চারদিক-যাদুকাটা তীরের পণতীর্থ by গোলাম সরোয়ার

১৫১৬ খ্রিষ্টাব্দে এই তীর্থের সূচনা করেন মহাপুরুষ শ্রীমান অদ্বৈত আচার্য প্রভু। মানুষ তাঁকে গৌরানা ঠাকুর বলে জানে। তাঁর জন্ম বর্তমান সুনামগঞ্জ জেলার তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের নবগ্রামে। কিন্তু সেই গ্রাম আর আজ নেই। নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে বহু আগেই। নবগ্রাম ছিল লাউড় রাজ্যের লাউড়ের গড় এলাকায়।


বর্তমানে অদ্বৈত আচার্য মন্দির গড়ে উঠেছে যাদুকাটা নদীর তীরবর্তী লাউড়ের গড়ের পাশের রাজারগাঁও গ্রামে। প্রতিবছর চৈত্র মাসের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে পুণ্যস্নানের জন্য এ স্থানে কয়েক লাখ লোকের সমাবেশ ঘটে। এখানে ভক্তরা স্নান ও তর্পণ করেন। এই পণতীর্থ প্রতিবছর একবারই হয়ে থাকে। এই দিন ও ক্ষণের জন্য ভক্তরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকেন পুরো বছর। আজ ১৩ মার্চ যাদুকাটা নদীর তীরে সমবেত হবেন পুণ্যার্থীরা। দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসেন তাঁরা যাদুকাটা নদীতে পুণ্যস্নানে মিলিত হতে।
ঐতিহাসিক সূত্রমতে, প্রাচীন শ্রীহট্ট একসময় জৈন্তা রাজ্যের অংশ ছিল। পরে জৈন্তা তিনটি রাজ্যে বিভক্ত হয়—জৈন্তা, গৌড় ও লাউড়। ভারতের আসামের কামরূপ থেকে রাজা কামসিন্ধুর বিধবা স্ত্রী উমরী রানী জনৈক প্রগশপতির দ্বারা হুমকিপ্রাপ্ত হয়ে শ্রীহট্টের উত্তরাঞ্চলে চলে আসেন। ইতিমধ্যে তিব্বতের হাথক শহরের যুবরাজ কৃষক চৌদ্দভাগা নদীর তীর ধরে ঘুরে ঘুরে জৈন্তাপুরে উপনীত হন। এখানে উমরী রানীর সঙ্গে পরিচয়ের পর চৌদ্দভাগা তাঁকে বিয়ে করেন। তাঁদের একটি পুত্রসন্তান হলে নাম রাখা হয় হাথক। পরে হাথক নামধারী কমপক্ষে নয়জন রাজা জৈন্তাপুরে রাজত্ব করেন। দশম রাজা গোবিন্দরাজ কেশব দেব একাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে রাজত্ব করেন। এরপর হাথকের পুত্র গুহক জৈন্তার রাজা নিযুক্ত হন। গুহক তাঁর তিন পুত্রকে সমানভাবে রাজত্ব ভাগ করে দিলে লুব্দুকের নামানুসারে তাঁর অংশের নাম হয় লাউড়। লাউড় রাজ্য বর্তমান লাউড়ের পাহাড় এবং সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পরে লাউড়ে রাজত্ব করেন আচার্য পরিবারের অরুণাচার্য বিজয় মাণিক্য। সর্বশেষ দিব্যসিংহ।
পঞ্চদশ শতাব্দীতে বৈষ্ণব সাধক অদ্বৈতাচার্যের পিতা কুবেরাচার্য বা কুবেরমিশ্র তর্ক পঞ্চানন রাজা দিব্য সিংহের মন্ত্রী ছিলেন। কুবেরাচার্য ছিলেন পণ্ডিত শাস্ত্রবিদ ও সভাপণ্ডিত। কিন্তু মন্ত্রী কুবেরাচার্যের পরপর ছয়টি সন্তান মারা যাওয়ায় তাঁর মনে ছিল প্রচণ্ড কষ্ট। তাই তিনি দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে ভারতে চলে যান। পরে রাজা দিব্য সিংহের আহ্বানে তিনি পুনরায় লাউড়ে ফিরে আসেন। কিছুকাল পর ১৪৩৫ খ্রিষ্টাব্দে স্ত্রী নাভা দেবীর গর্ভে তিনি এক সন্তান লাভ করেন। কমলের মতো সুন্দর বলে তার নাম রাখেন কমলাক্ষ।
কমলাক্ষের মাতা নাভা দেবী স্বপ্নে দেখতে পান, তাঁর কোলের শিশু শঙ্খচক্র গদাপদধারী মহাবিষ্ণু। তাঁর অঙ্গজ্যোতিতে চারদিক আলোকিত। মুখে দিব্য আভা। হতবিহ্বল নাভা দেবী সেই স্বর্গীয় মূর্তির সম্মুখে প্রণত হয়ে শ্রীচরণোদন প্রার্থনা করেন। কিন্তু মাতা কর্তৃক সন্তানের পাদোদক প্রার্থনা করা অনুচিত। তাই স্বপ্ন ভেঙে গেলে নাভা দেবী মহা চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কমলাক্ষের অনুরোধে স্বপ্নের সব বৃত্তান্ত তাঁকে খুলে বলেন। সবশেষে বললেন, ‘সপ্ততীর্থবারি অবগাহনের ভাগ্য কি আমার হবে?’
মায়ের অভিলাষ পূরণে কমলাক্ষ হাত মুঠ করে বললেন, ‘সপ্ততীর্থ হানি হেথায় করিব স্থাপন। আজ রাতে সব তীর্থের এখানে আগমন ঘটবে এবং আগামী প্রাতে মাতা সে তীর্থবারিতে অবগাহন করবেন।’ নিকটস্থ শৈলশিখরে কমলাক্ষ অবস্থান করে প্রভাতে ঘণ্টাধ্বনি করলেন। সঙ্গে সঙ্গে সব তীর্থবারি অঝোরধারায় বইতে শুরু করল। কমলাক্ষের মাতা নাভা দেবীর যেন বিশ্বাস হতে চায় না। মনে প্রশ্ন জাগে, এ কি সত্যিই সপ্ততীর্থ? কমলাক্ষ তাঁর মায়ের সঙ্গে সপ্ততীর্থবারিকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এই হলো শ্যামার সামৃত যমুনা, পাপনাশিনী গঙ্গা এবং রক্তপীত আদিতীর্থবারি। আনন্দ-উত্ফুল্ল মনে জননী তীর্থগণকে প্রণাম করে সপ্ততীর্থবারিতে অবগাহন করলেন। সেই থেকে এই তীর্থের নাম হলো পণতীর্থ।
তীর্থগণ পণ করে গিয়েছিলেন, পৃথিবী যত দিন থাকবে তত দিন প্রতিবছর মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে তীর্থগণের আগমন ঘটবে এখানে। সপ্ততীর্থের আগমন ঘটে বলেই এটি পৃথিবীর সব তীর্থের শ্রেষ্ঠ তীর্থ, হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে।
এ সত্য আজও প্রতিফলিত হয় যাদুকাটা নদীর তীরে। এই পুণ্যতিথিতে বেড়ে যায় জলের ধারা। প্রতিবছর এ সময় লক্ষাধিক মানুষের আগমনে নিভৃত এই জনপদে নেমে আসে প্রাণচাঞ্চল্য। সবাই এই পুণ্যসলিলার পূতঃবারিতে স্নান করে ধন্য হন। নিজেকে করেন কুলুষমুক্ত। তাঁদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়, ‘জয় জয় অদ্বৈত আচার্য দয়াময়, যার হুংকারে গৌর অবতার হয়।’

No comments

Powered by Blogger.