পর্যবেক্ষণ-কর্নেল তাহেরের বিচার: একটি সতর্ক ভাবনা by লরেন্স লিফশুলজ
সামরিক আদালতে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল এম এ তাহেরের (বীর উত্তম) গোপন বিচারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা মামলায় মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজের বক্তব্য জানতে চেয়েছেন হাইকোর্ট। ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে ২৬ জানুয়ারি হাইকোর্টে হাজির হতে পারেননি তিনি।
তবে হাইকোর্ট বেঞ্চের অনুরোধে সাড়া দিয়ে তাঁর বক্তব্য হলফনামা আকারে উপস্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তিনি। ২০০৬ সালের জুলাই মাসে কর্নেল তাহেরের বিচার ও তাহের সম্পর্কে তাঁর দুটি লেখা ছাপা হয়েছিল প্রথম আলোয়। এই লেখা দুটি কর্নেল তাহের ও তাঁর বিচারের ব্যাপারে লিফশুলজের বক্তব্যের প্রতিফলন। এ পরিস্থিতিতে লেখা দুটি আবার প্রকাশের আগ্রহ লেখকের। লিফশুলজের ইচ্ছা ও পাঠকের আগ্রহের বিবেচনায় লেখা দুটি পুনর্মুদ্রিত হলো।
আজ থেকে ঠিক ৩০ বছর আগে আমি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এক দিন আগেই চলে এসেছিলাম আমি। ‘স্মৃতিতে ধরে রাখার মতো একটি দিন।’ সেদিন ছিল ২৮ জুন, ১৯৭৬।
এক সপ্তাহ আগে ‘এক নম্বর বিশেষ সামরিক আদালত’ গোপনে তাঁদের কাজ শুরু করেছিলেন। এক দিনের জন্য আদালত বসার পর একটি মামলার বিবাদীপক্ষের আইনজীবীদের প্রস্তুতির জন্য সাত দিনের সময় দিয়ে আদালত এক সপ্তাহের অবকাশে চলে যান। ছয় মাস আগে থেকেই মামলার প্রস্তুতি চলছিল। কর্নেল আবু তাহেরসহ ২০ জনেরও বেশি লোকের বিচার শুরু হয়েছিল। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বন্দিজীবনের পুরো সময়টিতে বারবার আবেদন সত্ত্বেও তাঁদের আইনগত পরামর্শ এবং স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ দেওয়া হয়নি।
বিচার শুরুর পর এই সংবাদদাতা হংকংয়ে দ্য ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ-এ এবং লন্ডনে বিবিসি ও দ্য গার্ডিয়ান-এ এ সংক্রান্ত খবর পাঠান। সে সময় আমি ছিলাম রিভিউ-এর দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের সংবাদদাতা। এসব রিপোর্ট পাঠাতে আমি বাধার সম্মুখীন হয়েছি। অবশেষে একজন যাত্রী একটি আন্তর্জাতিক বিমানে করে এর কপিগুলো নিয়ে যান। যার অর্থ দাঁড়ায়, বিচারের খবরগুলো থাইল্যান্ড থেকে পাঠানো হয়েছিল। ফলে ঢাকাবাসী এ সংক্রান্ত প্রথম রিপোর্টগুলো পেয়েছিলেন বিবিসি বাংলা বিভাগের মাধ্যমে।
২৮ জুন যখন বিচারকাজ পুনরায় শুরু হয়, তখন প্রধান কৌঁসুলি এ টি এম আফজাল, এই সামরিক আদালতের চেয়ারম্যান কর্নেল ইউসুফ হায়দার এবং অন্যরা জেলগেটে প্রবেশ করার সময় আমি (আমি ১৯৭৪ সালের পুরো সময় বাংলাদেশ থেকে সংবাদ পাঠিয়েছি) তাঁদের ছবি তোলার জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তারা আমাকে বলেন, এটি অতি গোপনীয় বিচার এবং আমাকে কারও বা কোনো কিছুর ছবি তুলতে দেওয়া হবে না। আমি জানাই, আমি কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ নিয়ে রিপোর্ট করছি। আমি তুলনামূলকভাবে একজন সুপরিচিত ব্যক্তি এবং এ ধরনের কোনো সরকারি নির্দেশনা আছে বলে আমার জানা নেই। যদি তাঁরা আমাকে এ বিষয়ে রিপোর্ট করতে বা ছবি তুলতে দিতে না চান, তাহলে তাঁদের উচিত আমাকে এ ব্যাপারে তথ্য মন্ত্রণালয়ের লিখিত নির্দেশ দেখানো। অন্যথায় একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি নির্বিঘ্নে আমার কাজ চালিয়ে যাব। যে পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে প্রশ্ন করছিলেন, এরপর আমি তাঁর ছবি তুলি। তিনি হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলেন এবং দৌড়ে চলে যান।
সেদিন সকালে অনেক ঘটনাই ঘটে যায়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভারী লোহার গেট দিয়ে কালো কোট পরা ৩০ জন ব্যারিস্টার বিচারের প্রথম অধিবেশনে আসেন। প্রতিষ্ঠিত কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের অভিযোগ ও বিচারের ঘটনা ঘটে, যখন আগের চারটি সরকার একের পর এক ক্ষমতায় এসেছিল অস্ত্রের বলে পূর্ববর্তী সরকারকে হটিয়ে। অধিকন্তু যেসব কর্মকর্তা ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলেন এবং সরকারি সংবাদপত্রে যাঁদের ‘ভারতের এজেন্ট’ বলে ভর্ৎসনা করা হয়েছিল, তাঁদের সবাইকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যাঁরা, তাঁরা হলেন ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত জামিল, যিনি জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করে রেখেছিলেন। সুতরাং ব্যাপারটা দাঁড়ায়, যেসব কর্মকর্তা ৩ নভেম্বরের জিয়াবিরোধী অভ্যুত্থানের পেছনে ছিলেন, তাঁরা ছিলেন মুক্ত আর যেসব ব্যক্তি ৭ নভেম্বর সাধারণ অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন—যে ঘটনায় জিয়া মুক্তি পেয়েছিলেন—তাঁরা বিচারে মৃত্যুদণ্ডের সম্মুখীন।
সেই ২১ জুন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটে আমি যখন অপেক্ষা করছিলাম, তখন জেলের সুউচ্চ রংচটা হলদে-বিবর্ণ প্রাচীরের ওপাশে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিচারকাজ শুরু হলো। বাংলাদেশ অথবা ‘পূর্ব পাকিস্তানে’র ইতিহাসে আগে কখনো একটি কারাগারের চৌহদ্দির মধ্যে বিচারের ঘটনা ঘটেনি। যাঁরা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আইনজীবী, তাঁদের বিচারপ্রক্রিয়া অনুযায়ী গোপনীয়তার শপথ নিতে হলো। দেশের ভেতরে মামলার সব খবরের ওপর গোপনীয়তা আরোপ করা হয়েছিল। কারাগারের নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল ব্যতিক্রমী: প্রতিটি প্রবেশপথের চারপাশে বালুর বস্তাসংবলিত মেশিনগান রাখা হয়েছিল। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে কর্তৃপক্ষ জেলের ভেতরে বিচারের আয়োজন করেছিল সম্ভাব্য গোলযোগ এড়ানোর উদ্দেশ্যে। প্রকাশ্য বিচার হলে আদালতে যাওয়ার পথে এই গোলযোগ ঘটতে পারত।
জেলগেটে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় অবস্থান করার পর আমি সেদিনের মতো একাই সেখান থেকে বিদায় নিই। বিচারকাজ কেন এ রকম গোপনীয়তার সঙ্গে হচ্ছে, সে ব্যাপারে একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি পাওয়ার জন্য আমি সামরিক আদালতের চেয়ারম্যানের সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বেলা ১১টায় আমাকে গ্রেপ্তার করে জেলে আটক রাখা হয়। কারাগারে প্রবেশের সময় আমি যেসব ছবি তুলেছিলাম, আমাকে সেসব ছবির ফিল্ম সমর্পণ করতে বলা হয়।
আমি পুলিশ কর্মকর্তাদের এবং সেনাবাহিনীর যে লেফটেন্যান্ট আমাকে হাজতে নিয়ে এসেছেন, তাঁকে জানাই, আমি স্বেচ্ছায় ফিল্ম দেব না। এরপর ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স (এনএসআই) সংস্থা এবং সামরিক আইন সদর দপ্তরে ফোন করা হয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ১০ জন কর্মকর্তা এসে হাজির হন। একজনমাত্র সাংবাদিকের জন্য এতজন নিরাপত্তাকর্মী!
একজন এনএসআই কর্মকর্তা, যিনি নিজেকে শামিম আহমেদ বলে উল্লেখ করেন, আমাকে জিজ্ঞেস করেন, কেন আমি তাহেরের মামলায় আগ্রহী। আমি ব্যাখ্যা দিই, গোপন বিচার আমাকে এ ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলেছে, যে ধরনের বিচার স্তালিন, ফ্রাঙ্কো বা জিয়া করেছেন। আমি তাঁকে বলি, আমি একজন রিপোর্টার, কাজেই মুজিবের হত্যাকারী ছয় মেজরকে যদি খালেদ মোশাররফ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে রাখতেন, তাহলেও আমি সে ঘটনার রিপোর্ট করতাম। এবং যদি খালেদ জীবিত থাকতেন এবং জিয়া তাঁকে বিচারের সম্মুখীন করতেন, তাহলেও আমি এখনকার মতো রিপোর্ট করার চেষ্টার জন্য জেলে থাকতাম। এবং এখন জিয়া তাহেরকে একটি কারাগারের ভেতরে বিচারের সম্মুখীন করেছেন, যেখানে গোপনীয়তা রক্ষার শপথের কারণে আইনজীবীরা আতঙ্কগ্রস্ত, আমি এর রিপোর্ট করব। আমি শামিম আহমেদকে জিজ্ঞেস করি, যা ঘটছে, জনগণ তা জানলে তাতে দোষের কী আছে? তিনি আমার ক্যামেরা কেড়ে নেন এবং সেটা একজন তরুণ টেলিযোগাযোগ কর্মকর্তার হাতে দেন। কয়েক বছর আগে এই লোক আমেরিকান অফিস অব পাবলিক সেইফটি প্রোগ্রামের অধীনে নিউইয়র্কে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তিনি ক্যামেরা থেকে ফিল্মটি ছিঁড়ে বের করে ফেলেন।
আমি কয়েক ঘণ্টা জেলে বন্দী ছিলাম। সে সময় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এরপর কী করা হবে। সেনাবাহিনীর একজন মেজর বলেন, সদর দপ্তর মনে করে, একজন বিদেশি সংবাদদাতাকে আটক রাখা অস্বস্তিদায়ক হতে পারে। সেদিন সন্ধ্যায় আমি তাহেরের বিচারসম্পর্কিত আরেকটি তারবার্তা পাঠাতে যাই। তারবার্তা অফিস আমার রিপোর্টটি গ্রহণ করেছিল, কিন্তু পাঠায়নি।
পরদিন সন্ধ্যায় আমি আমার আবাসস্থলে ফেরার পর পাঁচজন স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) কর্মকর্তা আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা জানান, আমাকে আবারও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তাঁদের ওপর নির্দেশ রয়েছে আমাকে সরাসরি বিমানবন্দরে নিয়ে গিয়ে দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য প্রথম যে বিমানটি পাওয়া যাবে, তাতে তুলে দেওয়ার। প্রথম বিমানটি ভারতে যাচ্ছিল। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা সম্পর্কে রিপোর্ট করার জন্য ছয় মাস আগে আমাকে ভারত থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। দিল্লিতে সেই দিনগুলোতে খুব কঠোর সেন্সরশিপ ছিল এবং কোনো বিদেশি সংবাদদাতাই এর প্রতি ভ্রুক্ষেপ করতেন না। কাজেই ভারত থেকে সাংবাদিক হিসেবে কেবল আমাকেই সসম্মানে বিতাড়িত করা হয়নি, আমার ঘটনাটি ছিল সর্বশেষ।
আমি এসবি কর্মকর্তাদের ধৈর্যের সঙ্গে বললাম, তাঁরা আমাকে ভারতে বহিষ্কার করতে পারেন না, কেননা ইতিমধ্যেই সেখান থেকে আমি বহিষ্কৃত হয়েছি। শেষ পর্যন্ত ব্যাংককে যাওয়ার পরবর্তী বিমানে উঠিয়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত আমাকে তিন দিন গৃহবন্দী করে রাখা হলো। ২১ জুলাই আমাকে থাইল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হলো এবং তাহেরের বিচারসম্পর্কিত সবশেষ বিদেশি ও অভ্যন্তরীণ সংবাদ প্রতিবেদনের সমাপ্তি ঘটল। এরপর কর্তৃপক্ষ তাদের গোপনীয়তা নির্বিঘ্নে বজায় রাখতে পারল।
আরও ১৭ দিন বিচারকাজ চলে। তাহের শুরুতে সামরিক আদালতে যেতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি একে ‘বিচারের নামে সরকারের অপরাধ সংঘটনের একটি হাতিয়ার’ আখ্যা দেন। তিনি আরও বলেন, তাঁর বিচার করতে হলে জুরিদের তালিকায় সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের থাকতে হবে, যাঁরা দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন—ইউসুফ হায়দারের মতো লোকেরা থাকলে হবে না—যিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। কিন্তু যখন আদালত গঠিত হয়, তখন এতে কোনো মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা ছিলেন না।
তাহেরের আইনজীবীরা শেষ পর্যন্ত তাঁকে বিচারকাজে অংশগ্রহণ করাতে সক্ষম হন। তাঁরা প্রথমে ভেবেছিলেন, আদালত ভীতি প্রদর্শন ছাড়াই কাজ করতে পারবেন। তাঁদের অনেককে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, সামরিক আদালত শুরু হওয়ার অনেক আগেই তাহেরের দণ্ড নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল, পরে যা জেনে তাঁরা আক্ষেপ করেছেন। ১৭ জুলাই আদালতের চেয়ারম্যান ইউসুফ হায়দার দণ্ডাদেশ ঘোষণা করেন। সেনাবাহিনীর হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে হায়দার তাহেরকে মৃত্যুদণ্ড দেন।
বিচার চলাকালে পুরো মাসে এ মামলাসংক্রান্ত অথবা বিচার নিয়ে রিপোর্ট করার চেষ্টার কারণে আমাকে বহিষ্কার করা-সংক্রান্ত একটি খবরও বাংলাদেশের সংবাদপত্রে দেখা যায়নি, যদিও প্রত্যেক সম্পাদক এবং অনেক সাংবাদিক ভালো করেই জানতেন কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রাচীরের ভেতরে কী ঘটছে। মে মাসে অর্থাৎ, বিচার শুরু হওয়ার এক মাস আগে একটি অঘোষিত কিন্তু ভালোভাবেই বোধগম্য গোপনীয় সংবাদের সামান্য লঙ্ঘন হয়, ইত্তেফাক-এর পেছনের পাতায় এক ইঞ্চির একটি খবর ছাপা হয় ‘ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হচ্ছে?’ শিরোনামে। তৎক্ষণাৎ সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর ইত্তেফাক-এর সম্পাদক আনোয়ার হোসেনকে ডেকে পাঠায় এবং শাসিয়ে দেয়, আবারও যদি এই চেষ্টা করা হয়, তাহলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে।
সংবাদপত্রের মুখ বন্ধ করে দিয়ে ১৮ জুন বিচার সম্পন্ন হওয়ার পর সরকার এ মামলার ব্যাপারে একটি সরকারি বিবৃতি প্রকাশের জন্য পত্রিকাগুলোকে নির্দেশ দেয়, এর বেশি কিছু নয়। বাংলাদেশ অবজারভার ও অন্যান্য পত্রিকায় ব্যানার শিরোনামে তাহেরের মৃত্যুদণ্ডের ঘোষণা ছাপা হয়। এটা ছিল বাংলা প্রচারমাধ্যমে এ-সম্পর্কিত প্রথম সংবাদ, যা প্রকাশিত হয় বিচারকাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর। অবশ্যই সেখানে আদালতে তাহেরের মর্মস্পর্শী ভাষণ অথবা আদালতের কোনো কার্যবিবরণী প্রকাশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। যদিও তাহের জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, তিনি তাঁর নামে কোনো আপিল করতে চান না এবং সরকারের কাছে তাঁর কিছুই চাওয়ার নেই, তা সত্ত্বেও তাঁর আইনজীবীরা রাষ্ট্রপতি এ এম সায়েমের প্রতি দণ্ডাদেশ রদ করার আবেদন জানান। আইনজীবী আতাউর রহমান খান ও জুলমত আলী আইন বুঝতেন এবং এটিও বুঝতেন, কীভাবে তাহেরের বিচার আইনের সবচেয়ে মৌলিক সত্যকে লঙ্ঘন করেছে। তবে সে সময় তাহেরের আইনজীবীরা উপলব্ধি করতে পারেননি এই বিচারের গোপন এজেন্ডার ওই অংশটি ছিল একটি মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করার ‘দ্রুত পন্থা’। সায়েম শিগগিরই এই এজেন্ডার একজন অপরিহার্য উপাদান হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করেন।
অনেক সময় বলা হয়ে থাকে, আমাদের সভ্যতার প্রলেপ খুবই পাতলা। সে সময় এ এম সায়েমের ভূমিকা দেখিয়ে দিয়েছে, এটা কত বেশি পাতলা হতে পারে। সায়েম ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি। পাঁচ বছর আগে তিনি প্রাণদণ্ডার্হ শাস্তি এবং সুপ্রিম কোর্ট দ্বারা একজন অভিযুক্তের অধিকার-সম্পর্কিত সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইনগত সিদ্ধান্তটি লিখেছিলেন। পূর্ণচন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে মামলায় সায়েম অভিযুক্তকে দেওয়া একটি মৃতুদণ্ডাদেশ রদ করেছিলেন। এই রায়টি যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত মিরান্ডা সিদ্ধান্তের মতো একটি আইনগত নজিরে পরিণত হয়, যা বিচারের সম্মুখীন একজন অভিযুক্তের জন্য আইনগত সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে। সায়েম যুক্তি দেখিয়েছিলেন, ‘একজন অভিযুক্তের জন্য শেষ মুহূর্তে একজন আত্মপক্ষ সমর্থনকারী আইনজীবীর নিয়োগ মামলায় একজন অভিযুক্তের সঠিকভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকারকে কার্যত রদ করে।’
মণ্ডল মামলায় সায়েম লিখেছিলেন: ‘ফৌজদারি কার্যপ্রণালি বিধি প্রত্যেক অভিযুক্ত ব্যক্তিকে একটি ফৌজদারি আদালতের সামনে আনার আগে একজন আইনজীবী দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার দেয়। এই অধিকার ব্যক্তিগত পরামর্শের জন্য আইনজীবীর আশ্রয় নেওয়া এবং পরবর্তীকালে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য মামলা প্রস্তুতির পর্যাপ্ত সুযোগ প্রদান পর্যন্ত সম্প্রসারিত। প্রাণদণ্ডার্হ অপরাধে অভিযুক্ত একজন বন্দীর আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য শেষ মুহূর্তে একজন আইনজীবী নিয়োগ লিগ্যাল রিমেমবের্যান্স ম্যানুয়ালের ১২ অনুচ্ছেদের ধারাই কেবল লঙ্ঘন করে না...ওই অনুচ্ছেদের বিস্তৃত ধারাগুলোর পেছনের উদ্দেশ্যও ব্যাহত করে। এ ধরনের নিয়োগের ফলে বন্দী কার্যপ্রণালি বিধির ৩৪০ অনুচ্ছেদ দ্বারা প্রাপ্য অধিকারও অগ্রাহ্য করা হয়। এই অধিকার অগ্রাহ্য করা হলে বিচার আইনানুগ হয়নি বলে গণ্য হবে এবং নতুন করে বিচারের প্রয়োজন হবে।’
তাহের তাঁর বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত আইনজীবীর আশ্রয় নেওয়ার অনুমতি পাননি। এভাবে সায়েমের নিজের ভাষায় এ ধরনের বিচার ছিল ‘আইন অনুযায়ী নয়’। তা সত্ত্বেও সায়েম একজন বিচারক হিসেবে লিখেছিলেন, পর্যাপ্ত আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার ছাড়া আইনের অধীনে কোনো ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যেতে পারে না। এখন রাষ্ট্রপতি পদে থেকে তিনি তাহেরের মৃত্যুদণ্ড পুনরায় সমর্থন করলেন। এবং দণ্ডাদেশ দেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত নিলেন। এখানে সবার জন্য দেখার বিষয়টি হলো, একজন বিচারক অপরাধীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এটা মানুষের ভণ্ডামির একটি সাধারণ উদাহরণ মাত্র। সায়েম সম্পর্কে আর কী বলার আছে, যিনি তাহেরের মৃত্যুদণ্ডের স্বীকৃতি দিয়ে সরাসরি আইন লঙ্ঘন করেছেন, যা তিনি নিজেই মণ্ডল মামলায় স্পষ্টভাবে বলেছিলেন।
তাহেরের বিচারের পর প্রধান কৌঁসুলি এ টি এম আফজাল ঢাকা উচ্চ আদালতের বিচারক পদে নিয়োগ পান এবং পরে তিনি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭৬ সালে তিনি ছিলেন একজন উদ্বিগ্ন ব্যক্তি। তিনি তাঁর সহকর্মীদের কাছে দাবি করেছিলেন, মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারে তিনি অন্য যে-কারও চেয়ে বেশি হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলেন। একজন কৌঁসুলি হিসেবে তিনি দাবি করেছেন, তিনি কখনো মৃত্যুদণ্ড চাননি। তিনি বলেছেন, এ ধরনের রায় অসম্ভব ছিল। এমন কোনো আইনের অস্তিত্ব ছিল না, যার অধীনে তাহেরকে তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যেতে পারে।
কিন্তু আফজাল কি রায়ের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছিলেন অথবা এই বিয়োগান্ত ঘটনায় তাঁর ভূমিকার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন? কখনো কি তিনি প্রতিবাদ করার কথা বিবেচনা করেছিলেন এবং বলেছিলেন, তিনি কেন্দ্রীয় কারাগারের চৌহদ্দির ভেতরে অনুষ্ঠিত গোপন বিচারের একটি পক্ষ হবেন না? আমরা যদি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রধান বিচারপতির (যিনি ১৯৭৬ সালের গ্রীষ্মে একটি দীর্ঘ ও সম্ভাবনাময় কর্মজীবনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছিলেন) ‘সাহসিকতার প্রতিকৃতি’ অথবা চরিত্রে নীতিবোধের প্রমাণ অনুসন্ধান করি, তাহলে আমরা সে ধরনের কোনো প্রমাণ খুঁজে পাব না।
এখন ৩০টি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কী ঘটেছে আমরা সবাই জানি। আজ আমরা তাহেরের ফাঁসির ৩০তম বার্ষিকী পালন করছি। আমার দৃষ্টিতে রাষ্ট্র ও বিচার বিভাগের উচিত, প্রকাশ্যে এ ঘোষণা দেওয়া যে আবু তাহেরের বিচার ভুল ছিল এবং তাঁর মৃত্যুদণ্ডও ভুল ছিল। ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাইয়ের রায় ত্যাগ করা উচিত এবং এমন একটি সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া উচিত যে তাঁকে বিচারের সম্মুখীন করেছিল যে সরকার, তারা তাহেরের নাগরিক ও আইনগত অধিকার ব্যাপকভাবে লঙ্ঘন করেছিল।
আজ আমি দুজন ব্যক্তির কথা স্মরণ করছি—বার্থোলোমিউ সাকো ও জিউসেপ্পি ভ্যানজেটি। এ দুই ইতালীয় অভিবাসী আমার দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন উন্নততর জীবনের খোঁজে। তাঁরা কোনো অপরাধ করেননি। তবে তাঁদের রাজনীতি মার্কিন কর্তৃপক্ষের পছন্দ হয়নি, ১৯২০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র সমাজতন্ত্রী, নৈরাজ্যবাদী ও কমিউনিস্টদের ব্যাপারে বিকারগ্রস্ত ছিল। সাকো ও ভ্যানজেটিকে একটি বিচারের পর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। সেই বিচারকাজে সব আইনগত মানদণ্ড সুপরিকল্পিতভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছিল। তবে সে বিচার তাহেরের বিচারের মতো গোপনে হয়নি। মৃত্যুদণ্ড থামানোর জন্য ইউরোপ, এশিয়া, লাতিন আমেরিকা ও যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়। তার পরও দুজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
কয়েক দশক ধরে এই মামলা ও বিচারকাজে বেআইনি কর্মকাণ্ড সম্পর্কিত নানা গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের গভর্নর মাইকেল ডুকাকিস ওই দুই ইতালীয়র মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার ৫০ বছর পর ১৯৭৯ সালে ঘোষণা করেন, সাকো ও ভ্যানজেটি নির্দোষ ছিলেন এবং তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। উল্লেখ্য, ম্যাসাচুসেটসেই তাঁদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। গভর্নর ডুকাকিস ঘোষণা করেছেন, প্রতিবছর তাঁদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার দিনটিকে ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্য ‘সাকো ও ভ্যানজেটি স্মরণ দিবস’ হিসেবে পালন করা হবে।
বাংলাদেশেও সময় এসেছে একই রকমের কিছু করার। এই কাজ সুসম্পন্ন করার উপযুক্ত পন্থা খুঁজে বের করতে হবে। ন্যায়বিচারের জন্য প্রয়োজন রায় আনুষ্ঠানিকভাবে উল্টে দেওয়া এবং এই মর্মে একটি সরকারি স্বীকৃতি যে আবু তাহেরের তথাকথিত পুরো বিচার ছিল যথাযথ আইনগত কার্যপ্রণালির এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন।
অতীতে ঘটে যাওয়া একটি অপরাধ সঠিকভাবে সংশোধন করা বেশ কঠিন। যা-ই করা হোক না কেন, তা কখনো যথেষ্ট হবে না। একটি জীবন কখনো ফিরিয়ে আনা যায় না। প্রতিদিন বাবার উপস্থিতি ছাড়া তিনটি শিশুর বেড়ে ওঠা কিংবা একজন অল্পবয়সী নারীর জীবনের বসন্তকালে স্বামীকে হারানোর অভিজ্ঞতা ‘প্রতিকারের’ কোনো উপায় নেই। এ ধরনের মনের ভেতরের ব্যাপারগুলো খুব বেশি প্রতিকারযোগ্য নয়। যা করা যেতে পারে তা খুবই যৎসামান্য: কর্তৃপক্ষের স্বীকার করে নেওয়া যে একটি দুঃখজনক ও ভুল কাজ হয়েছে। ন্যায়বিচারের জন্য এটা খুবই ন্যূনতম প্রয়োজন।
অবশ্যই হাজার হাজার হূদয়বিদারক ঘটনা আছে, যেগুলোর প্রতি সারা বিশ্বে সামান্যই মনোযোগ দেওয়া হয়। বাংলাদেশেও কারাগারে মৃত্যু ও সংক্ষিপ্ত বিচারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার অনেক ঘটনা রয়েছে, যেগুলো ঘটেছে ১৯৭৫, ১৯৭৭ ও ১৯৮১ সালে। এগুলোর প্রতিও সতর্কতার সঙ্গে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। আজ তাহেরের ঘটনার প্রতি আমরা দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্যান্য ঘটনার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় দায়িত্বকেও খাটো করে দেখা উচিত নয়। হয়তো বা এ ক্ষেত্রে সাফল্য ১৯৭০-এর দশকের পর ঘটে যাওয়া হেফাজতে বহু মৃত্যুর পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নে ও সরকারি ব্যাখ্যা প্রদানে সহায়ক হবে।
আশা করা যায়, আর্জেন্টিনা ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো একদিন বাংলাদেশেও একটি জাতীয় কমিশন গঠিত হবে এবং তা কারাগারে মৃত্যুর বহু ঘটনার দিকে ক্রমান্বয়ে দৃষ্টি দেবে, যেখানে সংক্ষিপ্ত বিচারের ফলে সংক্ষিপ্ত সময়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। আর্জেন্টিনার কমিশন ‘নুনকা মাস’ বা ‘আর কখনো নয়’ নামে একটি উল্লেখযোগ্য রিপোর্ট তৈরি করেছে। এ রিপোর্টের অভিঘাত এমন এক সমাজে আইনের শাসন পুনরুদ্ধারে সহায়ক হয়েছে, যে সমাজ হেফাজতে হাজার হাজার অন্তর্ধান ও মৃত্যুর কারণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
বাংলাদেশের প্রয়োজন তার অতীতের ঘটনার ব্যাপারে এ ধরনের একটি হিসাব-নিকাশ করা। অনেক ঘটনার মধ্যে মাত্র কয়েকটির উল্লেখ করছি, যেগুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত: ১৯৭৫ সালে তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর সহকর্মীদের মৃত্যু, ১৯৭৭ সালে সারা দেশের কারাগারগুলোতে গোপনে ৪০০-এরও বেশি সেনার মৃত্যুদণ্ড, ১৯৮১ সালে সেনা হেফাজতে জেনারেল মনজুরের মৃত্যু এবং ১৯৮১ সালে সামরিক বাহিনীর ১৩ কর্মকর্তার গোপন বিচার ও মৃত্যুদণ্ড। তাহেরের মামলার ন্যায়বিচারের আহ্বান কোনো নির্দিষ্ট দল বা নির্দিষ্ট সরকারের প্রতি নয়। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, তাদের উচিত তাহেরের মামলার রায় উল্টে দেওয়ার চেষ্টা করা।
আজ আমি খালেদা জিয়ার প্রতি তাঁর বিবেক সন্ধানের অনুরোধ করছি। কারণ, যাঁরা ক্ষমতার পথে অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েছেন, তাঁরা ‘বিবেক’ নামে পরিচিত ওই মিটমিটে আলোর সন্ধান পেতে সক্ষম হতে পারেন। আমি বিশ্বাস করি, মহাত্মা গান্ধী ও হেনরি ডেভিড থরো (মার্কিন লেখক, যাঁর দ্বারা গান্ধী অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন) একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সঠিক ছিলেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কোনো জটিল বিষয় বাছাই করতে মানুষের নৈতিক শক্তির অভাব থাকতে পারে। তার পরও তাঁদের একটি বিষয় বেছে নেওয়া উচিত, শেষ পর্যন্ত তাঁদের পছন্দটি নৈতিক বলে বিবেচিত হোক বা না-হোক।
এই পরিস্থিতিতে লক্ষণীয় হলো, খালেদা জিয়া একসময় আবু তাহেরকে একজন পারিবারিক বন্ধু হিসেবে গণ্য করতেন। তাহের তাঁর বাসায় বেড়াতে গেছেন এবং ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সকালে জিয়া যখন জীবন নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন, তখন তাহেরকেই ডেকেছিলেন। জিয়া জানতেন, উদ্ধারের জন্য তাহের ঠিক কাদের নিয়ে আসবেন। খালেদা দেখেছেন, তাহের আর তাঁর সহযোগীরা জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করেছেন। এরপর জিয়া বহু সেনার সামনে তাহেরকে তাঁর জীবন বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
আজ তাহেরের ফাঁসির ৩০তম বার্ষিকী। যে প্রক্রিয়ায় তাহেরের বিচার হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী কখনো প্রকাশ্যে সে প্রক্রিয়ার প্রতি সমর্থন দিতে পারেন—এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। এটা মানুষের কোনো ভদ্রতার মধ্যেই পড়ে না। একজন ব্যক্তি হিসেবে এটা স্বীকার করে নেওয়ার ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর রয়েছে যে তাহেরের বিচার এবং বিচারের প্রক্রিয়া পুরোপুরি ভুল, এমনকি অবৈধ ছিল। যদি তিনি এ সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে তিনি বলতে পারেন, ন্যায়বিচার প্রয়োজন, যা রায়কে উল্টে দেবে এবং অতীতের ভুল স্বীকার করে নিতে হবে। এর বেশি কিছু বলার প্রয়োজন নেই।
এমনটি যে ঘটবে সে ব্যাপারে আমি আশাবাদী নই এবং মোহগ্রস্তও নই। তবে একজন লেখক হিসেবে এটা তুলে ধরা এবং পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি উত্থাপন করার অধিকার আমার আছে। থরো বিশ্বাস করতেন, মানুষ অনেক দেরিতে হলেও তাঁদের আগের কোনো প্রতিকূল ধারণা ত্যাগ করতে বা অতীতের ভুল উপলব্ধি করতে পারেন, এতে কোনো বাধা নেই। তবে এটা তাঁদের জন্য খুবই বিরল ঘটনা। যদিও এটা তাঁদের পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার।
আমার নিজের মত হলো, ভবিষ্যতে কোনো সরকার এ বিষয়ে নৈতিক ও নীতিগত পন্থায় ভূমিকা রাখবে। যে পর্যন্ত না তাহেরের মামলার রায় উল্টে যাচ্ছে, সে পর্যন্ত আমাদের বিরাম নেই। আমার বন্ধুরা, এটা ন্যায়বিচারের প্রশ্ন।
২০০৬ সালের ২১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে প্রদত্ত বক্তৃতা, ইংরেজি থেকে অনূদিত।
লরেন্স লিফশুলজ: প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক।
আজ থেকে ঠিক ৩০ বছর আগে আমি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এক দিন আগেই চলে এসেছিলাম আমি। ‘স্মৃতিতে ধরে রাখার মতো একটি দিন।’ সেদিন ছিল ২৮ জুন, ১৯৭৬।
এক সপ্তাহ আগে ‘এক নম্বর বিশেষ সামরিক আদালত’ গোপনে তাঁদের কাজ শুরু করেছিলেন। এক দিনের জন্য আদালত বসার পর একটি মামলার বিবাদীপক্ষের আইনজীবীদের প্রস্তুতির জন্য সাত দিনের সময় দিয়ে আদালত এক সপ্তাহের অবকাশে চলে যান। ছয় মাস আগে থেকেই মামলার প্রস্তুতি চলছিল। কর্নেল আবু তাহেরসহ ২০ জনেরও বেশি লোকের বিচার শুরু হয়েছিল। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বন্দিজীবনের পুরো সময়টিতে বারবার আবেদন সত্ত্বেও তাঁদের আইনগত পরামর্শ এবং স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ দেওয়া হয়নি।
বিচার শুরুর পর এই সংবাদদাতা হংকংয়ে দ্য ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ-এ এবং লন্ডনে বিবিসি ও দ্য গার্ডিয়ান-এ এ সংক্রান্ত খবর পাঠান। সে সময় আমি ছিলাম রিভিউ-এর দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের সংবাদদাতা। এসব রিপোর্ট পাঠাতে আমি বাধার সম্মুখীন হয়েছি। অবশেষে একজন যাত্রী একটি আন্তর্জাতিক বিমানে করে এর কপিগুলো নিয়ে যান। যার অর্থ দাঁড়ায়, বিচারের খবরগুলো থাইল্যান্ড থেকে পাঠানো হয়েছিল। ফলে ঢাকাবাসী এ সংক্রান্ত প্রথম রিপোর্টগুলো পেয়েছিলেন বিবিসি বাংলা বিভাগের মাধ্যমে।
২৮ জুন যখন বিচারকাজ পুনরায় শুরু হয়, তখন প্রধান কৌঁসুলি এ টি এম আফজাল, এই সামরিক আদালতের চেয়ারম্যান কর্নেল ইউসুফ হায়দার এবং অন্যরা জেলগেটে প্রবেশ করার সময় আমি (আমি ১৯৭৪ সালের পুরো সময় বাংলাদেশ থেকে সংবাদ পাঠিয়েছি) তাঁদের ছবি তোলার জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। উপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তারা আমাকে বলেন, এটি অতি গোপনীয় বিচার এবং আমাকে কারও বা কোনো কিছুর ছবি তুলতে দেওয়া হবে না। আমি জানাই, আমি কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ নিয়ে রিপোর্ট করছি। আমি তুলনামূলকভাবে একজন সুপরিচিত ব্যক্তি এবং এ ধরনের কোনো সরকারি নির্দেশনা আছে বলে আমার জানা নেই। যদি তাঁরা আমাকে এ বিষয়ে রিপোর্ট করতে বা ছবি তুলতে দিতে না চান, তাহলে তাঁদের উচিত আমাকে এ ব্যাপারে তথ্য মন্ত্রণালয়ের লিখিত নির্দেশ দেখানো। অন্যথায় একজন সাংবাদিক হিসেবে আমি নির্বিঘ্নে আমার কাজ চালিয়ে যাব। যে পুলিশ কর্মকর্তা আমাকে প্রশ্ন করছিলেন, এরপর আমি তাঁর ছবি তুলি। তিনি হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলেন এবং দৌড়ে চলে যান।
সেদিন সকালে অনেক ঘটনাই ঘটে যায়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ভারী লোহার গেট দিয়ে কালো কোট পরা ৩০ জন ব্যারিস্টার বিচারের প্রথম অধিবেশনে আসেন। প্রতিষ্ঠিত কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের অভিযোগ ও বিচারের ঘটনা ঘটে, যখন আগের চারটি সরকার একের পর এক ক্ষমতায় এসেছিল অস্ত্রের বলে পূর্ববর্তী সরকারকে হটিয়ে। অধিকন্তু যেসব কর্মকর্তা ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছিলেন এবং সরকারি সংবাদপত্রে যাঁদের ‘ভারতের এজেন্ট’ বলে ভর্ৎসনা করা হয়েছিল, তাঁদের সবাইকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যাঁরা, তাঁরা হলেন ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত জামিল, যিনি জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করে রেখেছিলেন। সুতরাং ব্যাপারটা দাঁড়ায়, যেসব কর্মকর্তা ৩ নভেম্বরের জিয়াবিরোধী অভ্যুত্থানের পেছনে ছিলেন, তাঁরা ছিলেন মুক্ত আর যেসব ব্যক্তি ৭ নভেম্বর সাধারণ অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলেন—যে ঘটনায় জিয়া মুক্তি পেয়েছিলেন—তাঁরা বিচারে মৃত্যুদণ্ডের সম্মুখীন।
সেই ২১ জুন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটে আমি যখন অপেক্ষা করছিলাম, তখন জেলের সুউচ্চ রংচটা হলদে-বিবর্ণ প্রাচীরের ওপাশে খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিচারকাজ শুরু হলো। বাংলাদেশ অথবা ‘পূর্ব পাকিস্তানে’র ইতিহাসে আগে কখনো একটি কারাগারের চৌহদ্দির মধ্যে বিচারের ঘটনা ঘটেনি। যাঁরা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আইনজীবী, তাঁদের বিচারপ্রক্রিয়া অনুযায়ী গোপনীয়তার শপথ নিতে হলো। দেশের ভেতরে মামলার সব খবরের ওপর গোপনীয়তা আরোপ করা হয়েছিল। কারাগারের নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল ব্যতিক্রমী: প্রতিটি প্রবেশপথের চারপাশে বালুর বস্তাসংবলিত মেশিনগান রাখা হয়েছিল। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে কর্তৃপক্ষ জেলের ভেতরে বিচারের আয়োজন করেছিল সম্ভাব্য গোলযোগ এড়ানোর উদ্দেশ্যে। প্রকাশ্য বিচার হলে আদালতে যাওয়ার পথে এই গোলযোগ ঘটতে পারত।
জেলগেটে দুই ঘণ্টারও বেশি সময় অবস্থান করার পর আমি সেদিনের মতো একাই সেখান থেকে বিদায় নিই। বিচারকাজ কেন এ রকম গোপনীয়তার সঙ্গে হচ্ছে, সে ব্যাপারে একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতি পাওয়ার জন্য আমি সামরিক আদালতের চেয়ারম্যানের সাক্ষাৎকার নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বেলা ১১টায় আমাকে গ্রেপ্তার করে জেলে আটক রাখা হয়। কারাগারে প্রবেশের সময় আমি যেসব ছবি তুলেছিলাম, আমাকে সেসব ছবির ফিল্ম সমর্পণ করতে বলা হয়।
আমি পুলিশ কর্মকর্তাদের এবং সেনাবাহিনীর যে লেফটেন্যান্ট আমাকে হাজতে নিয়ে এসেছেন, তাঁকে জানাই, আমি স্বেচ্ছায় ফিল্ম দেব না। এরপর ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্স (এনএসআই) সংস্থা এবং সামরিক আইন সদর দপ্তরে ফোন করা হয়। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ১০ জন কর্মকর্তা এসে হাজির হন। একজনমাত্র সাংবাদিকের জন্য এতজন নিরাপত্তাকর্মী!
একজন এনএসআই কর্মকর্তা, যিনি নিজেকে শামিম আহমেদ বলে উল্লেখ করেন, আমাকে জিজ্ঞেস করেন, কেন আমি তাহেরের মামলায় আগ্রহী। আমি ব্যাখ্যা দিই, গোপন বিচার আমাকে এ ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলেছে, যে ধরনের বিচার স্তালিন, ফ্রাঙ্কো বা জিয়া করেছেন। আমি তাঁকে বলি, আমি একজন রিপোর্টার, কাজেই মুজিবের হত্যাকারী ছয় মেজরকে যদি খালেদ মোশাররফ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে রাখতেন, তাহলেও আমি সে ঘটনার রিপোর্ট করতাম। এবং যদি খালেদ জীবিত থাকতেন এবং জিয়া তাঁকে বিচারের সম্মুখীন করতেন, তাহলেও আমি এখনকার মতো রিপোর্ট করার চেষ্টার জন্য জেলে থাকতাম। এবং এখন জিয়া তাহেরকে একটি কারাগারের ভেতরে বিচারের সম্মুখীন করেছেন, যেখানে গোপনীয়তা রক্ষার শপথের কারণে আইনজীবীরা আতঙ্কগ্রস্ত, আমি এর রিপোর্ট করব। আমি শামিম আহমেদকে জিজ্ঞেস করি, যা ঘটছে, জনগণ তা জানলে তাতে দোষের কী আছে? তিনি আমার ক্যামেরা কেড়ে নেন এবং সেটা একজন তরুণ টেলিযোগাযোগ কর্মকর্তার হাতে দেন। কয়েক বছর আগে এই লোক আমেরিকান অফিস অব পাবলিক সেইফটি প্রোগ্রামের অধীনে নিউইয়র্কে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তিনি ক্যামেরা থেকে ফিল্মটি ছিঁড়ে বের করে ফেলেন।
আমি কয়েক ঘণ্টা জেলে বন্দী ছিলাম। সে সময় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এরপর কী করা হবে। সেনাবাহিনীর একজন মেজর বলেন, সদর দপ্তর মনে করে, একজন বিদেশি সংবাদদাতাকে আটক রাখা অস্বস্তিদায়ক হতে পারে। সেদিন সন্ধ্যায় আমি তাহেরের বিচারসম্পর্কিত আরেকটি তারবার্তা পাঠাতে যাই। তারবার্তা অফিস আমার রিপোর্টটি গ্রহণ করেছিল, কিন্তু পাঠায়নি।
পরদিন সন্ধ্যায় আমি আমার আবাসস্থলে ফেরার পর পাঁচজন স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) কর্মকর্তা আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁরা জানান, আমাকে আবারও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তাঁদের ওপর নির্দেশ রয়েছে আমাকে সরাসরি বিমানবন্দরে নিয়ে গিয়ে দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য প্রথম যে বিমানটি পাওয়া যাবে, তাতে তুলে দেওয়ার। প্রথম বিমানটি ভারতে যাচ্ছিল। ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা সম্পর্কে রিপোর্ট করার জন্য ছয় মাস আগে আমাকে ভারত থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। দিল্লিতে সেই দিনগুলোতে খুব কঠোর সেন্সরশিপ ছিল এবং কোনো বিদেশি সংবাদদাতাই এর প্রতি ভ্রুক্ষেপ করতেন না। কাজেই ভারত থেকে সাংবাদিক হিসেবে কেবল আমাকেই সসম্মানে বিতাড়িত করা হয়নি, আমার ঘটনাটি ছিল সর্বশেষ।
আমি এসবি কর্মকর্তাদের ধৈর্যের সঙ্গে বললাম, তাঁরা আমাকে ভারতে বহিষ্কার করতে পারেন না, কেননা ইতিমধ্যেই সেখান থেকে আমি বহিষ্কৃত হয়েছি। শেষ পর্যন্ত ব্যাংককে যাওয়ার পরবর্তী বিমানে উঠিয়ে দেওয়ার আগ পর্যন্ত আমাকে তিন দিন গৃহবন্দী করে রাখা হলো। ২১ জুলাই আমাকে থাইল্যান্ডে পাঠিয়ে দেওয়া হলো এবং তাহেরের বিচারসম্পর্কিত সবশেষ বিদেশি ও অভ্যন্তরীণ সংবাদ প্রতিবেদনের সমাপ্তি ঘটল। এরপর কর্তৃপক্ষ তাদের গোপনীয়তা নির্বিঘ্নে বজায় রাখতে পারল।
আরও ১৭ দিন বিচারকাজ চলে। তাহের শুরুতে সামরিক আদালতে যেতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি একে ‘বিচারের নামে সরকারের অপরাধ সংঘটনের একটি হাতিয়ার’ আখ্যা দেন। তিনি আরও বলেন, তাঁর বিচার করতে হলে জুরিদের তালিকায় সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের থাকতে হবে, যাঁরা দেশের জন্য যুদ্ধ করেছেন—ইউসুফ হায়দারের মতো লোকেরা থাকলে হবে না—যিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। কিন্তু যখন আদালত গঠিত হয়, তখন এতে কোনো মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তা ছিলেন না।
তাহেরের আইনজীবীরা শেষ পর্যন্ত তাঁকে বিচারকাজে অংশগ্রহণ করাতে সক্ষম হন। তাঁরা প্রথমে ভেবেছিলেন, আদালত ভীতি প্রদর্শন ছাড়াই কাজ করতে পারবেন। তাঁদের অনেককে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, সামরিক আদালত শুরু হওয়ার অনেক আগেই তাহেরের দণ্ড নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল, পরে যা জেনে তাঁরা আক্ষেপ করেছেন। ১৭ জুলাই আদালতের চেয়ারম্যান ইউসুফ হায়দার দণ্ডাদেশ ঘোষণা করেন। সেনাবাহিনীর হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে হায়দার তাহেরকে মৃত্যুদণ্ড দেন।
বিচার চলাকালে পুরো মাসে এ মামলাসংক্রান্ত অথবা বিচার নিয়ে রিপোর্ট করার চেষ্টার কারণে আমাকে বহিষ্কার করা-সংক্রান্ত একটি খবরও বাংলাদেশের সংবাদপত্রে দেখা যায়নি, যদিও প্রত্যেক সম্পাদক এবং অনেক সাংবাদিক ভালো করেই জানতেন কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রাচীরের ভেতরে কী ঘটছে। মে মাসে অর্থাৎ, বিচার শুরু হওয়ার এক মাস আগে একটি অঘোষিত কিন্তু ভালোভাবেই বোধগম্য গোপনীয় সংবাদের সামান্য লঙ্ঘন হয়, ইত্তেফাক-এর পেছনের পাতায় এক ইঞ্চির একটি খবর ছাপা হয় ‘ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হচ্ছে?’ শিরোনামে। তৎক্ষণাৎ সেনাবাহিনীর সদর দপ্তর ইত্তেফাক-এর সম্পাদক আনোয়ার হোসেনকে ডেকে পাঠায় এবং শাসিয়ে দেয়, আবারও যদি এই চেষ্টা করা হয়, তাহলে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হবে।
সংবাদপত্রের মুখ বন্ধ করে দিয়ে ১৮ জুন বিচার সম্পন্ন হওয়ার পর সরকার এ মামলার ব্যাপারে একটি সরকারি বিবৃতি প্রকাশের জন্য পত্রিকাগুলোকে নির্দেশ দেয়, এর বেশি কিছু নয়। বাংলাদেশ অবজারভার ও অন্যান্য পত্রিকায় ব্যানার শিরোনামে তাহেরের মৃত্যুদণ্ডের ঘোষণা ছাপা হয়। এটা ছিল বাংলা প্রচারমাধ্যমে এ-সম্পর্কিত প্রথম সংবাদ, যা প্রকাশিত হয় বিচারকাজ শেষ হয়ে যাওয়ার পর। অবশ্যই সেখানে আদালতে তাহেরের মর্মস্পর্শী ভাষণ অথবা আদালতের কোনো কার্যবিবরণী প্রকাশের অনুমতি দেওয়া হয়নি। যদিও তাহের জোরের সঙ্গে বলেছিলেন, তিনি তাঁর নামে কোনো আপিল করতে চান না এবং সরকারের কাছে তাঁর কিছুই চাওয়ার নেই, তা সত্ত্বেও তাঁর আইনজীবীরা রাষ্ট্রপতি এ এম সায়েমের প্রতি দণ্ডাদেশ রদ করার আবেদন জানান। আইনজীবী আতাউর রহমান খান ও জুলমত আলী আইন বুঝতেন এবং এটিও বুঝতেন, কীভাবে তাহেরের বিচার আইনের সবচেয়ে মৌলিক সত্যকে লঙ্ঘন করেছে। তবে সে সময় তাহেরের আইনজীবীরা উপলব্ধি করতে পারেননি এই বিচারের গোপন এজেন্ডার ওই অংশটি ছিল একটি মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করার ‘দ্রুত পন্থা’। সায়েম শিগগিরই এই এজেন্ডার একজন অপরিহার্য উপাদান হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করেন।
অনেক সময় বলা হয়ে থাকে, আমাদের সভ্যতার প্রলেপ খুবই পাতলা। সে সময় এ এম সায়েমের ভূমিকা দেখিয়ে দিয়েছে, এটা কত বেশি পাতলা হতে পারে। সায়েম ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রধান বিচারপতি। পাঁচ বছর আগে তিনি প্রাণদণ্ডার্হ শাস্তি এবং সুপ্রিম কোর্ট দ্বারা একজন অভিযুক্তের অধিকার-সম্পর্কিত সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইনগত সিদ্ধান্তটি লিখেছিলেন। পূর্ণচন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে মামলায় সায়েম অভিযুক্তকে দেওয়া একটি মৃতুদণ্ডাদেশ রদ করেছিলেন। এই রায়টি যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত মিরান্ডা সিদ্ধান্তের মতো একটি আইনগত নজিরে পরিণত হয়, যা বিচারের সম্মুখীন একজন অভিযুক্তের জন্য আইনগত সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে। সায়েম যুক্তি দেখিয়েছিলেন, ‘একজন অভিযুক্তের জন্য শেষ মুহূর্তে একজন আত্মপক্ষ সমর্থনকারী আইনজীবীর নিয়োগ মামলায় একজন অভিযুক্তের সঠিকভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকারকে কার্যত রদ করে।’
মণ্ডল মামলায় সায়েম লিখেছিলেন: ‘ফৌজদারি কার্যপ্রণালি বিধি প্রত্যেক অভিযুক্ত ব্যক্তিকে একটি ফৌজদারি আদালতের সামনে আনার আগে একজন আইনজীবী দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার দেয়। এই অধিকার ব্যক্তিগত পরামর্শের জন্য আইনজীবীর আশ্রয় নেওয়া এবং পরবর্তীকালে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য মামলা প্রস্তুতির পর্যাপ্ত সুযোগ প্রদান পর্যন্ত সম্প্রসারিত। প্রাণদণ্ডার্হ অপরাধে অভিযুক্ত একজন বন্দীর আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য শেষ মুহূর্তে একজন আইনজীবী নিয়োগ লিগ্যাল রিমেমবের্যান্স ম্যানুয়ালের ১২ অনুচ্ছেদের ধারাই কেবল লঙ্ঘন করে না...ওই অনুচ্ছেদের বিস্তৃত ধারাগুলোর পেছনের উদ্দেশ্যও ব্যাহত করে। এ ধরনের নিয়োগের ফলে বন্দী কার্যপ্রণালি বিধির ৩৪০ অনুচ্ছেদ দ্বারা প্রাপ্য অধিকারও অগ্রাহ্য করা হয়। এই অধিকার অগ্রাহ্য করা হলে বিচার আইনানুগ হয়নি বলে গণ্য হবে এবং নতুন করে বিচারের প্রয়োজন হবে।’
তাহের তাঁর বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত আইনজীবীর আশ্রয় নেওয়ার অনুমতি পাননি। এভাবে সায়েমের নিজের ভাষায় এ ধরনের বিচার ছিল ‘আইন অনুযায়ী নয়’। তা সত্ত্বেও সায়েম একজন বিচারক হিসেবে লিখেছিলেন, পর্যাপ্ত আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার ছাড়া আইনের অধীনে কোনো ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যেতে পারে না। এখন রাষ্ট্রপতি পদে থেকে তিনি তাহেরের মৃত্যুদণ্ড পুনরায় সমর্থন করলেন। এবং দণ্ডাদেশ দেওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত নিলেন। এখানে সবার জন্য দেখার বিষয়টি হলো, একজন বিচারক অপরাধীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এটা মানুষের ভণ্ডামির একটি সাধারণ উদাহরণ মাত্র। সায়েম সম্পর্কে আর কী বলার আছে, যিনি তাহেরের মৃত্যুদণ্ডের স্বীকৃতি দিয়ে সরাসরি আইন লঙ্ঘন করেছেন, যা তিনি নিজেই মণ্ডল মামলায় স্পষ্টভাবে বলেছিলেন।
তাহেরের বিচারের পর প্রধান কৌঁসুলি এ টি এম আফজাল ঢাকা উচ্চ আদালতের বিচারক পদে নিয়োগ পান এবং পরে তিনি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭৬ সালে তিনি ছিলেন একজন উদ্বিগ্ন ব্যক্তি। তিনি তাঁর সহকর্মীদের কাছে দাবি করেছিলেন, মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারে তিনি অন্য যে-কারও চেয়ে বেশি হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলেন। একজন কৌঁসুলি হিসেবে তিনি দাবি করেছেন, তিনি কখনো মৃত্যুদণ্ড চাননি। তিনি বলেছেন, এ ধরনের রায় অসম্ভব ছিল। এমন কোনো আইনের অস্তিত্ব ছিল না, যার অধীনে তাহেরকে তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যেতে পারে।
কিন্তু আফজাল কি রায়ের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছিলেন অথবা এই বিয়োগান্ত ঘটনায় তাঁর ভূমিকার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন? কখনো কি তিনি প্রতিবাদ করার কথা বিবেচনা করেছিলেন এবং বলেছিলেন, তিনি কেন্দ্রীয় কারাগারের চৌহদ্দির ভেতরে অনুষ্ঠিত গোপন বিচারের একটি পক্ষ হবেন না? আমরা যদি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রধান বিচারপতির (যিনি ১৯৭৬ সালের গ্রীষ্মে একটি দীর্ঘ ও সম্ভাবনাময় কর্মজীবনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছিলেন) ‘সাহসিকতার প্রতিকৃতি’ অথবা চরিত্রে নীতিবোধের প্রমাণ অনুসন্ধান করি, তাহলে আমরা সে ধরনের কোনো প্রমাণ খুঁজে পাব না।
এখন ৩০টি বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কী ঘটেছে আমরা সবাই জানি। আজ আমরা তাহেরের ফাঁসির ৩০তম বার্ষিকী পালন করছি। আমার দৃষ্টিতে রাষ্ট্র ও বিচার বিভাগের উচিত, প্রকাশ্যে এ ঘোষণা দেওয়া যে আবু তাহেরের বিচার ভুল ছিল এবং তাঁর মৃত্যুদণ্ডও ভুল ছিল। ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাইয়ের রায় ত্যাগ করা উচিত এবং এমন একটি সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া উচিত যে তাঁকে বিচারের সম্মুখীন করেছিল যে সরকার, তারা তাহেরের নাগরিক ও আইনগত অধিকার ব্যাপকভাবে লঙ্ঘন করেছিল।
আজ আমি দুজন ব্যক্তির কথা স্মরণ করছি—বার্থোলোমিউ সাকো ও জিউসেপ্পি ভ্যানজেটি। এ দুই ইতালীয় অভিবাসী আমার দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন উন্নততর জীবনের খোঁজে। তাঁরা কোনো অপরাধ করেননি। তবে তাঁদের রাজনীতি মার্কিন কর্তৃপক্ষের পছন্দ হয়নি, ১৯২০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র সমাজতন্ত্রী, নৈরাজ্যবাদী ও কমিউনিস্টদের ব্যাপারে বিকারগ্রস্ত ছিল। সাকো ও ভ্যানজেটিকে একটি বিচারের পর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। সেই বিচারকাজে সব আইনগত মানদণ্ড সুপরিকল্পিতভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছিল। তবে সে বিচার তাহেরের বিচারের মতো গোপনে হয়নি। মৃত্যুদণ্ড থামানোর জন্য ইউরোপ, এশিয়া, লাতিন আমেরিকা ও যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়। তার পরও দুজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
কয়েক দশক ধরে এই মামলা ও বিচারকাজে বেআইনি কর্মকাণ্ড সম্পর্কিত নানা গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে গেলে ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের গভর্নর মাইকেল ডুকাকিস ওই দুই ইতালীয়র মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার ৫০ বছর পর ১৯৭৯ সালে ঘোষণা করেন, সাকো ও ভ্যানজেটি নির্দোষ ছিলেন এবং তাঁদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। উল্লেখ্য, ম্যাসাচুসেটসেই তাঁদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। গভর্নর ডুকাকিস ঘোষণা করেছেন, প্রতিবছর তাঁদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার দিনটিকে ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্য ‘সাকো ও ভ্যানজেটি স্মরণ দিবস’ হিসেবে পালন করা হবে।
বাংলাদেশেও সময় এসেছে একই রকমের কিছু করার। এই কাজ সুসম্পন্ন করার উপযুক্ত পন্থা খুঁজে বের করতে হবে। ন্যায়বিচারের জন্য প্রয়োজন রায় আনুষ্ঠানিকভাবে উল্টে দেওয়া এবং এই মর্মে একটি সরকারি স্বীকৃতি যে আবু তাহেরের তথাকথিত পুরো বিচার ছিল যথাযথ আইনগত কার্যপ্রণালির এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন।
অতীতে ঘটে যাওয়া একটি অপরাধ সঠিকভাবে সংশোধন করা বেশ কঠিন। যা-ই করা হোক না কেন, তা কখনো যথেষ্ট হবে না। একটি জীবন কখনো ফিরিয়ে আনা যায় না। প্রতিদিন বাবার উপস্থিতি ছাড়া তিনটি শিশুর বেড়ে ওঠা কিংবা একজন অল্পবয়সী নারীর জীবনের বসন্তকালে স্বামীকে হারানোর অভিজ্ঞতা ‘প্রতিকারের’ কোনো উপায় নেই। এ ধরনের মনের ভেতরের ব্যাপারগুলো খুব বেশি প্রতিকারযোগ্য নয়। যা করা যেতে পারে তা খুবই যৎসামান্য: কর্তৃপক্ষের স্বীকার করে নেওয়া যে একটি দুঃখজনক ও ভুল কাজ হয়েছে। ন্যায়বিচারের জন্য এটা খুবই ন্যূনতম প্রয়োজন।
অবশ্যই হাজার হাজার হূদয়বিদারক ঘটনা আছে, যেগুলোর প্রতি সারা বিশ্বে সামান্যই মনোযোগ দেওয়া হয়। বাংলাদেশেও কারাগারে মৃত্যু ও সংক্ষিপ্ত বিচারে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার অনেক ঘটনা রয়েছে, যেগুলো ঘটেছে ১৯৭৫, ১৯৭৭ ও ১৯৮১ সালে। এগুলোর প্রতিও সতর্কতার সঙ্গে দৃষ্টি দেওয়া উচিত। আজ তাহেরের ঘটনার প্রতি আমরা দৃষ্টি নিবদ্ধ করলেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্যান্য ঘটনার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় দায়িত্বকেও খাটো করে দেখা উচিত নয়। হয়তো বা এ ক্ষেত্রে সাফল্য ১৯৭০-এর দশকের পর ঘটে যাওয়া হেফাজতে বহু মৃত্যুর পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নে ও সরকারি ব্যাখ্যা প্রদানে সহায়ক হবে।
আশা করা যায়, আর্জেন্টিনা ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো একদিন বাংলাদেশেও একটি জাতীয় কমিশন গঠিত হবে এবং তা কারাগারে মৃত্যুর বহু ঘটনার দিকে ক্রমান্বয়ে দৃষ্টি দেবে, যেখানে সংক্ষিপ্ত বিচারের ফলে সংক্ষিপ্ত সময়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে। আর্জেন্টিনার কমিশন ‘নুনকা মাস’ বা ‘আর কখনো নয়’ নামে একটি উল্লেখযোগ্য রিপোর্ট তৈরি করেছে। এ রিপোর্টের অভিঘাত এমন এক সমাজে আইনের শাসন পুনরুদ্ধারে সহায়ক হয়েছে, যে সমাজ হেফাজতে হাজার হাজার অন্তর্ধান ও মৃত্যুর কারণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
বাংলাদেশের প্রয়োজন তার অতীতের ঘটনার ব্যাপারে এ ধরনের একটি হিসাব-নিকাশ করা। অনেক ঘটনার মধ্যে মাত্র কয়েকটির উল্লেখ করছি, যেগুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়া উচিত: ১৯৭৫ সালে তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁর সহকর্মীদের মৃত্যু, ১৯৭৭ সালে সারা দেশের কারাগারগুলোতে গোপনে ৪০০-এরও বেশি সেনার মৃত্যুদণ্ড, ১৯৮১ সালে সেনা হেফাজতে জেনারেল মনজুরের মৃত্যু এবং ১৯৮১ সালে সামরিক বাহিনীর ১৩ কর্মকর্তার গোপন বিচার ও মৃত্যুদণ্ড। তাহেরের মামলার ন্যায়বিচারের আহ্বান কোনো নির্দিষ্ট দল বা নির্দিষ্ট সরকারের প্রতি নয়। যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, তাদের উচিত তাহেরের মামলার রায় উল্টে দেওয়ার চেষ্টা করা।
আজ আমি খালেদা জিয়ার প্রতি তাঁর বিবেক সন্ধানের অনুরোধ করছি। কারণ, যাঁরা ক্ষমতার পথে অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়েছেন, তাঁরা ‘বিবেক’ নামে পরিচিত ওই মিটমিটে আলোর সন্ধান পেতে সক্ষম হতে পারেন। আমি বিশ্বাস করি, মহাত্মা গান্ধী ও হেনরি ডেভিড থরো (মার্কিন লেখক, যাঁর দ্বারা গান্ধী অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন) একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সঠিক ছিলেন। তাঁরা বিশ্বাস করতেন, কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নীতি-নৈতিকতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। কোনো জটিল বিষয় বাছাই করতে মানুষের নৈতিক শক্তির অভাব থাকতে পারে। তার পরও তাঁদের একটি বিষয় বেছে নেওয়া উচিত, শেষ পর্যন্ত তাঁদের পছন্দটি নৈতিক বলে বিবেচিত হোক বা না-হোক।
এই পরিস্থিতিতে লক্ষণীয় হলো, খালেদা জিয়া একসময় আবু তাহেরকে একজন পারিবারিক বন্ধু হিসেবে গণ্য করতেন। তাহের তাঁর বাসায় বেড়াতে গেছেন এবং ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সকালে জিয়া যখন জীবন নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন, তখন তাহেরকেই ডেকেছিলেন। জিয়া জানতেন, উদ্ধারের জন্য তাহের ঠিক কাদের নিয়ে আসবেন। খালেদা দেখেছেন, তাহের আর তাঁর সহযোগীরা জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করেছেন। এরপর জিয়া বহু সেনার সামনে তাহেরকে তাঁর জীবন বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
আজ তাহেরের ফাঁসির ৩০তম বার্ষিকী। যে প্রক্রিয়ায় তাহেরের বিচার হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী কখনো প্রকাশ্যে সে প্রক্রিয়ার প্রতি সমর্থন দিতে পারেন—এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। এটা মানুষের কোনো ভদ্রতার মধ্যেই পড়ে না। একজন ব্যক্তি হিসেবে এটা স্বীকার করে নেওয়ার ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর রয়েছে যে তাহেরের বিচার এবং বিচারের প্রক্রিয়া পুরোপুরি ভুল, এমনকি অবৈধ ছিল। যদি তিনি এ সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে তিনি বলতে পারেন, ন্যায়বিচার প্রয়োজন, যা রায়কে উল্টে দেবে এবং অতীতের ভুল স্বীকার করে নিতে হবে। এর বেশি কিছু বলার প্রয়োজন নেই।
এমনটি যে ঘটবে সে ব্যাপারে আমি আশাবাদী নই এবং মোহগ্রস্তও নই। তবে একজন লেখক হিসেবে এটা তুলে ধরা এবং পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি উত্থাপন করার অধিকার আমার আছে। থরো বিশ্বাস করতেন, মানুষ অনেক দেরিতে হলেও তাঁদের আগের কোনো প্রতিকূল ধারণা ত্যাগ করতে বা অতীতের ভুল উপলব্ধি করতে পারেন, এতে কোনো বাধা নেই। তবে এটা তাঁদের জন্য খুবই বিরল ঘটনা। যদিও এটা তাঁদের পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার।
আমার নিজের মত হলো, ভবিষ্যতে কোনো সরকার এ বিষয়ে নৈতিক ও নীতিগত পন্থায় ভূমিকা রাখবে। যে পর্যন্ত না তাহেরের মামলার রায় উল্টে যাচ্ছে, সে পর্যন্ত আমাদের বিরাম নেই। আমার বন্ধুরা, এটা ন্যায়বিচারের প্রশ্ন।
২০০৬ সালের ২১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র মিলনায়তনে প্রদত্ত বক্তৃতা, ইংরেজি থেকে অনূদিত।
লরেন্স লিফশুলজ: প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক।
No comments