মিডিয়া ভাবনা-চলচ্চিত্রশিল্পের জন্য চাই সামগ্রিক নীতিমালা by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

বাংলাদেশের গণমাধ্যমে একটি অবহেলিত শাখা হলো চলচ্চিত্র। স্বাধীনতার ৩৯ বছরেও চলচ্চিত্রশিল্পের বড় রকমের কোনো অগ্রগতি হয়নি। মেইন স্ট্রিম চলচ্চিত্র পাকিস্তান আমলে নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও যে শিল্পমান বজায় রেখেছিল, স্বাধীনতার পর নানা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও চলচ্চিত্রের অগ্রগতি তো দূরের কথা, সেই মানও ধরে রাখতে পারেনি।


কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া। স্বাধীনতার পর এ পর্যন্ত কত সরকার, কত তথ্যমন্ত্রী, তথ্যসচিব এলেন-গেলেন, কিন্তু চলচ্চিত্রশিল্পে বড় কোনো অগ্রগতি ঘটল না। সামান্য অগ্রগতি এবং উচ্চমানের স্বাক্ষর রেখেছে বিকল্প ধারার কয়েকটি চলচ্চিত্র। যারা সরকারের কোনো সহযোগিতা সাধারণত পায় না।
চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শন প্রাইভেট সেক্টর ও ব্যক্তি প্রতিভার বিষয় হলেও ব্যয়বহুলতার কারণে এ ব্যাপারে সরকারের নানা সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। একজন ঔপন্যাসিক বা কবির ক্ষেত্রে যার প্রয়োজন হয় না। তাই চলচ্চিত্রের অগ্রগতি প্রসঙ্গে সরকারের ভূমিকা বা ব্যর্থতা নিয়ে বারবার আলোচনা করতে হয়।
আজ এই আলোচনার সুযোগ হয়েছে একটি সেমিনারের সূত্রে। কয়েক দিন আগে ‘১১তম আন্তর্জাতিক স্বল্পদৈর্ঘ্য ও মুক্ত চলচ্চিত্র উত্সব (২০১০)’ উপলক্ষে আয়োজিত এক সেমিনারে ‘বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্র নীতিমালা প্রণয়নে চলচ্চিত্রজনের প্রস্তাবনা’ শীর্ষক এক আলোচনা চক্র অনুষ্ঠিত হয়। তথ্যসচিব কামাল চৌধুরী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দেন। এই সেমিনারের মূল ধারণাপত্রে বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার মানজারে হাসীন মুরাদ জাতীয় চলচ্চিত্র নীতিমালায় কী কী বিষয় স্থান পাওয়া উচিত তা নিয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করেন। এই ধারণাপত্রকে চলচ্চিত্র নীতিমালার একটি সুচিন্তিত রূপরেখা বলা যায়। কিন্তু এত বড় রূপরেখা বিস্তারিত আলোচনার জন্য একটি সেমিনার যথেষ্ট নয়। সভার সভাপতিসহ কয়েকজন বক্তা এই সীমাবদ্ধতার কারণে আরও ব্যাপক পরিসরে আলোচ্য বিষয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেন। একজন চলচ্চিত্র পরিচালক যথার্থভাবে উল্লেখ করেন, সরকারের উদ্যোগে ১৯৮৮ সালে প্রয়াত সাংবাদিক ওবায়েদ উল হকের নেতৃত্বে গঠিত একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নীতিমালা সম্পর্কে দীর্ঘদিন আলোচনা করে একটি রিপোর্ট সরকারের কাছে পেশ করে। এই কমিটিতে চলচ্চিত্র জগতের খ্যাতনামা ও শ্রদ্ধাভাজন অনেক ব্যক্তি যুক্ত ছিলেন। সভায় দাবি করা হয়, আলোচ্য রিপোর্টের প্রায় ৮০ ভাগ সুপারিশ এখনো প্রাসঙ্গিক।
আমাদের সরকার কীভাবে চলে তার একটা নমুনা পাওয়া গেল এই সভায়। ১৯৮৮ সালে চলচ্চিত্র নীতিমালার জন্য যে সুপারিশমালা দেওয়া হয়েছিল (এগুলো রাজনৈতিক বিষয় নয়) তা ২০১০ সাল পর্যন্ত কোনো সরকার বিবেচনার জন্য হাতে নেয়নি। হাতে না নিয়ে বিভিন্ন আমলে তথ্যমন্ত্রী ও তথ্যসচিবেরা নানা অনুষ্ঠানে চলচ্চিত্রশিল্পের অগ্রগতির জন্য নানা বক্তব্য, উপদেশ, প্রতিশ্রুতি ও উন্নয়ন পরিকল্পনা দিয়ে গেছেন। কেউ বলেননি, এ ব্যাপারে একটি রিপোর্ট রয়েছে, তাঁরা তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছেন। সব তথ্যমন্ত্রী ও সচিবেরা নিজের আমলে চলচ্চিত্রশিল্পের অগ্রগতির জন্য ‘এ’ থেকে সব কথাবার্তা শুরু করেন। ফলে তাঁদের সময়ে দু-একটি কাজ ছাড়া কোনো বড় অগ্রগতির সূচনা করা সম্ভব হয়না। ‘এ’ থেকে আবার আলোচনা, মতবিনিময় শুরু হয়। ১৯৮৮ সালে প্রণীত সুচিন্তিত রিপোর্টটি তাঁদের কাছে বিবেচনাযোগ্য মনে হয় না। কারণ তাঁদের আমলে রিপোর্টটি প্রণীত হয়নি। রিপোর্টে যত ভালো ভালো সুপারিশই থাকুক না কেন। বর্তমান সরকারের আমলে এ ব্যাপারে একটি ব্যতিক্রম হলো, বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে প্রণীত ড. কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের আলোকে বর্তমান সরকার একটি শিক্ষানীতি কমিটি করেছিল। সেই কমিটি ড. কুদরত-এ-খুদা রিপোর্টের আলোকেই ২০০৯ সালে শিক্ষানীতি প্রস্তাব করেছে। এভাবেই কাজ হওয়া উচিত। তবে এ ক্ষেত্রে একটা সুবিধা ছিল। তা হলো, কুদরত-এ-খুদা রিপোর্টটি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই প্রণীত হয়েছিল। কাজেই কৃতিত্বটা নিজের ঘরেই থাকছে।
আলোচ্য আলোচনা সভায় তথ্যসচিব চলচ্চিত্রশিল্প নিয়ে সরকারের অনেক পরিকল্পনা ও অগ্রগতির কথা জানিয়েছেন, যা প্রশংসাযোগ্য। কিন্তু কাদের পরামর্শে বা সুপারিশে সরকার এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করছে তা বলেনি। অনুমান করছি, বিগত বিভিন্ন সরকারের আমলে যেসব সিদ্ধান্ত বা প্রকল্প গৃহীত হয়েছিল সেগুলোই বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু চলচ্চিত্রশিল্পের জন্য একটি সামগ্রিক পরিকল্পনা হওয়া উচিত। বিচ্ছিন্নভাবে এফডিসি স্টুডিওতে একটি মেশিন বসিয়ে বা অনুদানের টাকা পাঁচ লাখ বাড়িয়ে দিয়ে চলচ্চিত্রশিল্পের ব্যাপক কোনো অগ্রগতি হবে না। কিন্তু তথ্য মন্ত্রণালয় মনে হয় এ রকম কসমেটিক উন্নয়নে আত্মতৃপ্তি বোধ করে। আমার ধারণা, অনেকটা এ কারণেই চলচ্চিত্রশিল্পের বড় কোনো অগ্রগতি এ যাবত্ হয়নি। আরেকটি বড় কারণ হলো, কোনো তথ্যমন্ত্রী বা তথ্যসচিব চলচ্চিত্র নিয়ে খুব আগ্রহী বা উদ্যোগী হয়নি।
আলোচ্য সেমিনারে মানজারে হাসিন মুরাদ যে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেছেন, তার শিরোনাম থেকেই বোঝা যায় চলচ্চিত্রশিল্পের জন্য কত কাজ ও নীতি প্রণয়ন বাকি রয়েছে। শিরোনামগুলো হলো, চলচ্চিত্রমাধ্যমের চরিত্র নির্ণয়, চলচ্চিত্রের ভূমিকা, চলচ্চিত্র নির্মাণ, পরিবেশন, প্রদর্শন, সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা, সরকারি উদ্যোগ, চলচ্চিত্র প্রযোজনা, পরিবেশনা, প্রদর্শন, এফডিসির ভূমিকা, চলচ্চিত্র শিক্ষা, চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রশিক্ষণ, সেন্সর ব্যবস্থা, চলচ্চিত্রবিষয়ক সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়, ডিএফপি, গণযোগাযোগ অধিদপ্তর, বিটিভি, সরকারি চলচ্চিত্র অনুদান, চলচ্চিত্র পরিবেশনা ও প্রদর্শন, জাতীয় চলচ্চিত্রকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, সৃজনশীল গুণী নির্মাতা ও প্রযোজকদের সহায়তা দান, চলচ্চিত্র উত্সব ও মন্ত্রণালয় পরিবর্তন ইত্যাদি।
বর্তমানে প্রায় প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই একটা অকার্যকর নীতি রয়েছে। বেশির ভাগ নীতিমালাই সুস্থ চলচ্চিত্র বিকাশের অনুকূল নয়। মন্ত্রী বা সচিবেরা সুস্থ চলচ্চিত্র বিকাশে বক্তব্যে নানা ভালো কথা বলেন। কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ নীতি পরিবর্তন করতে উদ্যোগী হন না। তাঁরা আগ্রহী কসমেটিক পরিবর্তনে। এখানেই যত সমস্যা। আমাদের চলচ্চিত্রশিল্পের রয়েছে অনেকগুলো মূল সমস্যা। এসব মূল সমস্যার সমাধান না করে সরকারি অনুদানের টাকা বাড়িয়ে বা চার বছরের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এক বছরে দিয়ে তথ্য মন্ত্রণালয় বিরাট সাফল্যের ঢেঁকুর তোলে। এগুলো নিশ্চয় সাফল্য, কিন্তু ছোট মাপের। চলচ্চিত্রশিল্পে অনেক বড় সমস্যা রয়ে গেছে। আলোচ্য সেমিনারে উত্থাপিত ধারণাপত্রের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে, কত কাজ রয়েছে করার। তথ্য মন্ত্রণালয়ের সেদিকে মনোযোগ নেই।
আলোচ্য সেমিনারে কয়েকজন বক্তার প্রস্তাব সমর্থন করে আমিও বলতে চাই, ১৯৮৮ সালে প্রণীত রিপোর্টটিকে ভিত্তি ধরে রিপোর্টটিকে সময়োপযোগী করার জন্য তথ্য মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে দিক। কমিটি তিন মাসের মধ্যে আলোচনা করে একটি পূর্ণাঙ্গ সুপারিশমালা তথ্য মন্ত্রণালয়কে দিতে পারে। বর্তমান সরকার তাদের সময়কালে যতটা সম্ভব তা বাস্তবায়নে অগ্রসর হবে। এভাবে ১০ বা ১৫ বছরে অন্তত তিনটি সরকারের আমলের চলচ্চিত্রশিল্পের বিরাজমান সমস্যা দূর হতে পারে, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি হতে পারে, কার্যকর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়িত হতে পারে, বর্তমানের চলচ্চিত্রশিল্প-সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নীতির পুনর্বিন্যাস হতে পারে। সবই করতে হবে একটি সামগ্রিক নীতিমালার আলোকে। বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটি প্রয়াস বড় কোনো সাফল্য বয়ে আনবে না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি পরপর কয়েকটি চলচ্চিত্র উত্সব উদ্বোধন করেছেন। এটা খুব ব্যতিক্রম। এতে মনে হয়, তিনি চলচ্চিত্রশিল্পের উন্নয়নে আগ্রহী। কিন্তু তাঁর আগ্রহটা যথার্থ ও আন্তরিক কি না তা বোঝা যাবে সরকারের কাজে। শুধু বক্তব্যে নয়। বক্তব্যে উন্নয়ন করা খুব সহজ কাজ। দেশের শিক্ষানীতি নিয়ে সরকার যেমন একটা বড় ধাক্কা দিয়েছে তেমনি চলচ্চিত্রনীতি নিয়েও একটা বড় ধাক্কা দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এটা খুব সম্ভাবনাময় শিল্প। অদক্ষ ব্যক্তিবর্গ ও অনুত্সাহী আমলাদের হাতে পড়ে চলচ্চিত্রশিল্প স্বাধীনতার ৩৯ বছরেও প্রত্যাশিত বিকাশ লাভ করেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি এ ব্যাপারে উদ্যোগী হন তাহলে একটা বড় কাজ হবে। চলচ্চিত্রে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার কিছু নেই। এটা একটা সৃজনশীল মাধ্যম। শিক্ষা, জ্ঞান ও প্রতিভা ছাড়া এই মাধ্যমে বিজয় অর্জন করা যায় না। কিছু ব্যবসা করা যায় হয়তো। ব্যবসা তো নানাভাবেই করা যায়।
আলোচ্য সেমিনারে ফিল্ম আর্কাইভস বনাম ফিল্ম ইনস্টিটিউট সম্পর্কে সামান্য বিতর্ক হয়েছে। আরও বড় পরিসরে এই বিতর্ক হওয়া দরকার। সরকার ঢাকার আগারগাঁওতে ১৫ তলার একটি ফিল্ম আর্কাইভস ভবন নির্মাণ করতে যাচ্ছে। খুব প্রশংসনীয় উদ্যোগ। কিন্তু চলচ্চিত্রকর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল একটি চলচ্চিত্রকেন্দ্রের। আর্কাইভস ও ইনস্টিটিউটকে একসঙ্গে করে ওই ১৫ তলা ভবনটিকে চলচ্চিত্রকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা গেলে সেটা অনেক বেশি কার্যকর হতো। আমাদের চলচ্চিত্রে এখন একাডেমিক শিক্ষা, টেকনিক্যাল শিক্ষা ও নানা মেয়াদে প্রশিক্ষণ খুব জরুরি। শুধু আর্কাইভস প্রতিষ্ঠা করা হলে এই চাহিদাগুলো পূরণ হবে বলে মনে হয় না। ফিল্ম আর্কাইভস ও ফিল্ম ইনস্টিটিউট সম্পর্কে তথ্য মন্ত্রণালয় জরুরি ভিত্তিতে একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করলে ভালো হয়। এত বড় একটি অবকাঠামো অনেক ভাবনাচিন্তা করে নির্মাণ করা উচিত। এই গরিব দেশে সরকারি অর্থ বা বিদেশি অনুদান সঠিকভাবে ব্যবহার না করলে আমরা সবাই দায়ী থাকব।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।

No comments

Powered by Blogger.