দুর্নীতি দমন-কাগুজে বাঘের হুংকারে আর লাভ হবে না by শাহ্দীন মালিক
গত দুই দিনে দুদক আইনের সংস্কার-সংক্রান্ত প্রস্তাবের ব্যাপারে দুদকের চেয়ারম্যান নিজেই প্রতিবাদ করেছেন। আইনে দুদককে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, সেই আইনের কোন বা কী ধরনের সংস্কারে প্রতিষ্ঠানটির দুর্নীতি দমনের হাত শক্ত হবে আর কোন সংস্কারে সেই হাত কাটা যাবে, সেটা এর চেয়ারম্যান সাহেবই সবচেয়ে ভালো জানেন। স্পষ্টত, সংস্কার প্রস্তাবে প্রতিষ্ঠানটির হাত কাটার আশঙ্কা দুদক চেয়ারম্যান তিনি নিজেই করেছেন।
এই সংস্কার প্রস্তাব যেহেতু মন্ত্রিসভা ইতিমধ্যেই অনুমোদন করেছে, সেহেতু আমরা সহজেই ধরে নিতে পারি, সংসদে এটা পাস হয়ে যাবে। আর কিছু না হোক, এই সংসদ দ্রুত আইন পাসে তার পটুতা বিলক্ষণ দেখিয়েছে। যেমন—গত ১১ দিনের অধিবেশনে আইন পাস হয়েছিল ১৩টি। অর্থাৎ আইন পাস করার আগে বিলের পরীক্ষা, ভালো-মন্দ বিচার-বিশ্লেষণ ইত্যাদির ব্যাপারে সংসদ বিশেষ ধার ধারে বলে মনে হয় না। কাউকে ডাকেও না, জিজ্ঞাসাও করে না। অন্তত এই দুর্নীতি আইনের প্রস্তাবিত সংস্কারের ব্যাপারে সংসদীয় কমিটি যদি কাউকে ডাকত, তাহলে সম্ভবত সবাই এর বিরোধিতা করত, কিন্তু সে পথে যায়নি সংসদীয় কমিটি।
প্রস্তাবিত এই সংস্কার আইন হিসেবে পাস হয়ে গেলে আমাদের ধারণা, টিআইবির দুর্নীতির ধারণাসূচকে অতীতের মতো প্রথম স্থান সগর্বে অলংকৃত করতে না পারলেও অন্তত তৃতীয় স্থানের গ্যারান্টি সহজেই দেওয়া যাবে। মন্ত্রিসভার মুখপাত্র ছাড়া আইনের এই সংস্কারের পক্ষে এখনো কেউ কথা বলেননি। আর যাঁরা লাভবান হবেন অর্থাৎ আমলাদের কিছু না বললেই চলে। কারণ তাঁদের উদ্দেশ্য তো হাসিল হয়েই যাবে। মজা হবে সরকার পরিবর্তনের পর। এখন যাঁরা মন্ত্রী আছেন, তখন তাঁরা মন্ত্রী থাকবেন না। অর্থাৎ তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করতে কোনো অনুমোদন লাগবে না। বর্তমানের আমলাদের কিছুসংখ্যক অবসরে গেলেও বর্তমান আমলাদের অধিকাংশই পরের সরকারের সময়ও থাকবেন। এবং তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করার অনুমোদন নিশ্চয়ই তাঁরা উচ্ছ্বসিত হয়ে দেবেন না। আমলাদের বাঁচানোর জন্য আইন সংস্কারের অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা, কিন্তু লাভের গুড় পিঁপড়ায় খাবে।
২.
গ্যাস, বিদ্যুৎ, দ্রব্যমূল্য, যানজট—কোনো কিছুরই বড় কোনো সমাধান এখনো হয়নি। এত দিন আশা ছিল, অন্তত সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান দৃঢ় থাকবে। শতকোটি টাকার দুর্নীতিরও সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছরের জেল। অবস্থানটা দৃঢ়তর হতো যদি এই শাস্তির মেয়াদ বাড়িয়ে আইন সংস্কার হতো। আমাদের প্রধান দুর্নীতিবিরোধী আইন ১৯৪৭ সালের। বয়স ৬০ পেরিয়ে গেছে, সেটারও সংস্কার-পরিবর্তন দরকার ছিল। সরকার সেই পথে না গিয়ে ‘দুর্নীতির মামলা যত কম করা যায় ততই ভালো’ এই নীতিতেই বিশ্বাসী হয়ে উঠছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এতে মন্ত্রিসভা হয়তো মনে করতে পারে, সরকারের কাজের গতি বাড়বে ও দুর্নীতি কমবে। কিন্তু আমাদের কাছে এটা স্পষ্ট, মন্ত্রিসভা আর আমলাদের বাইরে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ার এই ধারণা হালে মোটেও পানি পাবে না। এমনিতেই সরকারের জনপ্রিয়তা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। নিজের জনপ্রিয়তা হ্রাস করার জন্য এ ধরনের উদ্যোগকে বিরোধীরা মনে মনে নিশ্চয়ই স্বাগত জানাবে। সে জন্যই বোধ হয় বলা হয়, যে নিজের পায়ে কুড়াল মারতে চায়, তাকে ঠেকানো মুশকিল।
এটাও অনস্বীকার্য, দুদকও তার তীক্ষতা হারিয়ে ফেলেছে। অবশ্য দুদকের চেয়ারম্যান আগেও আক্ষেপ করেছেন, তাঁর অবস্থা নখকাটা বাঘের মতো। সারা বিশ্বের গত ৫০ বছরের উন্নয়ন-ধারায় এটা স্পষ্টভাবে স্বীকৃত, দুর্নীতি ও উন্নতি একসঙ্গে চলে না। দুর্নীতি কমলে উন্নতি বাড়বে। দুর্নীতি না কমিয়ে কোনো দেশ বা সমাজ উন্নতি করতে পেরেছে বলে আমাদের জানা নেই। হয়তো মন্ত্রিসভা মনে করছে, বাংলাদেশে দুর্নীতি আর উন্নতি একই সঙ্গে সমান তালে চলতে পারে। দেশ ও জাতির দুর্ভাগ্য হবে যদি এ ধারণাটা বর্তমান সরকার আরও জোরালোভাবে ধরে রাখে। কারণ তাদের ধারণা যে ভুল, সেটা প্রমাণ করার সুযোগের জন্য জনগণের তো আরও তিন বছর অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
তবে আমরা সব সময় আশা নিয়ে থাকি, আশা নিয়ে বাঁচি। আশা করব, মন্ত্রিসভার বোধোদয় হবে। দুর্নীতিবাজ আমলা বাঁচাও—এটা সরকারের মূলমন্ত্র হবে না, মূলমন্ত্র হবে গ্যাস দেব, বিদ্যুৎ দেব, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কমাব আর দুর্নীতিবাজদের শায়েস্তা করব।
ড. শাহ্দীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট; শিক্ষক, ব্র্যাক স্কুল অব ল।
প্রস্তাবিত এই সংস্কার আইন হিসেবে পাস হয়ে গেলে আমাদের ধারণা, টিআইবির দুর্নীতির ধারণাসূচকে অতীতের মতো প্রথম স্থান সগর্বে অলংকৃত করতে না পারলেও অন্তত তৃতীয় স্থানের গ্যারান্টি সহজেই দেওয়া যাবে। মন্ত্রিসভার মুখপাত্র ছাড়া আইনের এই সংস্কারের পক্ষে এখনো কেউ কথা বলেননি। আর যাঁরা লাভবান হবেন অর্থাৎ আমলাদের কিছু না বললেই চলে। কারণ তাঁদের উদ্দেশ্য তো হাসিল হয়েই যাবে। মজা হবে সরকার পরিবর্তনের পর। এখন যাঁরা মন্ত্রী আছেন, তখন তাঁরা মন্ত্রী থাকবেন না। অর্থাৎ তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করতে কোনো অনুমোদন লাগবে না। বর্তমানের আমলাদের কিছুসংখ্যক অবসরে গেলেও বর্তমান আমলাদের অধিকাংশই পরের সরকারের সময়ও থাকবেন। এবং তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা করার অনুমোদন নিশ্চয়ই তাঁরা উচ্ছ্বসিত হয়ে দেবেন না। আমলাদের বাঁচানোর জন্য আইন সংস্কারের অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা, কিন্তু লাভের গুড় পিঁপড়ায় খাবে।
২.
গ্যাস, বিদ্যুৎ, দ্রব্যমূল্য, যানজট—কোনো কিছুরই বড় কোনো সমাধান এখনো হয়নি। এত দিন আশা ছিল, অন্তত সরকারের দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান দৃঢ় থাকবে। শতকোটি টাকার দুর্নীতিরও সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছরের জেল। অবস্থানটা দৃঢ়তর হতো যদি এই শাস্তির মেয়াদ বাড়িয়ে আইন সংস্কার হতো। আমাদের প্রধান দুর্নীতিবিরোধী আইন ১৯৪৭ সালের। বয়স ৬০ পেরিয়ে গেছে, সেটারও সংস্কার-পরিবর্তন দরকার ছিল। সরকার সেই পথে না গিয়ে ‘দুর্নীতির মামলা যত কম করা যায় ততই ভালো’ এই নীতিতেই বিশ্বাসী হয়ে উঠছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এতে মন্ত্রিসভা হয়তো মনে করতে পারে, সরকারের কাজের গতি বাড়বে ও দুর্নীতি কমবে। কিন্তু আমাদের কাছে এটা স্পষ্ট, মন্ত্রিসভা আর আমলাদের বাইরে সরকারের জনপ্রিয়তা বাড়ার এই ধারণা হালে মোটেও পানি পাবে না। এমনিতেই সরকারের জনপ্রিয়তা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে। নিজের জনপ্রিয়তা হ্রাস করার জন্য এ ধরনের উদ্যোগকে বিরোধীরা মনে মনে নিশ্চয়ই স্বাগত জানাবে। সে জন্যই বোধ হয় বলা হয়, যে নিজের পায়ে কুড়াল মারতে চায়, তাকে ঠেকানো মুশকিল।
এটাও অনস্বীকার্য, দুদকও তার তীক্ষতা হারিয়ে ফেলেছে। অবশ্য দুদকের চেয়ারম্যান আগেও আক্ষেপ করেছেন, তাঁর অবস্থা নখকাটা বাঘের মতো। সারা বিশ্বের গত ৫০ বছরের উন্নয়ন-ধারায় এটা স্পষ্টভাবে স্বীকৃত, দুর্নীতি ও উন্নতি একসঙ্গে চলে না। দুর্নীতি কমলে উন্নতি বাড়বে। দুর্নীতি না কমিয়ে কোনো দেশ বা সমাজ উন্নতি করতে পেরেছে বলে আমাদের জানা নেই। হয়তো মন্ত্রিসভা মনে করছে, বাংলাদেশে দুর্নীতি আর উন্নতি একই সঙ্গে সমান তালে চলতে পারে। দেশ ও জাতির দুর্ভাগ্য হবে যদি এ ধারণাটা বর্তমান সরকার আরও জোরালোভাবে ধরে রাখে। কারণ তাদের ধারণা যে ভুল, সেটা প্রমাণ করার সুযোগের জন্য জনগণের তো আরও তিন বছর অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
তবে আমরা সব সময় আশা নিয়ে থাকি, আশা নিয়ে বাঁচি। আশা করব, মন্ত্রিসভার বোধোদয় হবে। দুর্নীতিবাজ আমলা বাঁচাও—এটা সরকারের মূলমন্ত্র হবে না, মূলমন্ত্র হবে গ্যাস দেব, বিদ্যুৎ দেব, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি কমাব আর দুর্নীতিবাজদের শায়েস্তা করব।
ড. শাহ্দীন মালিক: অ্যাডভোকেট, সুপ্রিম কোর্ট; শিক্ষক, ব্র্যাক স্কুল অব ল।
No comments