আলোকের এই ধরনাধারায় (পর্ব-২১)-নতুন দেশে তাঁর ঠাই হলো না by আলী যাকের
আজ আমি আমার কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কথা উল্লেখ করতে চাই, যাঁরা আমার জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। বস্তুতপক্ষে স্কুল ছাড়ার পর থেকেই আমার সত্যিকারের শিক্ষা অর্জন শুরু এবং বিশ্ববিদ্যালয় পেরোবার পরই আমার সত্যিকারের পড়াশোনা শুরু হয়েছিল।
তবে এসব বিষয়ে আলোচনার অবতারণা করব আরো পরে। আজ গেণ্ডারিয়ায় ফিরে যাই, আবার সেই কৈশোর থেকে যৌবনে উত্তরণের সময়ে।
সেই কবেকার কথা। এক কিশোর তার বড় বোনের সঙ্গে রিকশায় করে চলেছে আরমানিটোলার দিকে। সেখানে নৃত্যনাট্য হবে_রবীন্দ্রনাথের 'শ্যামা'। শান্তিনিকেতন থেকে এসেছে চৌকস শিল্পী সমন্বয়ে একটি দল, যাদের নিবেদন ওই সন্ধ্যায় এই শ্যামা নাটক। কিশোরের মনে কৌতূহল আছে, তবে তেমন প্রগাঢ় কোনো আগ্রহ নেই। কিশোর তখনো শান্তিনিকেতন চেনে না, রবীন্দ্রনাথের শ্যামা তো নিতান্তই অপরিচিত। বারবার প্রশ্ন করে সে তার দিদিকে, 'শ্যামা আসলে কী দিদি?' দিদি কথা এড়িয়ে যান। বলেন, 'দেখলেই বুঝতে পারবি।' দিদির হাত ধরে কিশোরটি ঢোকে ঢাকার আরমানিটোলায় অবস্থিত শাবিস্তান সিনেমা হলে। হলের মাঝামাঝি দুটো সিটে দুজন গিয়ে বসে। অল্পক্ষণের মধ্যে শুরু হয় বাদ্যের ঝংকার এবং সুমধুর কণ্ঠে গান। তার পরই শুরু হয় সংলাপ, যা এই কিশোর জীবনেও কোনো দিন শোনেনি। আস্তে আস্তে নিজের অজান্তে কিশোরটি রবীন্দ্রনাথের শ্যামা নৃত্যনাট্যে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়। সব ছাপিয়ে তার মরমে প্রবেশ করে একটি বিশেষ কণ্ঠস্বর। সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে, 'ধরা সে যে দেয় নাই, দেয় নাই।' বারবার ফিরে আসে সেই সুর। কী এক রোমাঞ্চে শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যায় যেন বিদ্যুতের চমক এক। এই প্রথম কিশোরের বোধের অজান্তে ঘটে যায় বোধেরও অধিক এক রূপান্তর। মন ভিজে আসে, মন ভেসে যায়। কোথায় কোন সুদূর থেকে বারবার ভেসে আসে সেই কথা, 'ধরা সে যে দেয় নাই, দেয় নাই।' দিদি জিজ্ঞেস করেন, 'কেমন লাগছে?' কিশোর দিদির দিকে তাকায়। তার শরীর ন্যুব্জ হয়ে আসে, রাঙা হয়ে ওঠে সে লজ্জায়। কী বলবে ভেবে পায় না সে। কেমন লাগছে? এ যে সুখ-স্বর্গে অবগাহনেরও অধিক। এই প্রথম কিশোরটি তার অন্তর দিয়ে অনুভব করে হার্দিক এবং শরীরী প্রেম কাকে বলে। কখন শেষ হয়ে যায় শ্যামা, সে বুঝতে পারে না। মোহগ্রস্ত কিশোর হল থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে দিদিকে জিজ্ঞেস করে, 'উনি কে ছিলেন?' দিদি যেন বুঝতে পারেন তার মনের কথা। বলে ওঠেন, 'মোহর, মোহর দি, কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়।' কিশোর রিকশায় বসে আনমনে নিঃশব্দে উচ্চারণ করে, 'মোহর, মোহর'।
শ্যামার কাছাকাছি সময়ে ওই শাবিস্তান সিনেমা হলেই কলকাতার বহুরূপী নাট্যদল নিয়ে আসে তাদের প্রযোজনায় রবীন্দ্রনাথের 'রক্তকরবী'। এই সময় আরো কিছু অনন্যসাধারণ ঘটনা ঘটে ঢাকার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। ধ্রুপদী সংগীতের একটি সম্মেলনে নামজাদা সব অবাঙালি ক্লাসিক্যাল শিল্পীরা ঢাকার গুলিস্তান সিনেমা হলে অংশগ্রহণ করেন। আমি সেই সময় বহরূপীর 'রক্তকরবী' দেখিনি। দেখেছি আরো অনেক পরে, কলকাতার নিউ এম্পায়ার থিয়েটারে। অসাধারণ ছিল পরিবেশনা! সেই সময়ের তুলনায় এই প্রযোজনা উন্নত ছিল নিশ্চয়ই, সে কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করা যায়। বলছিলাম গুলিস্তান সিনেমা হলে ধ্রুপদী সংগীতের উৎসবের প্রসঙ্গ কথা। ওই অনুষ্ঠানে আমার যাওয়া হয়নি। যাওয়ার কথাও নয়। নিতান্তই স্বল্প বয়সী কিশোর ধ্রুপদী সংগীতের কি-ই বা বুঝি। তবে গল্প শুনেছিলাম। আর গল্পটা মজার। ওই অনুষ্ঠানে উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান ঠুমরি গাইছিলেন। ঠুমরি গানে অমন পারদর্শিতা তাঁর অগ্রজপ্রতিম খাঁ সাহেব আবদুল করীম খাঁ ছাড়া আর কারো ছিল বলে আমাদের জানা নেই। তো ওই অনুষ্ঠানে বড়ে গোলাম আলী খান ঠুমরি গাওয়া শেষ করে তানপুরায় সুর বেঁধে যখন খেয়াল গাইবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, তখন দর্শকসারি থেকে এক পদস্থ পাকিস্তানি আমলা তাঁকে একটি চটুল সংগীত পরিবেশন করতে অনুরোধ করেন। তানপুরার তারের ওপরে তার আঙুল থেমে যায়। তিনি অল্প কিছুক্ষণ দর্শকদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর আস্তে আস্তে তানপুরাটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ান, দর্শকদের উদ্দেশে মৃদুস্বরে বলেন, 'আমার বাজনা শোনার জন্য আপনাদের অশেষ ধন্যবাদ।' তারপর ধীরপায়ে মঞ্চ থেকে বাইরে বেরিয়ে যান। এর কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে চলে যান। সেখানে তাঁর নিবাস হয় কলকাতা। কলকাতা তথা সারা ভারতের মানুষ ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খানকে মাথায় তুলে রাখতেন। বড় শখ করে গোলাম আলী খান এসেছিলেন ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে। নতুন দেশে তাঁর ঠাঁই হলো না। আমরা পরে বড় কষ্ট করে বুঝেছি যে পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্রে শুদ্ধ সংস্কৃতির সম্মানজনক স্বীকৃতি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই ধ্রুপদী শিল্পকলার শিল্পীরা ঘন ঘন ভারতে যান অর্থ এবং স্বীকৃতির আশায়। (চলবে...)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
সেই কবেকার কথা। এক কিশোর তার বড় বোনের সঙ্গে রিকশায় করে চলেছে আরমানিটোলার দিকে। সেখানে নৃত্যনাট্য হবে_রবীন্দ্রনাথের 'শ্যামা'। শান্তিনিকেতন থেকে এসেছে চৌকস শিল্পী সমন্বয়ে একটি দল, যাদের নিবেদন ওই সন্ধ্যায় এই শ্যামা নাটক। কিশোরের মনে কৌতূহল আছে, তবে তেমন প্রগাঢ় কোনো আগ্রহ নেই। কিশোর তখনো শান্তিনিকেতন চেনে না, রবীন্দ্রনাথের শ্যামা তো নিতান্তই অপরিচিত। বারবার প্রশ্ন করে সে তার দিদিকে, 'শ্যামা আসলে কী দিদি?' দিদি কথা এড়িয়ে যান। বলেন, 'দেখলেই বুঝতে পারবি।' দিদির হাত ধরে কিশোরটি ঢোকে ঢাকার আরমানিটোলায় অবস্থিত শাবিস্তান সিনেমা হলে। হলের মাঝামাঝি দুটো সিটে দুজন গিয়ে বসে। অল্পক্ষণের মধ্যে শুরু হয় বাদ্যের ঝংকার এবং সুমধুর কণ্ঠে গান। তার পরই শুরু হয় সংলাপ, যা এই কিশোর জীবনেও কোনো দিন শোনেনি। আস্তে আস্তে নিজের অজান্তে কিশোরটি রবীন্দ্রনাথের শ্যামা নৃত্যনাট্যে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়। সব ছাপিয়ে তার মরমে প্রবেশ করে একটি বিশেষ কণ্ঠস্বর। সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনে, 'ধরা সে যে দেয় নাই, দেয় নাই।' বারবার ফিরে আসে সেই সুর। কী এক রোমাঞ্চে শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে যায় যেন বিদ্যুতের চমক এক। এই প্রথম কিশোরের বোধের অজান্তে ঘটে যায় বোধেরও অধিক এক রূপান্তর। মন ভিজে আসে, মন ভেসে যায়। কোথায় কোন সুদূর থেকে বারবার ভেসে আসে সেই কথা, 'ধরা সে যে দেয় নাই, দেয় নাই।' দিদি জিজ্ঞেস করেন, 'কেমন লাগছে?' কিশোর দিদির দিকে তাকায়। তার শরীর ন্যুব্জ হয়ে আসে, রাঙা হয়ে ওঠে সে লজ্জায়। কী বলবে ভেবে পায় না সে। কেমন লাগছে? এ যে সুখ-স্বর্গে অবগাহনেরও অধিক। এই প্রথম কিশোরটি তার অন্তর দিয়ে অনুভব করে হার্দিক এবং শরীরী প্রেম কাকে বলে। কখন শেষ হয়ে যায় শ্যামা, সে বুঝতে পারে না। মোহগ্রস্ত কিশোর হল থেকে বেরিয়ে আসতে আসতে দিদিকে জিজ্ঞেস করে, 'উনি কে ছিলেন?' দিদি যেন বুঝতে পারেন তার মনের কথা। বলে ওঠেন, 'মোহর, মোহর দি, কনিকা বন্দ্যোপাধ্যায়।' কিশোর রিকশায় বসে আনমনে নিঃশব্দে উচ্চারণ করে, 'মোহর, মোহর'।
শ্যামার কাছাকাছি সময়ে ওই শাবিস্তান সিনেমা হলেই কলকাতার বহুরূপী নাট্যদল নিয়ে আসে তাদের প্রযোজনায় রবীন্দ্রনাথের 'রক্তকরবী'। এই সময় আরো কিছু অনন্যসাধারণ ঘটনা ঘটে ঢাকার সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। ধ্রুপদী সংগীতের একটি সম্মেলনে নামজাদা সব অবাঙালি ক্লাসিক্যাল শিল্পীরা ঢাকার গুলিস্তান সিনেমা হলে অংশগ্রহণ করেন। আমি সেই সময় বহরূপীর 'রক্তকরবী' দেখিনি। দেখেছি আরো অনেক পরে, কলকাতার নিউ এম্পায়ার থিয়েটারে। অসাধারণ ছিল পরিবেশনা! সেই সময়ের তুলনায় এই প্রযোজনা উন্নত ছিল নিশ্চয়ই, সে কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করা যায়। বলছিলাম গুলিস্তান সিনেমা হলে ধ্রুপদী সংগীতের উৎসবের প্রসঙ্গ কথা। ওই অনুষ্ঠানে আমার যাওয়া হয়নি। যাওয়ার কথাও নয়। নিতান্তই স্বল্প বয়সী কিশোর ধ্রুপদী সংগীতের কি-ই বা বুঝি। তবে গল্প শুনেছিলাম। আর গল্পটা মজার। ওই অনুষ্ঠানে উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খান ঠুমরি গাইছিলেন। ঠুমরি গানে অমন পারদর্শিতা তাঁর অগ্রজপ্রতিম খাঁ সাহেব আবদুল করীম খাঁ ছাড়া আর কারো ছিল বলে আমাদের জানা নেই। তো ওই অনুষ্ঠানে বড়ে গোলাম আলী খান ঠুমরি গাওয়া শেষ করে তানপুরায় সুর বেঁধে যখন খেয়াল গাইবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন, তখন দর্শকসারি থেকে এক পদস্থ পাকিস্তানি আমলা তাঁকে একটি চটুল সংগীত পরিবেশন করতে অনুরোধ করেন। তানপুরার তারের ওপরে তার আঙুল থেমে যায়। তিনি অল্প কিছুক্ষণ দর্শকদের দিকে তাকিয়ে থাকেন। তারপর আস্তে আস্তে তানপুরাটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ান, দর্শকদের উদ্দেশে মৃদুস্বরে বলেন, 'আমার বাজনা শোনার জন্য আপনাদের অশেষ ধন্যবাদ।' তারপর ধীরপায়ে মঞ্চ থেকে বাইরে বেরিয়ে যান। এর কয়েক দিনের মধ্যেই তিনি পাকিস্তান ছেড়ে ভারতে চলে যান। সেখানে তাঁর নিবাস হয় কলকাতা। কলকাতা তথা সারা ভারতের মানুষ ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খানকে মাথায় তুলে রাখতেন। বড় শখ করে গোলাম আলী খান এসেছিলেন ভারত ছেড়ে পাকিস্তানে। নতুন দেশে তাঁর ঠাঁই হলো না। আমরা পরে বড় কষ্ট করে বুঝেছি যে পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্রে শুদ্ধ সংস্কৃতির সম্মানজনক স্বীকৃতি পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই ধ্রুপদী শিল্পকলার শিল্পীরা ঘন ঘন ভারতে যান অর্থ এবং স্বীকৃতির আশায়। (চলবে...)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments