আন্তর্জাতিক নারী দিবস-প্রতিবন্ধী নারী ও মেয়েশিশুদের নিয়ে কতটা ভাবছি by শাহরিয়ার হায়দার ও দিবা হোসেন
আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শতবর্ষ যখন ঘটা করে উদযাপিত হলো তখন কর্মসূত্রেই প্রতিবন্ধী নারী ও মেয়েশিশুর কথা সবার আগে আমাদের মনের মধ্যে ভেসে উঠেছে। প্রতিবছর জাতীয়ভাবে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আমরা দিবসটি পালন করছি, নারীর অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হচ্ছি, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা নারীদের সম-অধিকার অর্জনে সফলও
হয়েছি; যেসব মানুষের দ্বিমুখী বৈষম্যের (প্রথমত নারী, দ্বিতীয়, প্রতিবন্ধী হওয়ার কারণে সৃষ্ট বৈষম্য) শিকার হচ্ছে সেই নারী ও মেয়েশিশু প্রতিবন্ধীদের সমান অধিকার ও সুযোগের জন্য কাজ করার কথা আমরা কতটা ভাবছি? তাদের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক, শিক্ষাগত, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক, পুনর্বাসন, কর্মসংস্থান ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের কতটুকু জানা আছে?
বাংলাদেশে মোটামুটি ৭০ থেকে ৮০ লাখ নারী প্রতিবন্ধী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে শারীরিক প্রতিবন্ধী প্রায় ৪০ শতাংশ। এরপর বাক ও শ্রবণ, দৃষ্টি এবং বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীদের সংখ্যা পরিলক্ষিত হয় (সিএসআইডি, ২০০২)। এই জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের ক্ষেত্রে বিরাট অসমতা লক্ষ করা যায়। বেশির ভাগ নারী প্রতিবন্ধী তাঁদের পরিবার ও সমাজ থেকেই প্রারম্ভিক অবহেলার শিকার হন। আমাদের দেশে নারী আন্দোলনের প্রায় তিন দশক হতে চলেছে, কিন্তু এর কোথাও আমরা বৈষম্যের শিকার প্রতিবন্ধী নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখি না। এর কারণটি এ রকম, প্রথমত পরিবার তাদের প্রতিবন্ধী মেয়েশিশুটিকে লুকিয়ে রাখে, ধীরে ধীরে সমাজও একইভাবে বালিকা থেকে নারী হয়ে ওঠা মানুষটিকে সবকিছু থেকে দুরে সরিয়ে রাখে। অন্য অনেক সংগ্রামে নারীরা শামিল হতে পারলেও নারী প্রতিবন্ধীদের সেই অগ্রযাত্রায় আমরা নিয়ে আসতে পারিনি। বাংলাদেশের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় শুধু অপ্রতিবন্ধী নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করছে। প্রতিবন্ধী নারী ও শিশুদের নিয়ে তেমন কোনো কার্যক্রম পরিলক্ষিত নয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করলেও সেখানে সুনির্দিষ্ট করে শুধু নারী, মেয়েশিশু প্রতিবন্ধীদের জন্য পরিচালিত কোনো কার্যক্রম সম্পর্কে আমরা অবগত নই। বাংলাদেশে ‘প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন ২০০১’ বিদ্যমান থাকলেও সেখানে নারী প্রতিবন্ধীদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো ধারা নেই। এই আইনটির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় পর্যায় থেকে জেলা পর্যায় পর্যন্ত যে তিনটি কমিটি গঠনের ব্যবস্থা রয়েছে, সেই কমিটিতে ‘নারী সদস্য’ হিসেবে একটি সদস্যপদ রাখা উচিত ছিল, যিনি নারীদের বিভিন্ন বিষয় উপলব্ধি করতে পারবেন একজন নারী হিসেবে। আমরা মনে করি, নতুন যে আইনটি হচ্ছে, সেখানে এ বিষয়টি ভাবা উচিত।
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নারীর কল্যাণে বাংলাদেশে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হলেও প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য সে রকম কোনো উদ্যোগে চোখে পড়ার মতো নয়। অথচ নারী প্রতিবন্ধীদের অনেকেরই বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে, যাঁরা উপযুক্ত বিকাশের সুযোগ পেলে তাঁদের প্রতিবন্ধিতার মাত্রা যা-ই হোক না কেন, তাঁরাও তাঁদের যোগ্য অবস্থান ও স্বীকৃতি লাভ করার ক্ষমতা রাখেন।
প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকেও যদি শিক্ষার সুযোগ দেওয়া যায়, তবে তাঁরা তাঁদের সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে উঠে সমাজে কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীরা কমবেশি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন, এর তুলনায় নারী প্রতিবন্ধীদের শিক্ষায় অংশগ্রহণের হার আশঙ্কাজনকভাবে কম। মেয়েশিশু প্রতিবন্ধীদের মধ্যে প্রাথমিক স্তরে ভর্তির হার শতকরা ৩০ দশমিক ৬৭ ভাগ, যেখানে উচ্চ শিক্ষায় মাত্র তিন দশমিক ৭৫ ভাগ নারী প্রতিবন্ধী রয়েছেন। দেখা যাচ্ছে, প্রাথমিক স্তরে যারা ভর্তি হচ্ছে, তারা ক্রমে ঝরে গিয়ে মাত্র এক-দশমাংশ টিকে থাকতে পারছে। এই ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যারা যুক্ত এবং পরিবারের সদস্য—উভয়ের নিরুত্সাহব্যঞ্জক ভূমিকাই গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে। আরও জানা গেছে, অনেক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে তার প্রতিবন্ধিতার কারণে বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে চান না। মেয়ে প্রতিবন্ধী হলে তার সঙ্গে এসে যুক্ত হয় কুসংস্কার, লুকিয়ে রাখার প্রবণতাসহ অন্যান্য বাধা। উপরন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য উপযুক্ত বিদ্যালয় কাঠামো না থাকায় অনেক শিক্ষার্থীই বিদ্যালয় ছেড়ে দিচ্ছে। এখানে নারী প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর বেলায় সমস্যার খতিয়ান আরও বৃদ্ধি পায়। বিশেষত সেসব নারী শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে সমস্য প্রকট হয় যখন তাঁরা বাড়ি থেকে দূরে হোস্টেলে লেখাপড়া করেন এবং যেখানে মহিলা তত্ত্বাবধায়ক থাকেন না। মূলধারা বা বিশেষ শিক্ষা, যে ব্যবস্থাই হোক না কেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্বিক পরিবেশ প্রতিবন্ধীদের (বিশেষত নারী প্রতিবন্ধী) অনকূলে নয় এবং তাঁদের বিশেষ প্রয়োজনগুলোর অপর্যাপ্ততা রয়েছে।
নারীমুক্তির একটি অন্যতম হাতিয়ার হলো অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন—যা প্রতিবন্ধী নারীদের একেবারেই নেই বললে চলে। যেকোনো অর্থনৈতিক কাজে যুক্ত হওয়ার জন্য যে ন্যূনতম প্রশিক্ষণ বা সাহায্য-সহযোগিতা দরকার হয় সেটি তাঁরা পান না। এমনকি নারী প্রতিবন্ধীরাও যে নিজেদের অর্থসংস্থান নিজেরাই করতে পারেন, এ মনোভাবটাও অনুপস্থিত। এ ছাড়া তাঁরা যদি কাজের সুযোগ পানও সেখানে একই প্রকার কাজে প্রতিবন্ধী নারীরা অপ্রতিবন্ধীদের তুলনায় বেতন ও অন্য সুবিধাদি কম পাচ্ছেন। এ সবের জন্য চাকরিদাতাদের নেতিবাচক মনোভাবকেই দায়ী করা যায়। এ অবস্থার উত্তরণে ভূমিকা রাখতে পারে সরকারি নীতি এবং মিডিয়া। সরকারের সব প্রতিষ্ঠানে যোগ্য নারী প্রতিবন্ধীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে ন্যূনতম কোটা যেমন—প্রতি সংস্থার এক শতাংশ যোগ্য নারী প্রতিবন্ধী রাখার নিয়ম করে দেয়, তবে যোগ্যতার কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত হবে। অন্যদিকে প্রচার মাধ্যম নারী প্রতিবন্ধীদের যোগ্যতা ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারে।
এসব কিছুর জন্য প্রয়োজন সেই নারীর সম্ভাবনার বিকাশ একটু বন্ধুত্বপূর্ণ পারিবারিক পরিবেশ ও সামাজিক নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা এবং কর্মস্থলের সহকর্মীদের সহযোগিতা। সবকিছু হয়তো এক দিনেই পরিবর্তিত হবে না, কিন্তু চেষ্টা তো করা যেতে পারে। সমাজের প্রতিটি স্তরের নারী প্রতিবন্ধীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান যথাযোগ্য করার জন্য জেন্ডার নীতিমালায় নারী প্রতিবন্ধীদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রদত্ত সুযোগের সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকা জরুরি। সমাজের মধ্য থেকেই তাঁদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রচেষ্টা শুরু করতে হবে, যেন সমাজ তাঁদের একজন উত্পাদনশীল ব্যক্তি হিসেবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত হয়। এজন্য একেবারে গ্রামীণ স্তর থেকে শহর পর্যন্ত নারী প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার সুযোগ এবং প্রয়োজনে বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা রাখতে হবে। পাশাপাশি নারী প্রতিবন্ধীদের স্বাস্থ্য এবং প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপরও গুরুত্ব দিয়ে যথাযোগ্য প্রতিবন্ধী স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা উচিত। শুধু সরকারই নয়, তাঁদের উপযুক্ত পুনর্বাসনে নারীদের উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংস্থার সঙ্গে মিলে একত্রে কাজ করতে হবে। নারী প্রতিবন্ধীদেরও যে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে সমান সুযোগ প্রাপ্তির অধিকার রয়েছে, সেটির প্রতি জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে নিয়মিত কার্যক্রম গ্রহণ করা উচিত। এ জন্য ‘জাতীয় নারী প্রতিবন্ধী দিবস’ ঘোষণা এবং ওই দিনে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা নারী প্রতিবন্ধীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মাননা জানানো, তাঁদের কর্মসংস্থানে অবদান রাখা ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কৃত করাসহ বিভিন্ন উত্সাহমূলক কার্যক্রম নেওয়া যায়। এভাবেই এমন একটি দিনের দেখা আমরা পাওয়ার প্রত্যাশা করি, যেদিন প্রতিবন্ধিতার কারণে কোনো নারী তাঁর যোগ্য সুযোগপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবেন না।
শাহরিয়ার হায়দার ও দিবা হোসেন: শিক্ষক, বিশেষ শিক্ষা বিভাগ, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
durbasha@gmail.com, diba_h@yahoo.com
বাংলাদেশে মোটামুটি ৭০ থেকে ৮০ লাখ নারী প্রতিবন্ধী রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে শারীরিক প্রতিবন্ধী প্রায় ৪০ শতাংশ। এরপর বাক ও শ্রবণ, দৃষ্টি এবং বুদ্ধিপ্রতিবন্ধীদের সংখ্যা পরিলক্ষিত হয় (সিএসআইডি, ২০০২)। এই জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের ক্ষেত্রে বিরাট অসমতা লক্ষ করা যায়। বেশির ভাগ নারী প্রতিবন্ধী তাঁদের পরিবার ও সমাজ থেকেই প্রারম্ভিক অবহেলার শিকার হন। আমাদের দেশে নারী আন্দোলনের প্রায় তিন দশক হতে চলেছে, কিন্তু এর কোথাও আমরা বৈষম্যের শিকার প্রতিবন্ধী নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখি না। এর কারণটি এ রকম, প্রথমত পরিবার তাদের প্রতিবন্ধী মেয়েশিশুটিকে লুকিয়ে রাখে, ধীরে ধীরে সমাজও একইভাবে বালিকা থেকে নারী হয়ে ওঠা মানুষটিকে সবকিছু থেকে দুরে সরিয়ে রাখে। অন্য অনেক সংগ্রামে নারীরা শামিল হতে পারলেও নারী প্রতিবন্ধীদের সেই অগ্রযাত্রায় আমরা নিয়ে আসতে পারিনি। বাংলাদেশের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় শুধু অপ্রতিবন্ধী নারী ও শিশুদের নিয়ে কাজ করছে। প্রতিবন্ধী নারী ও শিশুদের নিয়ে তেমন কোনো কার্যক্রম পরিলক্ষিত নয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করলেও সেখানে সুনির্দিষ্ট করে শুধু নারী, মেয়েশিশু প্রতিবন্ধীদের জন্য পরিচালিত কোনো কার্যক্রম সম্পর্কে আমরা অবগত নই। বাংলাদেশে ‘প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন ২০০১’ বিদ্যমান থাকলেও সেখানে নারী প্রতিবন্ধীদের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো ধারা নেই। এই আইনটির উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় পর্যায় থেকে জেলা পর্যায় পর্যন্ত যে তিনটি কমিটি গঠনের ব্যবস্থা রয়েছে, সেই কমিটিতে ‘নারী সদস্য’ হিসেবে একটি সদস্যপদ রাখা উচিত ছিল, যিনি নারীদের বিভিন্ন বিষয় উপলব্ধি করতে পারবেন একজন নারী হিসেবে। আমরা মনে করি, নতুন যে আইনটি হচ্ছে, সেখানে এ বিষয়টি ভাবা উচিত।
সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নারীর কল্যাণে বাংলাদেশে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হলেও প্রতিবন্ধী নারীদের জন্য সে রকম কোনো উদ্যোগে চোখে পড়ার মতো নয়। অথচ নারী প্রতিবন্ধীদের অনেকেরই বিশেষ পারদর্শিতা রয়েছে, যাঁরা উপযুক্ত বিকাশের সুযোগ পেলে তাঁদের প্রতিবন্ধিতার মাত্রা যা-ই হোক না কেন, তাঁরাও তাঁদের যোগ্য অবস্থান ও স্বীকৃতি লাভ করার ক্ষমতা রাখেন।
প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীকেও যদি শিক্ষার সুযোগ দেওয়া যায়, তবে তাঁরা তাঁদের সীমাবদ্ধতাকে কাটিয়ে উঠে সমাজে কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন। শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীরা কমবেশি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন, এর তুলনায় নারী প্রতিবন্ধীদের শিক্ষায় অংশগ্রহণের হার আশঙ্কাজনকভাবে কম। মেয়েশিশু প্রতিবন্ধীদের মধ্যে প্রাথমিক স্তরে ভর্তির হার শতকরা ৩০ দশমিক ৬৭ ভাগ, যেখানে উচ্চ শিক্ষায় মাত্র তিন দশমিক ৭৫ ভাগ নারী প্রতিবন্ধী রয়েছেন। দেখা যাচ্ছে, প্রাথমিক স্তরে যারা ভর্তি হচ্ছে, তারা ক্রমে ঝরে গিয়ে মাত্র এক-দশমাংশ টিকে থাকতে পারছে। এই ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যারা যুক্ত এবং পরিবারের সদস্য—উভয়ের নিরুত্সাহব্যঞ্জক ভূমিকাই গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে। আরও জানা গেছে, অনেক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে তার প্রতিবন্ধিতার কারণে বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে চান না। মেয়ে প্রতিবন্ধী হলে তার সঙ্গে এসে যুক্ত হয় কুসংস্কার, লুকিয়ে রাখার প্রবণতাসহ অন্যান্য বাধা। উপরন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য উপযুক্ত বিদ্যালয় কাঠামো না থাকায় অনেক শিক্ষার্থীই বিদ্যালয় ছেড়ে দিচ্ছে। এখানে নারী প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর বেলায় সমস্যার খতিয়ান আরও বৃদ্ধি পায়। বিশেষত সেসব নারী শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে সমস্য প্রকট হয় যখন তাঁরা বাড়ি থেকে দূরে হোস্টেলে লেখাপড়া করেন এবং যেখানে মহিলা তত্ত্বাবধায়ক থাকেন না। মূলধারা বা বিশেষ শিক্ষা, যে ব্যবস্থাই হোক না কেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সার্বিক পরিবেশ প্রতিবন্ধীদের (বিশেষত নারী প্রতিবন্ধী) অনকূলে নয় এবং তাঁদের বিশেষ প্রয়োজনগুলোর অপর্যাপ্ততা রয়েছে।
নারীমুক্তির একটি অন্যতম হাতিয়ার হলো অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন—যা প্রতিবন্ধী নারীদের একেবারেই নেই বললে চলে। যেকোনো অর্থনৈতিক কাজে যুক্ত হওয়ার জন্য যে ন্যূনতম প্রশিক্ষণ বা সাহায্য-সহযোগিতা দরকার হয় সেটি তাঁরা পান না। এমনকি নারী প্রতিবন্ধীরাও যে নিজেদের অর্থসংস্থান নিজেরাই করতে পারেন, এ মনোভাবটাও অনুপস্থিত। এ ছাড়া তাঁরা যদি কাজের সুযোগ পানও সেখানে একই প্রকার কাজে প্রতিবন্ধী নারীরা অপ্রতিবন্ধীদের তুলনায় বেতন ও অন্য সুবিধাদি কম পাচ্ছেন। এ সবের জন্য চাকরিদাতাদের নেতিবাচক মনোভাবকেই দায়ী করা যায়। এ অবস্থার উত্তরণে ভূমিকা রাখতে পারে সরকারি নীতি এবং মিডিয়া। সরকারের সব প্রতিষ্ঠানে যোগ্য নারী প্রতিবন্ধীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে ন্যূনতম কোটা যেমন—প্রতি সংস্থার এক শতাংশ যোগ্য নারী প্রতিবন্ধী রাখার নিয়ম করে দেয়, তবে যোগ্যতার কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত হবে। অন্যদিকে প্রচার মাধ্যম নারী প্রতিবন্ধীদের যোগ্যতা ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, সচেতনতামূলক বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারে।
এসব কিছুর জন্য প্রয়োজন সেই নারীর সম্ভাবনার বিকাশ একটু বন্ধুত্বপূর্ণ পারিবারিক পরিবেশ ও সামাজিক নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা এবং কর্মস্থলের সহকর্মীদের সহযোগিতা। সবকিছু হয়তো এক দিনেই পরিবর্তিত হবে না, কিন্তু চেষ্টা তো করা যেতে পারে। সমাজের প্রতিটি স্তরের নারী প্রতিবন্ধীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান যথাযোগ্য করার জন্য জেন্ডার নীতিমালায় নারী প্রতিবন্ধীদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রদত্ত সুযোগের সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকা জরুরি। সমাজের মধ্য থেকেই তাঁদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রচেষ্টা শুরু করতে হবে, যেন সমাজ তাঁদের একজন উত্পাদনশীল ব্যক্তি হিসেবে গ্রহণ করতে প্রস্তুত হয়। এজন্য একেবারে গ্রামীণ স্তর থেকে শহর পর্যন্ত নারী প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার সুযোগ এবং প্রয়োজনে বৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা রাখতে হবে। পাশাপাশি নারী প্রতিবন্ধীদের স্বাস্থ্য এবং প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপরও গুরুত্ব দিয়ে যথাযোগ্য প্রতিবন্ধী স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা উচিত। শুধু সরকারই নয়, তাঁদের উপযুক্ত পুনর্বাসনে নারীদের উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা সংস্থাগুলোকে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সংস্থার সঙ্গে মিলে একত্রে কাজ করতে হবে। নারী প্রতিবন্ধীদেরও যে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে সমান সুযোগ প্রাপ্তির অধিকার রয়েছে, সেটির প্রতি জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে নিয়মিত কার্যক্রম গ্রহণ করা উচিত। এ জন্য ‘জাতীয় নারী প্রতিবন্ধী দিবস’ ঘোষণা এবং ওই দিনে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা নারী প্রতিবন্ধীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মাননা জানানো, তাঁদের কর্মসংস্থানে অবদান রাখা ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কৃত করাসহ বিভিন্ন উত্সাহমূলক কার্যক্রম নেওয়া যায়। এভাবেই এমন একটি দিনের দেখা আমরা পাওয়ার প্রত্যাশা করি, যেদিন প্রতিবন্ধিতার কারণে কোনো নারী তাঁর যোগ্য সুযোগপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবেন না।
শাহরিয়ার হায়দার ও দিবা হোসেন: শিক্ষক, বিশেষ শিক্ষা বিভাগ, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
durbasha@gmail.com, diba_h@yahoo.com
No comments