আন্তর্জাতিক পানি আইন-বাংলাদেশ নীতিগত অনুমোদন দিচ্ছে না কেন? by মো. সিরাজুল ইসলাম
গত ২২ মার্চ ছিল বিশ্ব পানি দিবস। দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘পানি ও খাদ্যনিরাপত্তা’। একবিংশ শতাব্দীতে মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম হতে পারে পানি সমস্যা। এর সঙ্গে মানুষের জীবন ধারণ, খাদ্যনিরাপত্তাসহ অনেক উন্নয়ন কার্যক্রম জড়িত। কালের পরিক্রমায় পানির চাহিদা বেড়েছে বহু গুণে।
এরই সঙ্গে বেড়েছে এর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিবাদও। অনেকের মতে, তাই জ্বালানির পর পানিসংক্রান্ত বিবাদ এই শতাব্দীতে বিশ্ব শান্তির জন্য বড় রকমের হুমকিরও কারণ হতে পারে।
বিশ্ব শান্তি তথা এক বা একাধিক রাষ্ট্রের ভেতর স্বার্থ নিয়ে সংঘাত বা শান্তি ব্যাহত হতে পারে এ রকম বিষয়গুলো নিয়ে আজকের সভ্য দুনিয়ায় অনেক নতুন নতুন আইন তৈরি হচ্ছে, যার একটি উদাহরণ হতে পারে আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন। উল্লেখ্য, ১৯৮৪ সালে এই সমুদ্র আইনটি প্রস্তাবনা করা হয়—শর্ত ছিল, ৬০টি দেশ যদি এটি স্বাক্ষর তথা নীতিগতভাবে সমর্থন করে, যাকে ইংরেজিতে বলে রেটিফিকেশন, তবেই এটি একটি আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হবে। ১৯৯৪ সালে এসে সেই শর্ত পূরণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই, তখন থেকে এটি একটি অবশ্য পালনীয় আন্তর্জাতিক আইন হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে, যার প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার ন্যায্য সমুদ্রসীমা নিশ্চিত করতে পেরেছে। দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে এত সহজে নিশ্চিতভাবেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব হতো না।
এ ধরনের আন্তর্জাতিক আইন, প্রটোকল বা কনভেনশনের ক্ষেত্রে একেকটার একেক রকম শর্ত থাকে। যেমন কিয়োটো প্রটোকলের ক্ষেত্রে শর্ত ছিল যে ৫৫ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে, এমন কয়টি দেশ এ চুক্তি স্বাক্ষর করলেই এটি আইনে পরিণত হবে। আন্তদেশীয় পানিবণ্টন এবং অববাহিকা অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে পানির ন্যায্য ব্যবহার নিশ্চিতকরণের জন্যও এ ধরনের একটি আইন বহু দিন ধরে ঝুলে আছে পর্যাপ্ত সংখ্যক দেশের স্বাক্ষরের অপেক্ষায়। দি কনভেনশন অন দ্য ল অব নন-নেভিগেশনাল ইউজেস অব ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটারকোর্সেস নামের এই খসরা আইন জাতিসংঘে উপস্থাপন করা হয় ২১ মে, ১৯৯৭ সালে। বাংলাদেশসহ ১০৩টি দেশ এ আইনের পক্ষে সায় দেয় আর বিপক্ষে মাত্র তিনটি দেশ। ভারতসহ ২৭টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। খসরাটি অবশ্য পালনীয় আইনে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত নির্ধারণ করা হয় যে ৩৫টি দেশকে কনভেনশনটি নীতিগতভাবে করতে হবে। হতাশার বিষয় হচ্ছে, প্রায় ১৫ বছর পার হওয়ার পর মাত্র ২৪টি দেশ এটি স্বাক্ষর করেছে। এর পরও আশাব্যঞ্জক এই যে যেখানে ২০০৮ পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল মাত্র ১৬টি, ২০১২ সালে এসে তা বেশ দ্রুত বেড়ে ২৪-এ দাঁড়িয়েছে। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে যে বাংলাদেশ এখনো আইনটি নীতিগতভাবে অনুমোদন বা স্বাক্ষর করেনি।
সংগত কারণে প্রশ্ন জাগে, কেন করেনি? সাধারণ জ্ঞান থেকেই এটা স্পষ্ট হয় যে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এ আইনকে একটি আশার আলো হিসেবে দেখবে। এ বিষয়ে জানার জন্য আমার শিক্ষক আইনুন নিশাতের শরণাপন্ন হয়েছিলাম। তিনি জানালেন, বিশেষজ্ঞ মত জানার জন্য তিনিসহ কয়েকজনের পরামর্শ চাওয়া হয়েছিল এবং তাঁরা আইনটি অতিসত্বর স্বাক্ষর করার জন্যই বলেছিলেন। আইনটিতে ‘সমতা’ ও ‘ন্যায্যতার’ ভিক্তিতে পানিবণ্টন ও ‘ভাটির দেশের কোনো ক্ষতি হয়, উজানের দেশের এমন কিছু করা উচিত নয়’ বলে নির্দেশনা দেওয়া আছে। ভাটি ও উজানের দেশের মধ্যে সার্বক্ষণিক তথ্য বিনিময়ের কথা বলা আছে, যেকোনো প্রকল্প গ্রহণের আগে পর্যাপ্ত সমীক্ষার কথা আছে—সংক্ষুব্ধ দেশের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপনের আগে আলোচনারও সুযোগ আছে। যদিও অনেকের মতে, উজান-ভাটির পানিবণ্টনের বিষয়গুলোতে এখনো কিছুটা অস্পষ্টতা আছে, তার পরও আমার কাছে নিশ্চিতভাবেই মনে হয়েছে যে বাংলাদেশের মতো একটি ভাটির দেশের জন্য এটি একমাত্র ভরসার স্থল হতে পারে। আর এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উচিত ছিল এই আইনে স্বাক্ষরের পাশাপাশি অন্য দেশগুলোও যাতে এই আইনে স্বাক্ষর করে সে ব্যাপারে প্রচারণা চালানো। এবং অতি দ্রুত ৩৫টি দেশ সে তালিকায় যুক্ত হয়।
ঐতিহাসিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলে ঘন লোকবসতির কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল এখানকার সহনীয় জলবায়ু, পর্যাপ্ত পানির প্রাপ্যতা ও নদীবিধৌত উর্বর ভূমি। পানির সঙ্গে ওতপোতভাবে জড়িয়ে আছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা, এমনকি আবহাওয়া-প্রকৃতিও। নদী আর পানিবিহীন বাংলাদেশ কল্পনাই করা যায় না। ৫৫ হাজার বর্গমাইলের দেশটিতে যে ১৫ কোটি লোক বাস করছে তার কারণ এর সুজলা-সুফলা প্রকৃতি। এবারকার পানি দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়টির সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে হয়, পানি না থাকার মানে এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া তথা জীবন বিপন্ন হওয়া।
সমুদ্র আইনের মতো পানি আইনে কোনো বিবাদের মীমাংসা ঠিক ততটা সহজ হবে এমন ভাবার কোন কারণ নেই। নদীর পানির ওপর উজানের অধিবাসীদেরও অধিকার আছে, আর সে ক্ষেত্রে যদি উত্তরাঞ্চল থেকেই গঙ্গা নদীর পানি প্রত্যাহার শুরু হয় তাহলে কী হবে? আছে পানির বহুবিধ ব্যবহারও, যেমন একটি নদীর পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্যও কিছু পানি রাখতে হয়, আবার নৌ চলাচল করলে তার জন্য রাখতে হবে পানি। শুধু পানির পরিমাণই নয়, এক দেশ থেকে অন্য দেশে পানি প্রবেশের সময় তার গুণগত মান কেমন হবে, এটাও একটি বিবেচনার বিষয়। ইউরোপে রাইন নদীর চুক্তিতে এটাও দেখা হয় ইত্যাদি।
ঠিক এই মুহূর্তে এ ধরনের একটি আন্তর্জাতিক আইনের অভাব সত্ত্বেও পৃথিবীর অনেক অঞ্চল যে সফলভাবে পানিবণ্টন সমস্যার সমাধান করছে না, তাও কিন্তু নয়। মেকং, রাইন বা নীল নদ কমিশন মোটামুটি সফল কিছু উদাহরণ হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে সাধারণ সূত্র হচ্ছে, চুক্তিতে অংশগ্রহণকারী দেশের সংখ্যা যত বেশি হয়, চুক্তিটি সফল হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। কেননা এ ক্ষেত্রে একটি দেশের একচ্ছত্র আধিপত্যের সুযোগ কম থাকে। আমাদের যৌথ নদী কমিশনে যদি চীন, নেপাল, ভুটান ইত্যাদি অববাহিকাভিত্তিক সব দেশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যেত, তাহলে এটি সম্ভবত অধিক কার্যকর হতো। আর, আন্তর্জাতিক পানি আইনটি কার্যকর হওয়ার পরও দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সুযোগ তো আছেই। বরং দর-কষাকষির সুবিধাটা বাড়বে বৈকি। এই যেমন মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা মীমাংসার পর ভারত নিজ থেকেই এখন দ্বিপক্ষীয় আলোচনার প্রস্তাব দিচ্ছে।
আমরা আশাবাদী, আজকের দুনিয়ার অনেক বিবদমান ইস্যুই অদূর ভবিষ্যতে ‘ন্যায্যতা’ ও ‘সমতা’ভিত্তিক আইনের মাধ্যমে সমাধান সম্ভব। সমুদ্র আইনে সফলতার পর বিষয়টি যে হেলাফেলা নয় এবং আশা আরও বেড়েছে। আন্তর্জাতিক এই পানি আইনটির ব্যাপারেও তাই দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের পর্যাপ্ত মনোযোগ কামনা করছি।
মো. সিরাজুল ইসলাম: পানি ও পরিবেশ প্রকৌশলী, সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, পরিবেশবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।
sirajulnorthsouth.edu
বিশ্ব শান্তি তথা এক বা একাধিক রাষ্ট্রের ভেতর স্বার্থ নিয়ে সংঘাত বা শান্তি ব্যাহত হতে পারে এ রকম বিষয়গুলো নিয়ে আজকের সভ্য দুনিয়ায় অনেক নতুন নতুন আইন তৈরি হচ্ছে, যার একটি উদাহরণ হতে পারে আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইন। উল্লেখ্য, ১৯৮৪ সালে এই সমুদ্র আইনটি প্রস্তাবনা করা হয়—শর্ত ছিল, ৬০টি দেশ যদি এটি স্বাক্ষর তথা নীতিগতভাবে সমর্থন করে, যাকে ইংরেজিতে বলে রেটিফিকেশন, তবেই এটি একটি আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হবে। ১৯৯৪ সালে এসে সেই শর্ত পূরণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই, তখন থেকে এটি একটি অবশ্য পালনীয় আন্তর্জাতিক আইন হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে, যার প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার ন্যায্য সমুদ্রসীমা নিশ্চিত করতে পেরেছে। দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে এত সহজে নিশ্চিতভাবেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব হতো না।
এ ধরনের আন্তর্জাতিক আইন, প্রটোকল বা কনভেনশনের ক্ষেত্রে একেকটার একেক রকম শর্ত থাকে। যেমন কিয়োটো প্রটোকলের ক্ষেত্রে শর্ত ছিল যে ৫৫ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে, এমন কয়টি দেশ এ চুক্তি স্বাক্ষর করলেই এটি আইনে পরিণত হবে। আন্তদেশীয় পানিবণ্টন এবং অববাহিকা অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে পানির ন্যায্য ব্যবহার নিশ্চিতকরণের জন্যও এ ধরনের একটি আইন বহু দিন ধরে ঝুলে আছে পর্যাপ্ত সংখ্যক দেশের স্বাক্ষরের অপেক্ষায়। দি কনভেনশন অন দ্য ল অব নন-নেভিগেশনাল ইউজেস অব ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটারকোর্সেস নামের এই খসরা আইন জাতিসংঘে উপস্থাপন করা হয় ২১ মে, ১৯৯৭ সালে। বাংলাদেশসহ ১০৩টি দেশ এ আইনের পক্ষে সায় দেয় আর বিপক্ষে মাত্র তিনটি দেশ। ভারতসহ ২৭টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। খসরাটি অবশ্য পালনীয় আইনে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে শর্ত নির্ধারণ করা হয় যে ৩৫টি দেশকে কনভেনশনটি নীতিগতভাবে করতে হবে। হতাশার বিষয় হচ্ছে, প্রায় ১৫ বছর পার হওয়ার পর মাত্র ২৪টি দেশ এটি স্বাক্ষর করেছে। এর পরও আশাব্যঞ্জক এই যে যেখানে ২০০৮ পর্যন্ত এ সংখ্যা ছিল মাত্র ১৬টি, ২০১২ সালে এসে তা বেশ দ্রুত বেড়ে ২৪-এ দাঁড়িয়েছে। তবে সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে যে বাংলাদেশ এখনো আইনটি নীতিগতভাবে অনুমোদন বা স্বাক্ষর করেনি।
সংগত কারণে প্রশ্ন জাগে, কেন করেনি? সাধারণ জ্ঞান থেকেই এটা স্পষ্ট হয় যে ভাটির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ এ আইনকে একটি আশার আলো হিসেবে দেখবে। এ বিষয়ে জানার জন্য আমার শিক্ষক আইনুন নিশাতের শরণাপন্ন হয়েছিলাম। তিনি জানালেন, বিশেষজ্ঞ মত জানার জন্য তিনিসহ কয়েকজনের পরামর্শ চাওয়া হয়েছিল এবং তাঁরা আইনটি অতিসত্বর স্বাক্ষর করার জন্যই বলেছিলেন। আইনটিতে ‘সমতা’ ও ‘ন্যায্যতার’ ভিক্তিতে পানিবণ্টন ও ‘ভাটির দেশের কোনো ক্ষতি হয়, উজানের দেশের এমন কিছু করা উচিত নয়’ বলে নির্দেশনা দেওয়া আছে। ভাটি ও উজানের দেশের মধ্যে সার্বক্ষণিক তথ্য বিনিময়ের কথা বলা আছে, যেকোনো প্রকল্প গ্রহণের আগে পর্যাপ্ত সমীক্ষার কথা আছে—সংক্ষুব্ধ দেশের আনুষ্ঠানিক অভিযোগ উপস্থাপনের আগে আলোচনারও সুযোগ আছে। যদিও অনেকের মতে, উজান-ভাটির পানিবণ্টনের বিষয়গুলোতে এখনো কিছুটা অস্পষ্টতা আছে, তার পরও আমার কাছে নিশ্চিতভাবেই মনে হয়েছে যে বাংলাদেশের মতো একটি ভাটির দেশের জন্য এটি একমাত্র ভরসার স্থল হতে পারে। আর এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উচিত ছিল এই আইনে স্বাক্ষরের পাশাপাশি অন্য দেশগুলোও যাতে এই আইনে স্বাক্ষর করে সে ব্যাপারে প্রচারণা চালানো। এবং অতি দ্রুত ৩৫টি দেশ সে তালিকায় যুক্ত হয়।
ঐতিহাসিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলে ঘন লোকবসতির কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল এখানকার সহনীয় জলবায়ু, পর্যাপ্ত পানির প্রাপ্যতা ও নদীবিধৌত উর্বর ভূমি। পানির সঙ্গে ওতপোতভাবে জড়িয়ে আছে এ অঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা, এমনকি আবহাওয়া-প্রকৃতিও। নদী আর পানিবিহীন বাংলাদেশ কল্পনাই করা যায় না। ৫৫ হাজার বর্গমাইলের দেশটিতে যে ১৫ কোটি লোক বাস করছে তার কারণ এর সুজলা-সুফলা প্রকৃতি। এবারকার পানি দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়টির সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলতে হয়, পানি না থাকার মানে এ অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া তথা জীবন বিপন্ন হওয়া।
সমুদ্র আইনের মতো পানি আইনে কোনো বিবাদের মীমাংসা ঠিক ততটা সহজ হবে এমন ভাবার কোন কারণ নেই। নদীর পানির ওপর উজানের অধিবাসীদেরও অধিকার আছে, আর সে ক্ষেত্রে যদি উত্তরাঞ্চল থেকেই গঙ্গা নদীর পানি প্রত্যাহার শুরু হয় তাহলে কী হবে? আছে পানির বহুবিধ ব্যবহারও, যেমন একটি নদীর পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্যও কিছু পানি রাখতে হয়, আবার নৌ চলাচল করলে তার জন্য রাখতে হবে পানি। শুধু পানির পরিমাণই নয়, এক দেশ থেকে অন্য দেশে পানি প্রবেশের সময় তার গুণগত মান কেমন হবে, এটাও একটি বিবেচনার বিষয়। ইউরোপে রাইন নদীর চুক্তিতে এটাও দেখা হয় ইত্যাদি।
ঠিক এই মুহূর্তে এ ধরনের একটি আন্তর্জাতিক আইনের অভাব সত্ত্বেও পৃথিবীর অনেক অঞ্চল যে সফলভাবে পানিবণ্টন সমস্যার সমাধান করছে না, তাও কিন্তু নয়। মেকং, রাইন বা নীল নদ কমিশন মোটামুটি সফল কিছু উদাহরণ হতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে সাধারণ সূত্র হচ্ছে, চুক্তিতে অংশগ্রহণকারী দেশের সংখ্যা যত বেশি হয়, চুক্তিটি সফল হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি। কেননা এ ক্ষেত্রে একটি দেশের একচ্ছত্র আধিপত্যের সুযোগ কম থাকে। আমাদের যৌথ নদী কমিশনে যদি চীন, নেপাল, ভুটান ইত্যাদি অববাহিকাভিত্তিক সব দেশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা যেত, তাহলে এটি সম্ভবত অধিক কার্যকর হতো। আর, আন্তর্জাতিক পানি আইনটি কার্যকর হওয়ার পরও দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সুযোগ তো আছেই। বরং দর-কষাকষির সুবিধাটা বাড়বে বৈকি। এই যেমন মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা মীমাংসার পর ভারত নিজ থেকেই এখন দ্বিপক্ষীয় আলোচনার প্রস্তাব দিচ্ছে।
আমরা আশাবাদী, আজকের দুনিয়ার অনেক বিবদমান ইস্যুই অদূর ভবিষ্যতে ‘ন্যায্যতা’ ও ‘সমতা’ভিত্তিক আইনের মাধ্যমে সমাধান সম্ভব। সমুদ্র আইনে সফলতার পর বিষয়টি যে হেলাফেলা নয় এবং আশা আরও বেড়েছে। আন্তর্জাতিক এই পানি আইনটির ব্যাপারেও তাই দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের পর্যাপ্ত মনোযোগ কামনা করছি।
মো. সিরাজুল ইসলাম: পানি ও পরিবেশ প্রকৌশলী, সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, পরিবেশবিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।
sirajulnorthsouth.edu
No comments