এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চায় ভারত by কাজী আলিম-উজ-জামান

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে সৌদি আরব সফর করেন। তিন দিনের এ সফরে মোট ১০টি চুক্তি স্বাক্ষর করে এশিয়ার রাজনীতি ও অর্থনীতিতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা এ দুটি দেশ। তবে স্রেফ চুক্তি স্বাক্ষরই এ সফরের মূল উদ্দেশ্য ছিল না।


বাণিজ্যিক যোগাযোগ উন্নয়নের মধ্য দিয়ে কূটনৈতিক সম্পর্কটা আরও ঝালাই করে নেওয়ার চেষ্টা দুই দেশেরই ছিল। বর্তমানে দুটি দেশই আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের শিকার। একদিকে বাণিজ্যিক স্বার্থ, অন্যদিকে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা—এ দুই অনিবার্য কারণে মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব আর দক্ষিণ এশিয়ার ভারত আরও কাছাকাছি আসার তাগিদ অনুভব করছে। সেই সূত্র ধরেই এ সফর। তবে এ দুটি দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের যেকোনো আলোচনায় পাকিস্তানের নাম চলে আসে। সৌদি আরব সব সময় পাকিস্তানের পৃষ্ঠপোষক। বিতাড়িত নওয়াজ শরিফকে আট বছর নিজের আশ্রয়ে রেখেছিল সৌদি আরব। আর পারভেজ মোশাররফের সঙ্গে আলোচনা করে তাঁকে দেশে ফেরত পাঠানোর কাজে সৌদি বাদশাহই ছিলেন সক্রিয়। আবার বাদশাহ ফাহাদ মারা গেলে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হয়েছিল পাকিস্তানেই। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে ঘিরে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থন দিয়েছিল সৌদিরা। তারা বরাবরই কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তানের অবস্থানকেই সমর্থন করে। এ থেকে বোঝা যায়, এ দুটি দেশের সম্পর্কটা কেমন।
আর ভারত-সৌদি আরব সম্পর্ক প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থিত নজিবুল্লাহর ‘গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র আফগানিস্তানকে যে কয়টি রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিয়েছিল, ভারত সেগুলোর একটি। আর ঠিক আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত বাহিনীকে সরাতে মুজাহিদীনদের যে কয়টি দেশ অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সহায়তা করেছিল, সৌদি আরব তার একটি। এ থেকে মনে হতে পারে, ভারত-সৌদি আরব সম্পর্ক বুঝি আদায়-কাঁচকলায়।
তবে আশার কথা, সৌদি আরবের সমর্থনেই ইসলামি সম্মেলন সংস্থায় (ওআইসি) পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের মর্যাদা পেয়েছে ভারত। আর দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে পাকিস্তান যেমন বাধা, যুক্তরাষ্ট্র তেমনি অনুঘটক। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারত ও সৌদি আরব উভয়ের সম্পর্কই গভীর।
প্রকৃত পক্ষে ঐতিহাসিকভাবেই এ দুটি দেশ পরস্পর সম্পর্কে আবদ্ধ। ইউরোপীয়রা ভারতবর্ষে আসার আগে আরব বণিকদেরই এ অঞ্চলে একচেটিয়া ব্যবসা ছিল। বিশেষ করে মসলার ব্যবসা। আর এ ব্যবসাই ছিল আরবের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতালাভের পরপরই সৌদি আরবের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। তখনো সৌদি আরবের তেলের খনি অনাবিষ্কৃত। ভারত দেশটির জন্য খাদ্য ও পানীয় পাঠাত। তবে এ দুটি দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে মাইলফলক হয়ে আছে ১৯৫৩ সাল। ওই বছর সৌদি বাদশাহ সউদ ভারত সফর করেন। আর এর দুই বছর পরই ফিরতি সফরে সৌদি যান ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। এরপর ১৯৮২ সালে ইন্দিরা গান্ধী এবং এর ২৮ বছর পর মনমোহন সিং সৌদি আরব সফর করলেন। আর ৫১ বছর পর ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসে প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রধান অতিথি হয়ে সৌদি বাদশাহ আবদুল্লাহ নয়াদিল্লি সফর করেন। অনেকেরই হয়তো মনে থাকবে, মনমোহন সিং প্রটোকল ভেঙে বিমানবন্দরে গিয়েছিলেন তাঁকে স্বাগত জানাতে।
কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য দুটি দেশ কোনো সময় চেষ্টা করেছে, আবার কোনো সময় ঢিল দিয়েছে। কিন্তু বাণিজ্যিক সম্পর্কে তার প্রভাব পড়েনি। ভারতের জ্বালানি তেলের চাহিদার চার ভাগের এক ভাগ জোগান দেয় সৌদিরা। এর বাইরে তারা ভারতে চামড়াজাত পণ্য, স্বর্ণ, জৈব ও অজৈব রাসায়নিক, মেটাল স্ক্র্যাপ রপ্তানি করে। আর ভারত থেকে আনে বাসমতি চাল, পোশাক ও কল-কারখানার বিভিন্ন যন্ত্রপাতি। ভারতের বাণিজ্যিক সহযোগীদের মধ্যে সৌদি আরবের অবস্থান সপ্তম, আর সৌদি আরবে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ভারতের অবস্থান পঞ্চম। আর প্রায় ২০ লাখ ভারতীয় সৌদি আরবে কাজ করে।
গভীর তাত্পর্যের সফর: স্বাস্থ্যমন্ত্রী গোলাম নবী আজাদ, শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মা, পেট্রোলিয়ামমন্ত্রী মুরলি দেওরা, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শশী থারুরকে সঙ্গে নিয়ে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি সৌদি আরব সফরে যান প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। মনমোহন সেখানকার মজলিশ-ই-শুরায় ভাষণ দেন এবং কিং সউদ ইউনিভার্সিটি তাঁকে অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রি দেয়। তিন দিনে অনেক ঘটনার মধ্যে দুটি হলো, মনমোহন সিংকে থাকতে দেওয়া হয় রাজপ্রাসাদের ভেতরেই, যে সম্মান পাননি ১৯৮২ সালে ইন্দিরা গান্ধীও। আর সফরসঙ্গী নারী কূটনীতিক লাথা রেড্ডিকে মজলিশ-ই-শুরায় প্রবেশ করতে দেওয়া হয় কোনো হিজাব ছাড়াই। প্রথমটা হয়তো নিরাপত্তার কারণে, আর দ্বিতীয়টাকে দেখা যেতে পারে বদলে যাওয়ার প্রতীক হিসেবে।
এ সফরের মধ্য দিয়ে সৌদি আরবের কাছ থেকে আরও বেশি জ্বালানি তেল পাওয়ার নিশ্চয়তা পেয়েছে ভারত। চলতি অর্থবছরে সেটা অন্তত ১২ শতাংশ বাড়ার কথা বলা হচ্ছে। বিশাখাপত্তনম ও বেঙ্গালুরুতে দুটি স্টোরেজ টার্মিনাল করার পরিকল্পনা করা হয়েছে, যেখানে যথাক্রমে ১৩ দশমিক ৩ লাখ টন এবং ৫০ লাখ টন করে তেল সঞ্চয় করা হবে। তেলের বাইরে আর যে চুক্তি হয়, তার মধ্যে রয়েছে বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তি, সাংস্কৃতিক ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সহায়তা চুক্তি। আট কোটি ডলারের আরেকটি চুক্তি হয়েছে, সেটা হলো টাটা মোটরস সৌদি আরবে স্কুলবাস সরবরাহ করবে।
শুধুই কি চুক্তি করার জন্য দোল আর হোলি উত্সবের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রীর মরুর দেশে সফর? এ ধরনের চুক্তি তো মন্ত্রী পর্যায়েও হতে পারত।
আন্তর্জাতিক এই প্রেক্ষাপটে এ সফরের গভীর তাত্পর্য আছে। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, অর্থনীতি ও নিরাপত্তা, মোটা দাগে বললে সন্ত্রাসবাদ দমনে সৌদিকে পাশে পাওয়া—এ দুটোই মনমোহন সিংয়ের সফরের মূল উদ্দেশ্য। অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদারের মাধ্যমেই কেবল সন্ত্রাসবাদ দমনে সৌদিকে পাশে পাওয়া সম্ভব হতে পারে বলে তাঁদের ধারণা। তা ছাড়া এশিয়ায় ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী চীন কিন্তু সম্প্রতি সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক যথেষ্ট উন্নতি করেছে। ২০০৬ সালে বাদশাহ বেইজিং যাওয়ার পর হু জিন তাও দু-দুবার রিয়াদ সফর করেন। চীন তেলের বিনিময়ে যৌথ উদ্যোগে সেখানে ব্যাপক বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে চীন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সৌদি আরব ২০২০ সালের মধ্যে ৯০ হাজার কোটি ডলারের বিনিয়োগ আশা করছে। এ অবস্থায় ভারত কীভাবে হাত গুটিয়ে বসে থাকে!
আর সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে ভারতের প্রত্যাশা, সৌদি আরব পাকিস্তানকে অন্তত চাপে রাখবে। যদিও দেশটির সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক বিন্দুমাত্র টলেনি। বর্তমান জারদারি প্রশাসনের ওপর তাদের যথেষ্ট কর্তৃত্ব আছে। ওদিকে আফগানিস্তানের বর্তমান হামিদ কারজাইয়ের সরকারের কট্টর সমর্থক ভারত। কিন্তু সৌদি আরব কারজাই নয়, তালেবানের সমর্থক ছিল। কিন্তু তালেবান আল-কায়েদার সঙ্গে হাত মেলানোর পর রিয়াদ সে সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছে বলে তাদের তরফ থেকে দাবি করা হচ্ছে। তা ছাড়া সৌদি আরবও এখন সন্ত্রাসের ঝুঁকিতে। খোদ বাদশাহ প্রাসাদ থেকে বের হন না। প্রাসাদের মধ্যেই হেলিপ্যাড। সেখান থেকে নিজস্ব উড়ানে বিদেশ সফরে যান। সন্ত্রাসের ভয়ে বাদশাহরই বন্দিজীবন।
একদিকে বাণিজ্যিক স্বার্থ, অন্যদিকে সন্ত্রাসবাদ দমন—ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁর সফরের মধ্য দিয়ে এ দুই পাখিই মারতে চেয়েছেন। তবে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার জন্য কেবল এ দুটি দেশের মতৈক্যই যথেষ্ট নয়। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকেও সঙ্গে রাখতে হবে। এ দুটি দেশও সন্ত্রাসবাদের বড় শিকার।

No comments

Powered by Blogger.