আল-কায়েদার জায়গা নিচ্ছে লস্কর-ই-তাইয়েবা? by আরিফ মো. তারেক হাবিব
আল-কায়েদার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে রীতিমতো হাঁপিয়ে উঠেছে মার্কিন সেনা ও গোয়েন্দারা। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে মিত্র দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে ২০০১ সালে আফগানিস্তানে আক্রমণ করার পর পেরিয়ে গেছে নয় বছরের বেশি সময়।
আল-কায়েদার শীর্ষ নেতা ওসামা বিন লাদেনকে পাকড়াও করতে না পারলেও ব্যাপক প্রচারণা ও অভিযানের মাধ্যমে জঙ্গিগোষ্ঠীটিকে বেশ কোণঠাসা করা গেছে বলে ধারণা করছেন মার্কিন কর্মকর্তারা। কিন্তু জঙ্গি হামলার হুমকি নিয়ে স্বস্তি মেলেনি। নতুন হুমকি হিসেবে উঠে এসেছে আরেকটি জঙ্গিগোষ্ঠী—পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তাইয়েবা বা এলইটি। এই গোষ্ঠী এখন অনেকটাই ঘুম হারাম করে দিয়েছে মার্কিন প্রশাসনের।
সন্ত্রাসবাদ বিশ্লেষকদের হিসাব-নিকাশ অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠনটির নাম লস্কর-ই-তাইয়েবা। আল-কায়েদার তুলনায় স্বল্প পরিচিতি, তহবিল সংগ্রহের বিস্তৃত উত্স আর পাকিস্তানের মতো পরমাণু শক্তিধর দেশের প্রশাসনের সমর্থন এলইটিকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। ১৫ বছর ধরে সংগঠনটি মূলত ভারতের স্বার্থবিরোধী কর্মসূচি পরিচালনার দিকে মনোনিবেশ করেছিল। বিশেষ করে বিরোধপূর্ণ কাশ্মীর অঞ্চলে ছিল তাদের মূল কার্যক্রম। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টেছে। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিশ্লেষকেরা বলছেন, এলইটি এখন পশ্চিমাদের ওপর আক্রমণ চালাতেই বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। তাদের কার্যক্রম ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে দিন দিন আন্তর্জাতিক রূপ নিচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় জঙ্গিগোষ্ঠী এলইটির কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯০ সালে। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতার নাম হাফিজ মোহাম্মদ সাইদ। অবশ্য আশির দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য গঠিত আফগান সার্ভিসেস ব্যুরো থেকেই এলইটির উদ্ভব বলে ধারণা করা হয়। আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত বাহিনী সরে গেলে এলইটির সদস্যরা তাজিকিস্তান ও বসনিয়ার গৃহযুদ্ধে অংশ নেয়। কিন্তু কাশ্মীর রক্ষার লড়াইয়ে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের আহ্বানে তারা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। অভিযোগ রয়েছে, ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে লড়াই করতে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার-সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) সরাসরি সামরিক ও রাজনৈতিক সমর্থন দিয়েছে এলইটিকে। এলইটির মূল ঘাঁটি এখন লাহোরের কাছে মুরিদকে এলাকায়। সেখানে পাকিস্তান সরকার এলইটিকে ৭৭ হেক্টর জমি দান করেছে। এ ছাড়া পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে দলটির বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণশিবির রয়েছে বলেও দাবি ভারতীয় গোয়েন্দাদের।
ভারত, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া ও অস্ট্রেলীয় সরকার জঙ্গি সংগঠন হিসেবে দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন গোয়েন্দা দপ্তর অভিযোগ তোলে, এলইটিকে সমর্থন দেওয়া অব্যাহত রেখেছে আইএসআই। গত মাসে মার্কিন সিনেটের এক শুনানিতে জাতীয় গোয়েন্দা দপ্তরের পরিচালক ডেনিস ব্লেয়ার বলেন, ‘এলইটি দিন দিন সরাসরি হুমকিতে পরিণত হচ্ছে। ইউরোপ ও নাগালের মধ্যে থাকা পশ্চিমা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার পরিকল্পনা করছে। জঙ্গিগোষ্ঠীটির ইহুদি স্বার্থসংশ্লিষ্ট স্থাপনা ও পশ্চিমারা যাতায়াত করে এমন স্থাপনাগুলোতে হামলা চালানোর আগ্রহ উদ্বেগ তৈরি করছে।’
২০০৩ সাল থেকে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন হামলায় এলইটির সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছেন গোয়েন্দারা। ইরাক থেকে আফগানিস্তান, ঢাকা থেকে কোপেনহেগেন পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে এলইটির তত্পরতা। সংগঠনটির বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা চালানোর অভিযোগটি ওঠে ২০০৮ সালে। ওই বছর নভেম্বরে ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলায় ১৬০ জনের বেশি মারা যায়, যাদের মধ্যে পশ্চিমা নাগরিকেরাও ছিলেন। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইয়ের সাবেক কর্মকর্তা ও সন্ত্রাসবাদ-বিশেষজ্ঞ ব্রুস রিডেল বলেন, ‘এলইটি পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে হামলা জোরদার করছে—মুম্বাই হামলার মাধ্যমে এটাই প্রমাণ হয়েছে। মুম্বাইয়ে সংগঠনটি যাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে, তারা আন্তর্জাতিক “জিহাদি” আন্দোলনের লক্ষ্যবস্তু।’
মুম্বাই হামলার পরপরই পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ লস্করের যোগাযোগ-বিশেষজ্ঞ জারার শাহকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর ল্যাপটপ থেকে ৩২০টি সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তুর একটি তালিকা উদ্ধার করা হয়। এসব লক্ষ্যবস্তুর বেশির ভাগই ছিল ভারতের বাইরে, বিশেষ করে ইউরোপে। একটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে এলইটির আত্মপ্রকাশের আরেকটি বড় প্রমাণ সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে ডেভিড কোলম্যান হেডলি নামের এক পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকের গ্রেপ্তারের ঘটনা। গত অক্টোবরে শিকাগো থেকে হেডলিকে গ্রেপ্তার করা হয়। হেডলির বিরুদ্ধে অভিযোগ, লস্করের হয়ে তিনি মুম্বাই হামলায় বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুর অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এ অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছেন হেডলি। তবে মার্কিন তদন্ত কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, হেডলি ও এলইটি ডেনমার্কের একটি পত্রিকার কার্যালয়ে হামলার পরিকল্পনার সঙ্গেও জড়িত। ওই পত্রিকার লক্ষ্য ও সামর্থ্য নিয়ে আমি যতটা উদ্বিগ্ন, আর খুব কম বিষয় নিয়ে এতটা উদ্বেগ রয়েছে আমার। ঢাকায় হামলার এই পরিকল্পনা এটাই প্রমাণ করছে লস্কর আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।’
পশ্চিমা দেশগুলোর গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, মুম্বাই হামলার আগে দেখা গেছে ভারতে হামলা করার ক্ষেত্রে বিদেশি নাগরিকদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করত এলইটি। কিন্তু পুনে ও মুম্বাই হামলার গতি-প্রকৃতি প্রমাণ করেছে, ভারতে হামলার ক্ষেত্রেও একটি আন্তর্জাতিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছে সংগঠনটি।
লস্কর কবে থেকে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে হামলা শুরু করেছে, তার সঠিক দিনক্ষণ এখনো বের করতে পারেননি পশ্চিমা গোয়েন্দারা। তবে সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় সামরিক কমান্ডার দিলশাদ আহমেদ ১৯৯৮ সালে বলেছিলেন, লস্করের উচিত তাদের কার্যক্রমের পরিধি বাড়ানো। এরই সূত্র ধরে ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিজেদের কর্মী পাঠায় সংগঠনটি। ওই বছরই ব্রিটিশ সেনারা দিলশাদসহ কয়েকজন লস্কর জঙ্গিকে আটক করেন। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে হামলার পর সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্বের অন্য ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর মতো মার্কিন ও পশ্চিমাবিরোধী হামলা শুরু করেনি লস্কর। কিন্তু মার্কিন গোয়েন্দারা দাবি করেছেন, ২০০৬ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে আফগানিস্তানে বিদেশি বাহিনীর বিরুদ্ধে ২০০ এলইটি জঙ্গি লড়াই করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, প্রযুক্তিগত সুবিধার বিবেচনায় আল-কায়েদার চেয়ে বড় হুমকি লস্কর-ই-তাইয়েবা। তা ছাড়া এলইটি এখনো মুক্ত পরিবেশে জঙ্গি প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালনা করতে পারছে। ভারতীয় ও মার্কিন গোয়েন্দাদের তথ্যানুযায়ী, গত ২০ বছরে সংগঠনটি দুই লাখের বেশি সদস্যকে এসব শিবিরে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এদের অনেকেই উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সংগঠনের পক্ষে কাজ করছে। তা ছাড়া পাকিস্তান সরকার সীমান্ত এলাকায় আল-কায়েদা দমনে যতটা আগ্রহী, লস্করের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে ততটা আগ্রহী নয়। এর অন্যতম কারণ আল-কায়েদার চেয়ে লস্করের কার্যক্রমের পরিধি অনেক বিস্তৃত। পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও কাশ্মীর অঞ্চলে বিদ্যালয়, অ্যাম্বুলেন্স ও স্বাস্থ্যসেবা, দাতব্য প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে সংগঠনটি। এ কারণে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে সংগঠনের জনপ্রিয়তা রয়েছে। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ মনে করে, ভারতের বিরুদ্ধে একটি বড় সহায়ক শক্তি লস্করের সদস্যরা।
২০০৯ সালের মার্চে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের একটি কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘লস্কর নেতারা এখন তাঁদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আন্তর্জাতিক ইসলামি “জিহাদি” আন্দোলনের সঙ্গে এক সূত্রে গেঁথেছেন। আল-কায়েদা ও এলইটি আগের চেয়ে অনেক ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে।’ তবে বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, পশ্চিমা বিশ্ব এখনো লস্করের প্রতি সেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে না। এর ফলে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো মুম্বাই হামলার মতো কোনো ম্যানহাটান বা মিয়ামি হামলা সংবাদ মাধ্যমের শিরোনামে স্থান করে নেবে। বিবিসি ও নিউজ উইক অবলম্বনে।
সন্ত্রাসবাদ বিশ্লেষকদের হিসাব-নিকাশ অনুযায়ী, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠনটির নাম লস্কর-ই-তাইয়েবা। আল-কায়েদার তুলনায় স্বল্প পরিচিতি, তহবিল সংগ্রহের বিস্তৃত উত্স আর পাকিস্তানের মতো পরমাণু শক্তিধর দেশের প্রশাসনের সমর্থন এলইটিকে এই জায়গায় নিয়ে এসেছে। ১৫ বছর ধরে সংগঠনটি মূলত ভারতের স্বার্থবিরোধী কর্মসূচি পরিচালনার দিকে মনোনিবেশ করেছিল। বিশেষ করে বিরোধপূর্ণ কাশ্মীর অঞ্চলে ছিল তাদের মূল কার্যক্রম। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টেছে। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বিশ্লেষকেরা বলছেন, এলইটি এখন পশ্চিমাদের ওপর আক্রমণ চালাতেই বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। তাদের কার্যক্রম ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে দিন দিন আন্তর্জাতিক রূপ নিচ্ছে।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বড় জঙ্গিগোষ্ঠী এলইটির কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৯০ সালে। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতার নাম হাফিজ মোহাম্মদ সাইদ। অবশ্য আশির দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য গঠিত আফগান সার্ভিসেস ব্যুরো থেকেই এলইটির উদ্ভব বলে ধারণা করা হয়। আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত বাহিনী সরে গেলে এলইটির সদস্যরা তাজিকিস্তান ও বসনিয়ার গৃহযুদ্ধে অংশ নেয়। কিন্তু কাশ্মীর রক্ষার লড়াইয়ে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের আহ্বানে তারা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। অভিযোগ রয়েছে, ভারত অধিকৃত কাশ্মীরে লড়াই করতে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার-সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই) সরাসরি সামরিক ও রাজনৈতিক সমর্থন দিয়েছে এলইটিকে। এলইটির মূল ঘাঁটি এখন লাহোরের কাছে মুরিদকে এলাকায়। সেখানে পাকিস্তান সরকার এলইটিকে ৭৭ হেক্টর জমি দান করেছে। এ ছাড়া পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে দলটির বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণশিবির রয়েছে বলেও দাবি ভারতীয় গোয়েন্দাদের।
ভারত, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া ও অস্ট্রেলীয় সরকার জঙ্গি সংগঠন হিসেবে দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে মার্কিন গোয়েন্দা দপ্তর অভিযোগ তোলে, এলইটিকে সমর্থন দেওয়া অব্যাহত রেখেছে আইএসআই। গত মাসে মার্কিন সিনেটের এক শুনানিতে জাতীয় গোয়েন্দা দপ্তরের পরিচালক ডেনিস ব্লেয়ার বলেন, ‘এলইটি দিন দিন সরাসরি হুমকিতে পরিণত হচ্ছে। ইউরোপ ও নাগালের মধ্যে থাকা পশ্চিমা লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার পরিকল্পনা করছে। জঙ্গিগোষ্ঠীটির ইহুদি স্বার্থসংশ্লিষ্ট স্থাপনা ও পশ্চিমারা যাতায়াত করে এমন স্থাপনাগুলোতে হামলা চালানোর আগ্রহ উদ্বেগ তৈরি করছে।’
২০০৩ সাল থেকে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন হামলায় এলইটির সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছেন গোয়েন্দারা। ইরাক থেকে আফগানিস্তান, ঢাকা থেকে কোপেনহেগেন পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে এলইটির তত্পরতা। সংগঠনটির বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা চালানোর অভিযোগটি ওঠে ২০০৮ সালে। ওই বছর নভেম্বরে ভারতের বাণিজ্যিক রাজধানী মুম্বাইয়ে সন্ত্রাসী হামলায় ১৬০ জনের বেশি মারা যায়, যাদের মধ্যে পশ্চিমা নাগরিকেরাও ছিলেন। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইয়ের সাবেক কর্মকর্তা ও সন্ত্রাসবাদ-বিশেষজ্ঞ ব্রুস রিডেল বলেন, ‘এলইটি পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে হামলা জোরদার করছে—মুম্বাই হামলার মাধ্যমে এটাই প্রমাণ হয়েছে। মুম্বাইয়ে সংগঠনটি যাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে, তারা আন্তর্জাতিক “জিহাদি” আন্দোলনের লক্ষ্যবস্তু।’
মুম্বাই হামলার পরপরই পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ লস্করের যোগাযোগ-বিশেষজ্ঞ জারার শাহকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর ল্যাপটপ থেকে ৩২০টি সম্ভাব্য লক্ষ্যবস্তুর একটি তালিকা উদ্ধার করা হয়। এসব লক্ষ্যবস্তুর বেশির ভাগই ছিল ভারতের বাইরে, বিশেষ করে ইউরোপে। একটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে এলইটির আত্মপ্রকাশের আরেকটি বড় প্রমাণ সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে ডেভিড কোলম্যান হেডলি নামের এক পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকের গ্রেপ্তারের ঘটনা। গত অক্টোবরে শিকাগো থেকে হেডলিকে গ্রেপ্তার করা হয়। হেডলির বিরুদ্ধে অভিযোগ, লস্করের হয়ে তিনি মুম্বাই হামলায় বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুর অবস্থান সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। এ অভিযোগ অবশ্য অস্বীকার করেছেন হেডলি। তবে মার্কিন তদন্ত কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, হেডলি ও এলইটি ডেনমার্কের একটি পত্রিকার কার্যালয়ে হামলার পরিকল্পনার সঙ্গেও জড়িত। ওই পত্রিকার লক্ষ্য ও সামর্থ্য নিয়ে আমি যতটা উদ্বিগ্ন, আর খুব কম বিষয় নিয়ে এতটা উদ্বেগ রয়েছে আমার। ঢাকায় হামলার এই পরিকল্পনা এটাই প্রমাণ করছে লস্কর আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।’
পশ্চিমা দেশগুলোর গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, মুম্বাই হামলার আগে দেখা গেছে ভারতে হামলা করার ক্ষেত্রে বিদেশি নাগরিকদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করত এলইটি। কিন্তু পুনে ও মুম্বাই হামলার গতি-প্রকৃতি প্রমাণ করেছে, ভারতে হামলার ক্ষেত্রেও একটি আন্তর্জাতিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছে সংগঠনটি।
লস্কর কবে থেকে পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে হামলা শুরু করেছে, তার সঠিক দিনক্ষণ এখনো বের করতে পারেননি পশ্চিমা গোয়েন্দারা। তবে সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় সামরিক কমান্ডার দিলশাদ আহমেদ ১৯৯৮ সালে বলেছিলেন, লস্করের উচিত তাদের কার্যক্রমের পরিধি বাড়ানো। এরই সূত্র ধরে ২০০৩ সালে ইরাকে মার্কিন বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিজেদের কর্মী পাঠায় সংগঠনটি। ওই বছরই ব্রিটিশ সেনারা দিলশাদসহ কয়েকজন লস্কর জঙ্গিকে আটক করেন। ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারে হামলার পর সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্বের অন্য ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর মতো মার্কিন ও পশ্চিমাবিরোধী হামলা শুরু করেনি লস্কর। কিন্তু মার্কিন গোয়েন্দারা দাবি করেছেন, ২০০৬ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে আফগানিস্তানে বিদেশি বাহিনীর বিরুদ্ধে ২০০ এলইটি জঙ্গি লড়াই করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, প্রযুক্তিগত সুবিধার বিবেচনায় আল-কায়েদার চেয়ে বড় হুমকি লস্কর-ই-তাইয়েবা। তা ছাড়া এলইটি এখনো মুক্ত পরিবেশে জঙ্গি প্রশিক্ষণ শিবির পরিচালনা করতে পারছে। ভারতীয় ও মার্কিন গোয়েন্দাদের তথ্যানুযায়ী, গত ২০ বছরে সংগঠনটি দুই লাখের বেশি সদস্যকে এসব শিবিরে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এদের অনেকেই উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সংগঠনের পক্ষে কাজ করছে। তা ছাড়া পাকিস্তান সরকার সীমান্ত এলাকায় আল-কায়েদা দমনে যতটা আগ্রহী, লস্করের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে ততটা আগ্রহী নয়। এর অন্যতম কারণ আল-কায়েদার চেয়ে লস্করের কার্যক্রমের পরিধি অনেক বিস্তৃত। পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও কাশ্মীর অঞ্চলে বিদ্যালয়, অ্যাম্বুলেন্স ও স্বাস্থ্যসেবা, দাতব্য প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে সংগঠনটি। এ কারণে স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে সংগঠনের জনপ্রিয়তা রয়েছে। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ মনে করে, ভারতের বিরুদ্ধে একটি বড় সহায়ক শক্তি লস্করের সদস্যরা।
২০০৯ সালের মার্চে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের একটি কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘লস্কর নেতারা এখন তাঁদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য আন্তর্জাতিক ইসলামি “জিহাদি” আন্দোলনের সঙ্গে এক সূত্রে গেঁথেছেন। আল-কায়েদা ও এলইটি আগের চেয়ে অনেক ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে।’ তবে বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, পশ্চিমা বিশ্ব এখনো লস্করের প্রতি সেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে না। এর ফলে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো মুম্বাই হামলার মতো কোনো ম্যানহাটান বা মিয়ামি হামলা সংবাদ মাধ্যমের শিরোনামে স্থান করে নেবে। বিবিসি ও নিউজ উইক অবলম্বনে।
No comments