ধর্ম-নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ইসলাম by মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান

পবিত্র কোরআনে নারীর প্রতি অত্যন্ত সম্মান দেখানো হয়েছে এবং ইসলামে নারীদের নির্যাতন করার কোনো সুযোগ নেই। নারী নির্যাতনকারীকে ঘৃণ্য অপরাধী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যেসব কারণে নারীরা সমাজে নির্যাতিত হয়, সেসব থেকে বিরত থাকতে মুসলমানদের আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিয়েছেন।


বর্তমানে সারা দুনিয়ায় নারী-পুরুষ কোনো না কোনোভাবে নির্যাতিত হচ্ছে। আমাদের দেশেও নারী নির্যাতনের ঘটনা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। নির্যাতনের ফলে অনেকের মৃত্যু হয়, কেউ আত্মহত্যায় বাধ্য হয়। কখনো স্বামী স্ত্রীকে অথবা স্ত্রী স্বামীকে হত্যা করছে। এসবের মূলে রয়েছে মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ, সম্প্রীতি ও ভালোবাসার অভাব এবং নারীর সম্পদের মোহ ও লালসা তাদের অন্তরকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। অথচ এসব লোভনীয় জাগতিক উপকরণ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘নারী, সন্তান, সোনা ও রুপার ভাণ্ডার এবং পছন্দসই ঘোড়া ও চতুষ্পদ জন্তু এবং খেত-খামারের প্রতি আসক্তি মানুষের কাছে মনোরম করা হয়েছে। এসব পার্থিব ভোগ্যবস্তু এবং আল্লাহর কাছে উত্তম আশ্রয়স্থল রয়েছে।’ (সূরা আলে ইমরান, আয়াত-১৪)
সারা বিশ্বে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উভয় প্রকারে অর্থের লোভে বিদেশে নারী পাচার করে, স্বামী-স্ত্রীর বিরোধের জের হিসেবে বা যৌতুকের জন্য মারপিট করে বা শ্বাসরুদ্ধ করে, বিষ প্রয়োগে, ধর্ষণের পর হত্যা করে, গুলি করে এবং এসিড নিক্ষেপ করে নানান উপায়ে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন চলছে। ইসলাম পরিপন্থী এসব লোমহর্ষক নির্যাতন বন্ধের উপায় খুঁজে বের করে সমস্যার সমাধানকল্পে ধর্মপ্রাণ জাতিকে ঐক্যবদ্ধভাবে চেষ্টা চালানো খুবই জরুরি। এসিড মেরে নারীর প্রতি প্রতিহিংসা চরিতার্থকরণ, যৌতুকের জন্য নিরীহ বধূর ওপর শ্বশুরালয়ের সবাই মিলে মানসিক নির্যাতন চালানো, কখনো শারীরিক অত্যাচার এমনকি অধিকাংশ সময় হত্যার ঘটনাও ঘটে থাকে। নারী নির্যাতন বন্ধে অভিভাবক মহলের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা দরকার। সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে যে নারী-পুরুষ মিলে যে ঘর-সংসার, বহু ঘর নিয়ে যে মুসলিম সমাজ, সেখানে প্রত্যেকেরই গুরুত্ব, মর্যাদা, অধিকার ও ভূমিকা রয়েছে।
ইসলামের বৈবাহিক রীতি অনুযায়ী দুজন আল্লাহভীরু নারী ও পুরুষ পরস্পরকে পছন্দ করে যে নীড় বাঁধে, সে সুখের ঘরে একে-অপরের প্রতি কোনোক্রমেই শত্রুভাবাপন্ন ও নির্যাতনকারী হতে পারে না। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে পারস্পরিক বিশ্বাস ও ভালোবাসাই ঘরের বন্ধনটি সুদৃঢ় এবং শান্তিময় করে রাখতে পারে। ইসলামে নারীকে অনেক বেশি মর্যাদা ও অধিকার দেওয়া হয়েছে। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ইসলাম ধর্মের জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে। নারী-পুরুষের সুন্দর শান্তিময় জীবন সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন, ‘পুরুষদের যেমন স্ত্রীদের ওপর অধিকার রয়েছে, তেমনিভাবে স্ত্রীদেরও পুরুষদের ওপর নিয়মানুযায়ী (সুন্দর ও মধুময় আচরণ স্ত্রীদেরও প্রাপ্য) অধিকার আছে।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২২৮)
অথচ শহর-গ্রামে যে কত বিচিত্র পন্থায় অহরহ নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। ঘরে-বাইরে, শিক্ষাঙ্গনে-কর্মস্থলে সর্বত্র মেয়েদের নানা প্রকার মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিস্থিতি মেয়েদের জন্য সহজেই বৈরী হয়ে ওঠে। সুযোগ পেলেই এক শ্রেণীর পুরুষ নারীর প্রতি অশোভন আচরণ করে থাকে। সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ও বিজাতীয় অপসংস্কৃতির প্রভাব, সুস্থ বিনোদনের অভাব কিংবা অন্যান্য কারণে সমাজে বখাটে যুবকদের সংখ্যা বাড়ছে, তা সমাজের অভিভাবকদের যেমন খুঁজে বের করতে হবে, তেমনি নারী নির্যাতন প্রতিরোধের আন্দোলনেও শামিল হতে হবে। দেশে নারী নির্যাতনবিরোধী কঠোর আইন আছে, কিন্তু এর যথাযথ প্রয়োগের অভাবে সহিংসতা বন্ধ হচ্ছে না। তাই নারী নির্যাতনের শিকার হওয়ার আগেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে মসজিদের ইমাম, খতিব ও ধর্মীয় নেতাদের সচেতনতা সৃষ্টির গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে।
মানুষের অত্যধিক লোভ-লালসা ও সম্পদের মোহই তাদের সব পাপকাজ ও নারীর প্রতি নির্যাতনের কারণ। তবে ধর্মপ্রাণ মানুষ চেষ্টা করলে সব ধরনের লোভ-লালসা এবং ধন-সম্পদের মোহকে সংযম, ভালোবাসা, আন্তরিক সদিচ্ছা এবং আল্লাহভীতির মাধ্যমে আয়ত্তে আনতে সক্ষম। এ জন্য তাদের সুবিচারক, সুবিবেচক, সচেতন ও বিচক্ষণ হতে হবে। নিজের সন্তানের প্রতি যেমন মায়া-মমতাবোধ রয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে অন্যের সন্তানের (জামাতা, পুত্রবধূ ও অন্যান্য আত্মীয়ের) প্রতিও মায়া-মমতাবোধ ও ভালোবাসাকে জাগ্রত করতে হবে, তাহলে পৃথিবীতে সামাজিক ও ধর্মীয়ভাবে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে আসবে। সমাজে এমন এক সচেতনতার বিকাশ প্রয়োজন, যাতে আইনের ভয়ে নয়, বরং দায়িত্ব ও কর্তব্যের আহ্বানে সমাজে পুরুষ সদস্যরা নারীর প্রতি সুন্দর এবং মর্যাদাবোধসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করবে। সেই সঙ্গে মা-বোনদেরও নিজ নিজ মানবিক মর্যাদা এবং অধিকার ও কর্তব্যের প্রতি সজাগ থাকা উচিত। পুরুষ নারীর প্রতিপক্ষ নয়, নারী পুরুষের প্রতিপক্ষ নয়; বরং দুয়ে মিলেই সমাজ। এ সচেতন দৃষ্টিভঙ্গির লালন এবং নৈতিকতার বিকাশের মধ্যেই নিহিত রয়েছে নারী নির্যাতন প্রতিরোধের বীজমন্ত্র।
নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে গণসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। সমাজে নারী ও পুরুষের যে ন্যায্য অধিকার ও গুরুত্ব রয়েছে, উভয়ে মিলে তারা যে অভিন্ন সত্তা, এ মানবিকতাবোধকে পুরুষেরা গভীরভাবে উপলব্ধি না করলে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটবে না। কারণ, নারী-পুরুষের সম্পর্ক ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যেই নির্যাতনের মূলসূত্রটি লুকায়িত আছে। এ মনোভাব পাল্টানোর জন্য উপযুক্ত আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের পাশাপাশি দেশের আলেম সমাজ ও সচেতন নাগরিকদের প্রধান দায়িত্ব নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ করার লক্ষ্যে সমাজে ধর্মীয় মূল্যবোধ, সুনীতি ও আদর্শ প্রতিষ্ঠার সামাজিক আন্দোলন জোরদার করা। নারীর প্রতি পুরুষের যখন পরিপূর্ণ আস্থা আসবে এবং স্ত্রীকে প্রেম-প্রীতি ও মায়ার বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারবে, তখনই পৃথিবী শান্তির নীড় হবে। ইসলামি জীবন দর্শনে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নির্যাতন প্রতিরোধে পবিত্র কোরআনের সূরা আন-নূরে আল্লাহ তাআলা যে সুন্দরতম সামাজিক বিধি-বিধান দিয়েছেন তা অত্যন্ত কার্যকর ও ফলপ্রসূ। ইসলামের বিধান যথাযথ কার্যকর হলে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী নির্যাতন চিরতরে বন্ধ হবে এবং মানবজীবনে শান্তি ও সমৃদ্ধি প্রতিষ্ঠিত হবে। সুতরাং নারী নির্যাতন প্রতিরোধে কার্যকরী ইসলামের সামাজিক বিধি-বিধানগুলো ব্যাপক প্রচার ও প্রসার করতে সমাজের ধর্মীয় নেতাদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক একাডেমি, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়। পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব হজরত মুহাম্মদ (সা.)।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.