ফিরে দেখা-ঊনসত্তরের মহান গণ-অভ্যুত্থানের কথা by তোফায়েল আহমেদ
আজ ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান দিবস। বাঙালি জাতির সংগ্রামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বলতম দিন। ১৯৬৯-এর এই দিনে উত্তাল সংগ্রামের যে দাবানল জ্বলে উঠেছিল, তা আজও চেতনায় সমুজ্জ্বল। স্বৈরশাসক আইয়ুব খান মনে করেছিলেন, বাংলার মানুষ চিরকাল থাকবে দাসত্বের শৃঙ্খলে আর তাঁর মসনদ হবে চিরস্থায়ী।
তাই বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফা দেওয়ার কারণে বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ফাঁসির মঞ্চে ঝোলাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেদিন বিক্ষুব্ধ বাংলার সন্তানেরা এতটাই দ্রোহের আগুনে জ্বলে উঠেছিল যে গণ-অভ্যুত্থানের পথে আইয়ুব খানকে ক্ষমতার মসনদ থেকে বিদায় জানায়। আর কৃতজ্ঞ জাতি মুক্ত করে আনে তাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে। আমাদের ইতিহাসের ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে রক্তে লেখা আত্মদান আর বিজয়ের গৌরব।
১৯৬৯-এর ২৪ জানুয়ারির ঝলমলে শীতের সকালটি আমাদের জীবনে অবিচল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসার আগেই ক্ষুব্ধ জনতার উত্তাল সংগ্রামের মুখে গণ-অভ্যুত্থান ঘটে। সেদিনের ঢাকার সংগ্রামের দৃশ্য ভাবতে কতই না ভালো লাগে। সেদিনের উজ্জ্বল স্মৃতি আজ যখন চোখে ভাসে, একটা কথা খুব মনে হয়, ক্ষমতার মোহে অন্ধ শাসকেরা যখন স্বৈরাচারী হয়, তখন মনে করে, ক্ষমতায় তারাই বোধহয় স্থায়ী, বাকি সবকিছুই অস্থায়ী। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান যে বীরত্বের ইতিহাস রচনা করেছিল, সেই ইতিহাসের কঠিন শিক্ষাই হলো, জনগণের সংগ্রাম দাবানলের মতো জ্বলে উঠতে সময় লাগে না। জনতার ঐক্য যখন এক সুতায় গাঁথা হয়, তখন কোনো অপশক্তির ষড়যন্ত্রে তা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। আর একজন স্বৈরশাসকের পতনের ইতিহাস যেমন করুণ, তেমনইয জনতার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামই সত্য, চিরসুন্দর। তাই সত্যের জয় অনিবার্য। ঊনসত্তরের ইতিহাসের এই পুনরাবৃত্তি এ দেশে দেড় দশকে দুই-দুবার ঘটেছে। ১৯৯০ আর ’৯৬-এর সংগ্রামী শিক্ষা গণতন্ত্রের ইতিহাসে আপন গতিপথে জায়গা করে নিয়েছে।
১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি দুটি কারণে আমার জীবনে স্মরণীয়। ওই দিন আমি ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হই আর সেদিনই জেলখানা থেকে বঙ্গবন্ধু আমাকে আশীর্বাদ করে অভিনন্দনবার্তা পাঠিয়ে প্রত্যাশা করেছিলেন ডাকসু নেতৃত্বের সংগ্রামী ভবিষ্যৎ। বঙ্গবন্ধুর আশীর্বাদপুষ্ট হয়েই সেবারের ডাকসু ঐতিহাসিক ও সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছিল। ডাকসুসহ চারটি ছাত্রসংগঠনের ঐক্যবদ্ধ সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ১৯৬৯-এর ১৭ জানুয়ারি থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর মুক্তি পর্যন্ত সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছিল। আইয়ুবের লৌহ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়ে ঊনসত্তরের ২৪ জানুয়ারি গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল। আজ মনে পড়ে সেই সংগ্রামের সহকর্মী-সহযোদ্ধাদের। আমরা ছাত্রসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে সফল হয়েছিলাম। সেই গৌরবময় আন্দোলনের নেতৃত্বে যাঁরা উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুর রউফ, সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী, ছাত্র ইউনিয়ন একাংশের সভাপতি সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দোহা, অন্য অংশের সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার, সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ, এনএসএফ একাংশের সভাপতি ইব্রাহিম খলিল, সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম মুন্সী ও ডাকসুর জিএস নাজিম কামরান চৌধুরী। সেই সময়ের জাতীয় ও ছাত্র-যুবনেতাদের অধিকাংশ ছিলেন কারাগারে। ঊনসত্তরের সেই অগ্নিঝরা প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা কিংবা ইতিহাসের উত্তাল পল্টনের দিকে যখন ফিরে তাকাই, তখন রীতিমতো অবাক হই। ১৭ জানুয়ারি পাঁচ শতাধিক ছাত্রছাত্রী নিয়ে বটতলা থেকে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, ১৮ জানুয়ারি সেই সংগ্রামের স্রোতে সহস্র কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই—আইয়ুব খানের পতন চাই।’ ১৯ তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল। সেদিন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলে গুলিবর্ষণ করা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি বটতলায় ছাত্রসমাবেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই অবস্থা। গাড়িবারান্দায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে হয় আমাদের। ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া হাজার হাজার ছাত্রের মিছিলে গুলিবর্ষণ হলে আসাদ নিহত হয়। আসাদের লাল রক্তে ভেজা শার্ট দিয়ে তৈরি হয় পতাকা। এখনো বনানীর বাড়ির ড্রইংরুমে প্রবেশ করে সেই শার্ট দিয়ে তৈরি পতাকার ছবিতে যখন চোখ আটকে যায়, যেন নতুন সংগ্রামের উদ্দীপনা পাই। আন্দোলন-সংগ্রাম-ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বিজয় আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে। ২১ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে আসাদের জানাজায় শোকে-ক্ষোভে উত্তাল জনসমুদ্র যেন এক শহীদের রক্ত ছাত্র-জনতার চেতনায় আগুন ছড়িয়েছে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধে আপসহীন সংগ্রামের শপথ নিতে এসেছে সবাই। মাওলানা ভাসানীসহ সব জাতীয় নেতা এসেছেন জানাজায়। ডাকসুর ভিপি ও সংগ্রাম পরিষদের মুখপাত্র হিসেবে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করি। ২২ জানুয়ারি কালো ব্যাজ ধারণ, কালো পতাকা উত্তোলন। ২৩ তারিখ মশালমিছিল আর ২৪ তারিখ দুপুর দুইটা পর্যন্ত হরতাল। ২২ তারিখ ঢাকায় সব বাড়ি আর গাড়িতে কালো পতাকা উড়ল। সে এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য। শোক নয়, যেন প্রতিবাদে জেগে উঠল নগর। একজন মানুষও দেখা গেল না, যার বুকে শোকের চিহ্ন কালো ব্যাজ নেই। ২৩ তারিখ ঢাকা মশালমিছিলের নগরে পরিণত হলো, যেন প্রতিবাদের আগুনে জ্বলে উঠল ঢাকা। ২৪ তারিখ হরতালের সকাল থেকে ছাত্র-জনতা নেমে এল রাজপথে। বিক্ষোভে উত্তাল হলো নগর। সচিবালয়ের পাশে আবদুল গণি রোডে মন্ত্রীর বাড়িতে আক্রমণ হলো, পুলিশের গুলিতে নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণীর ছাত্র মতিউরের সঙ্গে মকবুল, রুস্তম মিলে চারজন নিহত হয়। লাশ নিয়ে দুপুর ১২টার দিকে পল্টনে যাই। সর্বত্র এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে মুহূর্তের মধ্যে বিক্ষুব্ধ মানুষের স্রোতে ঢাকা হয়ে ওঠে অগ্নিগর্ভ। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলল ঢাকায়। দৈনিক পাকিস্তান, মর্নিং নিউজ অফিসে আগুন। এমএনএ এন এ লস্করের বাড়িতে আগুন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সাক্ষীদের বাড়ি খুঁজতে থাকল জনতা। বিচারপতি এস এ রহমানের বাড়িতে আক্রমণ হলে তিনি লুঙ্গি পরে পলায়ন করেন। পল্টনে তিল ধারণের জায়গা নেই। মানুষ, মানুষ আর মানুষ। তারা গভর্নর হাউস আক্রমণ করতে চায়। বিনা মাইকে সেদিন পিনপতন নীরবতায় আমাকে বক্তৃতা করতে হয়। লাশ নিয়ে মিছিল করে আমরা ইকবাল হলের (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) মাঠে চলে আসি। বেলা তিনটার পর সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। মানুষ তা অমান্য করে বানের স্রোতের মতো নেমে আসে রাজপথে। এদিকে ২০ তারিখ আসাদের মৃত্যুর পর সংগ্রামে আসা ছাত্ররা পকেটে ঠিকানা নিয়ে আসত। এখনো ওই সংগ্রামের সাফল্য যেমন আনন্দ দেয়, মাথা উঁচু করে পথ চলতে প্রেরণা জোগায়, তেমনই মতিউরের পকেটে পাওয়া চিরকুটের কথা মনে পড়লে বুক ভারী হয়ে আসে।
মতিউরের বুকপকেটে পাওয়া চিরকুট নিয়ে দেখলাম লেখা আছে, ‘মা, তুমি মনে করো তোমার মতিউর বাংলার মানুষ ও প্রিয় নেতা শেখ মুজিবের জন্য জীবন দিয়ে গেল। ইতি—মতিউর রহমান, ১০ম শ্রেণী, পিতা আজহার উদ্দিন মালিক, নবকুমার ইন্সটিটিউট। ন্যাশনাল ব্যাংক কলোনি, মতিঝিল।’ সান্ধ্য আইনের মধ্যে মতিউরের লাশ তার মায়ের কাছে নিয়ে গেলে যে হূদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়, তা হূদয় দিয়ে শুধু অনুভব করা যায়, ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। মতিউরের মা বলেছিলেন, ‘সন্তানের রক্ত যেন বৃথা না যায়।’ ২০ জানুয়ারি শহীদ মিনারে আসাদের রক্ত ছুঁয়ে আমরা যে শপথ নিয়েছিলাম, ২৪ জানুয়ারি মতিউরের রক্তে ওই সংগ্রাম বিজয়ের পূর্ণতা লাভ করে। এদিকে ২৪ জানুয়ারি গণ-অভ্যুত্থান ঘটলে ২৫, ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত সান্ধ্য আইন বহাল থাকে। সান্ধ্য আইন প্রত্যাহারের পর নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ৯ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে জনসভা। আমার জীবনের সেটিই পল্টনের প্রথম জনসভা। জনসভা নয়, যেন জনসমুদ্র। আমরা ১০ জন ছাত্রনেতা বক্তৃতা করি। সেদিনের শপথ দিবসের সভায় টানা ৪৫ মিনিট বক্তৃতা করে যখন ইতি টানি, তখন স্লোগানে স্লোগানে জনসমুদ্রে যেন ঢেউ উঠছে, ‘শপথ নিলাম, শপথ নিলাম, মুজিব তোমায় মুক্ত করব—শপথ নিলাম, শপথ নিলাম, মাগো তোমায় মুক্ত করব।’ মণি সিংহ, তাজউদ্দীন আহমদ, শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেননসহ অনেকেই তখন জেলে। ছাত্র-জনতার বুকের রক্তে ১১ দফার আন্দোলন আর শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি এক হয়ে গেল। ছাত্র-জনতা মুজিবকে না নিয়ে ঘরে ফিরবে না। সভা শেষে তাই সবাই ছুটল কেন্দ্রীয় কারাগারের দিকে। আজও সেই সব স্মৃতি আমার মানসপটে ভেসে ওঠে। অর্ধলক্ষাধিক বিক্ষুব্ধ মানুষের মিছিলকে সেদিন কারাগারের সামনে থেকে আমরা ফিরিয়ে এনেছিলাম। এদিকে ১৪ ফেব্রুয়ারি পল্টনে ‘ডাক’-এর আহ্বানে জনসভা। সেদিনই বঙ্গবন্ধু আমায় কারাগারে ডাকেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা ক্যান্টনমেন্টের কারাগারে দেখা করাতে নিয়ে যান। মাজদা গাড়ি ড্রাইভ করেছিলেন শেখ কামাল। সেখানেই বঙ্গবন্ধু আমাকে বুকে জড়িয়ে আদর করেছিলেন। সেসব ভাবলে এখনো বুক ভরে যায়, দুই চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। কী উষ্ণ ভালোবাসাই না ছিল বঙ্গবন্ধুর হূদয়জুড়ে। বিকেলে জনসভায় গেলে সভাপতি পদে নূরুল আমিনের নাম প্রস্তাব হলে জনতা তা প্রত্যাখ্যান করে। তখন আমাকে মঞ্চে নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর ছবি বুকে লাগিয়ে বক্তৃতায় জনতার সমর্থন আদায় করি এই বলে যে শেখ মুজিবের মুক্তি ছাড়া গোলটেবিল নয়। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন আমাদের নেতা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। নেতা ফিরে আসবেন, তাঁকে মুক্ত না করে আমরা ঘরে ফিরব না। ওই রাতেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ফজলুল হককে কারাগারে গুলি করা হয়। সার্জেন্ট জহুর নিহত হন। প্রতিবাদে জনতা নেমে আসে রাজপথে। ১৫ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি আবার সান্ধ্য আইন জারি হয়। এরই মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. শামসুজ্জোহা গুলিতে মারা যান। ২০ তারিখ সান্ধ্য আইনের মধ্যে ঢাকা মশাল মিছিলের নগর হয়ে উঠলে সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করা হয়। ২১ তারিখ পল্টনের মহাসমুদ্র থেকে আলটিমেটাম ঘোষিত হয়, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দীকে মুক্তি দিতে হবে। ২২ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টায় বঙ্গবন্ধু ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিসহ সব রাজবন্দীকে মুক্তি দিতে সরকার বাধ্য হয়। লাখ লাখ জনতা ছুটে যায় পল্টনে, তাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে দেখতে। কিন্তু শিক্ষা ভবনের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে আমরা ফিরিয়ে নিয়ে যাই ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িতে। পল্টনে অধীর আগ্রহে থাকা জনতাকে বললাম, ২৩ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নেতার সংবর্ধনা। সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেন জনতার বাঁধভাঙা জোয়ার। সভাপতিত্ব করলেও রীতিভঙ্গ করে নেতার আগেই বক্তৃতায় হূদয়ের গভীর থেকে উচ্চারিত হয় সত্যবচন, ‘যে নেতা তাঁর জীবনের যৌবন কাটিয়েছেন পাকিস্তানের কারাগারে; ফাঁসির মঞ্চে বাঙালির মুক্তির কথা বলেছেন, সেই নেতাকে কৃতজ্ঞচিত্তে জাতির পক্ষ থেকে একটি উপাধি দিতে চাই।’ ১০ লাখ লোক ২০ লাখ হাত উঁচিয়ে সম্মতি জানিয়েছিল। তখনই কৃতজ্ঞচিত্তে শেখ মুজিবকে জাতির পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনজোয়ারই শুধু নয়, সমগ্র জাতি তখন আনন্দ আর কৃতজ্ঞতায় আবেগাপ্লুত হয়েছিল। পল্টনে শপথ গ্রহণের ১৪ দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধুসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দী এবং অপরাপর রাজনৈতিক নেতাকে আমরা মুক্ত করেছিলাম। দুই বছরের মাথায় প্রিয় নেতার নেতৃত্বে আমরা দীর্ঘ সংগ্রামের পথ মাড়িয়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে গণরায় নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করেছিলাম। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘জাগো জাগো, বাঙালি জাগো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’—হূদয় উজাড় করা স্লোগানে বাঙালি জাতি নেতার নির্দেশে এক স্রোতে দাঁড়িয়েছিল। ঊনসত্তরের ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সংবর্ধনায় বঙ্গবন্ধু যে কথাগুলো বলেছিলেন, তা আজ খুব বেশি মনে পড়ে। তিনি ওই দিন বরাবরের মতো বাঙালি জাতিকে হূদয়ের গভীর ভালোবাসা দিয়ে ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে সম্বোধন করে বলেছিলেন, ‘রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে তোমরা যারা আমায় কারাগার থেকে মুক্ত করেছ, যদি কোনো দিন পারি, নিজের রক্ত দিয়ে হলেও সেই ঋণ শোধ করে যাব।’ জাতির জনক একা নন, সপরিবারে জাতির অধিকার রক্ষায় রক্ত দিয়ে সেই ঋণ পরিশোধ করে গেছেন।
তোফায়েল আহমেদ: সংসদ সদস্য, সভাপতি, শিল্প মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
১৯৬৯-এর ২৪ জানুয়ারির ঝলমলে শীতের সকালটি আমাদের জীবনে অবিচল সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল। সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসার আগেই ক্ষুব্ধ জনতার উত্তাল সংগ্রামের মুখে গণ-অভ্যুত্থান ঘটে। সেদিনের ঢাকার সংগ্রামের দৃশ্য ভাবতে কতই না ভালো লাগে। সেদিনের উজ্জ্বল স্মৃতি আজ যখন চোখে ভাসে, একটা কথা খুব মনে হয়, ক্ষমতার মোহে অন্ধ শাসকেরা যখন স্বৈরাচারী হয়, তখন মনে করে, ক্ষমতায় তারাই বোধহয় স্থায়ী, বাকি সবকিছুই অস্থায়ী। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান যে বীরত্বের ইতিহাস রচনা করেছিল, সেই ইতিহাসের কঠিন শিক্ষাই হলো, জনগণের সংগ্রাম দাবানলের মতো জ্বলে উঠতে সময় লাগে না। জনতার ঐক্য যখন এক সুতায় গাঁথা হয়, তখন কোনো অপশক্তির ষড়যন্ত্রে তা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না। আর একজন স্বৈরশাসকের পতনের ইতিহাস যেমন করুণ, তেমনইয জনতার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামই সত্য, চিরসুন্দর। তাই সত্যের জয় অনিবার্য। ঊনসত্তরের ইতিহাসের এই পুনরাবৃত্তি এ দেশে দেড় দশকে দুই-দুবার ঘটেছে। ১৯৯০ আর ’৯৬-এর সংগ্রামী শিক্ষা গণতন্ত্রের ইতিহাসে আপন গতিপথে জায়গা করে নিয়েছে।
১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি দুটি কারণে আমার জীবনে স্মরণীয়। ওই দিন আমি ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হই আর সেদিনই জেলখানা থেকে বঙ্গবন্ধু আমাকে আশীর্বাদ করে অভিনন্দনবার্তা পাঠিয়ে প্রত্যাশা করেছিলেন ডাকসু নেতৃত্বের সংগ্রামী ভবিষ্যৎ। বঙ্গবন্ধুর আশীর্বাদপুষ্ট হয়েই সেবারের ডাকসু ঐতিহাসিক ও সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছিল। ডাকসুসহ চারটি ছাত্রসংগঠনের ঐক্যবদ্ধ সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ১৯৬৯-এর ১৭ জানুয়ারি থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর মুক্তি পর্যন্ত সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছিল। আইয়ুবের লৌহ শাসনের ভিত কাঁপিয়ে দিয়ে ঊনসত্তরের ২৪ জানুয়ারি গণ-অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল। আজ মনে পড়ে সেই সংগ্রামের সহকর্মী-সহযোদ্ধাদের। আমরা ছাত্রসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে সফল হয়েছিলাম। সেই গৌরবময় আন্দোলনের নেতৃত্বে যাঁরা উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন তৎকালীন ছাত্রলীগের সভাপতি আবদুর রউফ, সাধারণ সম্পাদক খালেদ মোহাম্মদ আলী, ছাত্র ইউনিয়ন একাংশের সভাপতি সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক, সাধারণ সম্পাদক শামসুদ্দোহা, অন্য অংশের সভাপতি মোস্তফা জামাল হায়দার, সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ, এনএসএফ একাংশের সভাপতি ইব্রাহিম খলিল, সাধারণ সম্পাদক ফখরুল ইসলাম মুন্সী ও ডাকসুর জিএস নাজিম কামরান চৌধুরী। সেই সময়ের জাতীয় ও ছাত্র-যুবনেতাদের অধিকাংশ ছিলেন কারাগারে। ঊনসত্তরের সেই অগ্নিঝরা প্রিয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা কিংবা ইতিহাসের উত্তাল পল্টনের দিকে যখন ফিরে তাকাই, তখন রীতিমতো অবাক হই। ১৭ জানুয়ারি পাঁচ শতাধিক ছাত্রছাত্রী নিয়ে বটতলা থেকে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, ১৮ জানুয়ারি সেই সংগ্রামের স্রোতে সহস্র কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই—আইয়ুব খানের পতন চাই।’ ১৯ তারিখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল। সেদিন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলে গুলিবর্ষণ করা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি বটতলায় ছাত্রসমাবেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই অবস্থা। গাড়িবারান্দায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতে হয় আমাদের। ওই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া হাজার হাজার ছাত্রের মিছিলে গুলিবর্ষণ হলে আসাদ নিহত হয়। আসাদের লাল রক্তে ভেজা শার্ট দিয়ে তৈরি হয় পতাকা। এখনো বনানীর বাড়ির ড্রইংরুমে প্রবেশ করে সেই শার্ট দিয়ে তৈরি পতাকার ছবিতে যখন চোখ আটকে যায়, যেন নতুন সংগ্রামের উদ্দীপনা পাই। আন্দোলন-সংগ্রাম-ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বিজয় আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে ওঠে। ২১ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে আসাদের জানাজায় শোকে-ক্ষোভে উত্তাল জনসমুদ্র যেন এক শহীদের রক্ত ছাত্র-জনতার চেতনায় আগুন ছড়িয়েছে। প্রতিবাদ-প্রতিরোধে আপসহীন সংগ্রামের শপথ নিতে এসেছে সবাই। মাওলানা ভাসানীসহ সব জাতীয় নেতা এসেছেন জানাজায়। ডাকসুর ভিপি ও সংগ্রাম পরিষদের মুখপাত্র হিসেবে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করি। ২২ জানুয়ারি কালো ব্যাজ ধারণ, কালো পতাকা উত্তোলন। ২৩ তারিখ মশালমিছিল আর ২৪ তারিখ দুপুর দুইটা পর্যন্ত হরতাল। ২২ তারিখ ঢাকায় সব বাড়ি আর গাড়িতে কালো পতাকা উড়ল। সে এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য। শোক নয়, যেন প্রতিবাদে জেগে উঠল নগর। একজন মানুষও দেখা গেল না, যার বুকে শোকের চিহ্ন কালো ব্যাজ নেই। ২৩ তারিখ ঢাকা মশালমিছিলের নগরে পরিণত হলো, যেন প্রতিবাদের আগুনে জ্বলে উঠল ঢাকা। ২৪ তারিখ হরতালের সকাল থেকে ছাত্র-জনতা নেমে এল রাজপথে। বিক্ষোভে উত্তাল হলো নগর। সচিবালয়ের পাশে আবদুল গণি রোডে মন্ত্রীর বাড়িতে আক্রমণ হলো, পুলিশের গুলিতে নবকুমার ইনস্টিটিউটের দশম শ্রেণীর ছাত্র মতিউরের সঙ্গে মকবুল, রুস্তম মিলে চারজন নিহত হয়। লাশ নিয়ে দুপুর ১২টার দিকে পল্টনে যাই। সর্বত্র এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে মুহূর্তের মধ্যে বিক্ষুব্ধ মানুষের স্রোতে ঢাকা হয়ে ওঠে অগ্নিগর্ভ। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলল ঢাকায়। দৈনিক পাকিস্তান, মর্নিং নিউজ অফিসে আগুন। এমএনএ এন এ লস্করের বাড়িতে আগুন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সাক্ষীদের বাড়ি খুঁজতে থাকল জনতা। বিচারপতি এস এ রহমানের বাড়িতে আক্রমণ হলে তিনি লুঙ্গি পরে পলায়ন করেন। পল্টনে তিল ধারণের জায়গা নেই। মানুষ, মানুষ আর মানুষ। তারা গভর্নর হাউস আক্রমণ করতে চায়। বিনা মাইকে সেদিন পিনপতন নীরবতায় আমাকে বক্তৃতা করতে হয়। লাশ নিয়ে মিছিল করে আমরা ইকবাল হলের (বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) মাঠে চলে আসি। বেলা তিনটার পর সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। মানুষ তা অমান্য করে বানের স্রোতের মতো নেমে আসে রাজপথে। এদিকে ২০ তারিখ আসাদের মৃত্যুর পর সংগ্রামে আসা ছাত্ররা পকেটে ঠিকানা নিয়ে আসত। এখনো ওই সংগ্রামের সাফল্য যেমন আনন্দ দেয়, মাথা উঁচু করে পথ চলতে প্রেরণা জোগায়, তেমনই মতিউরের পকেটে পাওয়া চিরকুটের কথা মনে পড়লে বুক ভারী হয়ে আসে।
মতিউরের বুকপকেটে পাওয়া চিরকুট নিয়ে দেখলাম লেখা আছে, ‘মা, তুমি মনে করো তোমার মতিউর বাংলার মানুষ ও প্রিয় নেতা শেখ মুজিবের জন্য জীবন দিয়ে গেল। ইতি—মতিউর রহমান, ১০ম শ্রেণী, পিতা আজহার উদ্দিন মালিক, নবকুমার ইন্সটিটিউট। ন্যাশনাল ব্যাংক কলোনি, মতিঝিল।’ সান্ধ্য আইনের মধ্যে মতিউরের লাশ তার মায়ের কাছে নিয়ে গেলে যে হূদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়, তা হূদয় দিয়ে শুধু অনুভব করা যায়, ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। মতিউরের মা বলেছিলেন, ‘সন্তানের রক্ত যেন বৃথা না যায়।’ ২০ জানুয়ারি শহীদ মিনারে আসাদের রক্ত ছুঁয়ে আমরা যে শপথ নিয়েছিলাম, ২৪ জানুয়ারি মতিউরের রক্তে ওই সংগ্রাম বিজয়ের পূর্ণতা লাভ করে। এদিকে ২৪ জানুয়ারি গণ-অভ্যুত্থান ঘটলে ২৫, ২৬ ও ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত সান্ধ্য আইন বহাল থাকে। সান্ধ্য আইন প্রত্যাহারের পর নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ৯ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে জনসভা। আমার জীবনের সেটিই পল্টনের প্রথম জনসভা। জনসভা নয়, যেন জনসমুদ্র। আমরা ১০ জন ছাত্রনেতা বক্তৃতা করি। সেদিনের শপথ দিবসের সভায় টানা ৪৫ মিনিট বক্তৃতা করে যখন ইতি টানি, তখন স্লোগানে স্লোগানে জনসমুদ্রে যেন ঢেউ উঠছে, ‘শপথ নিলাম, শপথ নিলাম, মুজিব তোমায় মুক্ত করব—শপথ নিলাম, শপথ নিলাম, মাগো তোমায় মুক্ত করব।’ মণি সিংহ, তাজউদ্দীন আহমদ, শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক, মতিয়া চৌধুরী, রাশেদ খান মেননসহ অনেকেই তখন জেলে। ছাত্র-জনতার বুকের রক্তে ১১ দফার আন্দোলন আর শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি এক হয়ে গেল। ছাত্র-জনতা মুজিবকে না নিয়ে ঘরে ফিরবে না। সভা শেষে তাই সবাই ছুটল কেন্দ্রীয় কারাগারের দিকে। আজও সেই সব স্মৃতি আমার মানসপটে ভেসে ওঠে। অর্ধলক্ষাধিক বিক্ষুব্ধ মানুষের মিছিলকে সেদিন কারাগারের সামনে থেকে আমরা ফিরিয়ে এনেছিলাম। এদিকে ১৪ ফেব্রুয়ারি পল্টনে ‘ডাক’-এর আহ্বানে জনসভা। সেদিনই বঙ্গবন্ধু আমায় কারাগারে ডাকেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা ক্যান্টনমেন্টের কারাগারে দেখা করাতে নিয়ে যান। মাজদা গাড়ি ড্রাইভ করেছিলেন শেখ কামাল। সেখানেই বঙ্গবন্ধু আমাকে বুকে জড়িয়ে আদর করেছিলেন। সেসব ভাবলে এখনো বুক ভরে যায়, দুই চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে। কী উষ্ণ ভালোবাসাই না ছিল বঙ্গবন্ধুর হূদয়জুড়ে। বিকেলে জনসভায় গেলে সভাপতি পদে নূরুল আমিনের নাম প্রস্তাব হলে জনতা তা প্রত্যাখ্যান করে। তখন আমাকে মঞ্চে নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর ছবি বুকে লাগিয়ে বক্তৃতায় জনতার সমর্থন আদায় করি এই বলে যে শেখ মুজিবের মুক্তি ছাড়া গোলটেবিল নয়। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন আমাদের নেতা জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। নেতা ফিরে আসবেন, তাঁকে মুক্ত না করে আমরা ঘরে ফিরব না। ওই রাতেই আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ফজলুল হককে কারাগারে গুলি করা হয়। সার্জেন্ট জহুর নিহত হন। প্রতিবাদে জনতা নেমে আসে রাজপথে। ১৫ থেকে ২০ ফেব্রুয়ারি আবার সান্ধ্য আইন জারি হয়। এরই মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. শামসুজ্জোহা গুলিতে মারা যান। ২০ তারিখ সান্ধ্য আইনের মধ্যে ঢাকা মশাল মিছিলের নগর হয়ে উঠলে সান্ধ্য আইন প্রত্যাহার করা হয়। ২১ তারিখ পল্টনের মহাসমুদ্র থেকে আলটিমেটাম ঘোষিত হয়, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দীকে মুক্তি দিতে হবে। ২২ ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টায় বঙ্গবন্ধু ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিসহ সব রাজবন্দীকে মুক্তি দিতে সরকার বাধ্য হয়। লাখ লাখ জনতা ছুটে যায় পল্টনে, তাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে দেখতে। কিন্তু শিক্ষা ভবনের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে আমরা ফিরিয়ে নিয়ে যাই ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাড়িতে। পল্টনে অধীর আগ্রহে থাকা জনতাকে বললাম, ২৩ ফেব্রুয়ারি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নেতার সংবর্ধনা। সেদিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেন জনতার বাঁধভাঙা জোয়ার। সভাপতিত্ব করলেও রীতিভঙ্গ করে নেতার আগেই বক্তৃতায় হূদয়ের গভীর থেকে উচ্চারিত হয় সত্যবচন, ‘যে নেতা তাঁর জীবনের যৌবন কাটিয়েছেন পাকিস্তানের কারাগারে; ফাঁসির মঞ্চে বাঙালির মুক্তির কথা বলেছেন, সেই নেতাকে কৃতজ্ঞচিত্তে জাতির পক্ষ থেকে একটি উপাধি দিতে চাই।’ ১০ লাখ লোক ২০ লাখ হাত উঁচিয়ে সম্মতি জানিয়েছিল। তখনই কৃতজ্ঞচিত্তে শেখ মুজিবকে জাতির পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনজোয়ারই শুধু নয়, সমগ্র জাতি তখন আনন্দ আর কৃতজ্ঞতায় আবেগাপ্লুত হয়েছিল। পল্টনে শপথ গ্রহণের ১৪ দিনের মাথায় বঙ্গবন্ধুসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দী এবং অপরাপর রাজনৈতিক নেতাকে আমরা মুক্ত করেছিলাম। দুই বছরের মাথায় প্রিয় নেতার নেতৃত্বে আমরা দীর্ঘ সংগ্রামের পথ মাড়িয়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে গণরায় নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করেছিলাম। ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘জাগো জাগো, বাঙালি জাগো’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’—হূদয় উজাড় করা স্লোগানে বাঙালি জাতি নেতার নির্দেশে এক স্রোতে দাঁড়িয়েছিল। ঊনসত্তরের ফাঁসির মঞ্চ থেকে ফিরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সংবর্ধনায় বঙ্গবন্ধু যে কথাগুলো বলেছিলেন, তা আজ খুব বেশি মনে পড়ে। তিনি ওই দিন বরাবরের মতো বাঙালি জাতিকে হূদয়ের গভীর ভালোবাসা দিয়ে ‘ভাইয়েরা আমার’ বলে সম্বোধন করে বলেছিলেন, ‘রক্ত দিয়ে, জীবন দিয়ে তোমরা যারা আমায় কারাগার থেকে মুক্ত করেছ, যদি কোনো দিন পারি, নিজের রক্ত দিয়ে হলেও সেই ঋণ শোধ করে যাব।’ জাতির জনক একা নন, সপরিবারে জাতির অধিকার রক্ষায় রক্ত দিয়ে সেই ঋণ পরিশোধ করে গেছেন।
তোফায়েল আহমেদ: সংসদ সদস্য, সভাপতি, শিল্প মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
No comments