চারদিক-একটি পাঠাগার এবং... by আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ

নদীটি একটু বাঁক ফিরে গ্রামটির গা ছুঁয়ে গেছে। এর তীরে নিবিড় ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে আছে একটি বটগাছ। অদূরে আরও একটি পাইকড়গাছ। নদীটির নাম বড়াল। পদ্মার শাখা। গ্রামটির নাম বনকিশোর। এই গ্রামে এসে বড়ালের ধারে দাঁড়ালে উদাস হয়ে যায় মন।


রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার ভায়ালক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের নিভৃত এই গ্রামের প্রায় সব লোকই জানে তাদের রক্তের গ্রুপ। প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা। সন্ধ্যায় সাংসারিক কাজ সেরে প্রায় সব বাড়ির গৃহবধূরা বই নিয়ে বসেন। গ্রামটিকে এভাবে বদলে দেওয়ার মূলে রয়েছে একটি পাঠাগার। বড়ালের ধারে বটের ছায়ায় আধাপাকা ঘরে চলছে এই পাঠাগার। অনিচ্ছা নিয়েও এর ভেতরে ঢুকলে আরও একটু বসতে ইচ্ছে করে। মন ভালো হয়ে যায়। গ্রামের লোকেরা জানায়, পাঠাগারটি তাদের চোখ খুলে দিয়েছে।
একসময় বনকিশোর গ্রামের বেশির ভাগ মানুষের বাড়িতে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা ছিল না। যাদের ছিল, তারাও এই পায়খানা ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিল না, যেখানে-সেখানে মলমূত্র ত্যাগ করত। গ্রামে ঢুকতে হলে নাকে রুমাল চেপে যেতে হতো। পেটের পীড়া লেগেই থাকত গ্রামের বাসিন্দাদের। গ্রামের কলেজপড়ুয়া ১১ জন যুবক একদিন বসে সিদ্ধান্ত নেন, গ্রামের এই চিত্র বদলে দিতে না পারলে এসব রোগব্যাধি থেকে তাঁদের মুক্তি নেই। তাঁরা মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করেন কিন্তু কেউ বুঝতে চায় না। তাঁদের কথায় কান দেয় না। এতে তাঁরা হতোদ্যম হয়ে পড়েননি।
এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য তাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজেদের হাতখরচের পয়সা বাঁচিয়ে একটা তহবিল তৈরি করেন। গ্রামের একটি হাট ইজারা নিয়ে তাঁরা তাঁদের এই তহবিলকে বড় করেন। তারপর নিজেরাই স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানার জন্য রিং-স্লাব তৈরি করা শুরু করেন। একেবারেই সহায়-সম্বলহীন মানুষের বাড়িতে তাঁরা একটি স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা বসিয়ে দেন। ব্যবহার করার জন্য অনুরোধ করেন। এভাবে একেকটি করে বাড়ি তাঁরা তাঁদের কর্মপরিকল্পনার আওতায় নিয়ে আসেন। একপর্যায়ে দুস্থ পরিবারগুলোতে তাঁদের কাজ শেষ হয়ে যায়। এরপর তাঁরা সচ্ছল পরিবারগুলোতে গিয়ে নিজ খরচে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা তৈরি করে নেওয়ার জন্য বোঝাতে থাকেন। সরকারিভাবে শতভাগ বাড়িতে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা তৈরির আন্দোলন শুরুর আগেই এই গ্রামের যুবকেরা শতভাগ বাড়িতে স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা তৈরি করে ফেলেন। এর পরও সমস্যা ছিল। পায়খানা থাকলেও সবাই তা ব্যবহার করত না। মানুষের এই অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য তাঁরা রাত-দিন পরিশ্রম করেন। একপর্যায়ে তাঁরা স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে গ্রামে নিয়ে যান। তিনি যুবকদের পক্ষ থেকে গ্রামবাসীকে বোঝান। একদিন গ্রামের পুরোনো চেহারাটা পাল্টে যায়। কিন্তু সমস্যা একটি নয়, মাদকাসক্ত হয়ে এই গ্রামের এক ব্যক্তি মারা গেলেন। তাঁর তিন শিশুকন্যা ইতি, বীথি ও পাখির কান্নায় বনকিশোর গ্রামের ১১ যুবক ভীষণভাবে বিচলিত বোধ করেন। তাঁরা গ্রামটিকে মাদকমুক্ত করার আন্দোলন শুরু করেন। এবার তাঁদের আন্দোলনে শরিক হয় অনেক মানুষ। তাঁরা উদ্যোগ নিয়ে পাশের গ্রামের একটি দেশি মদের ভাটি উচ্ছেদ করেন এবং গ্রামে প্রকাশ্যে মাদক সেবন নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। আন্দোলনটি পুরোপুরি সফল হয়। এখন এই গ্রামের আর কেউ প্রকাশ্যে মাদক সেবন করে না। তাঁরা স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং রাস্তার ধারে বৃক্ষ রোপণ করেন। বিকেলে শিক্ষার্থী, শিক্ষক, কৃষক থেকে শুরু করে সবাই এসে বসেন তাঁদের পাঠাগারে। সপ্তাহের একদিন ১১ জনের একজন বই নিয়ে যান বাড়ি বাড়ি। পড়া বই ফেরত নিয়ে আবার নতুন বই দিয়ে আসেন।
গত ৪ ডিসেম্বর পাঠাগারে গিয়ে এই বাস্তব চিত্রটা দেখা গেল। পাঠাগারের টেবিলে বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন গ্রামের কৃষক আকবর আলী। বললেন, ‘আমরা প্রথমে না বুঝে এদের কার্যক্রমের বিরোধিতা করেছি। এখন মনে হয়, ওরা আসলে গ্রামের মানুষের চোখ খুলে দিচ্ছে। কেউ ওদের ওপর রাগ করে থাকতে পারছে না। ওদের পাঠাগারে এলেই মন ভালো হয়ে যায়।’ সেখানে পাওয়া গেল রাজশাহী চিনিকলের স্থানীয় একজন কর্মকর্তা আফজাল হোসেন, স্কুলশিক্ষক অবিনাশ কুমার সাহা, কাঠমিস্ত্রি আবদুস সালাম, পাশের চক শিমুলিয়া গ্রামের কৃষক আজাহারুল হক, গৃহবধূ হিরা বেগমসহ আরও অনেককেই। সবচেয়ে বেশি অবাক হতে হলো ৭০ বছর বয়সী আসকান আলীকে দেখে। না, তাঁর বয়সের জন্য নয়, অবাক হতে হলো তাঁর কথা শুনে। তিনি লেখাপড়া জানেন না। পত্রিকার পাতা উল্টে শুধু ছবি দেখেন। ছবি দেখতে কেন আসেন, জানতে চাইলে আসকান আলী বলেন, ‘১০ বছর থাইকি আমি দুই চোকে কিচু দেকতে পাইনি। গরিব মানুষ, ট্যাকা-পয়সা নাই। ডাক্তার দেকাতে পারিনি। ভাবিচুনু, মরার আগে আর দুনিয়া দেকতে পাইরব লে। এই পাঠাগারের ছালপাল আমাক দুনিয়া দেকাইচে। আমি একুন দেকতে পাই।’ জানা গেল, এই পাঠাগারের উদ্যোগে চক্ষুশিবির করে এলাকার শতাধিক মানুষের চোখের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হয়েছে। তাঁদেরই উদ্যোগে গ্রামের মানুষ জেনে গেছে নিজ নিজ রক্তের গ্রুপ এবং তারা এও জেনে গেছে, কেন নিজের রক্তের গ্রুপটি জেনে রাখা দরকার। পাঠাগারের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে, এই গ্রামের কোনো মানুষ রক্তের অভাবে মারা যাবে না। যেকোনো গ্রুপের রক্তের জন্য তাঁরা সব সময় প্রস্তুত রয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.