নগরায়ণ-জীবন দিয়েই শুধু বোঝাতে হবে তাদের মূল্য কত? by সারওয়ার জাহান
আবারও মৃত্যুর ঘটনায় শিরোনাম হলো গার্মেন্টসের শ্রমিকেরা। তবে এবার পুলিশের গুলি খেয়ে বা পদদলিত হয়ে মৃত্যু নয়, আগুনের ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে মৃত্যু হলো ২১ জনের। ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় একটি খবরের শিরোনাম ছিল এ রকম: গরিব গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে নিহত জরিনা বেগমের ছেলে বিলাপ করছিলেন এই
বলে—‘এক লাখ টাকা দাম দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হলো আমার মায়ের, বোনের লাশের দামও এক লাখ, আর লাশ বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য দেবে আরও ১৫ হাজার করে। গরিব গার্মেন্টসে কাজ করে আমার মা আর বোন যে এখন অনেক বড়লোক হয়ে গেছে।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘জীবিত ও মৃত’ নামক ছোটগল্পে লিখেছিলেন ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই’, গরিব গার্মেন্টসের জরিনা বেগম, তাঁর মেয়ে ও আরও ১৯ জন গার্মেন্টস শ্রমিক জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গেলেন তাঁদের মূল্য কত।
বাংলাদেশের এই হতদরিদ্র লোকগুলো যত দিন বেঁচে থাকে তত দিন আমাদের কাছে থাকে অপাঙেক্তয়; আমাদের ধারণায় এক ধরনের পরজীবী, যারা আমাদের অনুকম্পা নিয়ে বেঁচে থাকে। অথচ আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিই যে এরা তা আমরা অনুধাবন করি না। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যে গার্মেন্টস শিল্পের এত অবদান, সেই শিল্পের ভিত্তিই হচ্ছে এ হতদরিদ্র মানুষগুলোর শ্রম। বছরে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রায় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা আয় করছে এদের শ্রমের বিনিময়ে। গ্রামের হতদরিদ্র মানুষগুলো যখন কাজ পায় না, নিজের ক্ষুদ্র জমিটি বিক্রি করে কিংবা অন্যের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশে গিয়ে অর্থ উপার্জন করে তা পাঠায় দেশে। তাদেরই পরিশ্রমের ফসল আরও প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের অর্থনীতির ভিতকে শক্ত করে। আমাদের মধ্যে যাঁরা অবস্থাপন্ন তাঁরা বিদেশে গিয়ে ডলার পাঠান না, বিদেশের ব্যাংকে জমা রাখেন বা বাড়ি কেনেন। গ্রামের ক্ষুদ্র কৃষক তাঁর শ্রমের বিনিময়ে যে খাদ্য ফলান, তা নিয়ে আমরা গর্ব বোধ করি এবং বলি—বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। অথচ তাঁদের মূল্যায়ন আমরা করি না, করি সরকারের।
ঢাকা মহানগরের কথাই ধরা যাক। এক দিন যদি রিকশাচালকেরা রিকশা না চালান, অটোরিকশা, ক্যাব ও বাসচালকেরা তাঁদের গাড়ি বের না করেন, যদি গৃহকর্মীরা কাজে না আসেন, ফুটপাতের হকাররা তাঁদের বিক্রি বন্ধ রাখেন এবং নির্মাণ শ্রমিকেরা কাজ না করেন, কী অবর্ণনীয় দুর্দশায় না পড়ি আমরা! অথচ তাঁদের বিপদে আমরা কখনোই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই না।
একটি সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে সব মানুষ, বিশেষ করে দারিদ্র্যসীমার নিচে যাঁরা বাস করেন, তাঁরা যাতে কাজ পান তার ব্যবস্থা করা। অথচ এই হতদরিদ্র মানুষগুলো কখনো সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকেন না। গ্রামে যখন কাজ পান না, ছুটে যান কাছাকাছি কোনো শহরে। সেখানে কাজ না পেলে ছুটে আসেন ঢাকায়। নিজের শ্রম বা সামান্য পুঁজি নিয়ে নিজেরাই নিজেদের কাজের ব্যবস্থা করেন। এভাবে তাঁরা নিজেরাই এক ধরনের অর্থনীতির পত্তন ঘটান, যাকে আমরা বলি অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি। আগে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের পরিচিতি ছিল সনাতন খাত হিসেবে। উন্নয়ন অর্থনীতির আধুনিকায়ন তত্ত্বে এই সনাতন খাত অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বিলীন হয়ে যাবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। কিন্তু কিথ হার্ট নামে একজন ব্রিটিশ নৃ-বিজ্ঞানী ১৯৭৩ সালে আফ্রিকার রাষ্ট্র ঘানায় এক গবেষণার মাধ্যমে দেখতে পান যে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এ খাতের একটি বিশেষ অবদান রয়েছে। তিনি এ খাতের নাম দেন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত। পরবর্তী সময়ে গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে বিলীন হওয়া তো দূরের কথা, উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে এ খাত যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রয়োজন শুধু প্রাতিষ্ঠানিক খাতের সঙ্গে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সমন্বয় ঘটানো।
বাংলাদেশের নগর-মহানগরে অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তার উদাহরণ আমরা দিয়েছি। তা সত্ত্বেও এ খাতের প্রতি যে আমরা নিষ্ঠুর, তা বলাই বাহুল্য। এ খাতে যাঁরা কাজ করেন, স্বল্প আয়ের কারণে তাঁরা কখনোই ভালো জায়গায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে পারেন না। তাঁদের আশ্রয় জোটে বস্তিতে। আগে বেশির ভাগ বস্তিই ছিল সরকারি জমিতে আর সরকারি জমিতে থাকার কারণে এগুলো ছিল বেআইনি, যার কারণে প্রায়ই এগুলো উচ্ছেদের শিকার হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বড় ধরনের উচ্ছেদ হয় ১৯৭৫ সালে। তবে সে সময় অনেক বস্তিবাসীকে টঙ্গী, মিরপুর ও ডেমরায় পুনর্বাসন করা হয়। এরপর ২০০২ সালে বড় ধরনের বস্তি উচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। তখন প্রায় ৫০ হাজার লোককে আগারগাঁওয়ের বস্তিগুলো থেকে উচ্ছেদ করা হয়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও হাজার হাজার বস্তিবাসীকে উচ্ছেদ করা হয়।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ঢাকা মহানগরের পরিকল্পিত উন্নয়নের লক্ষ্যে নিয়োজিত একটি প্রতিষ্ঠান। যদিও ঢাকা মহানগরের প্রায় ৪০ ভাগ লোকই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, তাদের গৃহায়ন সমস্যা সমাধানে রাজউক কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি। বরং সাধারণ জনগণের জমি অধিগ্রহণ করে তা উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোর কাছে প্লট বানিয়ে বিক্রি করেছে। গুলশান, বারিধারা, বনানী ও উত্তরার মতো পশ এলাকাগুলো তাদের প্রয়োজনেই তৈরি করা হয়েছে এবং তাদের আরও সম্পদশালী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প, উত্তরা (তৃতীয় পর্ব) প্রকল্প ও ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পে আরও আট হাজার ৬৯১ একর জমি উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোর মধ্যে বণ্টন করা হচ্ছে। তাদের জন্য ঢাকার কাছে বানানো হচ্ছে আরও চারটি উপশহর।
২০০০ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকা মহানগরের বাসযোগ্য ভূমির মাত্র তিন ভাগের মালিকানা দরিদ্র পরিবারের। যেহেতু আয় কম, সেহেতু যাদের জমি নেই তারা বস্তিতে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, সরকারি জমি থেকে বস্তি উচ্ছেদের ফলে এখন শতকরা ৮০ ভাগ হতদরিদ্র পরিবারই ব্যক্তিমালিকানাধীন বস্তিতে বাস করে। এ পরিবারগুলো যে ভাড়া দেয় তা নেহাতই কম নয়। বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দরিদ্র বস্তিবাসী আধাপাকা ঘরের প্রতি বর্গ ফুটের জন্য ভাড়া দেয় ১০.১০ টাকা আর মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো একই ধরনের ঘরের জন্য প্রতি বর্গ ফুটে ভাড়া দেয় ৫.২৭ টাকা। অপরদিকে, পাকা বাড়ির প্রতি বর্গ ফুটের জন্য দরিদ্র পরিবারগুলো ভাড়া দেয় ১০.২০ টাকা, মধ্যবিত্ত পরিবার দেয় ৭.১০ টাকা এবং উচ্চবিত্ত পরিবার দেয় ১২.৩০ টাকা।
এটা এখন অনেকটাই স্পষ্ট যে এই হতদরিদ্র পরিবারগুলো কিছুটা সরকারি সহযোগিতা পেলে তাদের জীবনযাপন অনেকটা সহজ করে নিতে পারে। কিন্তু অত্যন্ত ক্ষমতাশালী চক্রের কারণে তা হয়ে উঠছে না। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিভিন্ন সংগঠনের চাপে উচ্ছেদকৃত দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য পাঁচ একর জমি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু এই চক্রের কারণে সিদ্ধান্তটি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। সম্প্রতি বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের এক গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু রাজউক এলাকার ভেতরেই প্রায় দুই হাজার একর কৃষি ও অকৃষি খাসজমি রয়েছে। এছাড়া রয়েছে প্রায় দুই হাজার ৫০০ একর খাস জলাভূমি। এগুলোর অনেকাংশই ক্ষমতাধরদের দখলে। এগুলোর কিছু অংশে কি হতদরিদ্র পরিবারগুলোর বসবাসের ব্যবস্থা করা যায় না? এসব জমি দরিদ্র পরিবারগুলোকে দিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই; বরং এগুলোতে ছোট ছোট ঘর বানিয়ে দরিদ্র পরিবারগুলোর কাছে ভাড়া দিয়ে সরকার আয়ও করতে পারে। গবেষণা থেকে তা-ই বেরিয়ে এসেছে।
দারিদ্র্য বিমোচন বিগত সব সরকারের আমলেই সরকারি কর্মকাণ্ড ও পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। বর্তমান সরকারের ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। গ্রামাঞ্চলে এ উদ্দেশ্যে তত্পরতা লক্ষ করা গেলেও শহরে, বিশেষ করে ঢাকা মহানগরে এর বিপরীতটাই চোখে পড়ে। বস্তিবাসী হওয়ার কারণে হতদরিদ্র পরিবারগুলো সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বলা হয়ে থাকে, এ ধরনের সযোগ-সুবিধা দেওয়া হলে গ্রামের মানুষগুলো ঢাকায় এসে ভিড় করবে। এর মানে হচ্ছে নগরায়ণকে অস্বীকার করা। বিশ্বের কোনো উন্নত দেশই নগরায়ণ ছাড়া উন্নত হতে পারেনি। উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে কৃষির ওপর নির্ভরতা কমে এবং নগরায়ণ ত্বরান্বিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রে শতকরা পাঁচ ভাগেরও কম লোক কৃষিকাজ করে থাকে। যুক্তরাজ্যে এ সংখ্যা দুই ভাগেরও কম। যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে, ঢাকার বাইরে যে পাঁচ শ শহর রয়েছে সেগুলোকে আকর্ষণীয় ও শক্তিশালী করা, যাতে সেই শহরগুলোতে হতদরিদ্র পরিবারগুলো কাজের সুযোগ পায়।
বৈষম্যের মাধ্যমে নগরায়ণের সমস্যাকে পাশ কাটানো যাবে না। যে সমাজে বৈষম্য বেশি সে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করাও দুরূহ। অথচ ন্যায়বিচারই হওয়া উচিত সমাজের ভিত্তি। আল কোরআনে সূরা নিসার ১৩৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা ন্যায়বিচারে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাকবে আল্লাহর সাক্ষীস্বরূপ; যদিও তা তোমাদের নিজেদের অথবা বাবা-মা এবং আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে যায়; সে বিত্তবান হোক অথবা বিত্তহীন হোক আল্লাহ উভয়েরই ঘনিষ্ঠতর। সুতরাং তোমরা ন্যায়বিচার করতে প্রবৃত্তির অনুগামী হবে না। যদি তোমরা পেঁচালো কথা বল অথবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে তোমরা যা কর আল্লাহ তো তার সম্যক খবর রাখেন।’ বিশিষ্ট চিন্তাবিদ আহমেদ দিদাতের ভাষায়, ‘যে জাতি ধর্ম, বর্ণ, গোত্র বা সম্পদের ভিত্তিতে বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করে, সে জাতির ধ্বংস অনিবার্য।’ আমরা কি সে পথেই ধাবিত হচ্ছি!
ড. সারওয়ার জাহান: প্রেসিডেন্ট, বিআইপি এবং প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, বুয়েট, ঢাকা।
sarwarjahan@urp.buet.ac.bd
বাংলাদেশের এই হতদরিদ্র লোকগুলো যত দিন বেঁচে থাকে তত দিন আমাদের কাছে থাকে অপাঙেক্তয়; আমাদের ধারণায় এক ধরনের পরজীবী, যারা আমাদের অনুকম্পা নিয়ে বেঁচে থাকে। অথচ আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তিই যে এরা তা আমরা অনুধাবন করি না। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে যে গার্মেন্টস শিল্পের এত অবদান, সেই শিল্পের ভিত্তিই হচ্ছে এ হতদরিদ্র মানুষগুলোর শ্রম। বছরে বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রায় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা আয় করছে এদের শ্রমের বিনিময়ে। গ্রামের হতদরিদ্র মানুষগুলো যখন কাজ পায় না, নিজের ক্ষুদ্র জমিটি বিক্রি করে কিংবা অন্যের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশে গিয়ে অর্থ উপার্জন করে তা পাঠায় দেশে। তাদেরই পরিশ্রমের ফসল আরও প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের অর্থনীতির ভিতকে শক্ত করে। আমাদের মধ্যে যাঁরা অবস্থাপন্ন তাঁরা বিদেশে গিয়ে ডলার পাঠান না, বিদেশের ব্যাংকে জমা রাখেন বা বাড়ি কেনেন। গ্রামের ক্ষুদ্র কৃষক তাঁর শ্রমের বিনিময়ে যে খাদ্য ফলান, তা নিয়ে আমরা গর্ব বোধ করি এবং বলি—বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। অথচ তাঁদের মূল্যায়ন আমরা করি না, করি সরকারের।
ঢাকা মহানগরের কথাই ধরা যাক। এক দিন যদি রিকশাচালকেরা রিকশা না চালান, অটোরিকশা, ক্যাব ও বাসচালকেরা তাঁদের গাড়ি বের না করেন, যদি গৃহকর্মীরা কাজে না আসেন, ফুটপাতের হকাররা তাঁদের বিক্রি বন্ধ রাখেন এবং নির্মাণ শ্রমিকেরা কাজ না করেন, কী অবর্ণনীয় দুর্দশায় না পড়ি আমরা! অথচ তাঁদের বিপদে আমরা কখনোই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই না।
একটি সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে সব মানুষ, বিশেষ করে দারিদ্র্যসীমার নিচে যাঁরা বাস করেন, তাঁরা যাতে কাজ পান তার ব্যবস্থা করা। অথচ এই হতদরিদ্র মানুষগুলো কখনো সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকেন না। গ্রামে যখন কাজ পান না, ছুটে যান কাছাকাছি কোনো শহরে। সেখানে কাজ না পেলে ছুটে আসেন ঢাকায়। নিজের শ্রম বা সামান্য পুঁজি নিয়ে নিজেরাই নিজেদের কাজের ব্যবস্থা করেন। এভাবে তাঁরা নিজেরাই এক ধরনের অর্থনীতির পত্তন ঘটান, যাকে আমরা বলি অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি। আগে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের পরিচিতি ছিল সনাতন খাত হিসেবে। উন্নয়ন অর্থনীতির আধুনিকায়ন তত্ত্বে এই সনাতন খাত অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে বিলীন হয়ে যাবে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল। কিন্তু কিথ হার্ট নামে একজন ব্রিটিশ নৃ-বিজ্ঞানী ১৯৭৩ সালে আফ্রিকার রাষ্ট্র ঘানায় এক গবেষণার মাধ্যমে দেখতে পান যে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এ খাতের একটি বিশেষ অবদান রয়েছে। তিনি এ খাতের নাম দেন অপ্রাতিষ্ঠানিক খাত। পরবর্তী সময়ে গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে বিলীন হওয়া তো দূরের কথা, উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে এ খাত যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রয়োজন শুধু প্রাতিষ্ঠানিক খাতের সঙ্গে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সমন্বয় ঘটানো।
বাংলাদেশের নগর-মহানগরে অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনীতি যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তার উদাহরণ আমরা দিয়েছি। তা সত্ত্বেও এ খাতের প্রতি যে আমরা নিষ্ঠুর, তা বলাই বাহুল্য। এ খাতে যাঁরা কাজ করেন, স্বল্প আয়ের কারণে তাঁরা কখনোই ভালো জায়গায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকতে পারেন না। তাঁদের আশ্রয় জোটে বস্তিতে। আগে বেশির ভাগ বস্তিই ছিল সরকারি জমিতে আর সরকারি জমিতে থাকার কারণে এগুলো ছিল বেআইনি, যার কারণে প্রায়ই এগুলো উচ্ছেদের শিকার হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বড় ধরনের উচ্ছেদ হয় ১৯৭৫ সালে। তবে সে সময় অনেক বস্তিবাসীকে টঙ্গী, মিরপুর ও ডেমরায় পুনর্বাসন করা হয়। এরপর ২০০২ সালে বড় ধরনের বস্তি উচ্ছেদের ঘটনা ঘটে। তখন প্রায় ৫০ হাজার লোককে আগারগাঁওয়ের বস্তিগুলো থেকে উচ্ছেদ করা হয়। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও হাজার হাজার বস্তিবাসীকে উচ্ছেদ করা হয়।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ঢাকা মহানগরের পরিকল্পিত উন্নয়নের লক্ষ্যে নিয়োজিত একটি প্রতিষ্ঠান। যদিও ঢাকা মহানগরের প্রায় ৪০ ভাগ লোকই দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, তাদের গৃহায়ন সমস্যা সমাধানে রাজউক কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি। বরং সাধারণ জনগণের জমি অধিগ্রহণ করে তা উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোর কাছে প্লট বানিয়ে বিক্রি করেছে। গুলশান, বারিধারা, বনানী ও উত্তরার মতো পশ এলাকাগুলো তাদের প্রয়োজনেই তৈরি করা হয়েছে এবং তাদের আরও সম্পদশালী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প, উত্তরা (তৃতীয় পর্ব) প্রকল্প ও ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পে আরও আট হাজার ৬৯১ একর জমি উচ্চমধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোর মধ্যে বণ্টন করা হচ্ছে। তাদের জন্য ঢাকার কাছে বানানো হচ্ছে আরও চারটি উপশহর।
২০০০ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ঢাকা মহানগরের বাসযোগ্য ভূমির মাত্র তিন ভাগের মালিকানা দরিদ্র পরিবারের। যেহেতু আয় কম, সেহেতু যাদের জমি নেই তারা বস্তিতে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, সরকারি জমি থেকে বস্তি উচ্ছেদের ফলে এখন শতকরা ৮০ ভাগ হতদরিদ্র পরিবারই ব্যক্তিমালিকানাধীন বস্তিতে বাস করে। এ পরিবারগুলো যে ভাড়া দেয় তা নেহাতই কম নয়। বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের এক গবেষণায় দেখা গেছে, দরিদ্র বস্তিবাসী আধাপাকা ঘরের প্রতি বর্গ ফুটের জন্য ভাড়া দেয় ১০.১০ টাকা আর মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো একই ধরনের ঘরের জন্য প্রতি বর্গ ফুটে ভাড়া দেয় ৫.২৭ টাকা। অপরদিকে, পাকা বাড়ির প্রতি বর্গ ফুটের জন্য দরিদ্র পরিবারগুলো ভাড়া দেয় ১০.২০ টাকা, মধ্যবিত্ত পরিবার দেয় ৭.১০ টাকা এবং উচ্চবিত্ত পরিবার দেয় ১২.৩০ টাকা।
এটা এখন অনেকটাই স্পষ্ট যে এই হতদরিদ্র পরিবারগুলো কিছুটা সরকারি সহযোগিতা পেলে তাদের জীবনযাপন অনেকটা সহজ করে নিতে পারে। কিন্তু অত্যন্ত ক্ষমতাশালী চক্রের কারণে তা হয়ে উঠছে না। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিভিন্ন সংগঠনের চাপে উচ্ছেদকৃত দরিদ্র পরিবারগুলোর জন্য পাঁচ একর জমি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু এই চক্রের কারণে সিদ্ধান্তটি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। সম্প্রতি বুয়েটের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের এক গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু রাজউক এলাকার ভেতরেই প্রায় দুই হাজার একর কৃষি ও অকৃষি খাসজমি রয়েছে। এছাড়া রয়েছে প্রায় দুই হাজার ৫০০ একর খাস জলাভূমি। এগুলোর অনেকাংশই ক্ষমতাধরদের দখলে। এগুলোর কিছু অংশে কি হতদরিদ্র পরিবারগুলোর বসবাসের ব্যবস্থা করা যায় না? এসব জমি দরিদ্র পরিবারগুলোকে দিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন নেই; বরং এগুলোতে ছোট ছোট ঘর বানিয়ে দরিদ্র পরিবারগুলোর কাছে ভাড়া দিয়ে সরকার আয়ও করতে পারে। গবেষণা থেকে তা-ই বেরিয়ে এসেছে।
দারিদ্র্য বিমোচন বিগত সব সরকারের আমলেই সরকারি কর্মকাণ্ড ও পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। বর্তমান সরকারের ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যতিক্রম ঘটেনি। গ্রামাঞ্চলে এ উদ্দেশ্যে তত্পরতা লক্ষ করা গেলেও শহরে, বিশেষ করে ঢাকা মহানগরে এর বিপরীতটাই চোখে পড়ে। বস্তিবাসী হওয়ার কারণে হতদরিদ্র পরিবারগুলো সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। বলা হয়ে থাকে, এ ধরনের সযোগ-সুবিধা দেওয়া হলে গ্রামের মানুষগুলো ঢাকায় এসে ভিড় করবে। এর মানে হচ্ছে নগরায়ণকে অস্বীকার করা। বিশ্বের কোনো উন্নত দেশই নগরায়ণ ছাড়া উন্নত হতে পারেনি। উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে কৃষির ওপর নির্ভরতা কমে এবং নগরায়ণ ত্বরান্বিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রে শতকরা পাঁচ ভাগেরও কম লোক কৃষিকাজ করে থাকে। যুক্তরাজ্যে এ সংখ্যা দুই ভাগেরও কম। যেটা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে, ঢাকার বাইরে যে পাঁচ শ শহর রয়েছে সেগুলোকে আকর্ষণীয় ও শক্তিশালী করা, যাতে সেই শহরগুলোতে হতদরিদ্র পরিবারগুলো কাজের সুযোগ পায়।
বৈষম্যের মাধ্যমে নগরায়ণের সমস্যাকে পাশ কাটানো যাবে না। যে সমাজে বৈষম্য বেশি সে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করাও দুরূহ। অথচ ন্যায়বিচারই হওয়া উচিত সমাজের ভিত্তি। আল কোরআনে সূরা নিসার ১৩৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা ন্যায়বিচারে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত থাকবে আল্লাহর সাক্ষীস্বরূপ; যদিও তা তোমাদের নিজেদের অথবা বাবা-মা এবং আত্মীয়স্বজনের বিরুদ্ধে যায়; সে বিত্তবান হোক অথবা বিত্তহীন হোক আল্লাহ উভয়েরই ঘনিষ্ঠতর। সুতরাং তোমরা ন্যায়বিচার করতে প্রবৃত্তির অনুগামী হবে না। যদি তোমরা পেঁচালো কথা বল অথবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে তোমরা যা কর আল্লাহ তো তার সম্যক খবর রাখেন।’ বিশিষ্ট চিন্তাবিদ আহমেদ দিদাতের ভাষায়, ‘যে জাতি ধর্ম, বর্ণ, গোত্র বা সম্পদের ভিত্তিতে বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করে, সে জাতির ধ্বংস অনিবার্য।’ আমরা কি সে পথেই ধাবিত হচ্ছি!
ড. সারওয়ার জাহান: প্রেসিডেন্ট, বিআইপি এবং প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান, নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ, বুয়েট, ঢাকা।
sarwarjahan@urp.buet.ac.bd
No comments