কালের পুরাণ-হলুদ কার্ড, লাল কার্ড ও সংসদবিমুখ বিএনপি by সোহরাব হাসান

আগামীকাল মঙ্গলবার জাতীয় সংসদের যে অধিবেশন শুরু হচ্ছে, সেই অধিবেশন নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ইংরেজি নতুন বছরের এই প্রথম অধিবেশনে প্রথা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ভাষণ দেবেন। সরকারি ও বিরোধী দলের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সদস্য সেই ভাষণের ওপর বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ পাবেন।


রাষ্ট্রপতির ভাষণে সাধারণত সরকারের এক বছরের সাফল্য ও কৃতিত্বের বয়ান থাকে। সরকারি দল স্বভাবতই রাষ্ট্রপতির বক্তব্যের প্রশংসা করবে। বিরোধী দলের সাংসদেরা সংসদে উপস্থিত থাকলে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর বক্তব্য দিতে গিয়ে সরকারের ব্যর্থতা ও দুর্বলতাগুলো তুলে ধরবেন। এটিই হলো গণতন্ত্র, এটাই হলো সুস্থ রাজনীতি।
প্রশ্ন হলো, সেই গণতন্ত্র ও সুস্থ রাজনীতিতে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি আস্থাশীল কি না? তাদের গত দুই বছরের কাজকর্মে আস্থার প্রমাণ তারা দেখাতে পারেনি। গণতন্ত্র হলো জনগণের রায় মেনে নেওয়া। কিন্তু বিএনপি ২০০৮ সালের নির্বাচনী রায় মানতে পারেনি। তারা এর মধ্যে ষড়যন্ত্র খুঁজেছে। বলেছে, নির্বাচনে তারা হারেনি, হারিয়েছে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার, নির্বাচন কমিশন, সেনাবাহিনী, পুলিশ, বিডিআর। হারিয়েছে আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভারত। নিজ দেশের জনগণের প্রতি কতটা অশ্রদ্ধা ও অভক্তি থাকলেই একটি দল এ ধরনের অসার কথাবার্তা বলতে পারে। এর অর্থ এই নয় যে আমাদের দেশের রাজনীতিতে বাইরের কোনো হস্তক্ষেপ নেই। হস্তক্ষেপ আছে এবং সে জন্য ক্ষমতাসীন ও বিরোধী—সব দলের রাজনীতিকেরাই দায়ী।
অন্যের ওপর দোষ চাপানোর চেয়ে বিএনপির নেতারা একবার আয়নায় নিজেদের মুখ দেখে নিতে পারেন। তাঁদের আমলে বাংলা ভাই, শায়খ আবদুর রহমান, মুফতি হান্নান, আসাদুল্লাহ গালিবদেরও কারা উসকে দিয়েছিল, কারা সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়েছিল, কারা বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের ঘরছাড়া করেছিল, বিএনপি নেতাদের তা পরিষ্কার করে বলতে হবে। বলতে হবে, হাওয়া ভবন নামে বিকল্প ক্ষমতাকেন্দ্রটি কারা তৈরি করেছিল এবং সেখানে কী কী ষড়যন্ত্র হতো। বলতে হবে, দেশে কোনো বাংলা ভাই নেই বলে কারা আস্ফাালন করেছিল। বলতে হবে, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার নেপথ্যে কারা ছিল। পাকিস্তানি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে যোগসাজশ করে কারা এখানে জঙ্গিবাদের চাষ করেছিল, কারা জজ মিয়া কাহিনি ফেঁদেছিল? সুস্থ রাজনীতির স্বার্থে যেমন, তেমনই বিএনপির পাপমোচনের জন্যও এসব প্রশ্নের সদুত্তর জরুরি।
নির্বাচনে জিতলে ভোটারদের অভিনন্দন আর হারলে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র আবিষ্কার আমাদের রাজনীতিকদের কু-অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ১৯৯১ সালের পর এমন কোনো নির্বাচন নেই, যা নিয়ে হারু পার্টি প্রশ্ন তোলেনি। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে বলে অভিযোগ এনেছিলেন শেখ হাসিনা। আবার ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের ফলাফল মানাতে সাতজন প্রভাবশালী রাষ্ট্রদূতকে খালেদা জিয়ার বাসায় ধরনা দিতে হয়েছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনের ফল মানতে পারেনি আওয়ামী লীগও। জনরায়কে অগ্রাহ্য করার কু-অভ্যাস থেকে বের হতে না পারলে গণতন্ত্র নিরাপদ হবে না। রাজনীতিও সুস্থ ধারায় প্রবাহিত হবে না।

২.
প্রশ্ন হলো, আগামীকালের শুরু হওয়া অধিবেশনে বিএনপি যাবে কি না? এ ব্যাপারে বিএনপির নেতারা মুখস্থ কথা বলে চলেছেন, ‘আমরা সংসদে যেতে চাই, কিন্তু সরকারি দল পরিবেশ তৈরি করছে না।’ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার বলেছেন, ‘যদি গালাগাল বন্ধ করা হয়, জনগণের সমস্যা নিয়ে আলোচনা হয়, তাহলে অবশ্যই আমরা সংসদে যাব।’ বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ জয়নাল আবদিন ফারুক বলেছেন, ‘সরকার বিএনপিকে সংসদে নিতে ব্যর্থ হয়েছে।’ আমরা মনে করি সংসদ বর্জনের জন্য এসব খোঁড়া যুক্তি। জাতীয় সংসদ তো কোনো দলের সম্পত্তি নয়। সরকার ও বিরোধী দল মিলেই সংসদ, যার কাছে সরকার জবাবদিহি করতে বাধ্য। কিন্তু বিরোধী দল যদি বছরের পর বছর অধিবেশন বর্জন করে চলে, তাহলে সরকারের জবাবদিহি হবে কী করে? কারা সরকারের ভুলত্রুটি জনগণের কাছে তুলে ধরবে? তারা একদিকে জাতীয় সংসদ বর্জন করবে, অন্যদিকে জাতীয় সংসদের শূন্য আসনে উপনির্বাচনে অংশ নেবে—এটি ধাপ্পাবাজি ছাড়া কিছু নয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও হবিগঞ্জের দুটি আসনে ২৭ জানুয়ারি যে উপনির্বাচন হচ্ছে, তাতে সোৎসাহে অংশ নিচ্ছে বিএনপি। ভোটারদের কর্তব্য হবে বিএনপির কাছ থেকে এই কড়ার নেওয়া যে, নির্বাচিত হলে তারা সংসদ বর্জন করবে না। বিরোধী দল সংসদে থাকলে দেশের অনেক সমস্যারই শান্তিপূর্ণ সমাধান হতো। কেবল সরকারি দল ও তাদের সমর্থকদের নিয়ে সংসদ চালানো আর দল বা জোটের বর্ধিত সভার মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। তাই দেশ ও জনগণের স্বার্থেই বিরোধী দলের সংসদে যাওয়া উচিত। না গেলে জনগণ ভাববে, সরকারি দলের সঙ্গে আপস করেই তারা সংসদ বর্জন করছে। সরকারি ও বিরোধী দলের সমর্থক ব্যবসায়ীদের মধ্যে অলিখিত নয়, লিখিত চুক্তি আছে, এর প্রমাণ বিভিন্ন ব্যাংক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান। ক্ষমতাবদলের সঙ্গে সঙ্গে আপসেই তাঁদের পরিচালনা পর্ষদেও পরিবর্তন আনেন, তবে যৌথ ব্যবসা-বাণিজ্য ঠিকই চালিয়ে যান। ব্যাংকার খন্দকার ইব্রাহিম খালেদ তো গতকাল পত্রিকায় রীতিমতো বোমা ফাটিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ১০-১৫ জন ব্যবসায়ী-রাজনীতিক শেয়ারবাজার থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছেন। এই টাকাটা তাঁরা আর বিনিয়োগে খাটাচ্ছেন না।...শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে শুধু একটি নয়, উভয় দলের লোকজন জড়িত। তাঁদের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ থাকলেও ব্যবসার বিরোধ নেই। (ইত্তেফাক, ২৩ জানুয়ারি ২০১১)।
আগামী অধিবেশনে যোগ দেওয়া না-দেওয়ার ব্যাপারে বিএনপি এখনো মনস্থির করতে পারেনি। হাতে সময় মাত্র এক দিন। এ ব্যাপারে পত্রিকায়ও পরস্পরবিরোধী খবর ছাপা হয়েছে। দৈনিক নয়া দিগন্ত লিখেছে, ‘বিএনপি আগামী অধিবেশনে সংসদে যাচ্ছে না।’ অন্যদিকে আমার দেশ জানিয়েছে, ‘জাতীয় সংসদের আগামী অধিবেশনের প্রথম দিনে যোগ দিচ্ছে না বিএনপি। তবে সরকার উদ্যোগ নিলে অধিবেশনের পরবর্তী কার্যদিবসে সংসদে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দিচ্ছে না দলটি।...বিএনপির নীতিনির্ধারক পর্যায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কয়েকটি সূত্র জানিয়েছে, সংসদে না যাওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত বিএনপি নেয়নি। সরকারের অসহযোগিতার জন্যই বিএনপি সংসদে যেতে পারছে না। সরকার উদ্যোগ নিলে ভবিষ্যতে যে অধিবেশন বসছে, তাতে বিএনপিসহ বিরোধী দলকে দেখা যেতে পারে। তবে প্রথম দিনে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা কম বলে সূত্রটি নিশ্চিত করে বলেছে, বছরের প্রথম অধিবেশন হওয়ায় ওই দিন রেওয়াজ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ভাষণ দেবেন। ওই ভাষণ হয়ে গেলে সরকারি উদ্যোগের ওপরই নির্ভর করবে বিএনপির সংসদে যোগ দেওয়া।’ (আমার দেশ, ২৩ জানুয়ারি ২০১১)। পত্রিকাটি আরও লিখেছে, ‘বিশ্ব ইজতেমা ও বিশ্বকাপ ক্রিকেটের কারণে আগামী কয়েক মাস আন্দোলনের কথা ভাবতে পারছে না বিএনপি। এ জন্য সংসদে যোগ দিয়ে সরকারি দলের দুই বছরের ব্যর্থতা জাতির সামনে তুলে ধরার সুযোগটি হাতছাড়া করতে চায় না বলে জানিয়েছেন দলের কয়েকজন নেতা।’
এখন দেখা যাক, দায়িত্বশীল বিরোধী দল কী রকম দায়িত্ব পালন করেছে। বিএনপির নেতারা দাবি করেন, তাঁরা নজিরবিহীনভাবে নাকি সংসদের প্রথম অধিবেশনে প্রথম দিন যোগ দিয়েছিলেন। তারপর কী করেছেন? প্রথম দিনে তাঁদের মনোনীত এবং এক-এগারোর পরিবর্তনকারী রাষ্ট্রপতির ভাষণকে বর্জন করেছেন। তারপর সংসদে সামনের সারিতে আসন পাওয়ার মতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে তাঁরা লাগাতার সংসদ বর্জন করেছেন। দলীয় চেয়ারপারসনের আহ্বানে নাকি কয়েকজন সদস্য পদত্যাগপত্র জমাও দিয়ে রেখেছেন। গত দুই বছরে ১৭৪ দিন অধিবেশন চললেও বিরোধী দল হাজির ছিল মাত্র ৪৪ দিন। বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া সংসদে গিয়েছেন মাত্র পাঁচ দিন। এটি কি ভোটারদের সঙ্গে মহাতামাশা নয়? গণতন্ত্রে এই তামাশা চলতে পারে না। বিএনপিকে বলতে হবে, তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে কি না? সংসদ কার্যকর রাখতে চায় কি না?
৩.
পৌরসভা নির্বাচনে আশাতীত ভালো ফল করে বিএনপি যে দারুণ উজ্জীবিত, তা বোঝা যায় নেতাদের কথাবার্তায়। ইতিমধ্যে তাঁদের কেউ কেউ সরকারকে হলুদ কার্ড ও লাল কার্ড দেখানোর কথা বলেছেন। কেউ বা আগামী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২৫টি আসন পাবে না বলে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। সেটি তাঁরা করতেই পারেন। গণতন্ত্রে তো কারও মুখে কুলুপ এঁটে দেওয়া যায় না। তাঁদের দাবি, সরকার গত দুই বছরে জনগণের জন্য কিছু করেনি বলেই জনগণ তাদের হলুদ কার্ড দেখিয়েছে। কিন্তু এই দুই বছরে বিরোধী দল জনগণের জন্য কী করেছে? জনগণের সমস্যা নিয়ে তারা মাঠে নামেনি, আন্দোলন করেনি। আন্দোলন করেছে ব্যক্তি ও দলের স্বার্থে। এখনো সংসদে যাওয়ার জন্য যেসব শর্ত জুড়ে দিয়েছে, তার বেশির ভাগই দলীয়। সেখানে জনগণের কথা নেই।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ এখন প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো সংগঠনের সভায় সভাপতিত্ব করেন বা প্রধান অতিথি হয়ে আসেন। শুক্রবার এক সভায় তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগকে জনগণ হলুদ কার্ড দেখিয়েছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে তাদের পরিণতি আরও করুণ হবে। আওয়ামী লীগ আগামী তিন বছর জনগণের জন্য কাজ না করলে তারা প্রত্যাখ্যান করবে। কাজ করলে ফলাফল ভিন্ন হবে। কিন্তু মওদুদ সাহেব এখনই নিশ্চিত হলেন কী করে যে আগামী নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় আসবে? ৬৫ লাখ ভোটারের রায় দিয়ে সাড়ে ছয় কোটি ভোটারের মনোভাব কি নিশ্চিত করা যায়?
শনিবার আরেকটি সভায় তিনি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের পদত্যাগ দাবি করেছেন। কারণ মুহিত শেয়ারবাজারের বিপর্যয়ের জন্য তাঁর ও এসইসির কিছু ভুল পদক্ষেপ দায়ী বলে স্বীকার করেছেন। এ জন্য মন্ত্রী বা সরকারের পদত্যাগ তিনি চাইতে পারেন। কিন্তু দেখতে হবে, সেই ব্যর্থতার পরিমাণ বিএনপি আমলের চেয়ে বেশি না কম। গত দুই বছরে সরকারের যত ব্যর্থতাই থাক না কেন, বিএনপির রেকর্ড ভাঙতে পারেনি। দেশ জঙ্গিবাদ ও হুন্ডিবাজের অভয়াশ্রমও হয়নি।
মওদুদের দাবি সম্পর্কে সরস মন্তব্য করেছেন আমাদের এক জ্যেষ্ঠ সহকর্মী। তিনি জানতে চেয়েছেন, অর্থমন্ত্রী পদত্যাগ করলে মওদুদ সাহেব কি সেই পদে অধিষ্ঠিত হবেন? বললাম, কী করে? তাঁর ব্যাখ্যা ছিল এরূপ, বর্তমান সংসদে দলবদলের সুযোগ না থাকলেও বিরোধী দল থেকে সরকারি দলে হিজরত করে মন্ত্রী হতে আপত্তি নেই। মওদুদ সাহেব এ রকম দলবদল একাধিকবার করেছেন। তিনি জিয়ার মন্ত্রী হয়েছিলেন। স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে প্রথমে আন্দোলন করে পরে মন্ত্রী হয়েছিলেন। পরে প্রধানমন্ত্রী ও উপরাষ্ট্রপতির পদও অলংকৃত করেছিলেন এই ধীমান রাজনীতিক। এ জন্য তিনি ভুল স্বীকার করেছেন, এমন প্রমাণ নেই। ১৯৯১-৯৬ সালেও তিনি জাতীয় পার্টির নেতা ছিলেন। ওই সময় বিএনপি সরকারের প্রায় প্রতিটি পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছেন। যেই দলটির বিরুদ্ধে আন্দোলন করে মওদুদ সাহেব তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তিন মাসের মাথায় সেই দলটির মনোনয়ন নিয়ে উপনির্বাচনে অংশ নেন। এখন মুহিত সাহেব অর্থমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করলে মওদুদের ভাগ্য খুলে যাবে কি না, সেটিই দেশবাসীর জিজ্ঞাসা।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.