আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-১৫)-পাড়াটাই ছিল একটা বাড়ি by আলী যাকের
গেণ্ডারিয়ায় যাওয়ার পর শুরুতে স্কুলে যেতে একদম ইচ্ছা করত না। তার চেয়ে মায়ের আশপাশে ঘুরঘুর, খুনসুটি, পাড়ার অলিগলিতে ঘোরাফেরা অথবা গেণ্ডারিয়া রেলস্টেশনের কাছে রেললাইন পেরিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানো ছিল অনেক বেশি আনন্দদায়ক। পেছন ফিরে তাকালে মনে হয় ইউনিভার্সিটির একটা ডিগ্রি অর্জন করেছি, নেহাত অর্জন করতে হয় বলে।
কিন্তু সত্যিকার অর্থে আমি একজন স্বশিক্ষিত ব্যক্তি। এ শিক্ষায় বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন মানুষ এবং গ্রন্থ আমায় অনুপ্রাণিত করেছে। শুরু করতে হয় আমার বাবাকে দিয়ে। একবার বাবার সঙ্গে আমাদের গ্রামের বাড়ি রতনপুরে বেড়াতে গিয়েছিলাম। যেমন প্রতিবছর যেতাম। তখন আমার বয়স ছয় কি সাড়ে ছয়। আমার বাবা খুব ভোরে আমাদের ঘুম থেকে তুলে দিতেন প্রতিদিন। রতনপুরে একদিন সূর্য উঠেছে কি ওঠেনি, বাবা আমাকে ঘুম থেকে তুলে বললেন, 'আয়'। ভূতে পাওয়া মানুষের মতো বাবার পেছনে পেছনে চললাম। আমাদের বাড়ির পুব দিকে একটা বড় পুকুর আছে। সেই পুকুরের পুব পাড়ে বাবা আমাকে নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন। ওইখান থেকে পুব দিকে তাকালে দেখা যায় আদিগন্ত সবুজ ধানের ক্ষেত শীতকালে। বর্ষায় থৈ থৈ করে পানি। তখন সূর্য কেবল উঁকি দিয়েছে পুব আকাশে। পুব দিকে তাকিয়ে বাবা আবৃত্তি করলেন, � heart leaps up with joy when I behold a rainbow in the s�. So was it when my life began. So is it now I am a man. So be it when I shall grow old, or let me die. Child is father of the man and I wish my days to be bound each to each by natural piety. আমার বাবার সবচেয়ে প্রিয় কবি William Wordsworth-এর অবিস্মরণীয় এক কবিতা। ওইদিন পুকুরের ওই পুব পাড়ে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ ধরে যে আমায় মুখস্থ করিয়েছিলেন সেই কবিতা, জীবনে আমি তা কখনো ভুলিনি। কেবল যে কবিতা ভুলিনি তাই নয়, নিসর্গ গেঁথে গেছে মাথার ভেতর। এখনো আমি গ্রামের বাড়িতে গেলে পুকুরের পুব পাড়ে দাঁড়িয়ে বাবার উদ্দেশে ডড়ৎফংড়িৎঃয আবৃত্তি করি। বস্তুতপক্ষে বাবার কল্যাণেই ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে আমার যৎকিঞ্চিৎ পরিচয়। আজকে আমি যে শেকসপিয়ারে আগ্রহী, এর পেছনেও বাবার অবদান অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। তবে শেকসপিয়ারকে আমার প্রিয় করার পেছনে আরো একজন আছেন। মরহুম অধ্যাপক আবু হেনা। তাঁর বিষয়ে আসছি আরো পরে।
ওই সময় পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হয়। এই নির্বাচনে, আমরা সবাই জানি, মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়। আমরা এখন জানি যে ১৯৫৪ সালে সেই নির্বাচনের মাধ্যমেই বাঙালি তার স্বাধিকারের পক্ষে রায় দিয়েছিল। যা হোক, এ নির্বাচনের ফল যখন বেরোলো আমার মা এবং বাবার মন খুব খারাপ হয়ে গেল। কেননা তাঁরা ছিলেন মুসলিম লীগ প্রার্থী বেগম শামসুন নাহার মাহমুদের সমর্থক। বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ যদিও মুসলিম লীগের রাজনীতি করতেন, ছিলেন একজন মুক্তমনা মানুষ। মা-বাবার মন খারাপ। অতএব, আমাদেরও মন খারাপ হয়ে গেল। তবে সেটা সাময়িক। রাজনীতি বোধ হয় শিশু-কিশোরদের মনে দীর্ঘদিনের জন্য রেখাপাত করে না। প্রসঙ্গত মনে পড়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান যখন মারা যান, ঠিক সেই সময় আমরা মায়ের সঙ্গে চট্টগ্রাম বেড়াতে গিয়েছিলাম। তখন আমার বয়স চার-পাঁচ বছর। রাতে ঘুমাতে যাব হঠাৎ শুনতে পেলাম রাস্তায় রিকশার ওপরে লাউডস্পিকারে একজন কেউ কাঁদতে-কাঁদতে ঘোষণা করছে, 'আমাদের প্রাণপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন...' ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমার মা বলে উঠলেন, 'হায়, হায় আমাদের কী হবে?' আমি কান্নাভেজা স্বরে মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'আমরাও কি মরে যাব?' পরের দিন সকালে লিয়াকত আলী খান আর আমার স্মৃতিতে থাকলেন না। আমি রঙিন ঘুড্ডি কিনতে দৌড়ালাম বাড়ির পাশের দোকানে। কাজেই বেগম শামসুন নাহার মাহমুদের পরাজয় কিংবা লিয়াকত আলী খানের মৃত্যু আমাকে বেশি দিন দুঃখ ভারাক্রান্ত রাখতে পারেনি। গেণ্ডারিয়া পাড়ায় আসার পর ক্রমে আবিষ্কার করলাম গোটা পাড়াটাই যেন একটা বিশাল বাড়ি আর সেই বিশাল বাড়ির একেকটি প্রকোষ্ঠ হচ্ছে বিভিন্ন বাসা। অতএব, আমাদের সবার সব বাড়ির ভেতর অবাধে ঢুকে পড়ার স্বাধীনতা ছিল। এভাবে সমবয়সীদের ছাড়িয়ে বড়দের সঙ্গেও এক ধরনের সখ্য গড়ে উঠল। প্রত্যেকেই আমাদের স্নেহের চোখে দেখতেন। অজয়দের বাড়িতে তার দুই দিদি, মনিষাদি এবং মমতাদি পড়াশোনায় অত্যন্ত ভালো ছিলেন। তাঁরা আমাকে খুব স্নেহ করতেন। শুনেছি ভারতে তাঁরা দুজনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়েছিলেন। আমাদের বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে বাস করতেন শ্রী দ্বারকানাথ বারোরী। তিনি মুসলিম লীগের আমলে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন এবং মন্ত্রীও হয়েছিলেন। তবে আমরা যখন তাঁকে গেণ্ডারিয়ায় দেখেছি তখন তিনি মন্ত্রী ছিলেন না। আমার বাবার সঙ্গে তাঁর বন্ধুতা ছিল। তাঁর সবচেয়ে ছোট ছেলে সদানন্দ বারোরী ছিল আমার বন্ধু। ওরা ছিল মেলা ভাইবোন। সবার সঙ্গেই আমাদের সুসম্পর্ক ছিল। ওই পরিবারের, আমার স্মৃতি যদি শঠতা না করে, সবচেয়ে বড় ছেলের নাম মৃণাল কান্তি বারোরী। আমরা যখন গেণ্ডারিয়ায় থাকতে যাই, তখন মৃণালদা আন্ডারগ্রাউন্ডে। তিনি তাঁদের অঞ্চল গোপালগঞ্জের গ্রামে গ্রামে কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি করতেন। যদিও শ্রী দ্বারকানাথ বারোরীদের বাড়িতে মৃণালদার নাম কখনো উচ্চারিত হতো না, কেমন একটা রহস্যময় নীরবতা ঘিরে থাকত তাঁকে। তবুও ওই বালক বয়সেও আমরা বেশ রোমাঞ্চিত হতাম।
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
ওই সময় পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হয়। এই নির্বাচনে, আমরা সবাই জানি, মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়। আমরা এখন জানি যে ১৯৫৪ সালে সেই নির্বাচনের মাধ্যমেই বাঙালি তার স্বাধিকারের পক্ষে রায় দিয়েছিল। যা হোক, এ নির্বাচনের ফল যখন বেরোলো আমার মা এবং বাবার মন খুব খারাপ হয়ে গেল। কেননা তাঁরা ছিলেন মুসলিম লীগ প্রার্থী বেগম শামসুন নাহার মাহমুদের সমর্থক। বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ যদিও মুসলিম লীগের রাজনীতি করতেন, ছিলেন একজন মুক্তমনা মানুষ। মা-বাবার মন খারাপ। অতএব, আমাদেরও মন খারাপ হয়ে গেল। তবে সেটা সাময়িক। রাজনীতি বোধ হয় শিশু-কিশোরদের মনে দীর্ঘদিনের জন্য রেখাপাত করে না। প্রসঙ্গত মনে পড়ে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান যখন মারা যান, ঠিক সেই সময় আমরা মায়ের সঙ্গে চট্টগ্রাম বেড়াতে গিয়েছিলাম। তখন আমার বয়স চার-পাঁচ বছর। রাতে ঘুমাতে যাব হঠাৎ শুনতে পেলাম রাস্তায় রিকশার ওপরে লাউডস্পিকারে একজন কেউ কাঁদতে-কাঁদতে ঘোষণা করছে, 'আমাদের প্রাণপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান আততায়ীর গুলিতে নিহত হয়েছেন...' ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমার মা বলে উঠলেন, 'হায়, হায় আমাদের কী হবে?' আমি কান্নাভেজা স্বরে মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'আমরাও কি মরে যাব?' পরের দিন সকালে লিয়াকত আলী খান আর আমার স্মৃতিতে থাকলেন না। আমি রঙিন ঘুড্ডি কিনতে দৌড়ালাম বাড়ির পাশের দোকানে। কাজেই বেগম শামসুন নাহার মাহমুদের পরাজয় কিংবা লিয়াকত আলী খানের মৃত্যু আমাকে বেশি দিন দুঃখ ভারাক্রান্ত রাখতে পারেনি। গেণ্ডারিয়া পাড়ায় আসার পর ক্রমে আবিষ্কার করলাম গোটা পাড়াটাই যেন একটা বিশাল বাড়ি আর সেই বিশাল বাড়ির একেকটি প্রকোষ্ঠ হচ্ছে বিভিন্ন বাসা। অতএব, আমাদের সবার সব বাড়ির ভেতর অবাধে ঢুকে পড়ার স্বাধীনতা ছিল। এভাবে সমবয়সীদের ছাড়িয়ে বড়দের সঙ্গেও এক ধরনের সখ্য গড়ে উঠল। প্রত্যেকেই আমাদের স্নেহের চোখে দেখতেন। অজয়দের বাড়িতে তার দুই দিদি, মনিষাদি এবং মমতাদি পড়াশোনায় অত্যন্ত ভালো ছিলেন। তাঁরা আমাকে খুব স্নেহ করতেন। শুনেছি ভারতে তাঁরা দুজনেই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হয়েছিলেন। আমাদের বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে বাস করতেন শ্রী দ্বারকানাথ বারোরী। তিনি মুসলিম লীগের আমলে পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিলেন এবং মন্ত্রীও হয়েছিলেন। তবে আমরা যখন তাঁকে গেণ্ডারিয়ায় দেখেছি তখন তিনি মন্ত্রী ছিলেন না। আমার বাবার সঙ্গে তাঁর বন্ধুতা ছিল। তাঁর সবচেয়ে ছোট ছেলে সদানন্দ বারোরী ছিল আমার বন্ধু। ওরা ছিল মেলা ভাইবোন। সবার সঙ্গেই আমাদের সুসম্পর্ক ছিল। ওই পরিবারের, আমার স্মৃতি যদি শঠতা না করে, সবচেয়ে বড় ছেলের নাম মৃণাল কান্তি বারোরী। আমরা যখন গেণ্ডারিয়ায় থাকতে যাই, তখন মৃণালদা আন্ডারগ্রাউন্ডে। তিনি তাঁদের অঞ্চল গোপালগঞ্জের গ্রামে গ্রামে কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতি করতেন। যদিও শ্রী দ্বারকানাথ বারোরীদের বাড়িতে মৃণালদার নাম কখনো উচ্চারিত হতো না, কেমন একটা রহস্যময় নীরবতা ঘিরে থাকত তাঁকে। তবুও ওই বালক বয়সেও আমরা বেশ রোমাঞ্চিত হতাম।
(চলবে)
লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments