ফখরে আলমের খোলা চিঠি-ড. ইউনূস, এবার জবাব দেবেন কি?
তখন ড. ইউনূস আরো সুদর্শন। মাথার চুল পাকেনি। তাঁর পেছন পেছন ঘুরতে ঘুরতে একসময় বুকে সাহস সঞ্চয় করে বলেই ফেলি, 'স্যার, আমি আপনার একটি এঙ্ক্লুসিভ সাক্ষাৎকার নিতে চাই।' ড. ইউনূস বললেন, 'কখন, কোথায়?'
'এখানে, এই কেতুরাম ঋষির বারান্দায় বসেই।'
'এখানে, এই কেতুরাম ঋষির বারান্দায় বসেই।'
ড. ইউনূস রাজি হলেন। মাইক্রো টেপ রেকর্ডারটা অন করে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার ধারণ করি। সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে ড. ইউনূস বললেন, 'ওদের দুজনকে (দেশের প্রধান দুই নেত্রী শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়াকে) এক ঘরে তালা মেরে রাখতে হবে। বলতে হবে, তোমরা আগে এক হও। তাহলেই দেশের সব সমস্যার সমাধান হবে।'
এই 'জ্ঞানদাতা', বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী, ক্ষুদ্রঋণের নায়ক ড. ইউনূস নিজেই পরে (ওয়ান-ইলেভেনের পর) রাজনীতি করতে নেমে কী রকম নাস্তানাবুদ হয়েছেন, তা দেশের মানুষ দেখেছে। ২০০৭ সালে রাজনীতিতে আসার আগ্রহ প্রকাশ করে তিনি জাতির উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি লিখেছিলেন। স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার এবং বাংলাদেশকে সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন ওই চিঠিতে। তাঁর সেই চিঠি পড়ে উৎসাহিত হয়ে ২০০৭ সালের ৮ এপ্রিল দৈনিক যায়যায়দিনে তাঁকেও একটি খোলা চিঠি লিখি। ওই চিঠিতে যশোরের মাটিতে গ্রামীণ ব্যাংকের নানা অমানবিক কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি তুলে ধরে ড. ইউনূসকে কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু একজন তুচ্ছ মফস্বল সাংবাদিকের চিঠি ভেবেই হয়তো তিনি তা আমলে নেননি; চিঠির জবাব দেওয়ার কোনো তাগাদা অনুভব করেননি।
তিন বছর পর আবার ড. ইউনূস আলোচনা-সমালোচনার পাত্র হয়েছেন। তাঁর কর্মকাণ্ডে দেশের মানমর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এমন একটি মুহূর্তে আবারও তাই তাঁর উদ্দেশে খোলা চিঠির মতো করে এই লেখা। একজন গ্রামীণ সাংবাদিক হিসেবে অনুসন্ধান আর পর্যবেক্ষণের পর তাঁর গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে, সেই গল্পগুলোই তাঁকেসহ দেশের মানুষকে আজ শোনাতে চাই।
১৯৯৫ সালের মার্চে যশোর সদর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা চকমলের সাক্ষাৎকার নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে এক গৃহস্থ বাড়ির আঙিনায় অনেক নারী-পুরুষের ভিড় দেখে মোটরসাইকেল থামিয়ে ঘটনা জানার চেষ্টা করি। মথুরাপুর গ্রামীণ ব্যাংকের কেন্দ্রপ্রধান নূরজাহান বেগমকে সেখানে দেখা যায়। এ কেন্দ্র থেকে অবুবক্করের স্ত্রী সাহেবা বিবি ছয় হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু ঋণ নেওয়ার পর থেকেই সাহেবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার পেছনেই তাঁদের সব শেষ হয়ে যায়। এ কারণে আবারও তিনি ওই ব্যাংক থেকে তিন হাজার টাকা ঋণ নেন। তাঁর ভ্যানচালক স্বামীও অসুস্থ। তাই ঘরের হাঁড়ি-পাতিল বিক্রি করে তিনি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন। কিন্তু কিছু টাকা বাকি থেকে যায়। এ টাকার জন্য কেন্দ্রপ্রধান ও গ্রামীণ ব্যাংকের লোকজন সাহেবার শেষসম্বল একটি ছাগল ও স্বামীর একমাত্র আয়ের মাধ্যম রিকশাভ্যানটি আটক করে রেখেছে। এ কারণে সালিস বসেছে।
সাহেবা বললেন, 'সাংবাদিক ভাই, আমার ছাগল ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।'
তাঁর স্বামী লুঙ্গির গিঁট থেকে একটি বিষের শিশি বের করে বললেন, 'ভ্যান ফেরত না পেলে আমি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করব।'
ওদের অনেক অনুরোধ করি। কিন্তু কোনো কাজ হয় না। পরে ছবি তুলে মনে দুঃখ নিয়ে যশোর শহরে এসে ঘটনাটি গ্রামীণ ব্যাংকের এরিয়া ম্যানেজারকে জানাই। ছবিসহ বাংলাবাজার পত্রিকায় 'নব্য কাবুলিওয়ালা' নামে রিপোর্ট পাঠাই। পরদিন যশোরের ম্যানেজার আমাকে জানান, ছাগল ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এমন ঘটনা আর ঘটবে না।
এবার সেই 'হিলারি আদর্শপল্লী'র গল্প শোনাই। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার মশিহাটি ঋষিপাড়ায় যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ফার্স্টলেডি হিলারি ক্লিনটন গ্রামীণ ব্যাংকের আমন্ত্রণে আসবেন। পত্রিকা থেকে আমাকে স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছে। ১৯৯৫ সালের ২ এপ্রিল মশিহাটি গ্রামে খুব ভোরে পেঁৗছে দেখি, এক মহাযজ্ঞ শুরু হয়েছে। হিলারির বসার জায়গা তৈরি হচ্ছে। মুড়ি ভাজার প্রশিক্ষণ চলছে। হিলারিকে বাংলার দেশি বিস্কুট, মুড়ি খাওয়ানো হবে। শিশুরা গম্ভীরা গান গাইছে। এসব দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করি। কিছুক্ষণের মধ্যে ড. ইউনূস ঋষিপাড়ায় এলেন। তখনই তাঁর সেই একান্ত সাক্ষাৎকারটি নিই। সাক্ষাৎকারে তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণের অতিরিক্ত সুদ সম্পর্কে বললেন, 'কম সুদেও আমরা ঋণ দিই।' 'শুধু মহিলাদের কেন ঋণ দেন?' তিনি বললেন, 'সবাই তো পুরুষদের ঋণ দেয়। এ জন্য আমি মহিলাদের ঋণ দিই।' ১৯৯৫ সালের ৫ এপ্রিল ছবিসহ সেই সাক্ষাৎকার বাংলাবাজার পত্রিকায় ছাপা হয়।
৩ এপ্রিল পাকা রাস্তায় গাড়ি রেখে সরু মেঠোপথে হেঁটে হিলারি ক্লিনটন মশিহাটি ঋষিপাড়ায় আসেন। গ্রামের প্রবেশমুখে দুটি শিশু মুক্তি আর সাথী হিলারিকে স্বাগত জানায়। এরপর হিলারি গ্রামীণ ব্যাংকের মহিলা সদস্যদের সঙ্গে বসে মতবিনিময় করেন।মহিলারা অঙ্গীকার করেন_'যৌতুক দেব না, যৌতুক নেব না। নিরাপদ পানি পান করব। সন্তানকে স্কুলে পাঠাব। বাল্যবিবাহ দেব না।' গ্রামের মেয়েরা আন্তরিকতার সঙ্গে মার্কিন ফার্স্টলেডিকে আটপৌরে জামদানি শাড়ি পরিয়ে দেয়। মুড়ি ভাজা খেয়ে, ঋষির সন্তানদের গম্ভীরা গান শুনে হিলারি 'দুলাভাই'কে (বিল ক্লিনটন) নিয়ে ফের ঋষিপাড়ায় আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্রামের বধূদের কাঁদিয়ে বিদায় নেন। এর পর থেকে মশিহাটি ঋষিপাড়ার নতুন নাম হয় হিলারি আদর্শপল্লী।
এর পরের গল্প মর্মান্তিক। হিলারিকে যে মুক্তি আর সাথী স্বাগত জানিয়েছিল, তারা বাল্যবিবাহের বলি হয়েছে। ১৯৯৯ সালে ১২ বছর বয়সে সাথীর বিয়ে হয় হিরণ্ময় নামে এক যুবকের সঙ্গে। ১১ বছরের মুক্তির বিয়ে হয় জুতো পলিশওয়ালা মুক্তোর সঙ্গে। দুজনের বিয়েতেই যৌতুক হিসেবে সাইকেল, ঘড়ি, টেলিভিশন দিতে হয়েছে। মুক্তির বাবার নাম মুকিন্দ। তাঁরও গ্রামীণ ব্যাংকের লোন ছিল। তিনি উপায়ান্তর না দেখে কিছু জমি ও সম্পদ বিক্রি করে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় চলে গেছেন। মুক্তিও স্বামীসহ সেখানে বসবাস করছে। ঋষিপাড়ায় এখন মুকিন্দের ভাই দীলিপ থাকেন। এ প্রতিবেদককে তিনি বললেন, দাদা ঋণ শোধ করে চলে গেছেন। সেখানে তাঁরা ভালোই আছেন।
সাথী এখন যশোর সদরের চুড়ামনকাঠিতে শ্বশুর ভক্ত দাসের বাড়িতে থাকে। তার স্বামী হিরণ্ময় ঢাকার মিরপুরে সেলুনে চুল কাটে। সাথীর দুটি সন্তান। স্বামী যে টাকা পাঠায়, তাতে কোনোমতে সংসার চলে। সাথী বলল, 'হিলারি আসার সময় আমি দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। প্রথমে আমাদের পিটি করানো হয়েছিল। আমি প্রথম হওয়ায় হিলারিকে গলায় ফুলের মালা পরানোর সুযোগ পাই। হিলারি আমাকে খুব আদর করেছিলেন। একটি সাদা ফ্রক দিয়েছিলেন।' সাথী আরো বলে, 'পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় বাবা-মা আমার বিয়ে দিয়ে দেন।' সাথীর দাদি কালীদাসি বললেন, 'ও বড় হয়ে গিয়েছিল বলে ওর বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। গ্রামীণ ব্যাংকের কেউ বিয়ে দিতে নিষেধ করেনি।'
এই মশিহাটি কেন্দ্রের লক্ষ্মীরানী, শান্তি, ভানুদাসী, মিনা রানী, গীতা রানী_এঁরা সবাই সহায়-সম্পদ এমনকি ভিটেমাটি বিক্রি করে গ্রামীণ ব্যাংকের কিস্তি দিয়েছেন। সাত হাজার টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে গৃহবধূ পারুল মারা যান। গ্রামীণ ব্যাংকের লোকজন পারুলের লাশ দাহ করতে দেয়নি। পরে স্বামী কার্তিক ওই টাকা পরিশোধের অঙ্গীকার করে স্ত্রীর লাশের সৎকারের ব্যবস্থা করেন। গ্রামের মমতা ঘরের টিন খুলে বিক্রি করে কিস্তি দিয়েছেন। মায়ারানী গরু-ছাগল, বিয়ের আংটি, থালা-বাটি, ভিটে বিক্রি করে কিস্তি দিয়েছেন। ভানুদাসী পাশের ফুলবাড়ী গ্রামের সুদখোর মহাজনের কাছ থেকে প্রতিমাসে ১০০ টাকায় ১০ টাকা সুদে ১৪ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে গ্রামীণের কিস্তি শোধ করেছেন।
এসব গল্পের পাশাপাশি আরেকটি কথা না বলে পারছি না। সেটি হলো_বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ঝিনাইদহের পাগলা কানাই মোড়ের মীর ইলিয়াস হোসেন দীলিপ ১৯৯৫ সালে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থটির নাম 'গ্রামীণ ব্যাংক, মহাজনী শোষণের অভিনব হাতিয়ার'। গ্রন্থটিতে দীলিপ দীর্ঘ গবেষণার পর গ্রামীণ ব্যাংকের নানা বিষয় তুলে ধরেছেন। অতিরিক্ত সুদ, ঋণের জালে আটকা পড়ার কাহিনী, সদস্যরা মালিক হয়েও কোনো লভ্যাংশ পান না_এ বিষয়গুলো তিনি বস্তুনিষ্ঠভাবে উপস্থাপন করেছেন। গ্রন্থের শেষ পৃষ্ঠায় দীলিপ লিখেছেন, 'অতি কৌশলে গ্রামীণ ব্যাংক দরিদ্র মহিলাদের মহাজনী শোষণের আওতায় এনে তাদের সবটুকু শ্রম নিংড়ে নিচ্ছে।'
২০০০ সালের ১৫ জানুয়ারি ওই গ্রন্থের রচয়িতা মীর ইলিয়াস হোসেনকে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে।
২০১০ সালের ৩০ নভেম্বর গ্রামীণ ব্যাংকের আণবিক বোমাটি ফাটান ডেনমার্কের সাংবাদিক টম হাইনেমান। 'ক্ষুদ্র ঋণের ফাঁদে' নামে হাইনেমানের তৈরি প্রামাণ্যচিত্রটি নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন (এনআরকে) প্রচার করে। তাতে বলা হয়, গ্রামীণ ব্যাংকের দরিদ্র ঋণগ্রহীতাদের জন্য নোরাডের অনুদানের ৭০০ কোটি টাকা এক তহবিল থেকে আরেক তহবিলে সরানো হয়েছে। প্রামাণ্যচিত্রে ঋণের জালে আটকা পড়ে গরিব আরো নিঃস্ব হয়েছে_এমন দৃশ্য দেখানো হয়েছে।
এ খবর জানতে পেরে দেশবাসী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। দেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। এরপর ড. ইউনূস কিছু ব্যাখ্যাও দেন।
এসব খবরের পর ফের সেই হিলারি আদর্শপল্লীতে ছুটি। ৩ ডিসেম্বর সেখানে গিয়ে জানতে পারি, হিলারির আগমন উপলক্ষে গ্রামীণ ব্যাংক পাকা দালান নির্মাণের জন্য ভক্ত দাসের স্ত্রী পার্বতী রানীকে ২৫ হাজার টাকা ঋণ দিয়েছিল। সেই টাকা শোধ করতে গিয়ে পার্বতী রানী সহায়-সম্পদ, ভিটেমাটি বিক্রি করে তিন সন্তান নিয়ে এখন গ্রামের পাশে সেনাবাহিনীর আবাসন প্রকল্পে একটি খুপরি ঘরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। সুনীলের স্ত্রী ময়নাকেও পাকা দালানের জন্য ঋণ দেওয়া হয়েছিল। কিস্তি দিতে না পেরে ময়না স্বামী-সন্তানসহ চট্টগ্রামে পালিয়ে যান। পরবর্তী সময়ে বাড়ি ফিরে ভিটেমাটি বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হয়ে কিস্তি পরিশোধ করেছেন। এখন তাঁরা যাযাবর। কালের কণ্ঠে ৬ ডিসেম্বর 'সেই হিলারিপাড়ায় শুধুই হায় হায়' শিরোনামে সরেজমিন প্রতিবেদনটি ছাপা হয়।
এরপর ঢাকা থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তারা এসে ওই মহিলাদের শাসিয়ে গেছেন বলে জানা যায়। সাংবাদিকদের সঙ্গে কেন কথা বলা হলো_এর কৈফিয়ত চেয়েছেন। একই সঙ্গে হুঁশিয়ার করে দিয়ে গেছেন, কেউ যেন সাংবাদিকদের সামনে মুখ না খোলে।
গ্রামীণ ব্যাংকের লোকজনের হাতে গরিব মানুষের একমাত্র সম্বল ছাগল আটক, মুক্তি-সাথীর বাল্যবিবাহ, মশিহাটি ঋষিপাড়া থেকে হিলারিপাড়ার করুণ পরিণতি, মীর ইলিয়াস হোসেন খুন, কিস্তির জন্য ভিটে বিক্রি, ঋষিপাড়ার সুখী মানুষের ঋণের জালে জর্জরিত হওয়ার শতভাগ সত্য কাহিনী ড. ইউনূস ও দেশবাসীর সামনে বিনয়ের সঙ্গে উপস্থাপন করলাম। সেই সঙ্গে প্রশ্ন রাখলাম_গরিবের সেবার নামে কেন এসব অমানবিক ঘটনার অবতারণা হলো? আশা করি এবার জবাব পাব।
এই 'জ্ঞানদাতা', বাংলাদেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী, ক্ষুদ্রঋণের নায়ক ড. ইউনূস নিজেই পরে (ওয়ান-ইলেভেনের পর) রাজনীতি করতে নেমে কী রকম নাস্তানাবুদ হয়েছেন, তা দেশের মানুষ দেখেছে। ২০০৭ সালে রাজনীতিতে আসার আগ্রহ প্রকাশ করে তিনি জাতির উদ্দেশে একটি খোলা চিঠি লিখেছিলেন। স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার এবং বাংলাদেশকে সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন ওই চিঠিতে। তাঁর সেই চিঠি পড়ে উৎসাহিত হয়ে ২০০৭ সালের ৮ এপ্রিল দৈনিক যায়যায়দিনে তাঁকেও একটি খোলা চিঠি লিখি। ওই চিঠিতে যশোরের মাটিতে গ্রামীণ ব্যাংকের নানা অমানবিক কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি তুলে ধরে ড. ইউনূসকে কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু একজন তুচ্ছ মফস্বল সাংবাদিকের চিঠি ভেবেই হয়তো তিনি তা আমলে নেননি; চিঠির জবাব দেওয়ার কোনো তাগাদা অনুভব করেননি।
তিন বছর পর আবার ড. ইউনূস আলোচনা-সমালোচনার পাত্র হয়েছেন। তাঁর কর্মকাণ্ডে দেশের মানমর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এমন একটি মুহূর্তে আবারও তাই তাঁর উদ্দেশে খোলা চিঠির মতো করে এই লেখা। একজন গ্রামীণ সাংবাদিক হিসেবে অনুসন্ধান আর পর্যবেক্ষণের পর তাঁর গ্রামীণ ব্যাংক সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে, সেই গল্পগুলোই তাঁকেসহ দেশের মানুষকে আজ শোনাতে চাই।
১৯৯৫ সালের মার্চে যশোর সদর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা চকমলের সাক্ষাৎকার নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে এক গৃহস্থ বাড়ির আঙিনায় অনেক নারী-পুরুষের ভিড় দেখে মোটরসাইকেল থামিয়ে ঘটনা জানার চেষ্টা করি। মথুরাপুর গ্রামীণ ব্যাংকের কেন্দ্রপ্রধান নূরজাহান বেগমকে সেখানে দেখা যায়। এ কেন্দ্র থেকে অবুবক্করের স্ত্রী সাহেবা বিবি ছয় হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু ঋণ নেওয়ার পর থেকেই সাহেবা অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসার পেছনেই তাঁদের সব শেষ হয়ে যায়। এ কারণে আবারও তিনি ওই ব্যাংক থেকে তিন হাজার টাকা ঋণ নেন। তাঁর ভ্যানচালক স্বামীও অসুস্থ। তাই ঘরের হাঁড়ি-পাতিল বিক্রি করে তিনি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন। কিন্তু কিছু টাকা বাকি থেকে যায়। এ টাকার জন্য কেন্দ্রপ্রধান ও গ্রামীণ ব্যাংকের লোকজন সাহেবার শেষসম্বল একটি ছাগল ও স্বামীর একমাত্র আয়ের মাধ্যম রিকশাভ্যানটি আটক করে রেখেছে। এ কারণে সালিস বসেছে।
সাহেবা বললেন, 'সাংবাদিক ভাই, আমার ছাগল ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।'
তাঁর স্বামী লুঙ্গির গিঁট থেকে একটি বিষের শিশি বের করে বললেন, 'ভ্যান ফেরত না পেলে আমি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করব।'
ওদের অনেক অনুরোধ করি। কিন্তু কোনো কাজ হয় না। পরে ছবি তুলে মনে দুঃখ নিয়ে যশোর শহরে এসে ঘটনাটি গ্রামীণ ব্যাংকের এরিয়া ম্যানেজারকে জানাই। ছবিসহ বাংলাবাজার পত্রিকায় 'নব্য কাবুলিওয়ালা' নামে রিপোর্ট পাঠাই। পরদিন যশোরের ম্যানেজার আমাকে জানান, ছাগল ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এমন ঘটনা আর ঘটবে না।
এবার সেই 'হিলারি আদর্শপল্লী'র গল্প শোনাই। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার মশিহাটি ঋষিপাড়ায় যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন ফার্স্টলেডি হিলারি ক্লিনটন গ্রামীণ ব্যাংকের আমন্ত্রণে আসবেন। পত্রিকা থেকে আমাকে স্পেশাল অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছে। ১৯৯৫ সালের ২ এপ্রিল মশিহাটি গ্রামে খুব ভোরে পেঁৗছে দেখি, এক মহাযজ্ঞ শুরু হয়েছে। হিলারির বসার জায়গা তৈরি হচ্ছে। মুড়ি ভাজার প্রশিক্ষণ চলছে। হিলারিকে বাংলার দেশি বিস্কুট, মুড়ি খাওয়ানো হবে। শিশুরা গম্ভীরা গান গাইছে। এসব দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করি। কিছুক্ষণের মধ্যে ড. ইউনূস ঋষিপাড়ায় এলেন। তখনই তাঁর সেই একান্ত সাক্ষাৎকারটি নিই। সাক্ষাৎকারে তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের ঋণের অতিরিক্ত সুদ সম্পর্কে বললেন, 'কম সুদেও আমরা ঋণ দিই।' 'শুধু মহিলাদের কেন ঋণ দেন?' তিনি বললেন, 'সবাই তো পুরুষদের ঋণ দেয়। এ জন্য আমি মহিলাদের ঋণ দিই।' ১৯৯৫ সালের ৫ এপ্রিল ছবিসহ সেই সাক্ষাৎকার বাংলাবাজার পত্রিকায় ছাপা হয়।
৩ এপ্রিল পাকা রাস্তায় গাড়ি রেখে সরু মেঠোপথে হেঁটে হিলারি ক্লিনটন মশিহাটি ঋষিপাড়ায় আসেন। গ্রামের প্রবেশমুখে দুটি শিশু মুক্তি আর সাথী হিলারিকে স্বাগত জানায়। এরপর হিলারি গ্রামীণ ব্যাংকের মহিলা সদস্যদের সঙ্গে বসে মতবিনিময় করেন।মহিলারা অঙ্গীকার করেন_'যৌতুক দেব না, যৌতুক নেব না। নিরাপদ পানি পান করব। সন্তানকে স্কুলে পাঠাব। বাল্যবিবাহ দেব না।' গ্রামের মেয়েরা আন্তরিকতার সঙ্গে মার্কিন ফার্স্টলেডিকে আটপৌরে জামদানি শাড়ি পরিয়ে দেয়। মুড়ি ভাজা খেয়ে, ঋষির সন্তানদের গম্ভীরা গান শুনে হিলারি 'দুলাভাই'কে (বিল ক্লিনটন) নিয়ে ফের ঋষিপাড়ায় আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্রামের বধূদের কাঁদিয়ে বিদায় নেন। এর পর থেকে মশিহাটি ঋষিপাড়ার নতুন নাম হয় হিলারি আদর্শপল্লী।
এর পরের গল্প মর্মান্তিক। হিলারিকে যে মুক্তি আর সাথী স্বাগত জানিয়েছিল, তারা বাল্যবিবাহের বলি হয়েছে। ১৯৯৯ সালে ১২ বছর বয়সে সাথীর বিয়ে হয় হিরণ্ময় নামে এক যুবকের সঙ্গে। ১১ বছরের মুক্তির বিয়ে হয় জুতো পলিশওয়ালা মুক্তোর সঙ্গে। দুজনের বিয়েতেই যৌতুক হিসেবে সাইকেল, ঘড়ি, টেলিভিশন দিতে হয়েছে। মুক্তির বাবার নাম মুকিন্দ। তাঁরও গ্রামীণ ব্যাংকের লোন ছিল। তিনি উপায়ান্তর না দেখে কিছু জমি ও সম্পদ বিক্রি করে খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গায় চলে গেছেন। মুক্তিও স্বামীসহ সেখানে বসবাস করছে। ঋষিপাড়ায় এখন মুকিন্দের ভাই দীলিপ থাকেন। এ প্রতিবেদককে তিনি বললেন, দাদা ঋণ শোধ করে চলে গেছেন। সেখানে তাঁরা ভালোই আছেন।
সাথী এখন যশোর সদরের চুড়ামনকাঠিতে শ্বশুর ভক্ত দাসের বাড়িতে থাকে। তার স্বামী হিরণ্ময় ঢাকার মিরপুরে সেলুনে চুল কাটে। সাথীর দুটি সন্তান। স্বামী যে টাকা পাঠায়, তাতে কোনোমতে সংসার চলে। সাথী বলল, 'হিলারি আসার সময় আমি দ্বিতীয় শ্রেণীর ছাত্রী। প্রথমে আমাদের পিটি করানো হয়েছিল। আমি প্রথম হওয়ায় হিলারিকে গলায় ফুলের মালা পরানোর সুযোগ পাই। হিলারি আমাকে খুব আদর করেছিলেন। একটি সাদা ফ্রক দিয়েছিলেন।' সাথী আরো বলে, 'পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ার সময় বাবা-মা আমার বিয়ে দিয়ে দেন।' সাথীর দাদি কালীদাসি বললেন, 'ও বড় হয়ে গিয়েছিল বলে ওর বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। গ্রামীণ ব্যাংকের কেউ বিয়ে দিতে নিষেধ করেনি।'
এই মশিহাটি কেন্দ্রের লক্ষ্মীরানী, শান্তি, ভানুদাসী, মিনা রানী, গীতা রানী_এঁরা সবাই সহায়-সম্পদ এমনকি ভিটেমাটি বিক্রি করে গ্রামীণ ব্যাংকের কিস্তি দিয়েছেন। সাত হাজার টাকা ঋণের বোঝা নিয়ে গৃহবধূ পারুল মারা যান। গ্রামীণ ব্যাংকের লোকজন পারুলের লাশ দাহ করতে দেয়নি। পরে স্বামী কার্তিক ওই টাকা পরিশোধের অঙ্গীকার করে স্ত্রীর লাশের সৎকারের ব্যবস্থা করেন। গ্রামের মমতা ঘরের টিন খুলে বিক্রি করে কিস্তি দিয়েছেন। মায়ারানী গরু-ছাগল, বিয়ের আংটি, থালা-বাটি, ভিটে বিক্রি করে কিস্তি দিয়েছেন। ভানুদাসী পাশের ফুলবাড়ী গ্রামের সুদখোর মহাজনের কাছ থেকে প্রতিমাসে ১০০ টাকায় ১০ টাকা সুদে ১৪ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে গ্রামীণের কিস্তি শোধ করেছেন।
এসব গল্পের পাশাপাশি আরেকটি কথা না বলে পারছি না। সেটি হলো_বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ঝিনাইদহের পাগলা কানাই মোড়ের মীর ইলিয়াস হোসেন দীলিপ ১৯৯৫ সালে গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থটির নাম 'গ্রামীণ ব্যাংক, মহাজনী শোষণের অভিনব হাতিয়ার'। গ্রন্থটিতে দীলিপ দীর্ঘ গবেষণার পর গ্রামীণ ব্যাংকের নানা বিষয় তুলে ধরেছেন। অতিরিক্ত সুদ, ঋণের জালে আটকা পড়ার কাহিনী, সদস্যরা মালিক হয়েও কোনো লভ্যাংশ পান না_এ বিষয়গুলো তিনি বস্তুনিষ্ঠভাবে উপস্থাপন করেছেন। গ্রন্থের শেষ পৃষ্ঠায় দীলিপ লিখেছেন, 'অতি কৌশলে গ্রামীণ ব্যাংক দরিদ্র মহিলাদের মহাজনী শোষণের আওতায় এনে তাদের সবটুকু শ্রম নিংড়ে নিচ্ছে।'
২০০০ সালের ১৫ জানুয়ারি ওই গ্রন্থের রচয়িতা মীর ইলিয়াস হোসেনকে অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে।
২০১০ সালের ৩০ নভেম্বর গ্রামীণ ব্যাংকের আণবিক বোমাটি ফাটান ডেনমার্কের সাংবাদিক টম হাইনেমান। 'ক্ষুদ্র ঋণের ফাঁদে' নামে হাইনেমানের তৈরি প্রামাণ্যচিত্রটি নরওয়ের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন (এনআরকে) প্রচার করে। তাতে বলা হয়, গ্রামীণ ব্যাংকের দরিদ্র ঋণগ্রহীতাদের জন্য নোরাডের অনুদানের ৭০০ কোটি টাকা এক তহবিল থেকে আরেক তহবিলে সরানো হয়েছে। প্রামাণ্যচিত্রে ঋণের জালে আটকা পড়ে গরিব আরো নিঃস্ব হয়েছে_এমন দৃশ্য দেখানো হয়েছে।
এ খবর জানতে পেরে দেশবাসী উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। দেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। এরপর ড. ইউনূস কিছু ব্যাখ্যাও দেন।
এসব খবরের পর ফের সেই হিলারি আদর্শপল্লীতে ছুটি। ৩ ডিসেম্বর সেখানে গিয়ে জানতে পারি, হিলারির আগমন উপলক্ষে গ্রামীণ ব্যাংক পাকা দালান নির্মাণের জন্য ভক্ত দাসের স্ত্রী পার্বতী রানীকে ২৫ হাজার টাকা ঋণ দিয়েছিল। সেই টাকা শোধ করতে গিয়ে পার্বতী রানী সহায়-সম্পদ, ভিটেমাটি বিক্রি করে তিন সন্তান নিয়ে এখন গ্রামের পাশে সেনাবাহিনীর আবাসন প্রকল্পে একটি খুপরি ঘরে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। সুনীলের স্ত্রী ময়নাকেও পাকা দালানের জন্য ঋণ দেওয়া হয়েছিল। কিস্তি দিতে না পেরে ময়না স্বামী-সন্তানসহ চট্টগ্রামে পালিয়ে যান। পরবর্তী সময়ে বাড়ি ফিরে ভিটেমাটি বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হয়ে কিস্তি পরিশোধ করেছেন। এখন তাঁরা যাযাবর। কালের কণ্ঠে ৬ ডিসেম্বর 'সেই হিলারিপাড়ায় শুধুই হায় হায়' শিরোনামে সরেজমিন প্রতিবেদনটি ছাপা হয়।
এরপর ঢাকা থেকে গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তারা এসে ওই মহিলাদের শাসিয়ে গেছেন বলে জানা যায়। সাংবাদিকদের সঙ্গে কেন কথা বলা হলো_এর কৈফিয়ত চেয়েছেন। একই সঙ্গে হুঁশিয়ার করে দিয়ে গেছেন, কেউ যেন সাংবাদিকদের সামনে মুখ না খোলে।
গ্রামীণ ব্যাংকের লোকজনের হাতে গরিব মানুষের একমাত্র সম্বল ছাগল আটক, মুক্তি-সাথীর বাল্যবিবাহ, মশিহাটি ঋষিপাড়া থেকে হিলারিপাড়ার করুণ পরিণতি, মীর ইলিয়াস হোসেন খুন, কিস্তির জন্য ভিটে বিক্রি, ঋষিপাড়ার সুখী মানুষের ঋণের জালে জর্জরিত হওয়ার শতভাগ সত্য কাহিনী ড. ইউনূস ও দেশবাসীর সামনে বিনয়ের সঙ্গে উপস্থাপন করলাম। সেই সঙ্গে প্রশ্ন রাখলাম_গরিবের সেবার নামে কেন এসব অমানবিক ঘটনার অবতারণা হলো? আশা করি এবার জবাব পাব।
No comments