দুই দু’গুণে পাঁচ-পুনশ্চ বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতা by আতাউর রহমান

লিখতে বসেই গল্পটা মনে পড়ে গেল: বিলেতের একটি বড় শহরে এক লোক দুটি পেঙ্গুইন নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এক কর্মকর্তার সেটা চোখে পড়ায় তিনি তাঁকে বললেন সেগুলো চিড়িয়াখানায় নিয়ে যেতে। লোকটি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।


কিন্তু সপ্তাহ খানেক পর পুনরায় একই দৃশ্য অবলোকন করে ওই কর্মকর্তা লোকটিকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘আপনাকে বলেছিলাম এগুলো চিড়িয়াখানায় নিয়ে যেতে, যাননি?’ লোকটি প্রত্যুত্তরে জানালেন, ‘গিয়েছিলাম তো। ওরা চিড়িয়াখানা খুব পছন্দ করেছে বলে মনে হয়েছে। তাই তো আজ ওদের জাদুঘর দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি।’
অনুরূপভাবে এই কলামের গেল কিস্তির ‘বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতা’ অনেক পাঠকের কাছে উপভোগ্য হয়েছে বলে মনে হয়েছে। অনেকেই টেলিফোনে ও ব্যক্তিগতভাবে এই অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছেন বিধায় আমি ওটার আরেকটা কিস্তি লিখতে মনস্থির করে ফেললাম। অবশ্য একজন পাঠক অনুযোগ করেছেন, ‘সবকিছু যিনি পণ্ড করেছেন তিনিই পণ্ডিত, এটা কেমন করে হয়?’ তাৎক্ষণিক জবাবে আমি তাঁকে বলেছি, ‘রম্যজগতে তথা হাসির রাজ্যে সবকিছুই সম্ভব।’ এ ক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দিয়ে ব্যাপারটা খোলাসা করা যেতে পারে। ইংরেজিতে লিখিত হাসির বইয়ে আছে: একজন কিশোর তার নবপরিচিত বন্ধুদের গল্পচ্ছলে বলছিল, ‘আমি বড় হয়ে পুলিশ অফিসার হতে এবং আমার বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করতে চাই।’ বন্ধুরা সমস্বরে বলে উঠল, ‘আমরা জানতাম না যে তোমার বাবা একজন পুলিশ অফিসার।’ তখন সে আবারও বলল, ‘না, তিনি তা নন। তিনি একজন সিঁধেল চোর।’ এক্ষণে কথা হলো, বাস্তবে এটা সম্ভব না হলেও হাসির গল্পে কিন্তু সম্ভব। বাস্তবে কোনো ছেলে তার বাবা সিঁধেল চোর, এটা মুখ ফুটে কাউকে কখনো বলবে না।
যা-ই হোক, কথা আর না বাড়িয়ে এবার আসল ব্যাপারটায় তথা বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতার ঘটনাসম্পর্কিত দ্বিতীয় কিস্তির পরিবেশনায় নিবিষ্ট হই।
বিলেতের অন্যতম বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক জি কে চেস্টারটন ছিলেন অসম্ভব মোটা। অন্যদিকে স্বনামধন্য নাট্যকার জর্জ বার্নার্ড শ ছিলেন একেবারে রোগা-পাতলা। দুজনের জীবনাদর্শও ছিল ভিন্ন। যে কারণে সুযোগ পেলে একে অন্যকে বাক্যবাণে বিদ্ধ করতে কার্পণ্য করতেন না। তো একবার এক ভোজসভায় হঠাৎ দুজনের সাক্ষাৎ ঘটল। তখন বিলেতে খুব দুর্ভিক্ষ চলছিল। তাই চেস্টারটন বার্নার্ড শকে ঠাট্টা করে বললেন, ‘মি. শ, আপনাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে ইংল্যান্ডে এখন দুর্ভিক্ষ চলছে।’ বার্নার্ড শ বিন্দুমাত্র ইতস্তত না করে সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন, ‘আর আপনাকে দেখলেই কিন্তু বিলক্ষণ বোঝা যাবে, দেশে কেন দুর্ভিক্ষ ঘটেছে।’ শর উত্তর শুনে চেস্টারটন একেবারে থ।
আমেরিকার দুই বিখ্যাত সিনেটর রেনডলফ ও হেনরি ক্লের মধ্যে একবার ভীষণ ঝগড়া হয়ে দুজনের মধ্যে কথাবার্তাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তো এই ঝগড়ার কয়েক সপ্তাহ পর রাজধানী ওয়াশিংটনের এক সরু রাস্তায় হঠাৎ দুজনের দেখা হয়ে গেল। রাস্তাটা এত সরু ছিল যে একজনকে রাস্তা ছেড়ে দিয়ে পাশের কাদামাটির মধ্যে দাঁড়িয়ে অন্যজনকে যাওয়ার রাস্তা করে দিতে হতো। দুজনই মুখোমুখি খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। অতঃপর ক্লের চোখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে রেনডলফ বেশ ঝাঁজালো কণ্ঠেই বলে উঠলেন, ‘আমি কোনো রাসকেলকে কখনো রাস্তা ছেড়ে দিই না।’ ‘কিন্তু আমি দিই’—এই বলে ক্লে রাস্তা থেকে নেমে রেনডলফকে যেতে দিলেন।
স্থানীয় জমিদারের এস্টেট থেকে হরিণ চুরি করে পলাতক এবং লন্ডনে এসে প্রাথমিক পর্যায়ে নাট্যশালার আস্তাবলে ঘোড়-রক্ষক শেকসপিয়ারের কালজয়ী নাটকগুলো প্রকৃতপক্ষে তিনিই লিখেছেন, নাকি তাঁর সমসাময়িক বিদ্বান ব্যক্তি ফ্রান্সিস বেকন লিখে দিয়েছেন, এ নিয়ে মতবিরোধ চিরন্তন। তো একবার মার্ক টোয়েন আমেরিকা থেকে ইংল্যান্ডে এলে একটি ঘরোয়া বৈঠকে এ ব্যাপারে তাঁর মতামত জানতে চাওয়া হলো। মার্ক টোয়েন বললেন, ‘আমি বরং মৃত্যু পর্যন্ত অপেক্ষা করব এবং অতঃপর স্বর্গে গিয়ে শেকসপিয়ারকে জিজ্ঞেস করে প্রকৃত সত্য জানার চেষ্টা করব।’ উপস্থিত লোকজনের মধ্য থেকে একজন বললেন, ‘তবে শেকসপিয়ার যদি স্বর্গে না গিয়ে নরকে গিয়ে থাকেন, তাহলে?’ এটা বলতেই মার্ক টোয়েন তাঁকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘সে ক্ষেত্রে আপনি ওটা জেনে নিয়েন।’
রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় শান্তিনিকেতনে ইংরেজি ও ফরাসির অধ্যাপক ছিলেন মরিস সাহেব। তিনি বাংলা ভাষাও বেশ কিছুটা রপ্ত করেছিলেন। তো একবার তিনি বিশ্বভারতীয় তৎকালীন ছাত্র প্রমথনাথ বিশীকে বললেন, গুরুদেব চিনির ওপর একটি মিষ্টি গান লিখেছেন, ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে, ওগো বিদেশিনী...’। প্রমথনাথ বিস্মিত হয়ে তাঁকে বললেন, তা চিনির গান তো মিষ্টি হবেই। কিন্তু এই ব্যাখ্যা আপনি কোথায় পেলেন? উত্তরে মরিস সাহেব বললেন, ‘কেন, স্বয়ং গুরুদেবই তো আমাকে বলেছেন।’
ভারতবর্ষের পরাধীন আমলে মহাত্মা গান্ধী কর্তৃক স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতৃত্ব প্রদানকালে একবার তিনি জাহাজযোগে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতবর্ষের বোম্বাই বন্দরে পৌঁছালে নৌবন্দরের কাস্টম কর্তৃপক্ষ তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল, ডিক্লারেশন দেওয়ার মতো তাঁর কাছে কিছু আছে কি না। প্রত্যুত্তরে তিনি বললেন, ‘আমি গরিব ভিখারি; আমার পার্থিব সম্পদের মধ্যে আছে ছয়টি চরকা, একটি ছাগলের দুধ রাখার জগ, ছয়টি হাতে বোনা লেংটি ও একটি তোয়ালে। আর আছে আমার খ্যাতি, যেটা পরিমাপ বা পরিধান করা যায় না।’
দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেলের বয়স যখন ৭৬ বছর, তখন একবার তিনি সি-প্লেনে নরওয়ের অসলো থেকে অন্য একটি শহরে যাওয়ার পথে প্লেনটি বিধ্বস্ত হয়ে পানিতে পড়ে যায়। কাকতালীয়ভাবে প্লেনটির ১৯ জন অধূমপায়ী যাত্রীর সবাই মারা যান এবং পাইপ-পায়ী রাসেলসহ অন্যরা প্রচণ্ড ঠান্ডা পানিতে হাবুডুবু খেয়ে শেষ পর্যন্ত উদ্ধারকারী নৌকায় উঠতে সক্ষম হন। ৭৬ বছরের বৃদ্ধ রাসেলকে অতঃপর যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, হিমশীতল পানিতে হাবুডুবু খাওয়ার সময় তিনি মনে মনে কী ভাবছিলেন? তখন তিনি একগাল হেসে জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমি ভাবছিলাম, পানিটা বেশ ঠান্ডা।’
পরিশেষে ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলীর (রা.) এক উপাখ্যান। একদা দুজন পরিব্রাজক একসঙ্গে ভ্রমণ করছিলেন, তাঁদের একজনের কাছে ছিল পাঁচটা এবং অন্যজনের কাছে তিনটা পাউরুটি। পথিমধ্যে আরেকজন তাঁদের সঙ্গে মিলিত হলে ক্ষুধার্ত অবস্থায় তিনজন রুটিগুলো সমান ভাগে ভাগ করে খেলেন। আগন্তুক বিদায় নেওয়ার কালে খাদ্যের দাম বাবদ আট দিরহাম দিয়ে গেলে পাঁচ রুটির মালিক পাঁচ দিরহাম রেখে তিন রুটির মালিককে তিন দিরহাম দিতে চাইলে বিরোধ বেধে গেল। তিন রুটির মালিক সমান ভাগ অর্থাৎ চার দিরহাম পেতে চাইলেন।
বিরোধটা হজরত আলী (রা.) পর্যন্ত গড়ালে তিনি কী চমৎকার সমাধান দিলেন, দেখুন! তিনি বললেন, ‘প্রতিটি পাউরুটিকে তিনটি সমান ভাগে ভাগ করলে মোট টুকরার সংখ্যা দাঁড়ায় ২৪। তিনজনের প্রত্যেকে আট টুকরা করে খেয়েছেন; যাঁর তিনটি পাউরুটি ছিল, তিনি তাঁর নয় টুকরার মধ্যে আট টুকরাই খেয়েছেন, মাত্র এক টুকরা অবশিষ্ট ছিল।
অন্যদিকে যাঁর পাঁচটি পাউরুটি ছিল, তিনি তাঁর ১৫ টুকরার মধ্যে আট টুকরা খেয়েছেন, অবশিষ্ট ছিল সাত টুকরা। তৃতীয় ব্যক্তি মোট আট টুকরা খেয়েছেন এবং আট দিরহাম পরিশোধ করেছেন। অতএব, আইনত পাঁচ রুটির মালিক পাবেন সাত দিরহাম এবং তিন রুটির মালিক পাবেন এক দিরহাম।
গল্পটি বোধ করি ইতিপূর্বেও একবার এ কলামেই বলা হয়েছে। কিন্তু এটা এমন একটা গল্প, যা বারবার বলা যেতে পারে, যাতে করে বিভিন্ন প্রজন্মের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্যের ব্যাপারে আগ্রহান্বিত ও গর্বিত হয়।
আতাউর রহমান: রম্য লেখক। ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক।

No comments

Powered by Blogger.