চলচ্চিত্র-‘মেহেরজান’ যা বলতে চেয়েছে by রুবাইয়াত হোসেন
মেহেরজান মুক্তি পাওয়ার পর ছবিটি নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় নানা রকম তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়েছে। রোবায়েত ফেরদৌস, মাহমুদুজ্জামান বাবু, কাবেরী গায়েন ও ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীও তাঁদের যৌথ রচনায় ছবিটির বিষয়বস্তু নিয়ে কতগুলো প্রসঙ্গ উত্থাপন করেছেন। মেহেরজান-এর পরিচালক হিসেবে সেসব প্রসঙ্গ ধরে কিছু বলা জরুরি।
.শিল্প ও ইতিহাসের মধ্যকার যোগসূত্র সব সময় যুক্তিনির্ভর নয়, বরং প্রায়ই তা আবেগনির্ভর। ইতিহাসে ‘একমাত্র’ সত্যের অনুসন্ধান যে ফলপ্রসূ কোনো চর্চা নয়, অনেক দিন ধরে ইতিহাসতাত্ত্বিকেরা সে কথা বলছেন। ইতিহাসের বয়ান সব সময় মতৈক্য অনুসরণ করে এগোয় না। একে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার অবকাশ থাকে এবং সব দৃষ্টিভঙ্গিই ইতিহাসের ভিন্ন ভিন্ন বয়ান প্রকাশের সুযোগ দেয়। ১৯৭১ নিঃসন্দেহে আমাদের জাতীয় চেতনার সর্বোচ্চ শিখর। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে এই ক্ষণটিতেই আমাদের উন্মেষ। আমাদের শিল্প, সাহিত্য, চলচ্চিত্র, নাটক ও সংগীতে মুক্তিযুদ্ধ তাই একটি পৌনঃপুনিক পরম্পরা। মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপ্তি এত ব্যাপক যে একটি চলচ্চিত্রে তার সামগ্রিকতা ধারণ করা অসম্ভব। কোনো সাহিত্য বা চলচ্চিত্রকর্ম ইতিহাসকে বড়জোর একটি বিশেষ কোণ থেকে আলোকপাত করতে সক্ষম। সেখানে তাই সত্যের ‘একমাত্র’ ও পুঙ্খানুপুঙ্খ উপস্থিতি খোঁজা খুব যৌক্তিক নয়।
মেহেরজান একাত্তরের নারীপ্রধান একটি আখ্যান। এই আখ্যানে রয়েছে সেই নারীদের গল্প, যাঁরা নিজেদের মতো করে যুদ্ধ করেছেন—কখনো হয়তো বন্দুক ছাড়াই; অহিংসার পথে রক্ষা করেছেন আত্মসম্মান। তাঁদের পাশাপাশি রয়েছে নানাজানের একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র, যিনি বাঙালির সংগ্রামকে বরাবর সম্মান করেন, সবশেষে জীবন দেন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে।
ঐতিহাসিক সত্যও কখনো কখনো প্রস্তরীভূত হয়ে পড়ে। খুঁড়ে তুললে আমাদের মধ্যে অস্বস্তি জাগায়। এই মর্মে পাঠকের কাছে দু-একটি দৃষ্টান্ত পেশ করি।
নীলিমা ইব্রাহিম তাঁর আমি বীরাঙ্গনা বলছির ভূমিকায় ৩০-৪০ জন মেয়ের উল্লেখ করেছেন, যাঁরা আত্মসমর্পণকারী বা বন্দী পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে ভারতে চলে গিয়েছিলেন (আমি বীরাঙ্গনা বলছি, নীলিমা ইব্রাহিম, জাগৃতি, ১৯৯৮)। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধাক্রান্ত মেয়েদের সম্মান দিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি ও বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব নিজে উপস্থিত থেকে অনেকের বিয়ে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর বিশেষ উদ্যোগে ও অর্থসহায়তায় সুফিয়া কামাল, বদরুন্নেসা আহমেদ, মালেকা খান প্রমুখ পুনর্বাসনকেন্দ্রটি পরিচালনা করতেন। তবু তাঁদের এই পুনর্বাসন-প্রক্রিয়া সহজসাধ্য ছিল না। একাত্তর-পরবর্তী সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এসব পুনর্বাসিত নারীর প্রতি স্পষ্টতই অনুদার ছিল। সুসান ব্রাউনমিলার উল্লেখ করেছেন, যেসব পুরুষ এঁদের বিয়ে করতেন, তাঁরা বিনিময়ে যৌতুক নিতেন, যার পরিধি ছিল ‘নতুন মডেলের লাল রঙের জাপানি গাড়ি থেকে শুরু করে অপ্রকাশিত কবিতার বই প্রকাশ’ পর্যন্ত (ব্রাউনমিলার, অ্যাগেইনস্ট আওয়ার উইল)।
১৯৭১ সালের ধর্ষণের শিকার নারীদের ঘটনাই সম্ভবত আমাদের ইতিহাসের অন্ধকারতম অধ্যায় ও সবচেয়ে হূদয়বিদারক ঘটনা। জাতীয়ভাবে আমরা এ ঘটনাকে অলংকৃত করেছি ‘৩০ লাখ শহীদ আর দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা’ বলে। ইতিহাসে বীরাঙ্গনাদের অবহেলিত অবস্থান চূড়ান্তে পৌঁছায় যখন ২০০৫ সালের মাধ্যমিক ইতিহাস বই বাংলাদেশ ও প্রাচীন বিশ্ব ইতিহাস-এ বীরাঙ্গনাদের কোনো উল্লেখই আর রাখা হয় না।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের মৌখিক ইতিহাস প্রকল্প শুরু হয় ১৯৯৬ সালে। ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালের মধ্যে পরিচালিত এই প্রকল্পে দেশের ১১টি অঞ্চলের প্রায় আড়াই হাজার মানুষের জবানি ধারণ করা হয়—সংস্কৃতিকর্মী, শিক্ষক, বিত্তবান, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক থেকে সবার—বাদ যায় শুধু মেয়েরা। অথচ বাংলাদেশের গ্রামের আর্থসামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে মেয়েদের যৌন নিপীড়নের অভিজ্ঞতা জানার জন্য তাঁদের একান্তে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়া জরুরি ছিল।
তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখন ও মুদ্রণ প্রকল্পের অধীনে ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৭ সালের মধ্যে সংগৃহীত ও প্রকাশিত হয় আট খণ্ডে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও দলিলপত্র। এটিই মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র আনুষ্ঠানিক তথ্যকোষ, যাতে এই নারীদের বিবৃতি আছে। মোট ২২৭ জনের মৌখিক জবানবন্দির মধ্যে ২৩ জন নারী। তাঁদের মাত্র ১১ জন যৌন নিপীড়নের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেছেন। এসব দলিলে একাত্তরে মেয়েদের ওপর ধর্ষণের নৃশংসতার কিছুটা আভাস পাই, কিন্তু তাঁদের প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। সেনাশিবিরে সংঘটিত যৌন দাসত্বের পুরো চিত্রটিও এতে অনুপস্থিত। ফলে ১৯৭১ সালের নিপীড়িত নারীদের নির্ভরযোগ্য ইতিহাস লিখতে গিয়ে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় তাঁদের সংখ্যার ব্যাপক তারতম্য। সুসান ব্রাউনমিলারের অ্যাগেইনস্ট আওয়ার উইল: মেন, উইমেন অ্যান্ড রেপ, সিরাজুল ইসলাম ও মিয়া শাজাহান সম্পাদিত বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ ও অন্যান্য দলিলপত্রের ভিত্তিতে ধর্ষিত নারীর সংখ্যা ৪০ হাজার থেকে আড়াই লাখ, গর্ভপাতের সংখ্যা ২৩ হাজার থেকে ৫০ হাজার এবং যুদ্ধশিশুর সংখ্যা ৪০০ থেকে ১০ হাজারের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যানে আসতে না পারায় বিষয়টি অমীমাংসিতই থেকে যায়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত নারীর একাত্তর বইয়ে দেখানো হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা দুর্দশায় ভুগেছেন, এখনো তাঁরা দুর্দশায় ভুগছেন। কুষ্টিয়ায় ধর্ষিত হওয়া যেসব নারীকে পরবর্তী সময়ে গণ-আদালতে নিয়ে আসা হয়, তাঁরা সামাজিকভাবে অবহেলিত হয়ে সার্বক্ষণিক আতঙ্কের মধ্যে থাকতেন। গণ-আদালতে হাজির হওয়ার পর এবং পত্রপত্রিকায় ছবি বেরোনোর পর থেকে তাঁরা সামাজিকভাবে আরও বেশি হেয়প্রতিপন্ন হতে থাকেন, (নারীর একাত্তর, পৃ. ১৭০)। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী বলেছেন, এমনকি একজন বিহারি ড্রাইভারও কীভাবে তাঁর অবস্থার সুযোগ নিয়েছিলেন। সুতরাং ১৯৭১ সালে কেবল পাকিস্তানি সৈন্যই নয়, বিহারি, আগাখানি, বাঙালি রাজাকার সবাই কমবেশি অবস্থার সুযোগ নিয়েছিল। আবার এও সত্য, পাকিস্তানি বাহিনীর মেজর আলতাফ করিম প্রিয়ভাষিণীর জীবন বাঁচান এবং সেনাশিবিরের ক্রমাগত নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করেন (নারীর একাত্তর, পৃ. ১৪৫)।
যুদ্ধকালে ধর্ষণকে নারীবাদীরা ‘ওয়ারস ডার্টি সিক্রেট’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। বিষয়টি নিয়ে আমরা খোলামেলা কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করি। সে কারণে আজ অবধি আমরা একপাশে সরিয়ে রেখেছি ১৯৭১-এ ধর্ষিত নারীদের আখ্যান। মেহেরজান-এর নীলা চরিত্রটি এই সামাজিক কালিমার বিরুদ্ধে একটি স্পষ্ট প্রতিবাদ। তিনি এমন একজন সাহসী নারী, যিনি ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মগ্লানিতে না ভুগে বরং সামাজিক কলঙ্কভীতিকে চ্যালেঞ্জ করেন। এই সিনেমায় নীলা আগাগোড়াই যুদ্ধংদেহী ও প্রতিবাদী হিসেবে উপস্থাপিত। যতক্ষণ না তিনি পেয়ারাবাগান থেকে আসা নারী মুক্তিযোদ্ধা জবার অনুপ্রেরণায় সম্মুখযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁকে আমরা অস্থির ও উদ্ভ্রান্ত দেখি। নীলা যখন যুদ্ধে যান, তাঁর গর্ভে তখন তিন মাসের যুদ্ধশিশু। নীলা একটি কাল্পনিক চরিত্র, কিন্তু তাঁর মধ্য দিয়ে যে তেজদীপ্ত সাহসিকতা প্রকাশ পেয়েছে, তা পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে যেমন, তেমনই আমাদের সমাজের কপটতার বিরুদ্ধেও একটি প্রতিবাদ।
৩.
নারীর একাত্তর-এ বাঙালি মেয়ের পাকিস্তানি সৈন্য কর্তৃক উদ্ধার পাওয়ার উল্লেখ আছে। ১৯৭১ সালে একদল পাকিস্তানি বাংলাদেশের প্রতি নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদনামায় যাঁরা স্বাক্ষর করেছিলেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন পাকিস্তানের মানবতাবাদী কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ। বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলায় কারাবন্দী হয়েছিলেন পাকিস্তানের মানবাধিকারকর্মী আসমা জাহাঙ্গীরের বাবা। এমন কিছু মানুষ সব সময়ই থাকেন, যাঁরা রাজনৈতিক ভেদরেখার ঊর্ধ্বে উঠে যান, থাকেন শান্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে। মেহেরজান-এ মানুষের তৈরি রাজনৈতিক সীমানা পেরিয়ে একটি সর্বজনীন মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ অহিংস শান্তিবাদের শক্তিকে উপজীব্য করা হয়েছে।
মেহেরজানসহ এ ছবির সব চরিত্রই যে কল্পিত, সে কথা ছবির শুরুতেই বলা হয়েছে। বালুচ সৈন্যের চরিত্রটিও একইভাবে সম্পূর্ণ কাল্পনিক। চরিত্রগুলো এসেছে কাহিনির প্রয়োজনে। এ ছবির মূল মর্ম একটি সর্বজনীন মানবতাবোধ ও দেশ-কাল-পাত্রের ঊর্ধ্বে চিরন্তন প্রেমের জয়গান—যা মানুষকে নিজের গণ্ডি পেরিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে। এর মধ্যে কোনো গোপন অভিসন্ধি বা ‘এজেন্ডা’ খোঁজা নিতান্তই নিষ্ফল ও অতিকল্পনামাত্র।
৪.
কোরীয় তাত্ত্বিক নোয়েলিন হেইজের তাঁর এক লেখায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যৌন দাসত্বের শিকার কোরিয়ার পুনর্বাসিত নারীদের ন্যায়বিচারের লক্ষ্যে একটি নান্দনিক সমাধানের পথ প্রস্তাব করেছিলেন। তাঁর প্রস্তাব ছিল, নারীবাদী তত্ত্বের গতানুগতিক ধারার বাইরে ‘অধিক শক্তিধর কিছুর সন্ধান করা, যা জীবনদায়ী, স্বতঃস্ফূর্ত ও পরিবর্তনশীল’। তাই যুদ্ধংদেহী পৃথিবীতে ‘অপর’কে ভালোবাসার গল্প শোনাতেই মেহেরজান ছবির জন্ম।
এই ছবিতে মুক্তিযুদ্ধকে ছোট করে দেখানোর কোনো অবকাশই নেই। কারণ বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের বাইরে আমার নিজেরও কোনো আত্মপরিচয় নেই। নিজের দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতিপাদ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জাতীয় পরিচয়ের শেকড় অনুসন্ধান। বস্তুত মেহেরজান-এর মতো ছবির মাধ্যমে একাত্তরের ধর্ষিত নারী ও যুদ্ধশিশুর প্রসঙ্গটিকে ওয়ার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের গোচরে এনে ১৯৭১-এ নির্বিচারে নির্যাতিত নারীদের বিচার দাবি করা সম্ভব—এ রকম একটি ভাবনা থেকেই মেহেরজানকে আমরা একটি আন্তর্জাতিক আঙ্গিকে নির্মাণের প্রয়াস পেয়েছি এবং একটি বৈশ্বিক মানবতাবোধের ভাষাভঙ্গি ব্যবহার করেছি। প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে দেখলে দর্শকেরা দেখবেন, এ ছবিতে যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির কথা থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথাকে হেয় করার সামান্যতম কোনো উপাদান নেই।
মেহেরজান-এ যুদ্ধবিরোধী স্বদলত্যাগী বালুচ সৈন্যের সঙ্গে বাঙালি মেয়ের যে প্রেম দেখানো হয়েছে, তা একেবারেই নান্দনিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপিত। যুদ্ধের সময় একজন বাঙালি মেয়ের পাকিস্তানি সেনার প্রেমে পড়ার গল্প আপাতদৃষ্টিতে অস্বাভাবিক। কিন্তু শত্রুরেখার এপারে-ওপারে নারী-পুরুষের প্রেম বাংলা ভাষায় ও সারা বিশ্বের কথাসাহিত্য, কবিতা, চলচ্চিত্র বা নাটকের চিরন্তন বিষয়।
নানাজানের চরিত্রটিও উন্মূল নয়। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পরে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস ঘরে বাইরে স্পষ্টত সে সময়ের প্রধান রাজনৈতিক ডিসকোর্সের বাইরে থেকে রচিত। সেই উপন্যাসের জমিদার চরিত্র নিখিলেশ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বাঙালির সহিংসতাকে প্রতিহত করেন, কিন্তু মাতৃভূমির জন্য তাঁর মহান দেশাত্মবোধ গভীরতম তন্ত্রীতে পৌঁছায়। নিজের গ্রামকে রক্ষা করতে গিয়ে নিখিলেশ আত্মাহুতি দেন। মেহেরজান-এর নানাজান চরিত্রের প্রেরণা সেখান থেকেই। নানাজান প্রাথমিকভাবে সাতচল্লিশের দেশভাগের যন্ত্রণায় কাতর এবং আরও একটি বিচ্ছেদের সামনে সংশয়ী, কিন্তু গভীর দেশপ্রেম তাঁর মন আচ্ছন্ন করে থাকে। নিজের গ্রাম ও জনগণকে রক্ষা করতেও বদ্ধপরিকর। নানাজান মেহেরজান-এ ক্রমাগত বাঙালির সংগ্রাম ও বঞ্চনার কথা বলেন, উল্লেখ করেন যে ১৯৪০-এর লাহোর প্রস্তাবে বাঙালিদের কোনো কথা ছিল না, তিনি জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বে আস্থা রাখেন না এবং পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্যে সংশয়হীন। মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি আশ্রয় দেন। জয় বাংলার মুক্তিযোদ্ধার হাতে তুলে দেন নিজের আদরের মেয়ে সালমাকে। সবশেষে শান্তি কমিটিতে যোগ না দেওয়ার পরিণতিতে রাজাকারদের ষড়যন্ত্রে নিহত হন।
এই ছবির নানাজানও কল্পিত চরিত্র। তবু ইতিহাসে তাঁদের মতো মানুষ বিস্মৃত হলেও বিরল নন। উনিশ শতকে বাঙালি নবজাগরণের জোয়ারের সময় রাজনৈতিকভাবে বিচক্ষণ, উচ্চশিক্ষিত ও উদারপন্থী একটি ক্ষুদ্র মুসলমান জনগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে। সেই প্রাজ্ঞ ও দেশপ্রেমিক বাঙালি মুসলমানের এক কাল্পনিক প্রতিভূ আমাদের নানাজান—যাঁরা খেতে গামছা বিছিয়ে নামাজ পড়া এই জনপদের কৃষক ও সাধারণ মানুষের কথা ভাবতেন; যাঁরা পরম আধ্যাত্মিকতায় সমর্পিত ছিলেন, কিন্তু মানুষের মুক্তির ও অসাম্প্রদায়িক সংগ্রামে পিছপা ছিলেন না।
জয়া বচ্চন অভিনীত মেহের ৩৮ বছর ধরে এই শহরে নিভৃতে বাস করেন, কারণ পরিবার ও সমাজ তাঁকে নিভৃতচারী হতে বাধ্য করেছে। এই ছবির শুরুতে মেহের যখন নামাজ পড়ছেন, তখন চারপাশে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান বিভিন্ন ধর্মের প্রতীকী উপকরণ তাঁর অসাম্প্রদায়িক মানসের পরিচয় দেয়। আধ্যাত্মিকতা ও অসাম্প্রদায়িকতা তাঁর মানসে বিরোধী নয়। একজন বাঙালি মুসলমান হিসেবে তাঁর আত্মপরিচয়ের এই অনুসন্ধান কোনো অপরাধের বিষয় হতে পারে না। এটি আমাদের ইতিহাস অনুসন্ধানের একটি অমীমাংসিত ধারাবাহিকতারই অংশ। এ নতুন কোনো অবতারণাও নয়। সুপণ্ডিত আহমদ ছফা সত্তরের দশকেই এই আরজি পেশ করেছিলেন।
আমরা মনে করি, মেহেরজান ছবির একাধিক ব্যাখ্যার সুযোগ রয়েছে। দর্শকদের আমরা সে বিতর্কে আহ্বানও জানাই।
রুবাইয়াত হোসেন: সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র মেহেরজানের পরিচালক।
মেহেরজান একাত্তরের নারীপ্রধান একটি আখ্যান। এই আখ্যানে রয়েছে সেই নারীদের গল্প, যাঁরা নিজেদের মতো করে যুদ্ধ করেছেন—কখনো হয়তো বন্দুক ছাড়াই; অহিংসার পথে রক্ষা করেছেন আত্মসম্মান। তাঁদের পাশাপাশি রয়েছে নানাজানের একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র, যিনি বাঙালির সংগ্রামকে বরাবর সম্মান করেন, সবশেষে জীবন দেন পাকিস্তানি সেনাদের হাতে।
ঐতিহাসিক সত্যও কখনো কখনো প্রস্তরীভূত হয়ে পড়ে। খুঁড়ে তুললে আমাদের মধ্যে অস্বস্তি জাগায়। এই মর্মে পাঠকের কাছে দু-একটি দৃষ্টান্ত পেশ করি।
নীলিমা ইব্রাহিম তাঁর আমি বীরাঙ্গনা বলছির ভূমিকায় ৩০-৪০ জন মেয়ের উল্লেখ করেছেন, যাঁরা আত্মসমর্পণকারী বা বন্দী পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে ভারতে চলে গিয়েছিলেন (আমি বীরাঙ্গনা বলছি, নীলিমা ইব্রাহিম, জাগৃতি, ১৯৯৮)। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধাক্রান্ত মেয়েদের সম্মান দিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। তিনি ও বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব নিজে উপস্থিত থেকে অনেকের বিয়ে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর বিশেষ উদ্যোগে ও অর্থসহায়তায় সুফিয়া কামাল, বদরুন্নেসা আহমেদ, মালেকা খান প্রমুখ পুনর্বাসনকেন্দ্রটি পরিচালনা করতেন। তবু তাঁদের এই পুনর্বাসন-প্রক্রিয়া সহজসাধ্য ছিল না। একাত্তর-পরবর্তী সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এসব পুনর্বাসিত নারীর প্রতি স্পষ্টতই অনুদার ছিল। সুসান ব্রাউনমিলার উল্লেখ করেছেন, যেসব পুরুষ এঁদের বিয়ে করতেন, তাঁরা বিনিময়ে যৌতুক নিতেন, যার পরিধি ছিল ‘নতুন মডেলের লাল রঙের জাপানি গাড়ি থেকে শুরু করে অপ্রকাশিত কবিতার বই প্রকাশ’ পর্যন্ত (ব্রাউনমিলার, অ্যাগেইনস্ট আওয়ার উইল)।
১৯৭১ সালের ধর্ষণের শিকার নারীদের ঘটনাই সম্ভবত আমাদের ইতিহাসের অন্ধকারতম অধ্যায় ও সবচেয়ে হূদয়বিদারক ঘটনা। জাতীয়ভাবে আমরা এ ঘটনাকে অলংকৃত করেছি ‘৩০ লাখ শহীদ আর দুই লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা’ বলে। ইতিহাসে বীরাঙ্গনাদের অবহেলিত অবস্থান চূড়ান্তে পৌঁছায় যখন ২০০৫ সালের মাধ্যমিক ইতিহাস বই বাংলাদেশ ও প্রাচীন বিশ্ব ইতিহাস-এ বীরাঙ্গনাদের কোনো উল্লেখই আর রাখা হয় না।
মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা কেন্দ্রের মৌখিক ইতিহাস প্রকল্প শুরু হয় ১৯৯৬ সালে। ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালের মধ্যে পরিচালিত এই প্রকল্পে দেশের ১১টি অঞ্চলের প্রায় আড়াই হাজার মানুষের জবানি ধারণ করা হয়—সংস্কৃতিকর্মী, শিক্ষক, বিত্তবান, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক থেকে সবার—বাদ যায় শুধু মেয়েরা। অথচ বাংলাদেশের গ্রামের আর্থসামাজিক ও ধর্মীয় অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে মেয়েদের যৌন নিপীড়নের অভিজ্ঞতা জানার জন্য তাঁদের একান্তে কথা বলার সুযোগ করে দেওয়া জরুরি ছিল।
তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লিখন ও মুদ্রণ প্রকল্পের অধীনে ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৭ সালের মধ্যে সংগৃহীত ও প্রকাশিত হয় আট খণ্ডে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও দলিলপত্র। এটিই মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র আনুষ্ঠানিক তথ্যকোষ, যাতে এই নারীদের বিবৃতি আছে। মোট ২২৭ জনের মৌখিক জবানবন্দির মধ্যে ২৩ জন নারী। তাঁদের মাত্র ১১ জন যৌন নিপীড়নের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেছেন। এসব দলিলে একাত্তরে মেয়েদের ওপর ধর্ষণের নৃশংসতার কিছুটা আভাস পাই, কিন্তু তাঁদের প্রকৃত সংখ্যা সম্পর্কে কোনো ধারণা পাওয়া যায় না। সেনাশিবিরে সংঘটিত যৌন দাসত্বের পুরো চিত্রটিও এতে অনুপস্থিত। ফলে ১৯৭১ সালের নিপীড়িত নারীদের নির্ভরযোগ্য ইতিহাস লিখতে গিয়ে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় তাঁদের সংখ্যার ব্যাপক তারতম্য। সুসান ব্রাউনমিলারের অ্যাগেইনস্ট আওয়ার উইল: মেন, উইমেন অ্যান্ড রেপ, সিরাজুল ইসলাম ও মিয়া শাজাহান সম্পাদিত বাংলাপিডিয়া: বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ ও অন্যান্য দলিলপত্রের ভিত্তিতে ধর্ষিত নারীর সংখ্যা ৪০ হাজার থেকে আড়াই লাখ, গর্ভপাতের সংখ্যা ২৩ হাজার থেকে ৫০ হাজার এবং যুদ্ধশিশুর সংখ্যা ৪০০ থেকে ১০ হাজারের কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যানে আসতে না পারায় বিষয়টি অমীমাংসিতই থেকে যায়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত নারীর একাত্তর বইয়ে দেখানো হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা দুর্দশায় ভুগেছেন, এখনো তাঁরা দুর্দশায় ভুগছেন। কুষ্টিয়ায় ধর্ষিত হওয়া যেসব নারীকে পরবর্তী সময়ে গণ-আদালতে নিয়ে আসা হয়, তাঁরা সামাজিকভাবে অবহেলিত হয়ে সার্বক্ষণিক আতঙ্কের মধ্যে থাকতেন। গণ-আদালতে হাজির হওয়ার পর এবং পত্রপত্রিকায় ছবি বেরোনোর পর থেকে তাঁরা সামাজিকভাবে আরও বেশি হেয়প্রতিপন্ন হতে থাকেন, (নারীর একাত্তর, পৃ. ১৭০)। ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী বলেছেন, এমনকি একজন বিহারি ড্রাইভারও কীভাবে তাঁর অবস্থার সুযোগ নিয়েছিলেন। সুতরাং ১৯৭১ সালে কেবল পাকিস্তানি সৈন্যই নয়, বিহারি, আগাখানি, বাঙালি রাজাকার সবাই কমবেশি অবস্থার সুযোগ নিয়েছিল। আবার এও সত্য, পাকিস্তানি বাহিনীর মেজর আলতাফ করিম প্রিয়ভাষিণীর জীবন বাঁচান এবং সেনাশিবিরের ক্রমাগত নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করেন (নারীর একাত্তর, পৃ. ১৪৫)।
যুদ্ধকালে ধর্ষণকে নারীবাদীরা ‘ওয়ারস ডার্টি সিক্রেট’ হিসেবে চিহ্নিত করেন। বিষয়টি নিয়ে আমরা খোলামেলা কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করি। সে কারণে আজ অবধি আমরা একপাশে সরিয়ে রেখেছি ১৯৭১-এ ধর্ষিত নারীদের আখ্যান। মেহেরজান-এর নীলা চরিত্রটি এই সামাজিক কালিমার বিরুদ্ধে একটি স্পষ্ট প্রতিবাদ। তিনি এমন একজন সাহসী নারী, যিনি ধর্ষণের শিকার হয়ে আত্মগ্লানিতে না ভুগে বরং সামাজিক কলঙ্কভীতিকে চ্যালেঞ্জ করেন। এই সিনেমায় নীলা আগাগোড়াই যুদ্ধংদেহী ও প্রতিবাদী হিসেবে উপস্থাপিত। যতক্ষণ না তিনি পেয়ারাবাগান থেকে আসা নারী মুক্তিযোদ্ধা জবার অনুপ্রেরণায় সম্মুখযুদ্ধে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁকে আমরা অস্থির ও উদ্ভ্রান্ত দেখি। নীলা যখন যুদ্ধে যান, তাঁর গর্ভে তখন তিন মাসের যুদ্ধশিশু। নীলা একটি কাল্পনিক চরিত্র, কিন্তু তাঁর মধ্য দিয়ে যে তেজদীপ্ত সাহসিকতা প্রকাশ পেয়েছে, তা পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে যেমন, তেমনই আমাদের সমাজের কপটতার বিরুদ্ধেও একটি প্রতিবাদ।
৩.
নারীর একাত্তর-এ বাঙালি মেয়ের পাকিস্তানি সৈন্য কর্তৃক উদ্ধার পাওয়ার উল্লেখ আছে। ১৯৭১ সালে একদল পাকিস্তানি বাংলাদেশের প্রতি নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদনামায় যাঁরা স্বাক্ষর করেছিলেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন পাকিস্তানের মানবতাবাদী কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ। বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলায় কারাবন্দী হয়েছিলেন পাকিস্তানের মানবাধিকারকর্মী আসমা জাহাঙ্গীরের বাবা। এমন কিছু মানুষ সব সময়ই থাকেন, যাঁরা রাজনৈতিক ভেদরেখার ঊর্ধ্বে উঠে যান, থাকেন শান্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে। মেহেরজান-এ মানুষের তৈরি রাজনৈতিক সীমানা পেরিয়ে একটি সর্বজনীন মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ অহিংস শান্তিবাদের শক্তিকে উপজীব্য করা হয়েছে।
মেহেরজানসহ এ ছবির সব চরিত্রই যে কল্পিত, সে কথা ছবির শুরুতেই বলা হয়েছে। বালুচ সৈন্যের চরিত্রটিও একইভাবে সম্পূর্ণ কাল্পনিক। চরিত্রগুলো এসেছে কাহিনির প্রয়োজনে। এ ছবির মূল মর্ম একটি সর্বজনীন মানবতাবোধ ও দেশ-কাল-পাত্রের ঊর্ধ্বে চিরন্তন প্রেমের জয়গান—যা মানুষকে নিজের গণ্ডি পেরিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে। এর মধ্যে কোনো গোপন অভিসন্ধি বা ‘এজেন্ডা’ খোঁজা নিতান্তই নিষ্ফল ও অতিকল্পনামাত্র।
৪.
কোরীয় তাত্ত্বিক নোয়েলিন হেইজের তাঁর এক লেখায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যৌন দাসত্বের শিকার কোরিয়ার পুনর্বাসিত নারীদের ন্যায়বিচারের লক্ষ্যে একটি নান্দনিক সমাধানের পথ প্রস্তাব করেছিলেন। তাঁর প্রস্তাব ছিল, নারীবাদী তত্ত্বের গতানুগতিক ধারার বাইরে ‘অধিক শক্তিধর কিছুর সন্ধান করা, যা জীবনদায়ী, স্বতঃস্ফূর্ত ও পরিবর্তনশীল’। তাই যুদ্ধংদেহী পৃথিবীতে ‘অপর’কে ভালোবাসার গল্প শোনাতেই মেহেরজান ছবির জন্ম।
এই ছবিতে মুক্তিযুদ্ধকে ছোট করে দেখানোর কোনো অবকাশই নেই। কারণ বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের বাইরে আমার নিজেরও কোনো আত্মপরিচয় নেই। নিজের দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রতিপাদ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জাতীয় পরিচয়ের শেকড় অনুসন্ধান। বস্তুত মেহেরজান-এর মতো ছবির মাধ্যমে একাত্তরের ধর্ষিত নারী ও যুদ্ধশিশুর প্রসঙ্গটিকে ওয়ার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের গোচরে এনে ১৯৭১-এ নির্বিচারে নির্যাতিত নারীদের বিচার দাবি করা সম্ভব—এ রকম একটি ভাবনা থেকেই মেহেরজানকে আমরা একটি আন্তর্জাতিক আঙ্গিকে নির্মাণের প্রয়াস পেয়েছি এবং একটি বৈশ্বিক মানবতাবোধের ভাষাভঙ্গি ব্যবহার করেছি। প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে গিয়ে দেখলে দর্শকেরা দেখবেন, এ ছবিতে যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির কথা থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের গৌরবগাথাকে হেয় করার সামান্যতম কোনো উপাদান নেই।
মেহেরজান-এ যুদ্ধবিরোধী স্বদলত্যাগী বালুচ সৈন্যের সঙ্গে বাঙালি মেয়ের যে প্রেম দেখানো হয়েছে, তা একেবারেই নান্দনিক দৃষ্টিকোণ থেকে উপস্থাপিত। যুদ্ধের সময় একজন বাঙালি মেয়ের পাকিস্তানি সেনার প্রেমে পড়ার গল্প আপাতদৃষ্টিতে অস্বাভাবিক। কিন্তু শত্রুরেখার এপারে-ওপারে নারী-পুরুষের প্রেম বাংলা ভাষায় ও সারা বিশ্বের কথাসাহিত্য, কবিতা, চলচ্চিত্র বা নাটকের চিরন্তন বিষয়।
নানাজানের চরিত্রটিও উন্মূল নয়। ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পরে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস ঘরে বাইরে স্পষ্টত সে সময়ের প্রধান রাজনৈতিক ডিসকোর্সের বাইরে থেকে রচিত। সেই উপন্যাসের জমিদার চরিত্র নিখিলেশ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বাঙালির সহিংসতাকে প্রতিহত করেন, কিন্তু মাতৃভূমির জন্য তাঁর মহান দেশাত্মবোধ গভীরতম তন্ত্রীতে পৌঁছায়। নিজের গ্রামকে রক্ষা করতে গিয়ে নিখিলেশ আত্মাহুতি দেন। মেহেরজান-এর নানাজান চরিত্রের প্রেরণা সেখান থেকেই। নানাজান প্রাথমিকভাবে সাতচল্লিশের দেশভাগের যন্ত্রণায় কাতর এবং আরও একটি বিচ্ছেদের সামনে সংশয়ী, কিন্তু গভীর দেশপ্রেম তাঁর মন আচ্ছন্ন করে থাকে। নিজের গ্রাম ও জনগণকে রক্ষা করতেও বদ্ধপরিকর। নানাজান মেহেরজান-এ ক্রমাগত বাঙালির সংগ্রাম ও বঞ্চনার কথা বলেন, উল্লেখ করেন যে ১৯৪০-এর লাহোর প্রস্তাবে বাঙালিদের কোনো কথা ছিল না, তিনি জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বে আস্থা রাখেন না এবং পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে বিস্তর পার্থক্যে সংশয়হীন। মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি আশ্রয় দেন। জয় বাংলার মুক্তিযোদ্ধার হাতে তুলে দেন নিজের আদরের মেয়ে সালমাকে। সবশেষে শান্তি কমিটিতে যোগ না দেওয়ার পরিণতিতে রাজাকারদের ষড়যন্ত্রে নিহত হন।
এই ছবির নানাজানও কল্পিত চরিত্র। তবু ইতিহাসে তাঁদের মতো মানুষ বিস্মৃত হলেও বিরল নন। উনিশ শতকে বাঙালি নবজাগরণের জোয়ারের সময় রাজনৈতিকভাবে বিচক্ষণ, উচ্চশিক্ষিত ও উদারপন্থী একটি ক্ষুদ্র মুসলমান জনগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে। সেই প্রাজ্ঞ ও দেশপ্রেমিক বাঙালি মুসলমানের এক কাল্পনিক প্রতিভূ আমাদের নানাজান—যাঁরা খেতে গামছা বিছিয়ে নামাজ পড়া এই জনপদের কৃষক ও সাধারণ মানুষের কথা ভাবতেন; যাঁরা পরম আধ্যাত্মিকতায় সমর্পিত ছিলেন, কিন্তু মানুষের মুক্তির ও অসাম্প্রদায়িক সংগ্রামে পিছপা ছিলেন না।
জয়া বচ্চন অভিনীত মেহের ৩৮ বছর ধরে এই শহরে নিভৃতে বাস করেন, কারণ পরিবার ও সমাজ তাঁকে নিভৃতচারী হতে বাধ্য করেছে। এই ছবির শুরুতে মেহের যখন নামাজ পড়ছেন, তখন চারপাশে হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান বিভিন্ন ধর্মের প্রতীকী উপকরণ তাঁর অসাম্প্রদায়িক মানসের পরিচয় দেয়। আধ্যাত্মিকতা ও অসাম্প্রদায়িকতা তাঁর মানসে বিরোধী নয়। একজন বাঙালি মুসলমান হিসেবে তাঁর আত্মপরিচয়ের এই অনুসন্ধান কোনো অপরাধের বিষয় হতে পারে না। এটি আমাদের ইতিহাস অনুসন্ধানের একটি অমীমাংসিত ধারাবাহিকতারই অংশ। এ নতুন কোনো অবতারণাও নয়। সুপণ্ডিত আহমদ ছফা সত্তরের দশকেই এই আরজি পেশ করেছিলেন।
আমরা মনে করি, মেহেরজান ছবির একাধিক ব্যাখ্যার সুযোগ রয়েছে। দর্শকদের আমরা সে বিতর্কে আহ্বানও জানাই।
রুবাইয়াত হোসেন: সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র মেহেরজানের পরিচালক।
No comments