গদ্যকার্টুন-শিক্ষাবিষয়ক কৌতুক by আনিসুল হক
শিক্ষক ক্লাসে বললেন, শোনো, এটা তো লাস্ট পিরিয়ড, আমি একটা করে প্রশ্ন করব। যে সবার আগে শুদ্ধ উত্তর দিতে পারবে, তাকে আমি আগে বাড়ি চলে যেতে দেব। ঠিক আছে? জি স্যার। ছাত্ররা একযোগে উত্তর দিল।বাবলুর খুব খিদে পেয়েছে। সে সবার আগে সঠিক উত্তরটা দিয়ে সবার আগেই ছুটি পেতে চায়।
শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা বলো তো, কে বলেছেন, চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির...
শাহিন বলে বসল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্যার।
উত্তর ঠিক হয়েছে। শাহিন, তুমি যেতে পারো।
এবার বল দেখি এটা কে বলেছেন, ‘বলো বীর, চির উন্নত মম শির!’
বাবলু হাত তোলার আগেই জহির বলে ফেলল, ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্যার।’
‘সঠিক জবাব। জহির, তুমি যেতে পারো, তোমার ছুটি।’
এবার স্যার বললেন, ‘বলো আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবে না। কে বলেছেন?’
‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্যার’—ফুয়াদ বলে ফেলল।
‘ঠিক। ফুয়াদ। তোমারও ছুটি।’
‘আচ্ছা বলো তো কে বলেছেন, গবর্নমেন্ট বাই দি পিপল অব দি পিপল ফর দি পিপল।’
রঞ্জু বলে উঠল, আব্রাহাম লিংকন স্যার।
বাবলুর আর সহ্য হলো না। সে বলে উঠল, ‘চোপ বেয়াদব।’
স্যার ঘুরে দাঁড়ালেন, কে? কে বলেছে এই কথা।
বাবলু বলল, ‘বেগম খালেদা জিয়া স্যার। স্যার এবার আমি যাই?’
‘উচিত শিক্ষা দিব’—স্যার রেগে গেলেন।
‘শেখ হাসিনা স্যার। দুইটার সঠিক উত্তর দিয়েছি। এবার আমি তো স্যার যেতে পারি!’ বাবলু বইখাতা বগলে নিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগল।
আরেক দিনের ঘটনা। শিক্ষক ক্লাসে ছেলেদের উপদেশমূলক কাহিনী লিখতে বললেন।
শাহিন লিখল, ‘আমার বাবার একটা মুরগির খামার আছে। রোজ সকালে বাবা খামার থেকে অনেক ডিম বের করেন। তারপর মুরগির ডিমগুলো একটা ট্রাকে তোলেন। সেসব নিয়ে তিনি বাজারে যান। আর সেগুলো বিক্রি করেন। একদিন ট্রাকটা দুর্ঘটনায় পড়ল। সবগুলো ডিমই ভেঙে গেল।’
শিক্ষক বললেন, এই গল্পের উপদেশ কী?
‘সব ডিম একই ঝুড়িতে রেখো না।’
জহির লিখল, ‘আমার বাবা খুব দক্ষ একজন ক্রীড়াবিদ। স্কুলে কলেজে তিনি বহু ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি সবচেয়ে ভালো পারেন উচ্চ লম্ফ বা হাই জাম্প। এখনো অফিসের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তিনি উচ্চ লম্ফে প্রথম পুরস্কার লাভ করে থাকেন। একদিন তিনি একটা বাগানে কাজ করছিলেন। পাশের রাস্তা দিয়ে তার বন্ধু সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল। বন্ধুকে দেখে তিনি তার নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। বন্ধুটি শুনতে পেল না। চলে যেতে লাগল। এবার বাবা এক লাফে বাগানের প্রাচীর পার হয়ে গেলেন। কিন্তু ওই পারে ছিল একটা খোলা ম্যানহোল। তিনি তার ওপরে পড়লেন এবং মারাত্মকভাবে আহত হলেন।’
শিক্ষক বললেন, ‘এই গল্পের উপদেশ কী?’
‘লাফানোর আগে দেখে নাও কোথায় পড়ছ।’
রঞ্জু লিখল, ‘নির্বাচনের আগে আগে একজন ব্যবসায়ী তার আগের দল ত্যাগ করে প্রতিদ্বন্দ্বী একটা দলে যোগ দিলেন। নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য প্রার্থীও হলেন। ওই নির্বাচনে ব্যবসায়ীর আগের দলটি ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করল এবং বর্তমান দলটি গো-হারা হারল। ব্যবসায়ী নিজেও হেরে গেলেন। এরপর তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা ইত্যাদি হতে লাগল।’
শিক্ষক বললেন, এই গল্পের উপদেশ কী?
‘ডিগবাজি দেওয়ার আগে ভালোমতো দেখে নাও কোথায় গিয়ে পড়বে।’ রঞ্জু বলল।
শিক্ষক স্তম্ভিত। ধাক্কা সামলে তিনি বাবলুকে বললেন, ‘বাবলু। তুমি কী লিখেছ?’
বাবলু বলল, ‘আমার ছোটভাই হাবলু রোজ বিকেলে টেলিভিশন দেখে। টেলিভিশনে সে সময় কুস্তি প্রতিযোগিতা হয়। সে হাঁ করে কুস্তি দেখে আর শূন্যের মধ্যে হাত-পা ছোড়ে। মাঝেমধ্যে আমাদেরও ফ্লাইং কিক মেরে বসে। বাবা বললেন, হাবলু সোনা, কুস্তি দেখতে হয় না। এটা দেখলে তুমি হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা এসব শিখবে। যদি দেখতে হয় অন্য কোনো চ্যানেল দেখো। এরপরে হাবলু রোজ বিকেলে টিভিতে সংসদ অধিবেশন দেখে। তার পর থেকে তার নামে বাসায় অনেক অভিযোগ আসতে লাগল। সে তার বন্ধুবান্ধবদের গালি-গালাজ ধাক্কাধাক্কি এসব করতে শুরু করেছে।’
শিক্ষক বললেন, এই গল্পের উপদেশ কী?
‘উপদেশটা হলো: আমি হাবলুর বড় ভাই। আমাকে সবাই মান্য করে চলবে। না হলে খবর আছে।’
আজকের লেখাটা বেশ হাল্কা হয়ে গেল। এটাকে একটা ভারি কথা দিয়ে শেষ করি। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান একবার বলেছিলেন, ‘আমার নির্দেশ দেওয়া আছে, যেকোনো জরুরি জাতীয় প্রয়োজনের সময় যেন আমাকে ডেকে তোলা হয়, জাগিয়ে দেওয়া হয়, এমনকি আমি যদি মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে থাকি, তাহলেও।’
যথেষ্ট ভারি হলো না? এবার তাহলে মার্ক টোয়েনের উক্তি পরিবেশন করি, ‘ইট কুড প্রবাবলি বি শ্যোন বাই ফ্যাক্টস অ্যান্ড ফিগারস দ্যাট দেয়ার ইজ নো ডিস্টিঙ্কটলি নেটিভ আমেরিকান ক্রিমিনাল ক্লাস এক্সেপ্ট কংগ্রেস।’
তবুও হাল্কা লাগছে? তাহলে গতকাল ১৫ মার্চ ২০১০ প্রথম আলোর শেষ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত খবরটা পাঠ করুন:
চুয়াডাঙ্গায় শিক্ষককে পেটালেন আ. লীগ নেতা
চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি: চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলায় এবার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়েছে। উপজেলা বাঁকা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুর রহমান ছাত্রলীগের দুই কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে গত শনিবার প্রধান শিক্ষক সাইদুর রহমানকে বেধড়ক পিটিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
শাহিন বলে বসল, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্যার।
উত্তর ঠিক হয়েছে। শাহিন, তুমি যেতে পারো।
এবার বল দেখি এটা কে বলেছেন, ‘বলো বীর, চির উন্নত মম শির!’
বাবলু হাত তোলার আগেই জহির বলে ফেলল, ‘কাজী নজরুল ইসলাম স্যার।’
‘সঠিক জবাব। জহির, তুমি যেতে পারো, তোমার ছুটি।’
এবার স্যার বললেন, ‘বলো আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবে না। কে বলেছেন?’
‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্যার’—ফুয়াদ বলে ফেলল।
‘ঠিক। ফুয়াদ। তোমারও ছুটি।’
‘আচ্ছা বলো তো কে বলেছেন, গবর্নমেন্ট বাই দি পিপল অব দি পিপল ফর দি পিপল।’
রঞ্জু বলে উঠল, আব্রাহাম লিংকন স্যার।
বাবলুর আর সহ্য হলো না। সে বলে উঠল, ‘চোপ বেয়াদব।’
স্যার ঘুরে দাঁড়ালেন, কে? কে বলেছে এই কথা।
বাবলু বলল, ‘বেগম খালেদা জিয়া স্যার। স্যার এবার আমি যাই?’
‘উচিত শিক্ষা দিব’—স্যার রেগে গেলেন।
‘শেখ হাসিনা স্যার। দুইটার সঠিক উত্তর দিয়েছি। এবার আমি তো স্যার যেতে পারি!’ বাবলু বইখাতা বগলে নিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগল।
আরেক দিনের ঘটনা। শিক্ষক ক্লাসে ছেলেদের উপদেশমূলক কাহিনী লিখতে বললেন।
শাহিন লিখল, ‘আমার বাবার একটা মুরগির খামার আছে। রোজ সকালে বাবা খামার থেকে অনেক ডিম বের করেন। তারপর মুরগির ডিমগুলো একটা ট্রাকে তোলেন। সেসব নিয়ে তিনি বাজারে যান। আর সেগুলো বিক্রি করেন। একদিন ট্রাকটা দুর্ঘটনায় পড়ল। সবগুলো ডিমই ভেঙে গেল।’
শিক্ষক বললেন, এই গল্পের উপদেশ কী?
‘সব ডিম একই ঝুড়িতে রেখো না।’
জহির লিখল, ‘আমার বাবা খুব দক্ষ একজন ক্রীড়াবিদ। স্কুলে কলেজে তিনি বহু ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। তিনি সবচেয়ে ভালো পারেন উচ্চ লম্ফ বা হাই জাম্প। এখনো অফিসের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় তিনি উচ্চ লম্ফে প্রথম পুরস্কার লাভ করে থাকেন। একদিন তিনি একটা বাগানে কাজ করছিলেন। পাশের রাস্তা দিয়ে তার বন্ধু সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল। বন্ধুকে দেখে তিনি তার নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। বন্ধুটি শুনতে পেল না। চলে যেতে লাগল। এবার বাবা এক লাফে বাগানের প্রাচীর পার হয়ে গেলেন। কিন্তু ওই পারে ছিল একটা খোলা ম্যানহোল। তিনি তার ওপরে পড়লেন এবং মারাত্মকভাবে আহত হলেন।’
শিক্ষক বললেন, ‘এই গল্পের উপদেশ কী?’
‘লাফানোর আগে দেখে নাও কোথায় পড়ছ।’
রঞ্জু লিখল, ‘নির্বাচনের আগে আগে একজন ব্যবসায়ী তার আগের দল ত্যাগ করে প্রতিদ্বন্দ্বী একটা দলে যোগ দিলেন। নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য প্রার্থীও হলেন। ওই নির্বাচনে ব্যবসায়ীর আগের দলটি ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করল এবং বর্তমান দলটি গো-হারা হারল। ব্যবসায়ী নিজেও হেরে গেলেন। এরপর তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা ইত্যাদি হতে লাগল।’
শিক্ষক বললেন, এই গল্পের উপদেশ কী?
‘ডিগবাজি দেওয়ার আগে ভালোমতো দেখে নাও কোথায় গিয়ে পড়বে।’ রঞ্জু বলল।
শিক্ষক স্তম্ভিত। ধাক্কা সামলে তিনি বাবলুকে বললেন, ‘বাবলু। তুমি কী লিখেছ?’
বাবলু বলল, ‘আমার ছোটভাই হাবলু রোজ বিকেলে টেলিভিশন দেখে। টেলিভিশনে সে সময় কুস্তি প্রতিযোগিতা হয়। সে হাঁ করে কুস্তি দেখে আর শূন্যের মধ্যে হাত-পা ছোড়ে। মাঝেমধ্যে আমাদেরও ফ্লাইং কিক মেরে বসে। বাবা বললেন, হাবলু সোনা, কুস্তি দেখতে হয় না। এটা দেখলে তুমি হিংস্রতা, নিষ্ঠুরতা এসব শিখবে। যদি দেখতে হয় অন্য কোনো চ্যানেল দেখো। এরপরে হাবলু রোজ বিকেলে টিভিতে সংসদ অধিবেশন দেখে। তার পর থেকে তার নামে বাসায় অনেক অভিযোগ আসতে লাগল। সে তার বন্ধুবান্ধবদের গালি-গালাজ ধাক্কাধাক্কি এসব করতে শুরু করেছে।’
শিক্ষক বললেন, এই গল্পের উপদেশ কী?
‘উপদেশটা হলো: আমি হাবলুর বড় ভাই। আমাকে সবাই মান্য করে চলবে। না হলে খবর আছে।’
আজকের লেখাটা বেশ হাল্কা হয়ে গেল। এটাকে একটা ভারি কথা দিয়ে শেষ করি। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান একবার বলেছিলেন, ‘আমার নির্দেশ দেওয়া আছে, যেকোনো জরুরি জাতীয় প্রয়োজনের সময় যেন আমাকে ডেকে তোলা হয়, জাগিয়ে দেওয়া হয়, এমনকি আমি যদি মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে থাকি, তাহলেও।’
যথেষ্ট ভারি হলো না? এবার তাহলে মার্ক টোয়েনের উক্তি পরিবেশন করি, ‘ইট কুড প্রবাবলি বি শ্যোন বাই ফ্যাক্টস অ্যান্ড ফিগারস দ্যাট দেয়ার ইজ নো ডিস্টিঙ্কটলি নেটিভ আমেরিকান ক্রিমিনাল ক্লাস এক্সেপ্ট কংগ্রেস।’
তবুও হাল্কা লাগছে? তাহলে গতকাল ১৫ মার্চ ২০১০ প্রথম আলোর শেষ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত খবরটা পাঠ করুন:
চুয়াডাঙ্গায় শিক্ষককে পেটালেন আ. লীগ নেতা
চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি: চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলায় এবার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে পিটিয়ে গুরুতর আহত করা হয়েছে। উপজেলা বাঁকা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুর রহমান ছাত্রলীগের দুই কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে গত শনিবার প্রধান শিক্ষক সাইদুর রহমানকে বেধড়ক পিটিয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments