ধান কাটা থেকে ঘরে তোলা পর্যন্ত ক্ষতির হিসাব by ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস
আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের ফসলের কর্তনোত্তর ক্ষতিবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ড. গুমের্টের মতে, ধানের কর্তনোত্তর ক্ষতির পরিমাণ ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। এর প্রধান কারণ ধান কাটতে দেরি করা, যথাসময়ে শ্রমিক না পাওয়া, যেনতেনভাবে ধান শুকানো ও গোলাজাত করা, সাধারণ মানের পুরনো চাল ছাঁটাই যন্ত্র ব্যবহার করা ইত্যাদি।
এ ছাড়া তাঁর মতে, চালের গুণাগুণ একটি জরুরি বিষয়। ধান ভালোভাবে শুকিয়ে যদি ঠিকমতো গোলাজাত করা না যায়, তাহলে চালের মান খারাপ হতে বাধ্য। ফলে চালের প্রকৃত বাজারও পাওয়া যায় না। অনেক সময় গোলাজাতকরণের সমস্যার কারণে যথেষ্ট দাম পাওয়ার আগেই চাল বিক্রি করে দিতে হয়।
আমাদের দেশে কর্তনোত্তর ধানের ক্ষতি নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা হয়েছে ১৯৮৩-৮৪ সালে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সহযোগিতায় এ গবেষণাকার্য পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ড. নূরুল হক চৌধুরী, মো. আবুল কাসেম প্রমুখ বিজ্ঞানী এ কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মো. আবুল কাসেমের মতে, এই গবেষণা কর্মকাণ্ড বেশ আগের হলেও আমাদের কিন্তু ওই পরিস্থিতি থেকে সামান্যই উত্তরণ ঘটেছে। কারণ তাঁর মতে, কর্তনোত্তর কর্মকাণ্ডে চাষি পর্যায়ে যে ধরনের সচেতনতা এবং যান্ত্রিকীকরণ দরকার ছিল, তা এখনো করা যায়নি। তাঁর ভাষায়, এ পর্যায়ে ধান মাড়াই যন্ত্রের ব্যবহার বেশ বাড়লেও অন্যান্য অন্তর্বর্তীকালীন কর্তনোত্তর পরিচর্যার জন্য যেসব ব্যবস্থা করা দরকার ছিল, সেগুলো এখনো তেমনটা হয়নি বলা যায়।
তাঁরা (ড. চৌধুরী ও কাসেম) বাংলাদেশের ঢাকা, সিলেট, রাজশাহী ও বগুড়ায় আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমের জন্য এই গবেষণা করেন। তাঁদের গবেষণা অনুযায়ী, ধান কাটার সময় ক্ষতির (কর্তনোত্তর ক্ষতি) পরিমাণ ১.১৪ থেকে ২.৫ শতাংশ। মাড়াইজনিত ক্ষতির পরিমাণ ০.৭৭ থেকে ০.৯৮ শতাংশ। ধান শুকানো ও সিদ্ধজনিত ক্ষতির পরিমাণ ১.৬৩ থেকে ১.৮৪ শতাংশ। ধান থেকে চাল বানাতে যে ক্ষতি হয়, তার পরিমাণ ৩.২৮ থেকে ৪.৫৪ শতাংশ। গোলাজাতকালে ক্ষতির পরিমাণ ০.৩০ থেকে ১.২০ শতাংশ। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ ১৩.০ থেকে ১৩.৭২ শতাংশ। উল্লেখ্য, আউশ, আমন ও বোরোর জন্য এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় একই রকম।
এসব ক্ষতি কিভাবে হয়, একটু দেখা যাক। একটি জমির ধান কাটার উপযুক্ত সময় তখন, যখন ৮০ শতাংশ ধান পেকে যায়। এর বেশি পাকাতে গেলে অবশ্যই কিছু ধান আপনাআপনিই ঝরে পড়বে। আবার কম পাকলে কিছু ধান কাঁচা থেকে যাবে। এর মাঝামাঝি অবস্থার জন্য ৮০ শতাংশ একটা ভালো বিবেচনা। বোরো বা আউশ মৌসুমে অনেক সময় ধান পাকানোর পুরো সময় পাওয়া যায় না। এবার যেমন বহু ধানের জমি পাকার আগেই পাহাড়ি ঢলে ডুবে গেল, আউশের বেলায়ও এমন ঘটতে পারে। এ ক্ষেত্রে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ষোলো আনা। আমন মৌসুমে ধান পাকার পরও জমিতে অনেক দিন পড়ে থাকতে দেখা যায়। ধান বেশি পেকে যায়। এ অবস্থায় প্রচুর ধান ঝরে পড়ে যায়। তবে এ ক্ষেত্রেও পাকা ধানের ৮০ শতাংশ মার্জিন ঠিক রেখে কাটতে পারলে ক্ষতির পরিমাণ অবশ্যই কমিয়ে আনা যায়। জমিতে ধান কাটার অপেক্ষায় থাকার প্রধান কারণ শ্রমিকের অভাব। এ জন্য ধান কাটা যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে তেমন কোনো সাশ্রয়ী ধান কাটা যন্ত্র এখনো প্রচলন করা সম্ভব হয়নি। কিছু সরকারি খামারে কম্বাইন্ড হারভেস্টার ব্যবহৃত হচ্ছে। চাষিরা নিজেদের মধ্যে সমবায়ী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে হয়তো এ ধরনের হার্ভেস্টারের প্রচলন করতে পারে। কিন্তু এর মাধ্যমে শ্রমিক বাঁচিয়ে সময়মতো ধান কাটা সম্ভব হলেও কর্তনজনিত ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা আরো গবেষণা করে দেখতে পারেন। এবার ধান মাড়াইয়ের ব্যাপারটা দেখা যাক। আমাদের দেশে ধান মাড়াইয়ের গতানুগতিক পদ্ধতি হলো শক্ত কোনো কিছুর ওপর ধানের আঁটি বাড়ি (আঘাত) দিয়ে মাড়াই এবং গরু দিয়ে মাড়াই করা। বর্তমানে পা বা শক্তি চালিত মাড়াই যন্ত্র দিয়ে ধান মাড়াই করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ধানের আঁটি বাড়ি দিয়ে মাড়াই করতে গিয়ে অপচয় বেশি হয় এবং মাড়াই যন্ত্র দিয়ে মাড়াই করলে ক্ষতির পরিমাণ কম হয়।
ধান শুকানোর ব্যাপারে আমাদের চাষিদের যথেষ্ট ধকল সইতে হয়। আমাদের দেশে ধান শুকানো হয় যেখানে-সেখানে। হাওর এলাকায় বোরো ধান শুকানো এবং আষাঢ় মাসে আউশ ধান শুকানো যথেষ্ট বিড়ম্বনাকর। ওই সময় প্রচুর ধান গজিয়ে গিয়ে বা অন্য উপায়ে নষ্ট হয়ে থাকে। এসব ধানের যেমন বীজ রাখা যায় না, তেমনি ধানের গুণও নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু এই বিড়ম্ব্বনা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের দেশে এখনো সুবিধাজনক কোনো ধান শুকানোর যন্ত্রের প্রচলন করা যায়নি। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে বিভিন্ন সময় কিছু যন্ত্র উদ্ভাবিত হলেও বিভিন্ন কারণে সেগুলোর উপযোগিতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে এ ব্যাপারে ভিয়েতনাম বেশ এগিয়ে আছে বলে জানা যায়। ভিয়েতনাম এবং আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের যৌথ প্রচেষ্টায় স্বল্প পরিসরে ব্যবহারোপযোগী ধান শুকানোর যন্ত্র কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশে বেশ ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করতে পারেন।
বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ সিদ্ধ চাল খেতে অভ্যস্ত। আর এই সিদ্ধ করতে গিয়ে অতিরিক্ত কিছু ঝামেলার শিকার হতে হয়। প্রথমত, একবার শুকানো ধান, আবার ভিজিয়ে নির্দিষ্ট সময় পর সিদ্ধ করতে হয়। এই সিদ্ধ করার সময় প্রচুর জ্বালানি নষ্ট হয়। পরে আবার শুকাতে হয়। এই দুইবার শুকানো এবং ভিজানোতে বেশ কর্তনোত্তর ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। সিদ্ধ করার ব্যাপারে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট একটি পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। যন্ত্রটি সাধারণ চাতাল ব্যবসায়ীদের কাছে পরিচিত করার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। গুদামজাত ও সিদ্ধ করার পর্যায়ে ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনার জন্য একটি বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। সেটা হলো মাড়াইয়ের পর ঝাড়াই করেই সিদ্ধ করে ফেলা। ফলে দুইবার শুকানোর দরকার হয় না। এতে ধান শুকাতে গিয়ে যে ক্ষতি, তা কমিয়ে আনা সম্ভব।
ধান পরিষ্কার করার জন্য চাষিরা সাধারণত কুলা ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা ঝাড়াইজনিত কর্তনোত্তর ক্ষতি কমানোর জন্য ঝাড়াই যন্ত্র ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন। ব্রিতে এ ধরনের যন্ত্র আছে। অনেক সময় মাড়াই এবং ঝাড়াইয়ের কাজ একসঙ্গেই করা হয়। আমাদের আলোচনায় আমরা দেখেছি, চাল ছাঁটাইয়ের সময় কর্তনোত্তর ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। সিদ্ধ চালের চেয়ে আতপ চালে এই ক্ষতি বেশি হয়। এ পর্যায়ের ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য ধান সিদ্ধ করে নেওয়া যায়। সেই সঙ্গে যথারীতি শুকিয়ে ধান থেকে চাল বানানোর জন্য আধুনিক ছাঁটাই যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে খোসা ছাড়ানো এবং পলিশের ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। তবে এই প্রযুক্তি সবার জন্য ব্যবহারোপযোগী করতে না পারলে লাভ নেই।
ধান গোলাজাত অবস্থায় প্রধানত বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় দ্বারা আক্রান্ত হয়। এ জন্য ধান ভালোভাবে শুকিয়ে বিশেষভাবে নির্মিত পাত্রের (টিন, পলিথিন বা মাটির তৈরি) মধ্যে সংরক্ষণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় পোকার আক্রমণে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ধান নষ্ট হয়ে যেতে পারে। দুর্বল গোলাজাতকরণের কারণে ইঁদুরের আক্রমণে ধান নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঘটনা অহরহই ঘটে থাকে।
অবশেষে বলতে হয়, কর্তনোত্তর অপচয় রোধের জন্য অবশ্যই সময়মতো ধান কাটতে হবে। ভালোভাবে শুকিয়ে এরপর বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে গোলাজাত করতে হবে। প্রয়োজনে সিদ্ধ করে ভালোভাবে শুকিয়ে তা আধুনিক ছাঁটাই যন্ত্রে ছাঁটাই করতে হবে। অর্থাৎ ধান কাটা থেকে ভাত রেঁধে পেটে যাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে সচেতন হতে হবে। তাহলেই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কর্তনোত্তর ক্ষতি কমানো যাবে।
লেখক : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান, উদ্ভিদ শারীরতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর
আমাদের দেশে কর্তনোত্তর ধানের ক্ষতি নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা হয়েছে ১৯৮৩-৮৪ সালে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সহযোগিতায় এ গবেষণাকার্য পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী ড. নূরুল হক চৌধুরী, মো. আবুল কাসেম প্রমুখ বিজ্ঞানী এ কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মো. আবুল কাসেমের মতে, এই গবেষণা কর্মকাণ্ড বেশ আগের হলেও আমাদের কিন্তু ওই পরিস্থিতি থেকে সামান্যই উত্তরণ ঘটেছে। কারণ তাঁর মতে, কর্তনোত্তর কর্মকাণ্ডে চাষি পর্যায়ে যে ধরনের সচেতনতা এবং যান্ত্রিকীকরণ দরকার ছিল, তা এখনো করা যায়নি। তাঁর ভাষায়, এ পর্যায়ে ধান মাড়াই যন্ত্রের ব্যবহার বেশ বাড়লেও অন্যান্য অন্তর্বর্তীকালীন কর্তনোত্তর পরিচর্যার জন্য যেসব ব্যবস্থা করা দরকার ছিল, সেগুলো এখনো তেমনটা হয়নি বলা যায়।
তাঁরা (ড. চৌধুরী ও কাসেম) বাংলাদেশের ঢাকা, সিলেট, রাজশাহী ও বগুড়ায় আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমের জন্য এই গবেষণা করেন। তাঁদের গবেষণা অনুযায়ী, ধান কাটার সময় ক্ষতির (কর্তনোত্তর ক্ষতি) পরিমাণ ১.১৪ থেকে ২.৫ শতাংশ। মাড়াইজনিত ক্ষতির পরিমাণ ০.৭৭ থেকে ০.৯৮ শতাংশ। ধান শুকানো ও সিদ্ধজনিত ক্ষতির পরিমাণ ১.৬৩ থেকে ১.৮৪ শতাংশ। ধান থেকে চাল বানাতে যে ক্ষতি হয়, তার পরিমাণ ৩.২৮ থেকে ৪.৫৪ শতাংশ। গোলাজাতকালে ক্ষতির পরিমাণ ০.৩০ থেকে ১.২০ শতাংশ। সব মিলিয়ে ক্ষতির পরিমাণ ১৩.০ থেকে ১৩.৭২ শতাংশ। উল্লেখ্য, আউশ, আমন ও বোরোর জন্য এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় একই রকম।
এসব ক্ষতি কিভাবে হয়, একটু দেখা যাক। একটি জমির ধান কাটার উপযুক্ত সময় তখন, যখন ৮০ শতাংশ ধান পেকে যায়। এর বেশি পাকাতে গেলে অবশ্যই কিছু ধান আপনাআপনিই ঝরে পড়বে। আবার কম পাকলে কিছু ধান কাঁচা থেকে যাবে। এর মাঝামাঝি অবস্থার জন্য ৮০ শতাংশ একটা ভালো বিবেচনা। বোরো বা আউশ মৌসুমে অনেক সময় ধান পাকানোর পুরো সময় পাওয়া যায় না। এবার যেমন বহু ধানের জমি পাকার আগেই পাহাড়ি ঢলে ডুবে গেল, আউশের বেলায়ও এমন ঘটতে পারে। এ ক্ষেত্রে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ষোলো আনা। আমন মৌসুমে ধান পাকার পরও জমিতে অনেক দিন পড়ে থাকতে দেখা যায়। ধান বেশি পেকে যায়। এ অবস্থায় প্রচুর ধান ঝরে পড়ে যায়। তবে এ ক্ষেত্রেও পাকা ধানের ৮০ শতাংশ মার্জিন ঠিক রেখে কাটতে পারলে ক্ষতির পরিমাণ অবশ্যই কমিয়ে আনা যায়। জমিতে ধান কাটার অপেক্ষায় থাকার প্রধান কারণ শ্রমিকের অভাব। এ জন্য ধান কাটা যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের দেশে তেমন কোনো সাশ্রয়ী ধান কাটা যন্ত্র এখনো প্রচলন করা সম্ভব হয়নি। কিছু সরকারি খামারে কম্বাইন্ড হারভেস্টার ব্যবহৃত হচ্ছে। চাষিরা নিজেদের মধ্যে সমবায়ী ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে হয়তো এ ধরনের হার্ভেস্টারের প্রচলন করতে পারে। কিন্তু এর মাধ্যমে শ্রমিক বাঁচিয়ে সময়মতো ধান কাটা সম্ভব হলেও কর্তনজনিত ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীরা আরো গবেষণা করে দেখতে পারেন। এবার ধান মাড়াইয়ের ব্যাপারটা দেখা যাক। আমাদের দেশে ধান মাড়াইয়ের গতানুগতিক পদ্ধতি হলো শক্ত কোনো কিছুর ওপর ধানের আঁটি বাড়ি (আঘাত) দিয়ে মাড়াই এবং গরু দিয়ে মাড়াই করা। বর্তমানে পা বা শক্তি চালিত মাড়াই যন্ত্র দিয়ে ধান মাড়াই করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ধানের আঁটি বাড়ি দিয়ে মাড়াই করতে গিয়ে অপচয় বেশি হয় এবং মাড়াই যন্ত্র দিয়ে মাড়াই করলে ক্ষতির পরিমাণ কম হয়।
ধান শুকানোর ব্যাপারে আমাদের চাষিদের যথেষ্ট ধকল সইতে হয়। আমাদের দেশে ধান শুকানো হয় যেখানে-সেখানে। হাওর এলাকায় বোরো ধান শুকানো এবং আষাঢ় মাসে আউশ ধান শুকানো যথেষ্ট বিড়ম্বনাকর। ওই সময় প্রচুর ধান গজিয়ে গিয়ে বা অন্য উপায়ে নষ্ট হয়ে থাকে। এসব ধানের যেমন বীজ রাখা যায় না, তেমনি ধানের গুণও নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু এই বিড়ম্ব্বনা থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের দেশে এখনো সুবিধাজনক কোনো ধান শুকানোর যন্ত্রের প্রচলন করা যায়নি। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে বিভিন্ন সময় কিছু যন্ত্র উদ্ভাবিত হলেও বিভিন্ন কারণে সেগুলোর উপযোগিতার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে এ ব্যাপারে ভিয়েতনাম বেশ এগিয়ে আছে বলে জানা যায়। ভিয়েতনাম এবং আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের যৌথ প্রচেষ্টায় স্বল্প পরিসরে ব্যবহারোপযোগী ধান শুকানোর যন্ত্র কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশে বেশ ব্যবহৃত হচ্ছে। আমাদের বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করতে পারেন।
বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ সিদ্ধ চাল খেতে অভ্যস্ত। আর এই সিদ্ধ করতে গিয়ে অতিরিক্ত কিছু ঝামেলার শিকার হতে হয়। প্রথমত, একবার শুকানো ধান, আবার ভিজিয়ে নির্দিষ্ট সময় পর সিদ্ধ করতে হয়। এই সিদ্ধ করার সময় প্রচুর জ্বালানি নষ্ট হয়। পরে আবার শুকাতে হয়। এই দুইবার শুকানো এবং ভিজানোতে বেশ কর্তনোত্তর ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। সিদ্ধ করার ব্যাপারে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট একটি পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। যন্ত্রটি সাধারণ চাতাল ব্যবসায়ীদের কাছে পরিচিত করার ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। গুদামজাত ও সিদ্ধ করার পর্যায়ে ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনার জন্য একটি বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। সেটা হলো মাড়াইয়ের পর ঝাড়াই করেই সিদ্ধ করে ফেলা। ফলে দুইবার শুকানোর দরকার হয় না। এতে ধান শুকাতে গিয়ে যে ক্ষতি, তা কমিয়ে আনা সম্ভব।
ধান পরিষ্কার করার জন্য চাষিরা সাধারণত কুলা ব্যবহার করে থাকে। কিন্তু বিজ্ঞানীরা ঝাড়াইজনিত কর্তনোত্তর ক্ষতি কমানোর জন্য ঝাড়াই যন্ত্র ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন। ব্রিতে এ ধরনের যন্ত্র আছে। অনেক সময় মাড়াই এবং ঝাড়াইয়ের কাজ একসঙ্গেই করা হয়। আমাদের আলোচনায় আমরা দেখেছি, চাল ছাঁটাইয়ের সময় কর্তনোত্তর ক্ষতির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। সিদ্ধ চালের চেয়ে আতপ চালে এই ক্ষতি বেশি হয়। এ পর্যায়ের ক্ষতি কমিয়ে আনার জন্য ধান সিদ্ধ করে নেওয়া যায়। সেই সঙ্গে যথারীতি শুকিয়ে ধান থেকে চাল বানানোর জন্য আধুনিক ছাঁটাই যন্ত্র ব্যবহার করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে খোসা ছাড়ানো এবং পলিশের ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। তবে এই প্রযুক্তি সবার জন্য ব্যবহারোপযোগী করতে না পারলে লাভ নেই।
ধান গোলাজাত অবস্থায় প্রধানত বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় দ্বারা আক্রান্ত হয়। এ জন্য ধান ভালোভাবে শুকিয়ে বিশেষভাবে নির্মিত পাত্রের (টিন, পলিথিন বা মাটির তৈরি) মধ্যে সংরক্ষণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় পোকার আক্রমণে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ধান নষ্ট হয়ে যেতে পারে। দুর্বল গোলাজাতকরণের কারণে ইঁদুরের আক্রমণে ধান নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঘটনা অহরহই ঘটে থাকে।
অবশেষে বলতে হয়, কর্তনোত্তর অপচয় রোধের জন্য অবশ্যই সময়মতো ধান কাটতে হবে। ভালোভাবে শুকিয়ে এরপর বিজ্ঞানভিত্তিক উপায়ে গোলাজাত করতে হবে। প্রয়োজনে সিদ্ধ করে ভালোভাবে শুকিয়ে তা আধুনিক ছাঁটাই যন্ত্রে ছাঁটাই করতে হবে। অর্থাৎ ধান কাটা থেকে ভাত রেঁধে পেটে যাওয়া পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে সচেতন হতে হবে। তাহলেই উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কর্তনোত্তর ক্ষতি কমানো যাবে।
লেখক : মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান, উদ্ভিদ শারীরতত্ত্ব বিভাগ, বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, গাজীপুর
No comments