবার ওপরে, এমনকি বিচার ব্যবস্থাও সর্বোচ্চ বিচারকের সম্মানে সম্মানিত করার জন্যই দেওয়া হয়েছে। যারা সংবিধান প্রণয়নের সময় এ অনুচ্ছেদ অন্তর্ভুক্ত করেছেন, তারা অনেক ভালো বলতে পারবেন মূল্য উদ্দেশ্য কী ছিল। তার পরও তার ক্ষমতা ক্ষেত্রবিশেষে প্রযোজ্য হবে, অবশ্যই সেটা হবে। আমার মতে, এমন ক্ষেত্রে যে বিচারক প্রচলিত আইনের আওতায় ন্যায়বিচার করেছেন, তার অর্থাৎ বিচারকের আইনের বাইরে যাওয়ার পথ ছিল না; কিন্তু মানবিক কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি ক্ষমা প্রদর্শন করলেও বিচারকের করা বিচারের প্রতি অবিচার হবে না, বরং জনমনে তা প্রকৃত ক্ষমা হিসেবেই গৃহীত হবে, মানুষ তাতে খুশি হবে। ফাঁসির আসামি বিপ্লবকে ক্ষমা করে দিয়ে রাষ্ট্রপতি 'ক্ষমাই মহত্ত্বের লক্ষণ' প্রমাণ করতে চেয়েছেন কি-না আমরা জানি না। তবে এটুকু বোধ হয় ভাবতে পারি যে, কাজটি মোটেই ভালো মনে করা হচ্ছে না, যেমন করা হয়নি বিএনপি জোট আমলের রাষ্ট্রপতি কানাডা-প্রবাসী ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত ঝিন্টুকে ক্ষমার ঘটনা। উভয় ক্ষেত্রেই দলীয় বিবেচনায় এ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে মর্মে সমালোচনার ঝড় উঠেছে। দলীয় বিবেচনার এমনতর আরও কিছু ঘটনা যারপরনাই সমালোচনা পেয়েছে, কিন্তু কে শোনে কার কথা? উভয় ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত সম্পর্কের প্রশ্নও উঠেছে কিন্তু।
রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান একজন সম্মানিত ব্যক্তি। দু-বছইর‌্যা তত্ত্বাবধায়কের আমলে অর্থাৎ সেনা-নির্দেশিত গত তত্ত্বাবধায়কের আমলে শেখ হাসিনা কারাবন্দি থাকাকালে তিনি যে মমতা ও প্রজ্ঞা দিয়ে আওয়ামী লীগকে ধরে রেখেছিলেন, তা প্রশংসনীয় এবং অনবদ্য নজিরও বটে। মাইনাস টু থেকে মাইনাস ওয়ানের প্রচণ্ড চাপ থাকা সত্ত্বেও, আওয়ামী অভ্যন্তরে প্রচণ্ড সংস্কারের একটা বলয় থাকা সত্ত্বেও জিল্লুর রহমানই সঠিক পথে চলেছিলেন এবং আদর্শচ্যুত হননি। অতএব আওয়ামী লীগ তাকে রাষ্ট্রপতির আসনে অধিষ্ঠিত করে সঠিক কাজটিই করেছে_ এটা স্বীকার করতেই হবে। আমরাও গর্বিত ও আনন্দিত। কিন্তু রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর তো তিনিও আরেক ইয়াজউদ্দীন হয়ে পড়বেন, এমন আশা আমরা করতে পারি না। ভৈরবকে জেলা করা নিয়ে তার একটা বক্তব্য তার সম্মানকে খাটো করেছিল। কিন্তু এবার চিহ্নিত সন্ত্রাসীর দণ্ড মওকুফ করে তিনি নিজেই সমালোচিত হচ্ছেন। গত মেয়াদে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের কারণের মধ্যে অনেক সফলতার পরও আওয়ামী সন্ত্রাস তথা কয়েকজন গডফাদারের অবদান কি তিনি ভুলে গেছেন? লক্ষ্মীপুরে কি তাহের তখন সন্ত্রাসী গডফাদার হিসেবে জনমনে আতঙ্ক ছিলেন না? তার ছেলেদের কর্মকাণ্ড কি আজও মানুষ ভুলে গেছে? সেই তাহের আবার আওয়ামী সমর্থনে মেয়র হলেন, কিন্তু কেন? এই একজনকে মেয়র পদে না আনলে কি আওয়ামী লীগ জলে ভেসে যেত? এখন আবার তার আবেদনে তার ছেলে খুনের দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে ক্ষমা করে দিয়ে কি আওয়ামী তরফ থেকে জনগণকে আবার এ ইঙ্গিত দিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, আমাদের সন্ত্রাসীদের আমরা আবার পুনর্বাসন করতে যাচ্ছি? তাহলে তো সামনের ভোটের সময়ের কথাটা আবারও মনে রাখতে হয়। তাহলে তো আমরা আগামী নির্বাচনে ফেনীর গডফাদার ভাইছারও পুনরুত্থানের আভাস পেতে পারি, নাকি?
রাষ্ট্রপতিকে মহামান্য বলার কোনো নির্দেশনা সংবিধানে নেই, রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রপতিই। কিন্তু তার পরও রাষ্ট্রের এক নম্বর ব্যক্তি হিসেবে, রাষ্ট্রের প্রতিভূ হিসেবে আমরা তাকে মহামান্য বলে যারপরনাই সম্মান করি। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন এই মহামান্য তুলে দিতে চাইলেও সে সম্মান এখনও বহাল আছে। সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদ মোতাবেক [৫৬(৩) ও ৯৫(১) অনুচ্ছেদ স্মর্তব্য] রাষ্ট্রপতি কেবল প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করবেন। এ দণ্ড মওকুফেও যদি তাই হয়ে থাকে, তবে প্রধানমন্ত্রী কাজটা ভালো করেননি। আরেক মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতে না পারলে দেশের অবস্থা কী হবে, আর পারলেই বা কী হবে, তা দীর্ঘ আলোচনার বিষয়। কিন্তু এজাতীয় দণ্ড মওকুফ যে আওয়ামী লীগকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তা স্বীকার করতেই হয়। প্রশ্ন উঠেছে, শেখ হাসিনা পিতৃহত্যার বিচার চাইতে পারলে নিহত নুরুল ইসলামের ছেলেমেয়ের কী দোষ? নুরুল ইসলামের স্ত্রী প্রশ্ন রেখেছেন, রাষ্ট্রপতি কি আইভি রহমানের খুনিদেরও ক্ষমা করে দেবেন? তখনও কি ক্ষমা মহত্ত্বের লক্ষণ হবে? যদি তা-ই হয়, সংবিধানের ৪৯ নং অনুচ্ছেদে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি সব দণ্ডপ্রাপ্তের সব দণ্ড মওকুফ করে দিয়ে মহত্ত্বের এক অনন্য নজির স্থাপন করতে পারেন, আমরা খুশিই হব।

বদিউর রহমান : সাবেক সচিব ও সাবেক চেয়ারম্যান, এনবিআর
 

No comments

Powered by Blogger.