শেকড়ের টান by তৈমুর রেজা

তাঁরা জন্মেছেন বাঙালি হয়ে, তবে ভিনদেশে। কর্মসূত্রে এই দেশে ফেরার পর সেই মানুষগুলোই বাংলাদেশের প্রেমে পড়ে গেছেন। এরকম দুই শেকড়-প্রেমিকের গল্প— আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে—এই বাংলায়
হয়ত মানুষ নয়—হয়ত বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে


হয়ত ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে

জীবনানন্দ বাংলায় ফিরতে চেয়েছিলেন। এই বাংলায় আর ফেরা হয়নি। অনেকেরই হয় না।
দেশ ছেড়ে বিমানে বা জাহাজে ওঠার সময় অনেকেই চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘আবার ফিরে আসব। আমি না পারি আমার সন্তান ফিরবে।’
তাও হয়ে ওঠে না। সন্তানেরা তত দিনে বিদেশি হয়ে যায়। ভিনদেশি রঙিন পাসপোর্টের মালিক হয়ে কে আর এই গরিব, অভাবী, দুর্যোগগ্রস্ত, দুর্নীতিতে ছেয়ে যাওয়া দেশে ফিরতে চায়?
শেষ পর্যন্ত ফিরে আসাটা তাই আর হয় না।
কিন্তু প্রচলিত এই পাণ্ডুলিপিই শেষ কথা নয়। কেউ কেউ উল্টো স্রোতে পথ চলতে চায়। কেউ কেউ মা-বাবার স্বপ্নটাকে সত্যি করে তোলে। কেউ কেউ হঠাত্ একদিন পুরোনো শেকড়ের প্রেমে পড়ে যায়। তেমনই কয়েকজন শেকড়ের প্রেমে পড়া মানুষের গল্প শোনা যাক।

বদলের স্বপ্ন
ষাটের দশকের গোড়ার দিকের কথা। হঠাত্ সিলেটিদের মধ্যে লন্ডনে যাওয়ার একটা ধুম পড়ে গেল। পিলপিল করে লোকে দেশ ছাড়ছে। সাইফুল ইসলাম নামের একজন বাঙালি সেই ডামাডোলের মধ্যে দেশ ছাড়লেন। তিনি ঘর বাঁধলেন যুক্তরাজ্যের মিডলসেক্সে। ১৯৬৯ সালে সেখানেই জন্ম নিল ওয়ারিস। ওয়ারিস ইসলাম। জন্মসূত্রে ব্রিটিশ নাগরিক। কিন্তু বাবার মাধ্যমে শেকড়ের গন্ধ পাওয়া এক বাঙালি।
ওয়ারিসের বাবা দেশ ছাড়লেন। কিন্তু তাঁর নোঙর পড়ে রইল বাংলাদেশে। একটু ফুরসত পেলেই এ দেশে উড়ে আসেন। বাবার সঙ্গে কখনো কখনো আসেন ওয়ারিস। দেশে পা দিয়ে নিজের নাড়ি টের পান।
ওয়ারিস পড়াশোনা করেছেন চলচ্চিত্রের ওপর, শেফিল্ড হ্যালাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। চিত্রনাট্য লেখা বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন ‘লন্ডন কলেজ অব প্রিন্টিং’ থেকে।
এরপর শুরু করলেন পেশাগত জীবন। দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন বিবিসিতে। হঠাত্ বিবিসিই তাঁকে প্রস্তাব দিল—বাংলাদেশে কাজ করবে? তারা একটা ধারাবাহিক নাটক বানাবে। সেখানে ‘স্ক্রিপ্ট এডিটর’ (চিত্রনাট্য সম্পাদক) পদে কাজ করতে হবে। পাশাপাশি পরিচালনাও করতে হবে তাঁকে।
ওয়ারিস মহানন্দে চলে এলেন বাংলাদেশে। আনন্দটা বেশি ছিল নাটক-সিনেমা নিয়ে কাজ করার সুযোগ পাওয়ায়। কিন্তু এ দেশে আসার পর ওয়ারিসের সামনে নতুন এক জগত্ খুলে গেল। সিনেমার চেয়েও বড় হয়ে উঠল বাংলাদেশ।
এবার যেন উপলব্ধি করতে পারলেন, বাংলাদেশ তাঁর নিজের দেশ।
কাজ করতে করতে প্রায় এক বছর কেটে গেছে। এর আগে বাংলাদেশে বহুবার এসেছেন। পর্যটকের মতো এসে ঘুরেফিরে দেখেছেন, চলে গেছেন। মনের মধ্যে দাগটা খুব স্থায়ী হয়ে ফোটেনি। কিন্তু এবার বেশ লম্বা সময় কাটল। দেশের তুচ্ছ সংস্কারের মধ্যেও তিনি খুঁজে পাচ্ছেন বেঁচে থাকার শক্তি।
তাঁর দেশটিকে পশ্চিমা গণমাধ্যম বড় নেতিবাচক করে উপস্থাপন করে। সেসব উপস্থাপনা দেখতে দেখতে বড় হওয়া ওয়ারিস এবার রুখে দাঁড়াতে চাইলেন। দেশটার এই ‘নেতিবাচক’ উপস্থাপন বদলাতে হবে।
শুরু হয় ওয়ারিসের স্বপ্ন দেখা। ওয়ারিস স্বপ্ন দেখেন তাঁর বাংলাদেশ নিয়ে। একটা সিনেমা বানাবেন ওয়ারিস। এই সিনেমা বদলের কথা বলবে, এই সিনেমা নতুন প্রজন্মের কাছে জীবনের প্রেরণা জোগাবে। ছবির মধ্যে উনি একটা গল্প বলবেন, যা স্বপ্নের মতো, কিন্তু জীবনের মতো সত্য। একদল লোক অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলবে। সেই অবিশ্বাস্য লড়াইয়ের কাহিনিই তিনি বলবেন তাঁর ছবিতে।
ছবির চিত্রনাট্য তিনি নিজেই করেছেন। অক্টোবরে তিনি ঢাকা ছাড়ছেন। পরের বছর ফিরে এসেই ছবির কাজে হাত দেবেন।
ওয়ারিস মহা উত্সাহের সঙ্গে বলেন, বাংলাদেশের সিনেমায় একটি বিপ্লব আসন্ন। নতুন সিনেমা তৈরি হবে এ দেশে।
সেই নতুনের মিছিলে তিনিও থাকতে চান। নতুনদের একটা দলও দাঁড় করাতে চেষ্টা করছেন। বিশ্বমানের চলচ্চিত্র বানানোটা ওয়ারিসের জন্য নতুন কিছু নয়। অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেছেন। তাঁর বানানো সিনেমা পুরস্কারও পেয়েছে।
ওয়ারিস স্বপ্নীল চোখে তাকান বাংলাদেশের দিকে। তাঁর খুব ইচ্ছে করে, তিনি বাংলাদেশে থাকবেন। শেষ পর্যন্ত এখানেই স্থির হতে পারবেন কি না জানেন না। কিন্তু জোর গলায় একটা কথা বলতে পারেন, ‘আমি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ব্র্যান্ডটাই বদলে দিতে চাই।’

ফিরে আসা
১৯৭৯ সালে মিশার জন্ম সিলেটে। কিন্তু বাবা তার আগেই দেশ ছেড়ে গেছেন। মিশার বাবা বাংলাদেশ ছেড়ে ব্রিটেনে স্থায়ী হয়েছেন খুবই অল্প বয়সে।
এমসি কলেজের একটা ডিগ্রি সম্বল করে বাবা যখন ‘বিলাত’ গেলেন, তখন তাঁর বয়স ১৯। মিশা ব্রিটেনে গেলেন দুই বছর বয়সে, মায়ের কোলে শুয়ে। তারপর সেখানেই বেড়ে ওঠা। পড়াশোনা করেছেন ‘আর্ট হিস্টরি’র ওপর, এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে।
মিশা ইউরোপ দেখে বড় হয়েছেন। বাংলাদেশ কখনো সেভাবে দেখার সুযোগ পাননি।
ব্রিটেনে যাওয়ার ১১ বছর পর প্রথম তিনি বাংলাদেশে আসেন, তিন সপ্তাহের সফরে। তারপর প্রায় ২০ বছর তিনি বাংলাদেশে আসেননি। সেবারের স্মৃতি তাই খুব রঙিন কিছু নয়।
শেষতক তিনি এলেন ২০০৮ সালে। তবে এবার আর বেড়াতে নয়; একেবারে তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে এলেন। বাংলাদেশে থাকবেন। ছোটবেলায় বাংলাদেশ নিয়ে তাঁর খুব হীনম্মন্যতা ছিল। তাঁর বাংলাদেশ ছিল বন্যা, দুর্যোগ, আর দুর্নীতির জনপদ। নাইন-ইলেভেনের পর এই দুস্থ ছবির ভেতর যুক্ত হলো সন্ত্রাসবাদ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশ ছিল একটা মূর্তিমান বিভীষিকা। এর রাবণ মূর্তি গড়ার পেছনে পশ্চিমা মিডিয়ার কৃতিত্ব আছেই। সেই সঙ্গে নিজেকেও তিনি একটু দোষ দেন। মিশা নিজেই যে দেশটাকে চিনতে পারেননি। ঠিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য তাঁর মাঝেমধ্যে বাংলাদেশে আসার সুযোগ পাওয়াটা দরকার ছিল। সে সুযোগ তিনি পাননি।
কিন্তু এবার তিনি বাংলাদেশকে ঠিকঠাক বুঝে নিতে চান। জন্মভূমির প্রতি নাড়ির টান থাকে মানুষের, সেই টান তিনি শুধু আবেগ দিয়ে বুঝতে চান না। নিজেকে সেই মাটির মধ্যে স্থাপন করে তিনি বাংলাদেশকে আরও সত্য করে তুলতে চান নিজের জীবনে।
এখন ঢাকায় তিনি একজন ফ্রিল্যান্স রিপোর্টার হিসেবে কাজ করছেন। বিভিন্ন সময় বিবিসি, প্রথম আলো, টাইম ম্যাগাজিন, ডন নিউজ—এ রকম সব নামজাদা সংবাদমাধ্যমে তিনি নিজের পছন্দের বিষয় নিয়ে কাজ করছেন, লেখালেখি করছেন।
দীর্ঘদিন ধরে তিনি লক্ষ করছেন, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ ছেলেমেয়েরা নিজের পরিচয় নিয়ে দ্বিধান্বিত থাকে। ব্রিটিশ, না বাঙালি—এই দোটানার মধ্যে পড়ে তারা ঠিকভাবে বিকশিত হয় না।
দুই সংস্কৃতির টানাহেঁচড়ার মধ্যে নিজের সংস্কৃতির প্রতিমা তারা খুঁজে পায় না। এখানে মিশার কোনো দ্বন্দ্ব নেই।
নিজেকে তিনি ভাবেন একজন বাঙালি ব্রিটিশ। তিনি যেমন বাঙালি, তেমনি তিনি একজন ব্রিটিশ। আজকাল লোকে ভাবে, দুটোর মধ্যে একটাকেই বেছে নিতে হয়। কিন্তু মিশা সবকিছু থেকে ভালোটুকু ছেঁকে নিতে চান জীবনের জন্য।
বাংলাদেশ তিনি ভালোবাসেন। এই ভালোবাসা নিছক আবেগের উচ্ছ্বাসে নয়। বাংলাদেশ তাঁর কাছে শেকড়ের সন্ধানের নাম। তিনি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে খুঁজে পেতে চান জীবন।
এখন থেকে তিনি থাকবেন দক্ষিণ এশিয়া আর ইউরোপে। তাঁর কাজের কেন্দ্র হবে ঢাকা আর প্যারিস।
হোডিং কার্টার একবার লিখেছিলেন, ‘আমাদের সন্তানের জন্য মাত্র দুটো স্থায়ী সম্পদই আমরা রেখে যেতে পারি। একটা হচ্ছে শেকড়, আরেকটা হলো উড়ে বেড়ানোর ডানা।’
ওয়ারিস-মিশারা এত দিন ডানাটাকে চিনেছেন, ব্যবহার করেছেন। এবার সেই শেকড়ের টান টের পাচ্ছেন। তাতে আখেরে আমাদেরই লাভ বোধহয়।

No comments

Powered by Blogger.