নিত্যজাতম্-লোম বাছতে কম্বল উজাড় by মহসীন হাবিব

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। এই ডিজিটাল বাংলাদেশের অর্থ কী, তা আজও পরিষ্কার নয়। এর আক্ষরিক অর্থ এমন হতে পারে যে সব ক্ষেত্রে অ্যানালগ পদ্ধতি ত্যাগ করে ডিজিটাল পদ্ধতিতে পরিবর্তন করা।


অর্থাৎ যে অফিসে হাতে খাতায় হিসাব টোকা হচ্ছে, সে অফিসে কম্পিউটার চালু করা, যেসব ক্ষেত্রে হাতে কলকব্জা চালানো হচ্ছে, সেসব পরিবর্তন করে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি ব্যবহার করা। নাকি এই ডিজিটাল বাংলাদেশের আরো কোনো অর্থ আছে? যেমন_সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করা, প্রশাসনকে আধুনিক করে তোলা, অর্থনীতি চাঙ্গা করা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ করে তোলা; প্রযুক্তির উত্তরোত্তর ব্যবহার বাড়িয়ে দেশকে ঘুষ-দুর্নীতি থেকে সরিয়ে আনা ইত্যাদি। বিভিন্ন সময়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে মনে হয়েছে, তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে এই শেষের লক্ষণগুলোকেই বুঝিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হলো, তিনি কি এই ডিজিটাল বাংলাদেশ করার ঘোষণাকে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি বলে ধরে নিয়েছেন, নাকি সত্যিই বাংলাদেশকে একটি সুসভ্য রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখছেন, নাকি মনেপ্রাণে একটি ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করতে চেয়েছেন? কারণ বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি এক কথা এবং তা বাস্তবায়ন আরেক কথা। এ দেশে তো প্রতিশ্রুতি দিলে তা বাস্তবায়নের কোনো প্রয়োজন পড়ে না। আজ অবধি বাংলাদেশের কোনো সরকার নির্বাচনী ইশতেহার পালন করেনি, মুখে বলা ছাড়া বাস্তবায়নের চাপও বোধ করেনি। তবে শীর্ষ ব্যক্তিরা কেউ কিছু স্বপ্ন দেখলে তা বাস্তবায়নের বহু উদাহরণ আছে। দেশের শীর্ষ নেতাদের ইচ্ছা পূরণ হয়নি, এমন ঘটনা খুব একটা নেই। অর্থসম্পদ গড়ে তোলার পাশাপাশি বাংলাদেশে ক্ষমতাসীনরা যিনি যখন প্রতিপক্ষের কাউকে ঘায়েল করতে চেষ্টা করেছেন, তাঁরা তা সফলতার সঙ্গেই করেছেন। এর একটি বা দুটি নয়, হাজার হাজার উদাহরণ আছে।
যা হোক, ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে তিনি যা-ই বুঝিয়ে থাকুন না কেন, তা এখন পর্যন্ত এককথায় সফলতার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। সে ব্যর্থতা সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অসততার কারণেই হোক, অদক্ষতার কারণেই হোক। বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের কলকব্জা থেকে শুরু করে বিমানের কলকব্জা পর্যন্ত মরিচা ধরে গেছে। বাংলাদেশজুড়ে গ্রামাঞ্চলের, এমনকি শহরাঞ্চলের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষার্থীরা চিরাচরিত কায়দায় উচ্চৈঃস্বরে নামতা মুখস্থ করে যাচ্ছে। আট বছরের শিশু দুলাল কোটি টাকা মূল্যের বই লুটের আসামি হচ্ছে। জাল স্বাক্ষর করে কারাগার থেকে আসামি বের করে নেওয়ার ঘটনা যে দেশে ঘটছে, তাকে কী করে ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে এগোচ্ছে বলা যায়, আমাদের জানা নেই। একের পর এক মানুষ স্রেফ লাপাত্তা হয়ে যেতে পারে কোনো ডিজিটাল দেশে? বাড়ির ভেতরে ঢুকে একাধিক মানুষকে হত্যা করে, বাড়ি ঢুকে টাকা, স্বর্ণালংকারসহ কোলের শিশুকে নিয়ে যাচ্ছে দুর্বৃত্তরা, অথচ তাদের ধরতে পারছে না (নাকি ধরছে না) আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী_এমন পরিস্থিতির কোনো দেশকে আমরা কী করে ডিজিটাল আখ্যায়িত করব? মানুষ বাড়ির গ্রিলে তালা দিয়ে, কি-হোল ব্যবহার করে, বাড়িতে প্রহরী বসিয়েও নিরাপদ বোধ করছে না।
বর্তমান সরকারের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিরোধী দলের উক্তিগুলোতে কিছু ভুল আছে। তারা এ সরকারকে বলে দলীকরণের সরকার। সব কিছুকে নাকি সরকার দলীয়করণের আওতায় নিয়ে এসেছে। এ বিষয়ে আমাদের ধারণা আরেকটু এগিয়ে। সরকার দলীয়করণের প্রচণ্ড ইচ্ছা থাকলেও তা করে উঠতে পারেনি। দলীকরণ করতে হলেও প্রশাসনিক দক্ষতা থাকা দরকার, যা বর্তমান সরকারের মধ্যে অনুপস্থিত। দ্বিতীয়ত, ঘুষ-দুর্নীতি দলীয়করণের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ভূমিকা পালন করছে। যেমন_পুলিশের কথাই ধরা যাক। ঢাকা ও এর আশপাশে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ থানায় দলীয় বিবেচনায় যেসব পুলিশ কর্মকর্তা পোস্টিং পেয়েছেন, তাঁদের উদ্ধত আচরণের কারণে তাঁরা বারবার সংবাদ শিরোনামে পরিণত হচ্ছেন। ফলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। কিন্তু এই ঢাকা শহরেই গুরুত্বপূর্ণ পদে, গুরুত্বপূর্ণ থানার দায়িত্বে এমন সব কর্মকর্তা রয়েছেন, যাঁদের চাকরি হয়েছে বিএনপির দলীয় লোক হিসেবে, যাঁরা কেউ কেউ বিএনপি দলের কোনো কোনো নেতার ঘনিষ্ঠ আত্মীয়, সাবেক কর্মী। তাহলে আর দলীয়করণ পুরোপুরি হলো কোথায়? নিঃসন্দেহে বলা যায়, এ ক্ষেত্রে দলীয়করণ ঘুষ-বাণিজ্যের কাছে পরাজিত হয়েছে। এ অবস্থা শুধু পুলিশে নয়, প্রায় সব ডিপার্টমেন্টেই বিদ্যমান। স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনে দায়িত্বশীল পদে এমন লোকও আছেন, যিনি জামায়াতে ইসলামীর রোকন ছিলেন। এমন লোকও আছেন, যিনি বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সবচেয়ে ঘৃণিত ও দোষি সাব্যস্ত ব্যক্তির নিকটাত্মীয়। এই কমিশনের কেউ কেউ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অফিসেও যাতায়াত করেন বলে অভিযোগ আছে। যদিও নির্বাচন কমিশন স্বাধীন, এর পরও বাস্তবতা হলো এ কমিশন দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি-পরিবেশের ঊধর্ে্ব নয়। সুতরাং যদি এমন হতো যে দক্ষতা-অভিজ্ঞতা এ ক্ষেত্রে বিবেচিত হয়েছে, তাহলে সরকারের প্রশংসা ছাড়া আর কোনো উক্তি করা যেত না। কিন্তু আসল ঘটনা তো তেমন নয়। প্রকৃত বিষয় হলো প্রশাসনকে দলীয়করণের আওতায় আনতে গেলেই এমন বিপত্তি ঘটবেই।
দেশের এ প্রশাসনকে যদি কোনো সরকার জবাবদিহিতার সঠিক বন্ধনে নিয়ে আসতে চেষ্টা করত, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের প্রতি দোষারোপের যে খেলা চলছে, সে খেলা থেকেও জনগণ অনেকটা নিস্তার পেত।
আজও বাংলাদেশের প্রশাসনে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি নিয়ে কোনো স্বচ্ছতা তৈরি হয়নি, ফলে প্রত্যেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে নিয়মবহির্ভূত সুবিধা আদায়ের প্রবণতা দেখা যায়। আর সেটা করতে হলে তাদের দুটি হাতিয়ার দরকার। একটি হলো রাজনৈতিক আনুগত্য প্রদর্শন করে অনুকম্পা লাভ, অন্যটি যথাযথ কর্তৃপক্ষকে আর্থিকভাবে সন্তুষ্ট করা। এ দুটো কাজ করতে গিয়ে তাদের আদাজল খেয়ে নামতে হচ্ছে সার্ভিস রুল পরিপন্থী কর্মকাণ্ডে।
দেশে সবাই যে চোখ বুজে আছেন এমন নয়। কেউ কেউ যে ভালো করতে চেষ্টা করছেন না, তাও নয়। কিন্তু তাঁদের সংখ্যা এত কম যে, স্রোতের বিপরীতে তাঁরা অনেকটা অসহায় হয়ে আছেন। প্রায় দুই বছর আগে টিআইবির দুর্নীতির ওপর এক প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই দুর্নীতি দমন সংস্থার চেয়ারম্যান বলেছিলেন, প্রকৃত অবস্থা টিআইবির প্রতিবেদনের চেয়েও ভয়াবহ। দুর্নীতি আরো বাড়ছে। এর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। দুদক চেয়ারম্যানের মতোই একই কথা প্রযোজ্য অধিকাংশ মন্ত্রীর বেলায়। তাঁদের চারপাশে যা চলছে, এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মানসিক শক্তি অনেকেরই নেই। ফলে কেউ কেউ চোখ বুজে ফেলছেন। এটা ঠিক নয়। মোদ্দা কথা, প্রচলিত একটি প্রবাদ আছে_লোম বাছতে কম্বল উজাড়। কম্বলের লোম বাছতে গেলে কম্বলই থাকে না। দেশের প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এমনভাবে অন্যায়-অবিচার ঢুকে পড়েছে যে এর বিরুদ্ধে এখন সরকারেরই একটি আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। তা না হলে ডিজিটাল বাংলাদেশ ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাবে।
লেখক : সাংবাদিক
mohshinhabib@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.