দারিদ্র্য-ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের সমস্যা কোথায়? by মামুন রশীদ
হতদরিদ্রদের দারিদ্র্যের বলয় থেকে বের করে আনার ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি দীর্ঘদিন ধরে যে সক্ষমতা প্রমাণ করে আসছে, তার বিরুদ্ধে কয়েক বছর ধরেই একধরনের সংঘবদ্ধ ও সংগঠিত প্রপাগান্ডা বা প্রচারণা দেখা গেছে। এর ওপর সম্প্রতি সম্প্রচারিত ডেনমার্কের একজন সাংবাদিকের তৈরি একটি ডকুমেন্টারি বা প্রামাণ্যচিত্রে যেভাবে ক্ষুদ্রঋণের সফলতা বা কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, তাতে অনেকেই দ্বিধান্বিত।
আমরা সবাই জানি, অধ্যাপক ইউনূস এখন আর ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে একাই কাজ করছেন না। এটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও ছড়িয়ে পড়েছে। তবে এ কথা ঠিক যে, ভারতের মধ্য ও দক্ষিণাঞ্চলে এই কার্যক্রম নিয়ে কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত বা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। তা সত্ত্বেও এর কার্যকারিতা বিবেচনা করেই ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার নতুন কাঠামোতে এটি পরিচালনার উদ্যোগ নিয়েছে। তবে সামগ্রিক বিবেচনায় ক্ষুদ্রঋণের সুদহার যে কখনো কখনো এর স্বাভাবিক সীমা ছাড়িয়ে বিতর্ক ও প্রশ্নের জন্ম দেয় এবং এই কার্যক্রমের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে, সেটিও অস্বীকার করা যাবে না।
বাংলাদেশ যে শুধু ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের পথিকৃৎ বা জনকই নয়, একই সঙ্গে বিশ্বে এ ধরনের বৃহত্তম ও সবচেয়ে সুদক্ষ কর্মযজ্ঞটিও পরিচালিত হচ্ছে এখানে, বিশেষ করে গ্রামের দরিদ্র নারীদের মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার বিষয়ে আস্থা সৃষ্টি এবং ক্ষুদ্র ব্যবসাকে আরেকটু বড় করে তোলার ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণের অবদান অনস্বীকার্য। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি যেভাবে অর্থায়নসুবিধা দরিদ্র মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে আসছে, তা আর্থিক খাতে বড় ও নামীদামি প্রতিষ্ঠানগুলো পারেনি। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের সুবাদে বিশ্বে এখন সামাজিক ব্যবসার নতুন ধারণা প্রচলিত ও বিকশিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী সংস্থাগুলো (এমএফআই) উন্নয়ন অংশীদার ও বাণিজ্যিক অর্থায়নের সুবিধা পেয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। বর্তমান সরকারও খুবই দরিদ্রবান্ধব এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে প্রতিযোগিতামূলক সুদহারের ভিত্তিতে কৃষি-ব্যবসায়ে সরাসরি ঋণ প্রদান কিংবা যেখানে শাখা নেই, সেখানে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোর মাধ্যমে ঋণ বিতরণের দিকনির্দেশনা দিয়েছে। ফলে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোর মাধ্যমে বিতরণের জন্য বড় ধরনের সিন্ডিকেটেড তহবিলও গড়ে তোলা হচ্ছে।
তবে ছোট ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো এখনো অর্থায়নের জন্য সদস্যদের কাছ থেকে নেওয়া চাঁদা বা আমানত এবং পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) দেওয়া তহবিলের ওপর নির্ভরশীল। সে জন্যই তারা প্রাথমিকভাবে গ্রাহকদের ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে সদস্য হয়ে চাঁদা দিতে বা সঞ্চয়ে প্রভাবিত করে বটে।
সম্প্রতি প্রকাশিত ‘মাইক্রোফিনানস ব্যানানা স্কিনস ২০০৯’ শীর্ষক একটি জরিপে অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে ক্ষুদ্রঋণের ব্যবসায় ঝুঁকির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান এবং এমনকি উন্নত কিছু দেশের চেয়েও বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী সংস্থাগুলোর ক্ষুদ্রঋণ জন্য ঝুঁকির মাত্রা কম। তবে ওই জরিপে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে তিনটি প্রধান ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে—প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাওয়া ও ম্যানেজমেন্ট অব ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) বা তথ্য ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা, ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়া এবং ব্যক্তি বা পরিবারকেন্দ্রিক পরিকল্পনা ও ধারাবাহিকতার অনুপস্থিতি।
উচ্চহারে ঋণ আদায় হওয়ার ফলে ব্যাংকের তুলনায় ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোর ঋণ বিতরণ কার্যক্রমকে ঝুঁকিমুক্ত বলে বিবেচনা করা হয়। তবে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ঋণ আদায়ের হার আগের চেয়ে কমে এসেছে। সে জন্য মনে রাখতে হবে যে অর্থনৈতিক মন্দায় ঋণের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। কারণ, ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণকারীরা স্বভাবতই দুর্বলতম অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে থাকেন।
তবে বাজার দখলের লক্ষ্যে ঋণ প্রদানকারীদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা দেখা দিলে তাতে ঋণের মান কমে ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। দেশের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে মাল্টিপল বরোয়িং বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতাও এই খাতে ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। কারণ, গ্রাহকেরা এক প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধের জন্য আরেক প্রতিষ্ঠান থেকে নতুন করে ঋণ নিয়ে ঝুঁকি বাড়ান। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে সাপ্তাহিক ভিত্তিতে কিস্তি পরিশোধের প্রবণতা থাকলেও গ্রহীতা যদি ঋণের টাকা ব্যবসায়িক কাজে না খাটিয়ে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক অন্য কাজে লাগান, তা একসময় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে।
রিপোর্টিংয়ের দুর্বলতার কারণে দেশে ক্ষুদ্রঋণের মান কমেছে। বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বাদ দিলে দেশের অধিকাংশ ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের রিপোর্টিংয়ে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে না বলে অভিযোগ আছে। এ ছাড়া যেসব ঋণগ্রহীতাকে পরবর্তী সময়ে চিহ্নিত করা কঠিন হবে এবং যাঁরা অতীতে টাকা নিয়ে তা যথাযথভাবে পরিশোধ করেছেন কি না, রেকর্ড জানা নেই—এমন গ্রাহককে ঋণ দিয়ে সেটির তদারকি করাও কঠিন কাজ বৈকি। তবে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো ইদানীং জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যের ভিত্তিতে কার্যক্রম চালাতে চাইলেও পদ্ধতিগত দুর্বলতার কারণে সেটিও পূর্ণাঙ্গভাবে করা সম্ভব হচ্ছে না বলে শুনেছি।
সরকারি ডেটাবেইস বা উপাত্ত না থাকলে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোকে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ঋণগ্রহীতাদের সম্পর্কে প্রয়োজনীয় সামাজিক তথ্যাবলি রেকর্ডে রাখতে হবে। এভাবেই ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের একটি ডেটাব্যাংক বা তথ্যভান্ডার গড়ে উঠতে পারে।
দেশে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের দ্বিতীয় প্রধান ঝুঁকিটা হলো, এর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়া। যেমন, কোনো কোনো ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা জনসেবামূলক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বাণিজ্যিক কার্যক্রমেও জড়িত থাকায় তাদের সত্যিকারের উদ্দেশ্য নিয়ে এবং এমনকি কোনো কোনো ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার কর্তাব্যক্তির লাইফস্টাইলের কারণে স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে।
দেশে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে তৃতীয়, কিন্তু সবচেয়ে উদ্বেগজনক ঝুঁকি হলো, ব্যক্তি বা পরিবারকেন্দ্রিক সিদ্ধান্তে পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়নে ধারাবাহিকতার অনুপস্থিতি এবং ঐতিহাসিকভাবেই এই খাতে মেধাবীদের না আসা। যে কারণে বছরের পর বছর ধরে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে সেকেন্ড টায়ার বা পরবর্তী নেতাদের প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের ঘাটতি লক্ষ করা গেছে।
আশার কথা হলো, বাংলাদেশে এরই মধ্যে মাইক্রো-ক্রেডিট রেগুলেটরি অ্যাক্ট, ২০০৬ আইন পাস ও একটি মাইক্রো-ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি বা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছে। ফলে দেশের ক্ষুদ্রঋণ খাতে মানসম্পন্ন ও অভিন্ন ধরনের রিপোর্টিং, কার্যক্রম মূল্যায়ন-প্রক্রিয়া, সঠিক নীতি-নির্দেশনা, ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণকারীদের নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় ডেটাব্যাংক বা তথ্যভান্ডার গঠন এবং এমএফআইগুলোর জন্য যথাযথ সমর্থন-সহযোগিতা ইত্যাদি ত্বরান্বিত হয়ে দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থাকে অধিকতর গতিশীল করে তুলবে বলে আমরা আশা করি।
তবে যেভাবে একটি আন্তর্জাতিক ও কিছু জাতীয় গণমাধ্যম ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে লিপ্ত বর্তমান বিশ্বের দুটি স্বনামখ্যাত প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার মতো প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে, তা মোটেও প্রশংসনীয় কাজ নয়। ডেনমার্কের বন্ধুটি সম্ভবত বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম নোয়াবেকির ওই নারীর কথা শোনেননি, যিনি বলেছিলেন যে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে যদি ৪০ ডলার না পেতেন, তাহলে তিনি হয়তো পতিতাবৃত্তির মতো পেশায় যোগ দিতে বাধ্য হতেন! যা-ই হোক, গ্রামের যেসব দরিদ্র মানুষ, বিশেষ করে, অসহায় নারীরা অন্য কোনো উৎস থেকে অর্থায়নের সুবিধা পাননি, তাঁরা ক্ষুদ্রঋণ পেয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলেন কি না, সেটি একদিন ইতিহাসই প্রমাণ করবে।
তবে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমকে ভবিষ্যতে কার্যকরভাবে ধরে রাখতে হলে তাদের হিসাব-নিকাশ রক্ষণাবেক্ষণে আরও স্বচ্ছতা আনয়ন, দ্বিতীয় ধাপের ব্যবস্থাপনা দক্ষতা বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য তথ্যপ্রযুক্তিকে আরও সম্পৃক্ত করার বিকল্প নেই।
মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক। নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব।
বাংলাদেশ যে শুধু ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের পথিকৃৎ বা জনকই নয়, একই সঙ্গে বিশ্বে এ ধরনের বৃহত্তম ও সবচেয়ে সুদক্ষ কর্মযজ্ঞটিও পরিচালিত হচ্ছে এখানে, বিশেষ করে গ্রামের দরিদ্র নারীদের মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার বিষয়ে আস্থা সৃষ্টি এবং ক্ষুদ্র ব্যবসাকে আরেকটু বড় করে তোলার ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণের অবদান অনস্বীকার্য। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি যেভাবে অর্থায়নসুবিধা দরিদ্র মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে আসছে, তা আর্থিক খাতে বড় ও নামীদামি প্রতিষ্ঠানগুলো পারেনি। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের সুবাদে বিশ্বে এখন সামাজিক ব্যবসার নতুন ধারণা প্রচলিত ও বিকশিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী সংস্থাগুলো (এমএফআই) উন্নয়ন অংশীদার ও বাণিজ্যিক অর্থায়নের সুবিধা পেয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। বর্তমান সরকারও খুবই দরিদ্রবান্ধব এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে প্রতিযোগিতামূলক সুদহারের ভিত্তিতে কৃষি-ব্যবসায়ে সরাসরি ঋণ প্রদান কিংবা যেখানে শাখা নেই, সেখানে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোর মাধ্যমে ঋণ বিতরণের দিকনির্দেশনা দিয়েছে। ফলে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোর মাধ্যমে বিতরণের জন্য বড় ধরনের সিন্ডিকেটেড তহবিলও গড়ে তোলা হচ্ছে।
তবে ছোট ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো এখনো অর্থায়নের জন্য সদস্যদের কাছ থেকে নেওয়া চাঁদা বা আমানত এবং পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) দেওয়া তহবিলের ওপর নির্ভরশীল। সে জন্যই তারা প্রাথমিকভাবে গ্রাহকদের ঋণ পাওয়ার শর্ত হিসেবে সদস্য হয়ে চাঁদা দিতে বা সঞ্চয়ে প্রভাবিত করে বটে।
সম্প্রতি প্রকাশিত ‘মাইক্রোফিনানস ব্যানানা স্কিনস ২০০৯’ শীর্ষক একটি জরিপে অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষাপটে ক্ষুদ্রঋণের ব্যবসায় ঝুঁকির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান এবং এমনকি উন্নত কিছু দেশের চেয়েও বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী সংস্থাগুলোর ক্ষুদ্রঋণ জন্য ঝুঁকির মাত্রা কম। তবে ওই জরিপে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে তিনটি প্রধান ঝুঁকি চিহ্নিত করা হয়েছে—প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাওয়া ও ম্যানেজমেন্ট অব ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) বা তথ্য ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা, ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়া এবং ব্যক্তি বা পরিবারকেন্দ্রিক পরিকল্পনা ও ধারাবাহিকতার অনুপস্থিতি।
উচ্চহারে ঋণ আদায় হওয়ার ফলে ব্যাংকের তুলনায় ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোর ঋণ বিতরণ কার্যক্রমকে ঝুঁকিমুক্ত বলে বিবেচনা করা হয়। তবে বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ঋণ আদায়ের হার আগের চেয়ে কমে এসেছে। সে জন্য মনে রাখতে হবে যে অর্থনৈতিক মন্দায় ঋণের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। কারণ, ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণকারীরা স্বভাবতই দুর্বলতম অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে থাকেন।
তবে বাজার দখলের লক্ষ্যে ঋণ প্রদানকারীদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা দেখা দিলে তাতে ঋণের মান কমে ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। দেশের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে মাল্টিপল বরোয়িং বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতাও এই খাতে ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। কারণ, গ্রাহকেরা এক প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধের জন্য আরেক প্রতিষ্ঠান থেকে নতুন করে ঋণ নিয়ে ঝুঁকি বাড়ান। ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে সাপ্তাহিক ভিত্তিতে কিস্তি পরিশোধের প্রবণতা থাকলেও গ্রহীতা যদি ঋণের টাকা ব্যবসায়িক কাজে না খাটিয়ে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক অন্য কাজে লাগান, তা একসময় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে।
রিপোর্টিংয়ের দুর্বলতার কারণে দেশে ক্ষুদ্রঋণের মান কমেছে। বড় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বাদ দিলে দেশের অধিকাংশ ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের রিপোর্টিংয়ে আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে না বলে অভিযোগ আছে। এ ছাড়া যেসব ঋণগ্রহীতাকে পরবর্তী সময়ে চিহ্নিত করা কঠিন হবে এবং যাঁরা অতীতে টাকা নিয়ে তা যথাযথভাবে পরিশোধ করেছেন কি না, রেকর্ড জানা নেই—এমন গ্রাহককে ঋণ দিয়ে সেটির তদারকি করাও কঠিন কাজ বৈকি। তবে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো ইদানীং জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যের ভিত্তিতে কার্যক্রম চালাতে চাইলেও পদ্ধতিগত দুর্বলতার কারণে সেটিও পূর্ণাঙ্গভাবে করা সম্ভব হচ্ছে না বলে শুনেছি।
সরকারি ডেটাবেইস বা উপাত্ত না থাকলে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোকে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ঋণগ্রহীতাদের সম্পর্কে প্রয়োজনীয় সামাজিক তথ্যাবলি রেকর্ডে রাখতে হবে। এভাবেই ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের একটি ডেটাব্যাংক বা তথ্যভান্ডার গড়ে উঠতে পারে।
দেশে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমের দ্বিতীয় প্রধান ঝুঁকিটা হলো, এর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়া। যেমন, কোনো কোনো ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা জনসেবামূলক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি বাণিজ্যিক কার্যক্রমেও জড়িত থাকায় তাদের সত্যিকারের উদ্দেশ্য নিয়ে এবং এমনকি কোনো কোনো ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার কর্তাব্যক্তির লাইফস্টাইলের কারণে স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে।
দেশে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে তৃতীয়, কিন্তু সবচেয়ে উদ্বেগজনক ঝুঁকি হলো, ব্যক্তি বা পরিবারকেন্দ্রিক সিদ্ধান্তে পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়নে ধারাবাহিকতার অনুপস্থিতি এবং ঐতিহাসিকভাবেই এই খাতে মেধাবীদের না আসা। যে কারণে বছরের পর বছর ধরে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে সেকেন্ড টায়ার বা পরবর্তী নেতাদের প্রক্রিয়ায় বড় ধরনের ঘাটতি লক্ষ করা গেছে।
আশার কথা হলো, বাংলাদেশে এরই মধ্যে মাইক্রো-ক্রেডিট রেগুলেটরি অ্যাক্ট, ২০০৬ আইন পাস ও একটি মাইক্রো-ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি বা নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়েছে। ফলে দেশের ক্ষুদ্রঋণ খাতে মানসম্পন্ন ও অভিন্ন ধরনের রিপোর্টিং, কার্যক্রম মূল্যায়ন-প্রক্রিয়া, সঠিক নীতি-নির্দেশনা, ক্ষুদ্রঋণ গ্রহণকারীদের নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় ডেটাব্যাংক বা তথ্যভান্ডার গঠন এবং এমএফআইগুলোর জন্য যথাযথ সমর্থন-সহযোগিতা ইত্যাদি ত্বরান্বিত হয়ে দেশের আর্থসামাজিক ব্যবস্থাকে অধিকতর গতিশীল করে তুলবে বলে আমরা আশা করি।
তবে যেভাবে একটি আন্তর্জাতিক ও কিছু জাতীয় গণমাধ্যম ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমে লিপ্ত বর্তমান বিশ্বের দুটি স্বনামখ্যাত প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার মতো প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে, তা মোটেও প্রশংসনীয় কাজ নয়। ডেনমার্কের বন্ধুটি সম্ভবত বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম নোয়াবেকির ওই নারীর কথা শোনেননি, যিনি বলেছিলেন যে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে যদি ৪০ ডলার না পেতেন, তাহলে তিনি হয়তো পতিতাবৃত্তির মতো পেশায় যোগ দিতে বাধ্য হতেন! যা-ই হোক, গ্রামের যেসব দরিদ্র মানুষ, বিশেষ করে, অসহায় নারীরা অন্য কোনো উৎস থেকে অর্থায়নের সুবিধা পাননি, তাঁরা ক্ষুদ্রঋণ পেয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলেন কি না, সেটি একদিন ইতিহাসই প্রমাণ করবে।
তবে ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমকে ভবিষ্যতে কার্যকরভাবে ধরে রাখতে হলে তাদের হিসাব-নিকাশ রক্ষণাবেক্ষণে আরও স্বচ্ছতা আনয়ন, দ্বিতীয় ধাপের ব্যবস্থাপনা দক্ষতা বৃদ্ধি এবং অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য তথ্যপ্রযুক্তিকে আরও সম্পৃক্ত করার বিকল্প নেই।
মামুন রশীদ: ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক। নিবন্ধে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব।
No comments