ঋণ আছে এবং থাকবে by সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
বাংলা অভিধান থেকে ঋ অক্ষরটি কি তুলে দেওয়া যায় না? খুব সীমিত তার ব্যবহার, বিদঘুটে তার চেহারা। তিনটি শব্দের জোরেই মনে হয় সে টিকে আছে, ঋষি, ঋতু এবং ঋণ। এই তিনের বাইরে তার তেমন কোনো কাজ নেই উল্লেখযোগ্য। তা ঋষি তো গেছে চলে।
কে আর কাকে ঋষি বলে আজকাল, বঙ্কিমচন্দ্রকেও এখন আর ঋষি বলা হয় না। মহর্ষিতেও ঋ নেই। তবে হ্যাঁ, ঋতু আছে। ছয়টি আছে কি না সন্দেহ। উল্টাপাল্টা কিছুটা হয়েছে বৈকি; কিন্তু তবু ঋতু আছে এবং মনে হয় থাকবে। আর থাকবে ঋণ। এমনকি বাংলার ঋতু যদি চলে যায়ও, তবু বাঙালির ঋণ থাকবে। ঋণ বাড়ছে বাড়ছে। আমরা তার ফাঁদে পড়েছি। ঋণ থেকে মুক্তি সহজ হবে না। মোটেই না।
কিন্তু সময় বদলেছে। এখন ঋণ দিতে পেরে কেউ নিজেকে ধন্য মনে করে না, টাকা ধার দিয়ে জাতে উঠতে চায় না, জাতে-ওঠারাই টাকা ধার দেয়; আবার অন্যদিকে ঋণ চাইছে বলে যে কেউ লজ্জায় মরে যাবে তাও মরে না। এখন ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, পানিপান্তা। বরঞ্চ বলা যাবে ধার দেওয়ার চেয়ে নেওয়াতেই কৃতিত্ব বেশি। আমাদের অর্থমন্ত্রীরা কে কার চেয়ে অধিক যোগ্য সেটা নির্ণয়ের সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য মাপকাঠি হচ্ছে কে কত বেশি ঋণ আনতে পারেন সেটা, অন্য কিছু নয়। ঋণ এনেছি_এই ঘোষণা কাগজে টিভিতে হৈচৈ করে প্রচার করা হয়। লজ্জার কোনো ছায়া দেখা যায় না। এটা যুগের হাওয়া। আমরা তো সামান্য দেশ, ওই যে অত বড় আমেরিকা, বিশ্বের ভেতর সবচেয়ে ধনী দেশ, তার হালটা কী? শুনলে বিশ্বাস হতে চায় না, তবু যাঁরা জানেন তাঁরাই বলেন আমেরিকা ঋণগ্রস্ত দেশ। ঋণ তার বাড়ছে। কিন্তু আমেরিকা লজ্জা পায় না, নত করে না মাথা, বরঞ্চ সদর্পে চলে; সারা বিশ্ব তার পদানত।
এই দর্শন আমাদের দেশেও সুপ্রাচীন। ঋণ করে হলেও ঘি খাও, এটি প্রাচীন বক্তব্য কেবল ঘি কেন, তেলও খাও। নুন খাও। আমাদের কৃষক যুগযুগান্তর ধরে ঋণগ্রস্ত। বন্ধনে জর্জর। যারা ধার দেয় তাদের বলা হয় মহাজন। কথাটার মধ্যে প্রশংসা আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু ঘৃণা যে নেই সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই। আছে, ঘৃণাও আছে। মহানজকে ঘৃণা করে না, এমন কৃষক বিরল। কিন্তু তাতে মহাজনের কিছু যায় আসে না। সে মস্ত জন হয়েই থাকে, তার সঙ্গে কাবুলিওয়ালার তফাৎ নেই; যদিও কাবুলিওয়ালা বিদেশি, মহাজন স্বদেশি বটে। কাবুলিওয়ালারা গেছে চলে। দুঃস্বপ্নের মতো ছিল, এখন আর নেই; কিন্তু মহাজনরা রয়েছে, রয়েছে ঋণ দেওয়ার ব্যাংক ও এনজিও; আর মহাজনরা তো আছেই, থাকবেই। কৃষক আছে, অথচ ঋণগ্রস্তরা নেই, এ প্রায় বর্ষা আছে অথচ সর্দিকাশি, জ্বরজারি নেই_এই রকমেরই অবাস্তব। ঋণ সালিশি বোর্ড এসেছে এবং গেছে চলে। কিন্তু বাংলার কৃষক মুক্ত হয়নি। কবে হবে কে জানে।
ওই যে বললাম, বড় ঋণগ্রস্তরা নত হয় না, দর্পভরে হামলা করে। যেমন ওই আমেরিকা। ছোট ঋণীরাই কেবল কাতর হয়, ঘুমাতে পারে না, শুকাতে থাকে দুশ্চিন্তায়। বড় ঋণীদের পোয়াবারো। আমাদের দেশেও তাই। বড় বড় ঋণ যারা নিচ্ছে তাদের কি কেউ কখনো দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখেছেন? পরোয়া করে কারো? বোঝার উপায় আছে কি যে তারা কোটি কোটি টাকা ধার করে বসে আছে? প্রাইভেট ব্যাংকের তো বদনামই ওটি যে পরিচালকরাই ধার নেয়। নানান নাম খাড়া করে এবং সেই সব নামের আড়ালে লুকিয়ে থাকে, সবাইকে জানিয়েই। ব্যাংকের ঋণ নিয়ে বিদেশে চলে যাওয়া কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়, আমাদের বাংলাদেশে। যত ধনী, তত ঋণী এবং ততই নিশ্চিত যে ঋণ শোধ করতে হবে না; বিপদ যত ছোট মনুষদের;' ছোট ছোট ঋণ তাদের এবং বড় বড় বিপদ।
তবে জাতি হিসেবে আমরা যে অত্যন্ত ঋণগ্রস্ত সে খবর আমাদের অহরহ জানানো হচ্ছে। বিদেশি শাসকরা ছিল। তারা লুণ্ঠন করেছে এবং যতই লুণ্ঠন করেছে ততই করে গেছে ঋণী। তারাই তো আমাদের আলো দিল, সংস্কৃতি শেখাল, সভ্যতার যতটুকু সামান্য ছিটেফোঁটা আমাদের সেটুকু দিয়ে গেল। নইলে আমাদের কী ছিল? সবচেয়ে বেশি দিয়েছে ইংরেজ। ভাষাও শিখিয়েছে। এ ভাষা শেখানোটা মস্তবড় ব্যাপার। আসলেই। জাপানিরা এখন পৃথিবীর ওপর অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে, কিন্তু ভাষা চাপাতে পারছে না, না পারলে পৃথিবীকে তেমনভাবে ঋণী করতে পারবে না যেমনভাবে ইংরেজরা করেছে তাদের ভাষার সাহায্যে। একেবারে বাপের নাম ভুলিয়ে ছেড়েছে। লুণ্ঠনকে মান্য করতে শিখিয়েছে সভ্যতার বিকিরণ বলে। বন্ধনকে বলেছে মুক্তি।
এইভাবে দেখার শিক্ষাটাই পাই আমরা। পেয়ে আসছি। যারা আমাদের শোষণ করে শেষ করেছে তাদের কাছেই নিজেদের ঋণী বিবেচনা করার শিক্ষাটা পাচ্ছি। কেবল ওপরেরটা দেখতে শেখানো হচ্ছে। ভেতরের সব কিছু অবজ্ঞা করে। মহাজনকে কৃষক ঘৃণা করে, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদকে আজ আমরা ঘৃণা করি না। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যে আমাদের প্রেমে পড়েনি, যতই দিচ্ছে ঋণ ততই ধন্য হচ্ছে নিজে এই মনোভাব যে তার নয়, সে যে ছদ্মবেশী শাইলক একজন, এই সত্য প্রকাশ করবে কে? বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তখন সর্বত্র ব্যাপ্ত ছিল। আমেরিকার কাছ থেকে আমরা ঋণ নেব না এই ঘোষণা তখন বের হয়ে এসেছিল ওই যুদ্ধের ভেতর থেকেই। এ ছিল স্বাধীনতার যে ঘোষণা তারই অবিচ্ছেদ্য (যদিও প্রচ্ছন্ন) অঙ্গ, কিন্তু ওই বড়াই আজ আমাদের কোথায়? আমেরিকা আজ আমাদের প্রধান ত্রাণকর্তা। তার কাছে আমাদের নানা রকম ঋণ ক্রমবর্ধমান। যে ছিল শত্রু, যে সর্বতোভাবে বাধা দিয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা লাভকে সেই হয়ে দাঁড়িয়েছে সবচেয়ে বড় মিত্র। আমেরিকা কি বদলেছে? মোটেই না। আমরা বদলেছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে আমরা যে সরে এসেছি তার অনেক প্রমাণ আছে। একটি বড় প্রমাণ ওই একদা শত্রুর ওপর আমাদের নির্ভরতা। শত্রু শত্রুতাই করছে, আগের মতোই, আগে করেছে যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে, এখন করছে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের দূতদের মাধ্যমে। শত্রুতাকে মনে করছি ত্রাণতৎপরতা। আমরা কি অন্ধ, নাকি বধির, নাকি দুটোই একত্রে? তা আমাদের দোষ কী, আমরা সামান্য মানুষ, গরিব, পশ্চাৎপদ; অত বড় সোভিয়েত ইউনিয়ন সেই তো ভেঙে গেল এবং ভাঙার একটা কারণ তো মনে হচ্ছে ঋণ গ্রহণের অভিলাষ।
বাড়িয়ে বলার উপায় নেই। ঋণের একটি সংস্কৃতিই দেশে গড়ে উঠেছে। এতে ধনীদের জন্য ঋণ নেওয়া অগৌরবের কোনো ব্যাপার নয়। বরঞ্চ গর্বেরই বিষয়, ভেতরে ভেতরে। কিন্তু গরিবদের ঋণ গ্রহণে উৎসাহী করার ব্যবস্থাও দেখতে পাচ্ছি। যে ব্যবস্থাকে মোটেই শাইলকি কারবার বলে চেনার উপায় নেই, খুবই মানবদরদি বলে মনে হচ্ছে। এখন শুনি বলা হয়, ঋণ একটি মৌলিক অধিকার। বলে কী! অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য_এগুলোই মানুষের মৌলিক অধিকার বলে স্বীকৃত ছিল, পরে শিক্ষাও যুক্ত হয়েছে, কিন্তু ঋণ? আগে কখনো শুনিনি, পৃথিবীর অন্য কোথাও শোনা গেছে কি না জানি না, গেলে সে দেশকে আমি হিংসা করব না, কেননা ঋণ গ্রহণ মানে তো বন্ধক ও সুদের রশিতে নিজেকে আবদ্ধ রাখা। কোনো ঋণদাতাই ঋণ গ্রহণকে মৌলিক অধিকার বলে প্রচার করতে পারবে না, যদি না মানুষের উপকারী হিসেবে তার পরিচিতি থাকে; এমনকি ওয়ার্ল্ড ব্যাংকও পারবে না, কেননা ইতিমধ্যেই শাইলক বলে বিশ্বব্যাপী পরিচয় লাভে সে ধন্য হয়ে গেছে। এসো, ঋণ নাও, এই আহ্বান ঠিক আছে : কিন্তু ঋণ একটি মৌলিক অধিকার_এটা বলা বোধ হয় একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে, এমনকি আমাদের এই সর্বগ্রাসী ঋণ গ্রহণের সংস্কৃতিতেও। এর পরে হয়তো শুনব আমরা যে নত হওয়া একটি মৌলিক অধিকার। গরিব মানুষের জন্য ঋণ গ্রহণ আর নত হয়ে থাকা_ দুয়ের মধ্যে ব্যবধানটা কতটুকুইবা।
'ঋ', তোমার ভয় নেই। ঋষি গেছে ঠিকই, ঋতুও বিপদে আছে। কিন্তু ঋণ আছে এবং থাকবে। নিজের পায়ে দাঁড়ানো_সে অনেক দূরে। বটেই তো। ঋ, তুমি থাকবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
কিন্তু সময় বদলেছে। এখন ঋণ দিতে পেরে কেউ নিজেকে ধন্য মনে করে না, টাকা ধার দিয়ে জাতে উঠতে চায় না, জাতে-ওঠারাই টাকা ধার দেয়; আবার অন্যদিকে ঋণ চাইছে বলে যে কেউ লজ্জায় মরে যাবে তাও মরে না। এখন ব্যাপারটা খুবই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, পানিপান্তা। বরঞ্চ বলা যাবে ধার দেওয়ার চেয়ে নেওয়াতেই কৃতিত্ব বেশি। আমাদের অর্থমন্ত্রীরা কে কার চেয়ে অধিক যোগ্য সেটা নির্ণয়ের সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য মাপকাঠি হচ্ছে কে কত বেশি ঋণ আনতে পারেন সেটা, অন্য কিছু নয়। ঋণ এনেছি_এই ঘোষণা কাগজে টিভিতে হৈচৈ করে প্রচার করা হয়। লজ্জার কোনো ছায়া দেখা যায় না। এটা যুগের হাওয়া। আমরা তো সামান্য দেশ, ওই যে অত বড় আমেরিকা, বিশ্বের ভেতর সবচেয়ে ধনী দেশ, তার হালটা কী? শুনলে বিশ্বাস হতে চায় না, তবু যাঁরা জানেন তাঁরাই বলেন আমেরিকা ঋণগ্রস্ত দেশ। ঋণ তার বাড়ছে। কিন্তু আমেরিকা লজ্জা পায় না, নত করে না মাথা, বরঞ্চ সদর্পে চলে; সারা বিশ্ব তার পদানত।
এই দর্শন আমাদের দেশেও সুপ্রাচীন। ঋণ করে হলেও ঘি খাও, এটি প্রাচীন বক্তব্য কেবল ঘি কেন, তেলও খাও। নুন খাও। আমাদের কৃষক যুগযুগান্তর ধরে ঋণগ্রস্ত। বন্ধনে জর্জর। যারা ধার দেয় তাদের বলা হয় মহাজন। কথাটার মধ্যে প্রশংসা আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু ঘৃণা যে নেই সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই। আছে, ঘৃণাও আছে। মহানজকে ঘৃণা করে না, এমন কৃষক বিরল। কিন্তু তাতে মহাজনের কিছু যায় আসে না। সে মস্ত জন হয়েই থাকে, তার সঙ্গে কাবুলিওয়ালার তফাৎ নেই; যদিও কাবুলিওয়ালা বিদেশি, মহাজন স্বদেশি বটে। কাবুলিওয়ালারা গেছে চলে। দুঃস্বপ্নের মতো ছিল, এখন আর নেই; কিন্তু মহাজনরা রয়েছে, রয়েছে ঋণ দেওয়ার ব্যাংক ও এনজিও; আর মহাজনরা তো আছেই, থাকবেই। কৃষক আছে, অথচ ঋণগ্রস্তরা নেই, এ প্রায় বর্ষা আছে অথচ সর্দিকাশি, জ্বরজারি নেই_এই রকমেরই অবাস্তব। ঋণ সালিশি বোর্ড এসেছে এবং গেছে চলে। কিন্তু বাংলার কৃষক মুক্ত হয়নি। কবে হবে কে জানে।
ওই যে বললাম, বড় ঋণগ্রস্তরা নত হয় না, দর্পভরে হামলা করে। যেমন ওই আমেরিকা। ছোট ঋণীরাই কেবল কাতর হয়, ঘুমাতে পারে না, শুকাতে থাকে দুশ্চিন্তায়। বড় ঋণীদের পোয়াবারো। আমাদের দেশেও তাই। বড় বড় ঋণ যারা নিচ্ছে তাদের কি কেউ কখনো দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখেছেন? পরোয়া করে কারো? বোঝার উপায় আছে কি যে তারা কোটি কোটি টাকা ধার করে বসে আছে? প্রাইভেট ব্যাংকের তো বদনামই ওটি যে পরিচালকরাই ধার নেয়। নানান নাম খাড়া করে এবং সেই সব নামের আড়ালে লুকিয়ে থাকে, সবাইকে জানিয়েই। ব্যাংকের ঋণ নিয়ে বিদেশে চলে যাওয়া কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়, আমাদের বাংলাদেশে। যত ধনী, তত ঋণী এবং ততই নিশ্চিত যে ঋণ শোধ করতে হবে না; বিপদ যত ছোট মনুষদের;' ছোট ছোট ঋণ তাদের এবং বড় বড় বিপদ।
তবে জাতি হিসেবে আমরা যে অত্যন্ত ঋণগ্রস্ত সে খবর আমাদের অহরহ জানানো হচ্ছে। বিদেশি শাসকরা ছিল। তারা লুণ্ঠন করেছে এবং যতই লুণ্ঠন করেছে ততই করে গেছে ঋণী। তারাই তো আমাদের আলো দিল, সংস্কৃতি শেখাল, সভ্যতার যতটুকু সামান্য ছিটেফোঁটা আমাদের সেটুকু দিয়ে গেল। নইলে আমাদের কী ছিল? সবচেয়ে বেশি দিয়েছে ইংরেজ। ভাষাও শিখিয়েছে। এ ভাষা শেখানোটা মস্তবড় ব্যাপার। আসলেই। জাপানিরা এখন পৃথিবীর ওপর অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করতে চাইছে, কিন্তু ভাষা চাপাতে পারছে না, না পারলে পৃথিবীকে তেমনভাবে ঋণী করতে পারবে না যেমনভাবে ইংরেজরা করেছে তাদের ভাষার সাহায্যে। একেবারে বাপের নাম ভুলিয়ে ছেড়েছে। লুণ্ঠনকে মান্য করতে শিখিয়েছে সভ্যতার বিকিরণ বলে। বন্ধনকে বলেছে মুক্তি।
এইভাবে দেখার শিক্ষাটাই পাই আমরা। পেয়ে আসছি। যারা আমাদের শোষণ করে শেষ করেছে তাদের কাছেই নিজেদের ঋণী বিবেচনা করার শিক্ষাটা পাচ্ছি। কেবল ওপরেরটা দেখতে শেখানো হচ্ছে। ভেতরের সব কিছু অবজ্ঞা করে। মহাজনকে কৃষক ঘৃণা করে, কিন্তু সাম্রাজ্যবাদকে আজ আমরা ঘৃণা করি না। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যে আমাদের প্রেমে পড়েনি, যতই দিচ্ছে ঋণ ততই ধন্য হচ্ছে নিজে এই মনোভাব যে তার নয়, সে যে ছদ্মবেশী শাইলক একজন, এই সত্য প্রকাশ করবে কে? বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তখন সর্বত্র ব্যাপ্ত ছিল। আমেরিকার কাছ থেকে আমরা ঋণ নেব না এই ঘোষণা তখন বের হয়ে এসেছিল ওই যুদ্ধের ভেতর থেকেই। এ ছিল স্বাধীনতার যে ঘোষণা তারই অবিচ্ছেদ্য (যদিও প্রচ্ছন্ন) অঙ্গ, কিন্তু ওই বড়াই আজ আমাদের কোথায়? আমেরিকা আজ আমাদের প্রধান ত্রাণকর্তা। তার কাছে আমাদের নানা রকম ঋণ ক্রমবর্ধমান। যে ছিল শত্রু, যে সর্বতোভাবে বাধা দিয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা লাভকে সেই হয়ে দাঁড়িয়েছে সবচেয়ে বড় মিত্র। আমেরিকা কি বদলেছে? মোটেই না। আমরা বদলেছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে আমরা যে সরে এসেছি তার অনেক প্রমাণ আছে। একটি বড় প্রমাণ ওই একদা শত্রুর ওপর আমাদের নির্ভরতা। শত্রু শত্রুতাই করছে, আগের মতোই, আগে করেছে যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে, এখন করছে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের দূতদের মাধ্যমে। শত্রুতাকে মনে করছি ত্রাণতৎপরতা। আমরা কি অন্ধ, নাকি বধির, নাকি দুটোই একত্রে? তা আমাদের দোষ কী, আমরা সামান্য মানুষ, গরিব, পশ্চাৎপদ; অত বড় সোভিয়েত ইউনিয়ন সেই তো ভেঙে গেল এবং ভাঙার একটা কারণ তো মনে হচ্ছে ঋণ গ্রহণের অভিলাষ।
বাড়িয়ে বলার উপায় নেই। ঋণের একটি সংস্কৃতিই দেশে গড়ে উঠেছে। এতে ধনীদের জন্য ঋণ নেওয়া অগৌরবের কোনো ব্যাপার নয়। বরঞ্চ গর্বেরই বিষয়, ভেতরে ভেতরে। কিন্তু গরিবদের ঋণ গ্রহণে উৎসাহী করার ব্যবস্থাও দেখতে পাচ্ছি। যে ব্যবস্থাকে মোটেই শাইলকি কারবার বলে চেনার উপায় নেই, খুবই মানবদরদি বলে মনে হচ্ছে। এখন শুনি বলা হয়, ঋণ একটি মৌলিক অধিকার। বলে কী! অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য_এগুলোই মানুষের মৌলিক অধিকার বলে স্বীকৃত ছিল, পরে শিক্ষাও যুক্ত হয়েছে, কিন্তু ঋণ? আগে কখনো শুনিনি, পৃথিবীর অন্য কোথাও শোনা গেছে কি না জানি না, গেলে সে দেশকে আমি হিংসা করব না, কেননা ঋণ গ্রহণ মানে তো বন্ধক ও সুদের রশিতে নিজেকে আবদ্ধ রাখা। কোনো ঋণদাতাই ঋণ গ্রহণকে মৌলিক অধিকার বলে প্রচার করতে পারবে না, যদি না মানুষের উপকারী হিসেবে তার পরিচিতি থাকে; এমনকি ওয়ার্ল্ড ব্যাংকও পারবে না, কেননা ইতিমধ্যেই শাইলক বলে বিশ্বব্যাপী পরিচয় লাভে সে ধন্য হয়ে গেছে। এসো, ঋণ নাও, এই আহ্বান ঠিক আছে : কিন্তু ঋণ একটি মৌলিক অধিকার_এটা বলা বোধ হয় একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে, এমনকি আমাদের এই সর্বগ্রাসী ঋণ গ্রহণের সংস্কৃতিতেও। এর পরে হয়তো শুনব আমরা যে নত হওয়া একটি মৌলিক অধিকার। গরিব মানুষের জন্য ঋণ গ্রহণ আর নত হয়ে থাকা_ দুয়ের মধ্যে ব্যবধানটা কতটুকুইবা।
'ঋ', তোমার ভয় নেই। ঋষি গেছে ঠিকই, ঋতুও বিপদে আছে। কিন্তু ঋণ আছে এবং থাকবে। নিজের পায়ে দাঁড়ানো_সে অনেক দূরে। বটেই তো। ঋ, তুমি থাকবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্লেষক
No comments