স্মরণ-সা'দত আলি আখন্দ স্মরণে by শামীম শমতাজ

একচলি্লশ বছর আগে ১২ মে এসেছিল আমাদের জীবনে, তখন সেই রক্তঝরা একাত্তর। চারদিকে যুদ্ধের দামামার মধ্যে আমরা কে কোথায় ছিটকে পড়েছি। যে একাত্তরে ৩০ লাখ শহীদ ছিনিয়ে নিয়ে এলো আমাদের স্বাধীনতার সূর্য, সেই একাত্তর ছিনিয়ে নিয়ে গেল আমাদের প্রাণপ্রিয় জন্মদাতা বাবা সা'দত আলি আখন্দকে।


আমরা তাঁর সন্তানরা দেশে-বিদেশে কেউ জানতে পারলাম না এই চরম দুঃসংবাদ, কেউ দেখতে পেলাম না বাবার শেষ সময়। যখন শুনতে পেলাম তত দিনে ক্যালেন্ডারের বেশ কয়েকটি পাতা বদলে গিয়েছে। আর আজ অবধি ভাবনার মধ্যেই রয়ে গেছে আমার বাবার প্রিয় মুখখানি। কে এই সা'দত আলি আখন্দ, যাঁর নাম নিয়ে প্রতিবছর ১২ মে ফিরে ফিরে আসে? সা'দত আলি আখন্দকে জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ইতিহাসের পাতায়- ২০ শতকের গোড়ায়, ইংরেজ শাসনামলে যখন বাংলার মুসলমান ছিল চরম আঁধারে ঢাকা, কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ, অস্থিরতা, অস্বাভাবিক অন্ধকারের দুঃসময়। সা'দত আলি আখন্দ যে সময়ে কলম হাতে নিলেন, তখন মুসলমান লেখকদের সংখ্যা হাতে গোনা। অত্যন্ত মেধাবী, বইপ্রেমী, ইতিহাসের ছাত্র, ছাত্রজীবনে কবিতা লিখতেন আর ব্রিটিশ সড়কারের পুলিশ বিভাগে ৩২ বছর চাকরিজীবনের মধ্যে তাঁর লেখা শুরু। প্রথম থেকেই তিনি মুসলমান তরুণদের জাগরণমূলক প্রবন্ধাদি লিখতেন। তাঁর লেখা 'তরুণ মুসলিম'-এর পাতায় আছে 'কে জাগাবে মুসলিম সমাজকে, কে তরুণ মুসলমিদের মুক্তির বাণী শোনাবে?' প্রথম দিকে এই ছিল তাঁর লেখার ধ্যান-ধারণা। তাঁর লেখার মধ্যে ফুটে উঠেছিল নানা প্রশ্ন- 'বাংলার গ্রামে গ্রামে যুগ-যুগান্তর ধরে দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে অজ্ঞাত ও ঘৃণ্য জীবন যাপন করে আসছে দিনের পর দিন ওরা কারা?' ১৯৩৬ সালে সা'দত আলি আখন্দের লেখা প্রথম বই 'তরুণ মুসলিম'-এ তিনি বাংলার তরুণ মুসলিমদের কণ্ঠে সমাজের নবজাগরণের আহ্বান জানিয়েছেন। ঘুমন্ত আত্মবিস্মৃত মুসলিমকে তিনি ঘুম ভেঙে জেগে ওঠার ডাক দিয়েছিলেন। পিছিয়ে পড়া মুসলিম সমাজের এগিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি নানা প্রস্তাবনা রেখে গেছেন তাঁর বইয়ের মধ্যে।
প্রায় প্রতিটি ১২ মে সা'দত আলি আখন্দের মৃত্যুবার্ষিকীতে পত্রিকার পাতায় ফিরে আসে আমার বাবার নাম, লেখা, কথা, নানা তথ্য ও অসংখ্য অজানা কাহিনী। তাঁর লেখার মধ্যে আমরা খুঁজে পাই আমাদের পূর্বপুরুষরা কী ভাবতেন, কী ছিল তাঁদের পথনির্দেশ। ব্রিটিশ শাসনের গোড়া থেকেই যে সংকট ও জটিলতা দেখা দিয়েছিল, তা ছিল- সে প্রথমে ভারতীয় না মুসলমান অথবা সে বাঙালি না মুসলমান। জাতীয় পরিচিতির এ সমস্যা মুসলমানদের রাজনীতিকেই শুধু জটিল করেনি, অন্তবিরোধ ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত করে তুলেছে এবং করছে। তথা সেইকালে সা'দত আলি আখন্দ এসব বিষয়ে যে বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন, তাঁর লেখায় তা ভাবলে আজ বিস্মিত হতে হয়। আজ ২০১২ সালের ১২ মে সা'দত আলি আখন্দ হারিয়ে যাননি বাংলার পাঠকদের কাছ থেকে। তাঁর সাহসী লেখনীই ফিরিয়ে নিয়ে আসছে বারবার প্রতিবারের ১২ মে-তে।
শামীম শমতাজ

No comments

Powered by Blogger.