চোখের জলে ভেজা ধান by আশরাফুল হক রাজীব

'ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী/ আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।' সত্যি তা-ই। ধানের এবার বাম্পার ফলন। সোনার ধান ঝিলিক দিচ্ছে কৃষকের উঠানে। সেখান থেকে কিছু যাচ্ছে বাজারে, কিছু উঠছে গোলায়। কিন্তু ঘরে ঘরে এত ধান, তবু নেই প্রাণভরা উৎসব। ঘাম ঝরানো ফসলের প্রকৃত মূল্য না পেয়ে হতাশায় আচ্ছন্ন কৃষক।


ঠেকায় পড়ে ধান বেচতে গিয়ে যে দাম মিলছে তাতে লাভ তো দূরের কথা, উৎপাদন খরচই উঠছে না। লোকসানের ঘানি টানতে হচ্ছে তাদের। বাম্পার ফলনের হাসি হারিয়ে গেছে কৃষকের মুখ থেকে। তাদের চোখের জলে ভেজা ধানের মূল্য যে বোঝে না কেউ! একমাত্র আশার আলো ছিল সরকারের ধান-চাল সংগ্রহ অভিযান। কিন্তু ঘোষণা দিয়েও সরকার মাঠে নামতে পারেনি।
৩ মে বোরো ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানে নামার কথা থাকলেও খাদ্য অধিদপ্তর এখনো তা শুরু করেনি। প্রস্তুতি না নিয়ে তাড়াহুড়া করে সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করলেও জেলা খাদ্য অফিস এখনো কোনো মিলারের সঙ্গে চুক্তি করেনি। ফলে মিলাররা সরকারি দরে ধান কিনছে না। সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে ফড়িয়ারা। প্রান্তিক চাষিরা বোরো ধান উঠানোর কিছুদিনের মধ্যেই তা বিক্রি করে দেয়। নানা প্রয়োজন মেটাতে নিজে চলার মতো ধান রেখে বাকিটা তারা অল্প দামেই বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয়। কারণ বেশির ভাগ কৃষকই নানা রকম ঋণ নিয়ে ফসল ফলায়। ধান বিক্রি করে তা শোধ করে।
প্রান্তিক চাষিদের সহায়তার জন্যই সরকার ধান-চাল সংগ্রহ করে। অথচ তারা যখন ধান-চাল বিক্রি করে সে সময় সরকার মাঠে থাকে না। যখন সরকার মাঠে যায় তখন প্রান্তিক চাষিদের হাতে ধান থাকে না। তা গিয়ে জমা হয় ফড়িয়াদের হাতে। কৃষকদের ঠকিয়ে ফড়িয়াদের সহায়তা করার জন্যই একটি চক্র ধান-চাল কিনতে বিলম্ব করে- এমন অভিযোগ রয়েছে। তারিখ নির্ধারণের পরও খাদ্য অধিদপ্তর কেন ধান-চাল কিনতে মাঠে নামেনি, তা জানতে চাইলে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আহমদ হোসেন খান বলেন, 'এখনো ধান ভেজা, আর্দ্রতা বেশি। ভেজা ধান কিনে গুদামজাত করা হলে তা নষ্ট হয়ে যাবে।'
এদিকে ধান-চালের দাম নিয়ে সরকার গভীর সংকটে পড়েছে। দাম বাড়ালে ভোক্তার সমস্যা, কমালে কৃষকের। এই অবস্থায় কার পক্ষে যাবে সরকার? সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ভালো দাম না পেলে প্রায় এক কোটি ৮০ লাখ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। মুখ ফিরিয়ে নেবে ধান উৎপাদন থেকে। আর ভালো দাম দিয়ে কেনা শুরু করলে বাজার তেতে উঠবে ঠিকই কিন্তু নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত প্রায় ১০ কোটি লোক সরকারের ওপর নাখোশ হবে। কৃষক আর ভোক্তা নিয়ে তাই এক ধরনের সংকটে থাকতে হচ্ছে সরকারকে।
এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার পথ খোঁজা হচ্ছে। কিছু চাল রপ্তানি করে বাজার চাঙ্গা করার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। সরকারের নীতিনির্ধারকদের একটি অংশ রপ্তানির পক্ষে। কিন্তু সামনের বছর নির্বাচনী বছর হওয়ায় নীতিনির্ধারকদের অন্য অংশটি রপ্তানি করে বাজার চড়িয়ে দেওয়ার বিপক্ষে।
কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেছেন, 'সব রাজনৈতিক দলেরই নির্বাচনী ভাবনা থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, আমরা কৃষকের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করছি। বর্তমান সরকারই কৃষকের স্বার্থ সবচেয়ে বেশি দেখে। কৃষককে ধাপে ধাপে ভর্তুকি দেওয়া হয়। গত সাড়ে তিন বছরে সারের কোনো সংকট হয়নি। বিদ্যুৎ সমস্যার মধ্যেও সেচ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে কৃষকদের সহায়তা করা হয়েছে। এই ভালো ফলন সরকার যে কৃষিবান্ধব সেটাই প্রমাণ করে। আর উৎপাদন ভালো বলেই রপ্তানিতে যেতে হবে সেটাও ঠিক নয়। এক বছরের ভালো উৎপাদনে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হলেই রপ্তানির বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। এ ছাড়া সরকার তো অ্যারোমেটিক চাল রপ্তানি করছে।'
খাদ্যমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক গত সোমবার খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট ও জাতীয় খাদ্যনীতি সক্ষমতা বৃদ্ধি কর্মসূচির যৌথ কর্মশালায় বলেছেন, সরকার চাল রপ্তানির চিন্তাভাবনা করছে। রূপসী বাংলা হোটেলে অনুষ্ঠিত ওই কর্মশালায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতসহ দেশি-বিদেশি খাদ্য বিশেষজ্ঞরা উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, বর্তমানে হাওরাঞ্চলের ধান কাটা প্রায় শেষ হয়েছে। রংপুর-দিনাজপুরসহ উত্তরাঞ্চলে শুরু হয়েছে। এ অবস্থায় ধানের দাম কমতে কমতে মণপ্রতি ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকা হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের ধান পুরোমাত্রায় কাটা শুরু হলে ধানের দাম আরো কমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
খাদ্যমন্ত্রী কালের কণ্ঠকে বলেছেন, যেকোনো মৌসুম শুরুর সময়ই ধান-চালের দাম কম থাকে। এটা সরকারের জন্য একটি সমস্যা। কারণ ধান-চালের দাম বাড়ালে কৃষক উপকৃত হন ঠিকই; কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভোক্তা। এই দুইয়ের মধ্যে যতটুকু সম্ভব সমন্বয় করে চলতে হয়। দুইয়ের মাঝখান দিয়ে যে শ্রেণীটি লাভবান হয় তারা হচ্ছে ফড়িয়া। এটাই বাস্তবতা।
গত ৩০ এপ্রিল খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ কমিটির সভায় ২৮ টাকা কেজি দরে ৯ লাখ টন চাল ও ১৮ টাকা কেজি দরে দেড় লাখ টন ধান কেনার সিদ্ধান্ত হয়। এ বছর প্রতি কেজি ধানের উৎপাদন খরচ হয়েছে ১৫ টাকা ৭৬ পয়সা। চাল আকারে এই খরচ প্রতি কেজিতে ২৪ টাকা ২৭ পয়সা।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক ও কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. মাহবুব হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ধানের দাম নির্ধারণের পর খাদ্য অধিদপ্তর দ্রুত মাঠে নামলে এর ফল কৃষক পেতেন। কারণ এখনই কৃষকের কাছে ধান রয়েছে। কয়েক দিন পর তা আর কৃষকের কাছে থাকবে না। তা চলে যাবে ফড়িয়াদের কাছে। যদিও সরকার সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনে না। এরপরও বাজার থেকে সংগ্রহ করা হলে এর প্রভাব পড়ে। কৃষক ভালো দাম পান। তিনি দ্রুত মাঠে গিয়ে ধান কেনার পরামর্শ দেন। একই সঙ্গে গুদাম খালি করার বিষয়টি আমলে নিতে বলেন। গুদাম খালি না থাকায় সরকার ধান কিনতে পারছে না। এ কারণে সীমিত সময়ের জন্য চাল বিদেশে রপ্তানির পরামর্শ দেন তিনি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমানে বোরো দেশের প্রধান ফসল। অথচ আশির দশক পর্যন্ত আউশ-আমনই ছিল প্রধান ফসল। কৃষির সেই অবস্থা পাল্টে গেছে। এখন প্রায় ৬০ শতাংশ জমিতে বোরো চাষ হয়। বোরো মৌসুমের চাষাবাদ প্রযুক্তিনির্ভর। সারের ব্যবহার হয় প্রচুর। সেচের পেছনে মোট ব্যয়ের ২৫ শতাংশ চলে যায়। বোরো মৌসুমে বেশি ধান উৎপাদন হলেও বেশি লাভ থাকে আমন মৌসুমে। তবে বোরোর একটি বিশেষ সুবিধা হচ্ছে, এর প্রাকৃতিক ঝুঁকি কম। হাওর এলাকায় অকাল বন্যা কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে শিলাবৃষ্টি ছাড়া কৃষকরা নির্বিঘ্নেই ফসল ঘরে তুলতে পারেন। অন্যদিকে আমন ধানের চাষাবাদের শুরুতেই বন্যার আশঙ্কা থাকে। এসব কারণে কৃষকরা বোরোর দিকে ঝুঁকছেন। কিন্তু উৎপাদন খরচ তুলতে না পারলে তাঁরা মুখ ফিরিয়ে নেবেন। এ কারণে তাঁদের বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া দরকার বলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা মনে করেন।
খাদ্য অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, সরকারি খাদ্য গুদামের ধারণক্ষমতা ১৬ লাখ টন। এসব গুদামে বর্তমানে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ টন খাদ্য মজুদ রয়েছে। চলতি অর্থবছরের শুরুতে সরকারি খাদ্য মজুদের পরিমাণ আট লাখ ৮০ হাজার টনে নেমে আসায় মজুদ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এর ফলে গত অক্টোবর মাসের শেষে সরকারি খাদ্যশস্যের মজুদের পরিমাণ ১৫ লাখ ৪৫ হাজার টনে উন্নীত হয়। বর্তমানে তা কিছুটা কমেছে। উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থাগুলোও তাদের সহায়তা কমিয়ে দিয়েছে। তারা বাংলাদেশে খাদ্য সহায়তার কৌশল পাল্টিয়েছে। বৈদেশিক খাদ্য সহায়তার পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়ে তা পাঁচ থেকে ছয় শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। গত অক্টোবর পর্যন্ত বৈদেশিক খাদ্য সহায়তা পাওয়া গেছে মাত্র ৪৮ হাজার টন। চলতি বছর আউশ, আমনের বাম্পার ফলনের পরও বেসরকারিভাবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাল আমদানি হয়েছে। গত ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত বেসরকারিভাবে মোট ১০ লাখ ২৯ হাজার টন খাদ্যশস্য আমদানি করা হয়েছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, চলতি অর্থবছরে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এক কোটি ১৬ লাখ ১০ হাজার হেক্টর জমিতে ধান আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে আরো ৮১ হাজার হেক্টর জমিতে অতিরিক্ত আবাদ করা হয়। ফলে উৎপাদনও হয়েছে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে অনেক বেশি।

No comments

Powered by Blogger.