নগর দর্পণ: চট্টগ্রাম-সিটি করপোরেশন কি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি? by বিশ্বজিত্ চৌধুরী
চট্টগ্রাম শহরের যেদিকে তাকান, দেখবেন বহুতল ভবন নির্মাণের প্রতিযোগিতা চলছে। বড় রাস্তাগুলোর দুই পাশে তো বটেই, গলি-ঘুপচি পর্যন্ত, যেখানে দুটি রিকশা পাশাপাশি চলাচলের উপায় নেই, সেখানেও চলছে ভবন নির্মাণের মহাযজ্ঞ। আমাদের মতো জনসংখ্যাবহুল দেশে আবাসন একটি বড় সমস্যা, সন্দেহ নেই,
কিন্তু যেভাবে মাঠ-ঘাট, পুকুর, দিঘি, পাহাড়, নালা-নর্দমা পর্যন্ত দখল করে শুধুই ভবন আর ভবন, সেখানে মানুষের নিঃশ্বাস নেওয়ার সুযোগটিও আর থাকছে কি না ভেবে দেখা দরকার।
এখন প্রশ্ন, ভেবে দেখার দায়িত্ব মূলত কার? নিশ্চয়ই চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এবং সিটি করপোরেশনের মতো প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু সরষের ভেতরেই ভূত থাকলে ভূত তাড়াবে কে?
সম্প্রতি চাক্তাই এলাকার একটি খেলার মাঠকে আবাসিক প্লট হিসেবে বিক্রি করার উদ্যোগ নিয়েছে সিটি করপোরেশন। চর চাক্তাই বিদ্যালয়সংলগ্ন মাঠ হলেও এটি এলাকার সাতটি বিদ্যালয়ের প্রায় ছয় হাজার ছাত্রছাত্রীর একমাত্র খেলার মাঠ। বিভিন্ন স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতাও হয় এখানে। এলাকার অনেক সামাজিক অনুষ্ঠান হয় ওই মাঠটিতে। সিটি করপোরেশন প্রায় দুই একরের এই মাঠকে প্লট বানিয়ে বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছে স্থানীয় পত্রপত্রিকায়।
খোলা জায়গায় প্লট তৈরি করে বিক্রির প্রবণতা সিটি করপোরেশনের দীর্ঘদিনের। এমনকি পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে পরিবেশবাদীদের যত কথাই থাক, তাতে কর্ণপাত না করে, পাহাড় কেটে প্লট বা ফ্ল্যাট তৈরি করে বিক্রি করতে দ্বিধা করেনি করপোরেশন। নাসিরাবাদ বা ফয়’স লেক এলাকায় এসব কীর্তির (!) সাক্ষ্য এখন স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। জলাধার ভরাট করেও বহুতল ভবন নির্মাণের প্রতিযোগিতায় শামিল হয়েছে সিটি করপোরেশন। আলকরণ এলাকায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে পুকুর ভরাট করে কর্ণফুলী অ্যাপার্টমেন্ট নামের যে ১০ তলা ভবনটি নির্মাণ করেছে, তাতে ভবনের সামনে রাস্তার জন্য জায়গা খালি রাখা বা ভবনের নিচতলায় ফ্ল্যাট অনুপাতে পর্যাপ্ত গাড়ি রাখার কোনো ব্যবস্থা হয়নি। এখন একই এলাকায় অন্য কোনো নির্মাতা যদি এসব নিয়মনীতি উপেক্ষা করে, তখন সিডিএর কিছু বলার মতো নৈতিক জোর কী থাকে?
একইভাবে মেডিকেল কলেজের পাশে একটি বড় নালার ওপর তৈরি হয়েছে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এর নিচতলাটি ভেঙে দিয়ে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে বাধ্য করা হয়।
নির্দ্বিধায় স্বীকার করি, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ বর্তমান মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনেক সমাজ-হিতৈষী প্রকল্পের অন্যতম। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস শহরের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ভবনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে না রেখে ফয়’স লেক এলাকায়, যেখানে আবাসিক প্লট বিক্রি করেছিল সিটি করপোরেশন, সেখানে করলেই কী তাঁর প্রকৃত দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যেত না?
আমরা আগেও দেখেছি, নগরের কোথাও মালিকানা নিয়ে কোনো সমস্যা আছে এমন খালি জায়গা দেখলেই সে ব্যাপারে উত্সাহী হয়ে ওঠেন মেয়র। একসময় অনেক জনকল্যাণমূলক কাজের সূচনা তিনি করেছেন বলেই এত কাল এ ব্যাপারটি নিয়ে তেমন শোরগোল ওঠেনি। নগরের প্রথম ও সর্ববৃহত্ সিএনজি স্টেশন, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় বা থিয়েটার ইনস্টিটিউট চট্টগ্রাম (টিআইসি) প্রভৃতি উদ্যোগকে সাধারণ মানুষ স্বাগতই জানিয়েছে। কিন্তু একপর্যায়ে বিরোধপূর্ণ খালি জায়গা কিনে নেওয়া এবং তাতে কখনো প্লট, ফ্ল্যাট বিক্রি কখনো বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান (যেমন, সিটি করপোরেশনের বিপণিকেন্দ্রগুলো) তৈরির মানসিকতা গড়ে ওঠে তাঁর। নগর পরিচালনায় সরকারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ পাওয়া যায় না, তাই সিটি করপোরেশনের নিজস্ব আয় দরকার—এই অজুহাতে অসংখ্য স্থাপনা গড়ে তুলেছেন মেয়র। এতে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের আসল চেহারাই যেন বদলে যেতে থাকে।
কিছুকাল আগে নগরের গোলপাহাড় মোড়ে দেবোত্তর সম্পত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি গোশালার জমি নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে বিরোধ চরমে পৌঁছে তাঁর। আইন-আদালত ও সরকারের উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত জমিটি দখলে নিতে পারেননি তিনি। মেয়র সবচেয়ে বেশি সমালোচনা ও প্রতিরোধের মুখে পড়েন নগরের অপর্ণাচরণ ও কৃষ্ণকুমারী উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে। মেয়েদের এ দুটি স্কুলে নিচের কয়েকটি তলায় বিপণিকেন্দ্র ও ওপরের তলাগুলো বিদ্যালয়ের জন্য রাখা হবে—সিটি করপোরেশনের এ রকম পরিকল্পনা জানার পর চট্টগ্রামের ছাত্র ও সামাজিক সংগঠনগুলো ক্ষোভে ফেটে পড়ে। মেয়েদের একটি স্কুলের ক্যাম্পাসে বিপণিকেন্দ্র তৈরির এ উদ্যোগকে অবিবেচনাপ্রসূত মনে করেছেন সবাই। প্রবীণ বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীসহ নাগরিক সমাজের নেতারা তখন প্রকাশ্যে মেয়রের এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ফলে ওই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারেননি তিনি।
এ কথা আগেও বলেছি আবার বলি, নগরবাসীর জন্য শিক্ষা ও চিকিত্সার ব্যাপারে বর্তমান মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছেন। বিভিন্ন এলাকায় মাতৃসদন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্যোগ নিয়ে এবং সেই সব প্রতিষ্ঠান মানসম্মত উপায়ে পরিচালনা করে নগরবাসীর কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন তিনি। বিভিন্ন স্থানে শৌচাগার নির্মাণ ও এর সুষ্ঠু পরিচালনাও দৃষ্টি কেড়েছে নগরবাসীর। জিইসির মোড়ে একটি উন্নতমানের শৌচাগার নির্মাণ করেছিলেন তিনি। কিন্তু পর্যাপ্ত পার্কিং-ব্যবস্থা নেই এই অজুহাত তুলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশাসন সেটি ভেঙে দিলে সচেতন নাগরিকেরা তা পছন্দ করেননি। কারণ, সবকিছুই যান্ত্রিক নিয়মনীতির দৃষ্টিতে নিলে জনহিতকর কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয়।
মেয়রের যাবতীয় কল্যাণমূলক কাজের স্বীকৃতি দিয়েও আমাদের এ কথা বলতেই হবে জায়গা-জমি কেনাবেচার কাজটি বর্তমান সিটি করপোরেশন যেভাবে শুরু করেছে, তাতে একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির সঙ্গে এই সেবামূলক প্রতিষ্ঠানটির কর্মকাণ্ডকে খুব একটা আলাদা করা যায় না। এমনকি নগরের উন্নয়নের জন্য সরকারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত বরাদ্দ পাওয়া যায় না বলে সিটি করপোরেশনের নিজস্ব আয় বৃদ্ধির পথ বের করতে হয়, এই যুক্তি সত্ত্বেও মেয়রকে ভূমিব্যবসায়ীর ভূমিকায় গ্রহণ করা সম্ভব নয় নগরবাসীর পক্ষে।
যে স্কুলমাঠটি নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ক সে সম্পর্কে আরেকটু বলি। ১৯৭২ সালে দক্ষিণ বাকলিয়ায় অবাঙালিদের ফেলে যাওয়া প্রায় আড়াই একর জমির ওপর গড়ে ওঠে চর চাক্তাই প্রাথমিক ও উচ্চবিদ্যালয়। ১৯৯৭ সালে সিটি করপোরেশন এই স্কুল ও সংলগ্ন মাঠটি অধিগ্রহণ করে। ইতিমধ্যে মাঠের পূর্ব পাশে গড়ে উঠেছে ব্র্যাক ও ইউসেপ স্কুল। মাঠের একটি অংশে একটি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠার কথা ছিল সিটি করপোরেশনের। কিন্তু হঠাত্ করে এই পরিকল্পনা বাতিল করে, প্রতি কাঠা ৩০ লাখ টাকা করে আবাসিক প্লট বিক্রির সিদ্ধান্ত এখানকার মানুষকে যুগপত্ বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ করেছে। করপোরেশনের আয় বৃদ্ধি ও তথাকথিত আবাসন সমস্যা সমাধানের এই উদ্যোগ যে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর শৈশবকে আনন্দ-বঞ্চিত করবে—এ কথা ভাবার মতো বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টি আমরা মহিউদ্দিন চৌধুরীর কাছে আশা করেছিলাম। সবচেয়ে বড় কথা, ‘জলবায়ু জলবায়ু’ বলে যে আমরা গলা ফাটাচ্ছি, একটি খোলা মাঠ, একখণ্ড সবুজের মৃত্যুও যে তাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে—এটুকু বোঝার মতো বোধবুদ্ধি তাঁর না থাকার কথা নয়।
যেকোনো খালি জায়গার ব্যাপারে মেয়র যে কী রকম উত্সাহী তার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ ফিশারিঘাট সংযোগ সড়কের পাশে দোকানপাট নির্মাণ। চাক্তাই থেকে পাথরঘাটা ফিশারিঘাট পর্যন্ত সংযোগ সড়কটি মাত্র মাসচারেক আগে উদ্বোধন করা হয়। এরই মধ্যে কর্ণফুলীর তীর ঘেঁষে নির্মিত রাস্তাটির পাশে সারি সারি দোকান নির্মাণ শুরু করেছে সিটি করপোরেশন। বন্দরের জায়গায় সিটি করপোরেশন কেন দোকানপাট নির্মাণ করবে ওই প্রশ্ন তো উঠছেই, তার চেয়েও বড় কথা, কর্ণফুলীর ক্যাপিটাল ড্রেজিংও ক্ষতিগ্রস্ত হবে এতে।
সচেতন নাগরিকদের ধারণা, নগর উন্নয়ন মানে যে শুধু ইট-রড-সিমেন্টের খাঁচা তৈরির মহাযজ্ঞ নয়, হয় এ কথা বর্তমান মেয়র বুঝতে পারছেন না, নয়তো জায়গা-জমি কেনাবেচা বা বহুতল ভবন নির্মাণের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত লাভালাভের ব্যাপারটিও জড়িত।
আমরা সিটি করপোরেশনকে রিয়েল এস্টেট কোম্পানির ভূমিকায় দেখতে চাই না।
বিশ্বজিত্ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com
এখন প্রশ্ন, ভেবে দেখার দায়িত্ব মূলত কার? নিশ্চয়ই চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এবং সিটি করপোরেশনের মতো প্রতিষ্ঠানের। কিন্তু সরষের ভেতরেই ভূত থাকলে ভূত তাড়াবে কে?
সম্প্রতি চাক্তাই এলাকার একটি খেলার মাঠকে আবাসিক প্লট হিসেবে বিক্রি করার উদ্যোগ নিয়েছে সিটি করপোরেশন। চর চাক্তাই বিদ্যালয়সংলগ্ন মাঠ হলেও এটি এলাকার সাতটি বিদ্যালয়ের প্রায় ছয় হাজার ছাত্রছাত্রীর একমাত্র খেলার মাঠ। বিভিন্ন স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতাও হয় এখানে। এলাকার অনেক সামাজিক অনুষ্ঠান হয় ওই মাঠটিতে। সিটি করপোরেশন প্রায় দুই একরের এই মাঠকে প্লট বানিয়ে বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন দিয়েছে স্থানীয় পত্রপত্রিকায়।
খোলা জায়গায় প্লট তৈরি করে বিক্রির প্রবণতা সিটি করপোরেশনের দীর্ঘদিনের। এমনকি পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে পরিবেশবাদীদের যত কথাই থাক, তাতে কর্ণপাত না করে, পাহাড় কেটে প্লট বা ফ্ল্যাট তৈরি করে বিক্রি করতে দ্বিধা করেনি করপোরেশন। নাসিরাবাদ বা ফয়’স লেক এলাকায় এসব কীর্তির (!) সাক্ষ্য এখন স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। জলাধার ভরাট করেও বহুতল ভবন নির্মাণের প্রতিযোগিতায় শামিল হয়েছে সিটি করপোরেশন। আলকরণ এলাকায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে পুকুর ভরাট করে কর্ণফুলী অ্যাপার্টমেন্ট নামের যে ১০ তলা ভবনটি নির্মাণ করেছে, তাতে ভবনের সামনে রাস্তার জন্য জায়গা খালি রাখা বা ভবনের নিচতলায় ফ্ল্যাট অনুপাতে পর্যাপ্ত গাড়ি রাখার কোনো ব্যবস্থা হয়নি। এখন একই এলাকায় অন্য কোনো নির্মাতা যদি এসব নিয়মনীতি উপেক্ষা করে, তখন সিডিএর কিছু বলার মতো নৈতিক জোর কী থাকে?
একইভাবে মেডিকেল কলেজের পাশে একটি বড় নালার ওপর তৈরি হয়েছে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে এর নিচতলাটি ভেঙে দিয়ে গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রাখতে বাধ্য করা হয়।
নির্দ্বিধায় স্বীকার করি, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ বর্তমান মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনেক সমাজ-হিতৈষী প্রকল্পের অন্যতম। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস শহরের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ভবনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে না রেখে ফয়’স লেক এলাকায়, যেখানে আবাসিক প্লট বিক্রি করেছিল সিটি করপোরেশন, সেখানে করলেই কী তাঁর প্রকৃত দূরদর্শিতার পরিচয় পাওয়া যেত না?
আমরা আগেও দেখেছি, নগরের কোথাও মালিকানা নিয়ে কোনো সমস্যা আছে এমন খালি জায়গা দেখলেই সে ব্যাপারে উত্সাহী হয়ে ওঠেন মেয়র। একসময় অনেক জনকল্যাণমূলক কাজের সূচনা তিনি করেছেন বলেই এত কাল এ ব্যাপারটি নিয়ে তেমন শোরগোল ওঠেনি। নগরের প্রথম ও সর্ববৃহত্ সিএনজি স্টেশন, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় বা থিয়েটার ইনস্টিটিউট চট্টগ্রাম (টিআইসি) প্রভৃতি উদ্যোগকে সাধারণ মানুষ স্বাগতই জানিয়েছে। কিন্তু একপর্যায়ে বিরোধপূর্ণ খালি জায়গা কিনে নেওয়া এবং তাতে কখনো প্লট, ফ্ল্যাট বিক্রি কখনো বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান (যেমন, সিটি করপোরেশনের বিপণিকেন্দ্রগুলো) তৈরির মানসিকতা গড়ে ওঠে তাঁর। নগর পরিচালনায় সরকারের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ পাওয়া যায় না, তাই সিটি করপোরেশনের নিজস্ব আয় দরকার—এই অজুহাতে অসংখ্য স্থাপনা গড়ে তুলেছেন মেয়র। এতে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের আসল চেহারাই যেন বদলে যেতে থাকে।
কিছুকাল আগে নগরের গোলপাহাড় মোড়ে দেবোত্তর সম্পত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত একটি গোশালার জমি নিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে বিরোধ চরমে পৌঁছে তাঁর। আইন-আদালত ও সরকারের উচ্চপর্যায়ের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত জমিটি দখলে নিতে পারেননি তিনি। মেয়র সবচেয়ে বেশি সমালোচনা ও প্রতিরোধের মুখে পড়েন নগরের অপর্ণাচরণ ও কৃষ্ণকুমারী উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে। মেয়েদের এ দুটি স্কুলে নিচের কয়েকটি তলায় বিপণিকেন্দ্র ও ওপরের তলাগুলো বিদ্যালয়ের জন্য রাখা হবে—সিটি করপোরেশনের এ রকম পরিকল্পনা জানার পর চট্টগ্রামের ছাত্র ও সামাজিক সংগঠনগুলো ক্ষোভে ফেটে পড়ে। মেয়েদের একটি স্কুলের ক্যাম্পাসে বিপণিকেন্দ্র তৈরির এ উদ্যোগকে অবিবেচনাপ্রসূত মনে করেছেন সবাই। প্রবীণ বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরীসহ নাগরিক সমাজের নেতারা তখন প্রকাশ্যে মেয়রের এই উদ্যোগের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ফলে ওই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারেননি তিনি।
এ কথা আগেও বলেছি আবার বলি, নগরবাসীর জন্য শিক্ষা ও চিকিত্সার ব্যাপারে বর্তমান মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী অনেক ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছেন। বিভিন্ন এলাকায় মাতৃসদন ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্যোগ নিয়ে এবং সেই সব প্রতিষ্ঠান মানসম্মত উপায়ে পরিচালনা করে নগরবাসীর কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছেন তিনি। বিভিন্ন স্থানে শৌচাগার নির্মাণ ও এর সুষ্ঠু পরিচালনাও দৃষ্টি কেড়েছে নগরবাসীর। জিইসির মোড়ে একটি উন্নতমানের শৌচাগার নির্মাণ করেছিলেন তিনি। কিন্তু পর্যাপ্ত পার্কিং-ব্যবস্থা নেই এই অজুহাত তুলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশাসন সেটি ভেঙে দিলে সচেতন নাগরিকেরা তা পছন্দ করেননি। কারণ, সবকিছুই যান্ত্রিক নিয়মনীতির দৃষ্টিতে নিলে জনহিতকর কাজ বাধাপ্রাপ্ত হয়।
মেয়রের যাবতীয় কল্যাণমূলক কাজের স্বীকৃতি দিয়েও আমাদের এ কথা বলতেই হবে জায়গা-জমি কেনাবেচার কাজটি বর্তমান সিটি করপোরেশন যেভাবে শুরু করেছে, তাতে একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানির সঙ্গে এই সেবামূলক প্রতিষ্ঠানটির কর্মকাণ্ডকে খুব একটা আলাদা করা যায় না। এমনকি নগরের উন্নয়নের জন্য সরকারের কাছ থেকে পর্যাপ্ত বরাদ্দ পাওয়া যায় না বলে সিটি করপোরেশনের নিজস্ব আয় বৃদ্ধির পথ বের করতে হয়, এই যুক্তি সত্ত্বেও মেয়রকে ভূমিব্যবসায়ীর ভূমিকায় গ্রহণ করা সম্ভব নয় নগরবাসীর পক্ষে।
যে স্কুলমাঠটি নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্ক সে সম্পর্কে আরেকটু বলি। ১৯৭২ সালে দক্ষিণ বাকলিয়ায় অবাঙালিদের ফেলে যাওয়া প্রায় আড়াই একর জমির ওপর গড়ে ওঠে চর চাক্তাই প্রাথমিক ও উচ্চবিদ্যালয়। ১৯৯৭ সালে সিটি করপোরেশন এই স্কুল ও সংলগ্ন মাঠটি অধিগ্রহণ করে। ইতিমধ্যে মাঠের পূর্ব পাশে গড়ে উঠেছে ব্র্যাক ও ইউসেপ স্কুল। মাঠের একটি অংশে একটি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠার কথা ছিল সিটি করপোরেশনের। কিন্তু হঠাত্ করে এই পরিকল্পনা বাতিল করে, প্রতি কাঠা ৩০ লাখ টাকা করে আবাসিক প্লট বিক্রির সিদ্ধান্ত এখানকার মানুষকে যুগপত্ বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ করেছে। করপোরেশনের আয় বৃদ্ধি ও তথাকথিত আবাসন সমস্যা সমাধানের এই উদ্যোগ যে হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর শৈশবকে আনন্দ-বঞ্চিত করবে—এ কথা ভাবার মতো বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টি আমরা মহিউদ্দিন চৌধুরীর কাছে আশা করেছিলাম। সবচেয়ে বড় কথা, ‘জলবায়ু জলবায়ু’ বলে যে আমরা গলা ফাটাচ্ছি, একটি খোলা মাঠ, একখণ্ড সবুজের মৃত্যুও যে তাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে—এটুকু বোঝার মতো বোধবুদ্ধি তাঁর না থাকার কথা নয়।
যেকোনো খালি জায়গার ব্যাপারে মেয়র যে কী রকম উত্সাহী তার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ ফিশারিঘাট সংযোগ সড়কের পাশে দোকানপাট নির্মাণ। চাক্তাই থেকে পাথরঘাটা ফিশারিঘাট পর্যন্ত সংযোগ সড়কটি মাত্র মাসচারেক আগে উদ্বোধন করা হয়। এরই মধ্যে কর্ণফুলীর তীর ঘেঁষে নির্মিত রাস্তাটির পাশে সারি সারি দোকান নির্মাণ শুরু করেছে সিটি করপোরেশন। বন্দরের জায়গায় সিটি করপোরেশন কেন দোকানপাট নির্মাণ করবে ওই প্রশ্ন তো উঠছেই, তার চেয়েও বড় কথা, কর্ণফুলীর ক্যাপিটাল ড্রেজিংও ক্ষতিগ্রস্ত হবে এতে।
সচেতন নাগরিকদের ধারণা, নগর উন্নয়ন মানে যে শুধু ইট-রড-সিমেন্টের খাঁচা তৈরির মহাযজ্ঞ নয়, হয় এ কথা বর্তমান মেয়র বুঝতে পারছেন না, নয়তো জায়গা-জমি কেনাবেচা বা বহুতল ভবন নির্মাণের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত লাভালাভের ব্যাপারটিও জড়িত।
আমরা সিটি করপোরেশনকে রিয়েল এস্টেট কোম্পানির ভূমিকায় দেখতে চাই না।
বিশ্বজিত্ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwa_chy@yahoo.com
No comments