চলতি পথে-রাজা হরিশ্চন্দ্রের প্রাসাদ-ঢিবি by দীপংকর চন্দ

আকাশের শরীরে জড়ানো সেদিন ধূসর, মলিন মেঘের চাদর। অথচ বাজার-অর্থনীতির সমর্থক বাতাসের সেই ধূসরতা, মলিনতা পছন্দ হচ্ছিল না মোটেই। সে চাইছিল আকাশটাকে নিজের মতো করে সাজাতে; ধনতান্ত্রিক সমাজের উপরতল যেমন, তেমনই চাকচিক্যে, তেমনই উজ্জ্বলতায়।


এ চাওয়ায় অবশ্য দোষের কিছু নেই, কারণ পৃথিবী এগিয়েছে অনেক দূর। এখন কি আর ধূসর-মলিন চাদর শরীরে জড়িয়ে অনড় কোনো মতাদর্শের ব্যাখ্যায়, নিবিড় কোনো নৈতিকতার প্রতি শর্তহীন ব্যাকুলতায় আটকে থাকা শোভা পায়?
বাতাস বইতে শুরু করল তীব্র বেগে। এতে কি বদলাল পরিস্থিতি? হ্যাঁ, বদলাল বুঝি। মেঘের চাদরের একটি অংশে ধরল চিড়। ধীরে ধীরে সেই চিড় ধরা অংশটুকু দখল করে নিল সূর্য। আকাশের সুদীর্ঘ নিমগ্নতায় শুরু হলো পরিবর্তন প্রক্রিয়া। আক্ষরিক অর্থে এই প্রক্রিয়া মন্দ, না ভালো? সে বিষয়ে সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়ার আগেই আমিনবাজার সেতু পার হলাম আমরা। চিশতিয়া রিফুয়েলিং স্টেশনের সামনে ফাগুনের আগুনমাখা কৃষ্ণচূড়ার বিপ্লবী প্রতিচ্ছবি। তারপর ক্লান্তিকর মাঠঘাট, বৈচিত্র্যহীন লোকালয়, আটপৌরে বাসস্টপেজ একের পর এক—হেমায়েতপুর, তেঁতুলঝোরা, ফুলবাড়িয়া, কর্ণপাড়া, গেন্ডা—শেষ অবধি সাভার বাজার।
বাস থেকে নেমে ওভারব্রিজ টপকে আমরা গেলাম ওপারে। চৌরঙ্গী সুপার মার্কেট আর জাতীয় অন্ধকল্যাণ সংস্থার বহুতল বিপণিবিতান দুপাশে ফেলে যে পথ চলে গেছে ভেতরে, দুই পায়ের ওপর পূর্ণ আস্থা রেখে এগিয়ে গেলাম সে পথেই। মিনিট পাঁচেক এগোতেই নয়ন ভ্যারাইটি স্টোর আবির্ভূত হলো হাতের বাঁ দিকে। মৃত্সামগ্রীর নানা সম্ভারে সাজানো এই দোকানটির স্বত্বাধিকারী মো. লিটন। একটু জিরিয়ে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষায় আমরা যখন দাঁড়ালাম তাঁর দোকানের ছায়ায়, তখন আকাশ পুরোপুরি মেঘহীন; বাতাসের আনুকূল্যে সূর্যের একচ্ছত্র আধিপত্য সেখানে প্রতিষ্ঠিত নিরঙ্কুশভাবেই। জিরিয়ে নিতে নিতে কথা হলো মো. লিটনের সঙ্গে। তাঁর কাছ থেকে জানা হয়ে যায়, জনবহুল সাভারের এ অঞ্চলটির নাম মজিদপুর। বর্তমানকালে স্থান হিসেবে মজিদপুরের প্রসিদ্ধি না থাকলেও প্রাচীনকালে অঞ্চলটির গুরুত্ব ছিল ভীষণ রকম। ঐতিহাসিক কিছু সংশয় ছাড়া বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞের ধারণা অনুযায়ী ঢাকা থেকে প্রায় ২৪ কিমি উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত প্রাচীন বংশাবতী বা অধুনা বংশাই নদীর বাঁ তীরের লোকালয়, যা বর্তমানে সাভার নামে পরিচিত, অনেক অনেক দিন আগে তা-ই ছিল রাজা হরিশ্চন্দ্রের রাজধানী। আর ইতিহাসখ্যাত রাজা হরিশ্চন্দ্রের প্রাসাদ ছিল এই মজিদপুরেই।
মো. লিটনের দোকান পেছনে ফেলে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই সাভার সিটি গার্ডেন কাঁচাবাজার। সেই কাঁচাবাজার অতিক্রম করে একটু এগোলেই চার রাস্তার মোড়। মোড়ের ডান দিকের সরু পথটি পিচঢালা হলেও গাছপালা-শোভিত, শান্ত, নির্জনতায় সমাহিত। কেউ কিছু বলুক আর না-ই বলুক, কী করে যেন বোঝাই যায়, এ পথে এগোলে পাওয়া যাবে রাজা হরিশ্চন্দ্রের প্রাসাদের খোঁজ। কিন্তু সেই প্রাসাদের রাজসিক অবয়ব কিংবা জৌলুশ কি আর আছে আজ? না, নেই। রাজপ্রাসাদের জৌলুশের সব চিহ্নই আজ ভূলুণ্ঠিত কালের কঠিন আঘাতে। উনিশ শতকের শেষভাগেও লোকগাথার এই প্রাসাদ চাপা পড়ে ছিল মাটির নিচে। স্থানীয় লোকজন মাটিচাপা এই স্থানটিকে রাজবাড়ি ঢিবি হিসেবেই চিহ্নিত করত। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে রাজবাড়ি-ঢিবির কাছাকাছি গ্রাম রাজাসনে এক প্রত্নতাত্ত্বিক খোঁড়াখুঁড়িতে আবিষ্কৃত হয় বৌদ্ধদের ধর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত কিছু প্রত্নবস্তু ও গুপ্ত রাজবংশের অনুকৃত মুদ্রাস্মারক। এরই সূত্র ধরে নব্বইয়ের দশকে খনন চলে হরিশ্চন্দ্র রাজার প্রাসাদ-ঢিবিতেও। সেই খননে এই ঢিবিতে অনাবৃত হয় মাঝারি আকারের একটি নিবেদনস্তূপ এবং দক্ষিণে একটি বিহারের ভগ্নপ্রায় অবকাঠামো।
স্তূপের প্রবেশপথেই ঘন ছায়া সৃষ্টি করে দাঁড়িয়ে আছে দুটি কাঁঠালগাছ। গাছ দুটোর মায়াজড়ানো ছায়া গায়ে মেখে স্তূপের অমসৃণ ধাপে পা রাখি আমরা। স্তূপের উল্টোদিকেই বিহার। হরিশ্চন্দ্র রাজার প্রাসাদ-ঢিবির উত্খননে অনাবৃত হওয়া বিহারটির মধ্যে একাধিক পুনর্নির্মাণ এবং একাধিক মেঝের চিহ্ন লক্ষ করা যায়। বিহারের স্থাপত্যশৈলীতে চারটি স্তর অনুধাবনযোগ্য। স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনন্য এই স্থাপত্যকীর্তির সবচেয়ে ওপরের স্তরে একটি স্বর্ণমুদ্রা ও একটি রৌপ্যমুদ্রা ছাড়াও এযাবত্ আবিষ্কৃত হয়েছে কয়েকটি ব্রোঞ্জনির্মিত বুদ্ধবিগ্রহ ও গুটিকয় তান্ত্রিক মূর্তি। শিল্পশৈলী বিবেচনায় এসব প্রত্নবস্তু খ্রিষ্টীয় সাত থেকে আট শতকের নিদর্শন বলে বিশেষজ্ঞদের অনুমান।
পুরো প্রাসাদ-ঢিবি ভালোভাবে ঘুরে দেখতে যতটা সময় লাগা উচিত, এর চেয়েও অনেক কম সময় নিলাম আমরা সূর্যের বৈরী আচরণের কারণে! বাজার-অর্থনীতির সমর্থক বাতাস মেঘের চাদর সরিয়ে নিয়েই খুশি, নৈতিকতা কিংবা মতাদর্শিক দেয়াল ভেঙে আকাশটাকে নিজের মতো করে সাজিয়েই তৃপ্ত, আনন্দিত। কিন্তু অসহনীয় দ্রব্যমূল্যের মতো তীব্র দহনগুণসম্পন্ন সূর্যের উত্তাপে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ যে দিশেহারা, সে খবর কি সে রাখে! একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে ফেরার পথ ধরি এরপর।

No comments

Powered by Blogger.