জালিস হাজির-পাকিস্তান পিপলস পার্টির পথে কাঁটা
আদালত অবমাননার দায়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানি সপ্তাহকাল আগে দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন। তবে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর অনিচ্ছা প্রকাশ করার মাধ্যমে বিচার বিভাগের প্রতি তাঁর দলের অশ্রদ্ধাবোধকে পরিষ্কার করে দিলেন।
পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) ক্ষমতারোহণের আগে থেকেই যেভাবে আদালতের রায়ের ব্যাপারে মানসিকতা পোষণ করে আসছে, তার পুনরাবৃত্তি ঘটছে এভাবেই। এই মানসিকতাকে তারা লড়াইয়ের মতো মনে করছে। তাদের এ অবস্থান অনাকাঙ্ক্ষিত। প্রচণ্ড জনমতের চাপে গিলানি শুরুতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা তাঁর নিজ দল পিপিপির বড় নেতাদের কাছে কখনোই সুখকর বলে বিবেচিত হয়নি। এটা ছিল সিনিয়র নেতাদের কাছে কাঁটাস্বরূপ।
সরকার তা প্রদর্শনের জন্য চার বছর ধরেই প্রস্তুতি নিয়ে আসছে। প্রধানমন্ত্রীর শাস্তি ঘোষণার পর অনুগত রাজনৈতিক নেতারা রাস্তা অবরোধ করেন, টায়ার পুড়িয়ে এবং সম্মানিত বিচারকদের বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দিয়ে তা-ই প্রমাণ করে দিলেন। পিপিপি আগেও আদালতবিরোধী বিভিন্ন আন্দোলন করেছে। তাদের এ কর্মকাণ্ডে বর্তমান বিচার বিভাগের নামে নানা কুৎসাও রটাতে দেখা গেছে। সিন্ধুতেও তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছিল। সেখানে আদালত ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করার চেষ্টা করেছেন। সেখানে আদালতের কাজে নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপের বিষয়টি যে অসাংবিধানিক, তা প্রমাণেরও চেষ্টা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা মুখে বলার আর কোনো মূল্য থাকে না।
জারদারির নেতৃত্বাধীন পিপিপি সরকার শুরু থেকেই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়কে গৌণ বলে গণ্য করার পরিকল্পনা করে আসছে। এ কারণেই রাজনীতিকে আইনের প্রতিপক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে তারা। অসাংবিধানিকভাবেই তাই তাদের শাসনকাজও পরিচালিত হয়ে আসছে। তারই ছোঁয়া লেগেছে আইনজীবীদের মধ্যে। জারদারি নিজে এবং তাঁর দলের বহু নেতাই আদালতের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করতে অনুপ্রাণিত করেছেন। রায়কে রাজনীতির আবরণে তিনি আচ্ছাদিত করেছেন। শুধু তাই নয়, প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রী জনসমাবেশেও আদালতকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছেন। এ প্রতিষ্ঠানকে বিতর্কিত করার অনেক চেষ্টাই তাঁরা চালিয়ে আসছেন।
এখন অ্যাটর্নি জেনারেল ঘোষণা দিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রীকে শাস্তি প্রদান সম্পূর্ণ বেআইনি হয়েছে। বলেছেন, এটা অগ্রহণযোগ্যও বটে। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার ব্যাপারে তাঁদের বক্তব্যও জাতিকে বিভ্রান্ত করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তাঁর থাকা না থাকার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন পার্লামেন্টের স্পিকার; যা কার্যকর করবে নির্বাচন কমিশন। আর এভাবেই তিনি দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা কার্যকর করতে যাচ্ছেন। এ প্রচেষ্টা তাঁর দলীয় নেতাদের অসাংবিধানিক আচরণ এবং দেশের সুপ্রিম কোর্টকে অবমাননা করে আসছে।
পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় নেতারা এসব করে আসছেন গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে। তাঁদের এই বেআইনি কাজগুলোকে চিরস্থায়ী করার অপচেষ্টা দেশে উচ্ছৃঙ্খলতাকেই উসকে দিচ্ছে।
শাস্তিপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যেই সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। সুপ্রিম কোর্টের অন্যান্য নির্দেশনার বিরোধিতা করেও দুর্নীতিকেই জায়েজ করার চেষ্টা করছেন তাঁরা। এখানেও তাঁরা আদালতকে স্পষ্টত অবমাননা করে চলেছেন, যা মন্ত্রীদেরও কাঠগড়ায় ওঠাতে যথেষ্ট। তাঁদের এসব কর্মকাণ্ড দেশের আদর্শকে দুর্নীতির মাধ্যমে কবরস্থ করার শক্ত পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য। তাঁরা সংবিধানকে একটি কাগজে রূপান্তরিত করেছেন। তাঁরা প্রমাণ করতে চাইছেন, জনগণ ইচ্ছা করলেই কিছু পরিবর্তন করতে পারে না কিংবা তাদের মতামতেরও কোনো মূল্য নেই। হালে মনে হচ্ছে, এজাজ হোসেন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার যে চেষ্টা করেছিলেন, তা এখন শুধু জনগণের মুখেই থেকে গেছে। পাকিস্তানে যেসব নারী-পুরুষ-যুবক ও বৃদ্ধ বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করেছিলেন, তাঁদের সেই আন্দোলনও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে চলেছে।
তবে যাঁরা নতুন পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখেছেন, তাঁরা শেষ হয়ে যাননি এখনো। জারদারি নেতৃত্বাধীন পিপিপিও যে সেটা ভুলে গেছে, তাও নয়। তবে পিপিপির শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছে, তাঁর বশংবদ নেতারা সেসব কাটিয়ে তুলতে সক্ষম হবেন। তিনি মনে করছেন, সিন্ধুর মানুষের জন্য তিনি যে মায়াকান্না জুড়েছেন, তাতেই তিনি পার পেয়ে যাবেন। মূল্যস্ফীতি, সন্ত্রাস, লোডশেডিংয়ের মতো আরো অনেক ব্যর্থতা কিন্তু তাঁকে জনবিচ্ছিন্ন করে দিতে যথেষ্ট। নতুন পাকিস্তানের স্বপ্ন কিন্তু এখনো শেষ হয়ে যায়নি।
লেখক : ফ্রিল্যান্স কলাম লেখক।
পাকিস্তানে প্রকাশিত দ্য নেশন থেকে
ভাষান্তর : মোস্তফা হোসেইন
No comments