গার্মেন্ট শ্রমিকের স্বার্থে মালিকদের বাগড়া by আবুল কাশেম
শ্রমিকদের সুবিধা বৃদ্ধি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার শ্রম আইন ২০০৬ সংশোধন করতে যাচ্ছে। এ জন্য ৫৪টি ধারা পরিবর্তন বা সংযোজন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংশোধিত আইন হলে প্রায় সব ক্ষেত্রে শ্রমিকদের সুবিধা দ্বিগুণ হবে।
কিন্তু মালিকপক্ষ তাতে জোর আপত্তি তুলেছে। গত ১৫ মার্চ সংশোধিত খসড়া আইনের ওপর শিল্প মালিকদের মতামত দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা না দিয়ে মালিকরা দেখা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে এবং তাঁদের আপত্তির কথা জানান।
মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি মো. ফজলুল হক ও এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বলেন, তাঁরা এ আইন সংশোধনের বিপক্ষে। এমন কোনো আইন করা ঠিক হবে না, যা সব মালিকের পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। একাধিক মন্ত্রীর কাছেও তাঁরা বলেছেন একই কথা। গত সপ্তাহে এমপ্লয়ার্স ফেডারেশন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে তাদের মতামত দেয় বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির সভাপতি। আর গার্মেন্ট মালিকদের বড় সংগঠন বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি- বিজিএমইএ খসড়া আইনের বিরোধিতা করে মতামত জমা দেয় তারও আগে। খসড়া আইনের চাকরিবিধিতে শ্রমিকদের যেসব সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছে সরকার, তার সব কিছুতেই বাগড়া দিয়ে বিজিএমইএ বলেছে, এসব সুযোগ দেওয়া হলে পোশাক খাত ধ্বংস হয়ে যাবে।
বিজিএমইএ সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সরকার শ্রম আইনে শ্রমিকদের সুবিধা নিয়ে আমাদের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলছে যেন আইয়ুব খান আর শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে।' বিজিএমইএর আপত্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে শ্রমমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কোনো জিনিসে আপত্তি না জানালে তো বোঝা যাবে না যে তারা বিজিএমইএ।'
সাধারণ কর্মঘণ্টা : ২০০৬ সালের আইনে বলা ছিল দুপুরের আহার ও বিশ্রামের (টিফিন) সময় বাদে আট ঘণ্টা হবে শ্রমিকের কর্মঘণ্টা। সংশোধনী আইনের খসড়ায় আহার ও বিশ্রামসহ কর্মঘণ্টা আট ঘণ্টা করার পক্ষে সরকার। এ ক্ষেত্রে শ্রমিক কাজ করবে মোট সাত ঘণ্টা। এতে আপত্তি জানিয়ে বিজিএমইএ বলছে, দেশের মোট শ্রমিক শ্রেণীর উৎপাদনকাজ এক ঘণ্টা কমলে ঘণ্টায় যদি ২০ টাকাও গড় উৎপাদন ধরা হয়, বছরে উৎপাদন ঘাটতি হবে আনুমানিক প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার।
এ ধরনের বিষয় সস্তা আবেগ দিয়ে নয়, ঠাণ্ডা মাথায় অর্থনীতি ও গণিতের মেধা দিয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে- এ মত দিয়ে বিজিএমইএ বলেছে, আইনে এ ধরনের সংশোধনী আনা হলে পোশাক শিল্পে দৈনিক প্রায় ৪০ লাখ কর্মঘণ্টা কমবে। তাতে শুধু রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পে দৈনিক প্রায় ১১ কোটি ৫৩ লাখ ৮৫ হাজার টাকার উৎপাদন কম হবে এবং বছর হিসাবে অঙ্কটি দাঁড়ায় প্রায় তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা। 'এ সংশোধন কোনো রকমেই বাঞ্ছনীয় নয়' মন্তব্য করে বিজিএমই আরো বলেছে, এ ধরনের সংশোধনীর ফলে রপ্তানি অর্ডার বাতিল হবে, স্টকলট বাড়বে। ধস নামবে জিডিপিতে।
গ্র্যাচুইটি : ২০০৬ সালের আইনে আছে, কোনো শ্রমিকের প্রতি পূর্ণ বছর চাকরি বা ছয় মাসের অতিরিক্ত সময়ের চাকরির জন্য চাকরি অবসানের সময় কমপক্ষে ৩০ দিনের বেতন শ্রমিককে গ্র্যাচুইটি হিসেবে মালিক পরিশোধ করবেন। এটি এ আইনের অধীন শ্রমিকের বিভিন্নভাবে চাকরি অবসানজনিত কারণে মালিকের দেওয়া ক্ষতিপূরণ বা নোটিশের পরিবর্তে দেওয়া মজুরি বা ভাতার অতিরিক্ত হবে। সংশোধিত আইনে শ্রমিকদের গ্র্যাচুইটি সুবিধা ৩০ দিনের মজুরির বদলে ৬০ দিনের মজুরির কথা বলেছে সরকার। এ সংশ্লিষ্ট ধারায় আরো যোগ করা হয়, বেসরকারি খাতের কোনো প্রতিষ্ঠানের তিন-চতুর্থাংশ শ্রমিক লিখিতভাবে আবেদন করলে প্রতিষ্ঠানটি তার শ্রমিকদের সুবিধার জন্য গ্র্যাচুইটি স্কিম গঠন করতে বাধ্য থাকবে। তবে এ সংশোধনীরও বিরোধিতা করেছে বিজিএমইএ।
বিজিএমইএ আগের ধারা বহাল রাখার দাবি জানিয়ে বলেছে, বিদ্যমান আইনে গ্র্যাচুইটি হলো ৩০ দিনের মজুরি এবং তা মালিকরা ইচ্ছা করলে দিতে পারেন, নাও পারেন। এখন তা বাড়িয়ে বছরে ৬০ দিনের মজুরি নির্ধারণ করাসহ তা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। বিজিএমইএ উদ্যোগটির সমালোচনা করে বলেছে, 'এ সুবিধার কিছু কিছু জাতীয়করণকৃত রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিভিন্ন করপোরেশনের অধীন কল-কারখানায় বিদ্যমান। রাষ্ট্রায়ত্ত সব কল-কারখানা 'আদমজী জুট মিল' হয়েছে অথবা হওয়ার পর্যায়ে আছে। প্রায় সব পাটকল বন্ধ হয়েছে এবং অনেক পাটকল-বস্ত্রকল অত্যন্ত নিম্নমানের। বন্ধ মিলগুলোর জমিতে ঘুঘু চরছে।'
এ ধারার বিরোধিতা করে বিজিএমইএ আরো বলেছে, 'যেসব অযৌক্তিক সুবিধা, অনাচার, অব্যবস্থাপনা, দায়িত্বহীনতা, জবাবদিহিতার অভাব ওই সব রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা ধ্বংস করেছে, আমরা আমাদের উদ্যোগ, মেধা, শ্রম ঘামে, ঘরবাড়ি বন্ধকের সঙ্গে তিল তিল করে গড়ে তোলা ব্যক্তি উদ্যোগের কল-কারখানা প্রতিষ্ঠানকে তার মুখোমুখি করতে চাই না। তৈরি পোশাক শিল্পসহ এসব ব্যক্তি উদ্যোগ ধ্বংস করে জাতির কী লাভ, আমরা বুঝি না। প্রচলিত বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর অতিরিক্ত কোনো অযৌক্তিক বিধান করার যেকোনো অপচেষ্টা ধ্বংসাত্মক হবে বলে মনে করি।'
মৃত্যুর ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ : ২০০৬ সালের আইনে বলা হয়েছে, শ্রমিক তিন বছরের বেশি সময় চাকরির পর কর্মরত থাকা অবস্থায় মারা গেলে মালিকপক্ষ ওই শ্রমিকের মনোনীত ব্যক্তি বা পোষ্যকে প্রতি পূর্ণ বছর বা তার ছয় মাসের বেশি সময় চাকরির জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৩০ দিনের মজুরি বা গ্র্যাচুইটি, যা অধিক হবে, তা পরিশোধ করবে। সংশোধিত আইনের খসড়ায় বলা হয়, ৬০ দিনের মজুরি বা গ্র্যাচুইটি, যা বেশি হবে, তাই পরিশোধ করবে। বিজিএমইএ আগের ধারাটিই বহাল রাখার প্রস্তাব করে বলেছে, মৃত্যুজনিত সুবিধা ন্যূনতম হিসাবে রাখা উচিত, যাতে সব প্রতিষ্ঠান দিতে সক্ষম হয়। নতুন সংশোধনী বাস্তবায়িত হলে মালিকরা ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হবেন।
২০০৬ সালের আইনের ১ ধারায় বলা আছে, দুর্ঘটনার কারণে মৃত্যু হলে ক্ষতিপূরণ এক লাখ টাকা এবং স্থায়ীভাবে সম্পূর্ণ অক্ষমতার কারণে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সংশোধিত খসড়ায় দুর্ঘটনার কারণে মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ বাড়িয়ে দুই লাখ টাকা এবং স্থায়ীভাবে সম্পূর্ণ অক্ষমতার কারণে ক্ষতিপূরণ আড়াই লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিজিএমইএ এখনকার আইনটিই বহাল রাখার সুপারিশ করেছে।
ছাঁটাইয়ের ক্ষতিপূরণ : শ্রম আইন ২০০৬-এর ধারা ২০-এর (২) (গ) অনুযায়ী, ছাঁটাই করা শ্রমিককে ক্ষতিপূরণ বাবদ তার প্রত্যেক বছর চাকরির জন্য ৩০ দিনের মজুরি বা গ্র্যাচুইটির মধ্যে যেটি বেশি হবে, তা পরিশোধ করতে হবে। সংশোধিত খসড়ায় ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৬০ দিনের মজুরি বা গ্র্যাচুইটির মধ্যে যেটি বেশি হবে তা পরিশোধের কথা বলা হয়েছে। আর বিজিএমইএ তাদের প্রস্তাবে বলেছে, শ্রমিকের চাকরি কোনো প্রতিষ্ঠানে পাঁচ বছর পূর্ণ হলে প্রতিবছর চাকরির জন্য ১৫ দিনের মজুরি, আর ১০ বছর চাকরি করলে প্রতিবছরে ৩০ দিনের মজুরি বা গ্র্যাচুইটির মধ্যে যেটি বেশি হবে, সেটি তারা পরিশোধ করবে। বিজিএমইএ সরকারের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেছে, শ্রম আইন সংশোধন করে হঠাৎ কোনো ক্ষতিপূরণ দ্বিগুণ করা হলে অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিক কারখানা চালাতে না পেরে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন।
অপসারণ হলে : বিদ্যমান আইনে বলা আছে, নিবন্ধন চিকিৎসক কোনো শ্রমিককে শারীরিক বা মানসিক অসক্ষম বললে শ্রমিককে চাকরি থেকে অপসারণ করা যাবে। এ ক্ষেত্রে বরখাস্ত হওয়া শ্রমিক কমপক্ষে এক বছর অবিচ্ছিন্ন চাকরি সম্পূর্ণ করলে তার প্রতিবছর চাকরির জন্য মালিক ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৩০ দিনের মজুরি বা গ্র্যাচুইটির মধ্যে যেটি বেশি হবে, তা পরিশোধ করবেন। সংশোধিত আইনের খসড়ায় প্রতিবছর চাকরির জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৬০ দিনের মজুরি বা গ্র্যাচুইটির মধ্যে যেটি বেশি, তা পরিশোধের কথা বলা হয়েছে। তবে শ্রমিকদের এই সুবিধাও বাড়ানোর বিপক্ষে বিজিএমইএ। তারা বলছে, ৩০ দিনের মজুরি বা গ্র্যাচুইটি পেতে হলে বরখাস্ত হওয়া শ্রমিককে ওই কারখানায় কমপক্ষে তিন বছর অবিচ্ছিন্নভাবে চাকরি করতে হবে।
অন্য কোনো কারণে বরখাস্ত করা প্রসঙ্গে বিদ্যমান আইনে বলা আছে, মালিক শ্রমিককে তার প্রত্যেক পূর্ণ বছরের চাকরির জন্য ক্ষতিপূরণ বাবদ ৩০ দিনের মজুরি বা গ্র্যাচুইটির মধ্যে যা বেশি হবে, তা পরিশোধ করবেন। খসড়া প্রতিবছর চাকরির জন্য ৬০ দিনের মজুরির কথা বলা হলেও বিজিএমইএ ৩০ দিনের মজুরি দেওয়ার বিষয়টি বহাল রাখতে বলেছে। বিজিএমইএর মতামত হলো- নতুন সংশোধনী যোগ করা হলে অবাধ্য শ্রমিকরা অহেতুক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে টার্মিনেশন বেনিফিট (চাকরি অবসানজনিত সুবিধা) গ্রহণে উৎসাহিত হবে। শ্রমিকদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার প্রবণতা বৃদ্ধিসহ মালিক-শ্রমিক সুসম্পর্কেরও অবনতি ঘটবে। মালিকরা অতিরিক্ত অর্থ দিতে বাধ্য হয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
মন্ত্রণালয়কে বিজিএমইএ আরো বলেছে, 'পাকিস্তানি, ভারতীয় নাগরিক বিভিন্ন বেনামে বা ছদ্মনামে এ দেশের পোশাক শিল্পে কাজ করছে বলে প্রমাণ রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন উগ্রপন্থী এনজিও, শ্রমিক নেতা নামধারীর অপতৎপরতার কারণে এ শিল্পে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা চালানোর চেষ্টা করে আসছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিক নামধারী একটি সংঘবদ্ধ দল অনাহূত কিছু কারণ দেখিয়ে কারখানায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার পাঁয়তারায় লিপ্ত। এরা এক কারখানা থেকে ক্ষতিপূরণসহ সুবিধা আদায় করে দলবেঁধে অন্য কারখানায় যোগদান করে।'
চাকরি ছেড়ে দেওয়া : ২০০৬ সালের আইনে বলা আছে, কোনো শ্রমিক ৬০ দিনের লিখিত নোটিশ দিয়ে চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে অস্থায়ী কিন্তু মাসিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োজিত শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ৩০ দিনের ও অন্য শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ১৪ দিনের মজুরি মালিক পরিশোধ করবেন। আর কোনো স্থায়ী শ্রমিক নিজে চাকরি থেকে ইস্তফা দিলে তিনি পাঁচ বছর থেকে ১০ বছরের কম সময় পর্যন্ত চাকরি করলে প্রতিবছরের জন্য ১৪ দিনের মজুুরি আর ১০ বছরের বেশি সময় চাকরি করলে প্রতিবছরের জন্য ৩০ দিনের মজুরির সমান অর্থ পাবেন। সংশোধিত আইনে বলা হয়েছে, পাঁচ বছরের বেশি ও ১০ বছরের কম চাকরির জন্য প্রতিবছরের জন্য ৩০ দিনের এবং ১০ বছর বা এর বেশি সময় চাকরি করলে প্রতিবছরের জন্য ৬০ দিনের মজুরি পরিশোধ করতে হবে। বিজিএমইএ এ সুবিধায় বাগড়া দিয়ে বলেছে, 'স্বার্থলোভী কিছু শ্রমিক আছে এক কারখানায় চাকরিরত অবস্থায় মজুরি গ্রহণ করে অন্য কারখানায় বাড়তি মজুরিতে যোগদান করে। পরে আগের কারখানার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বের করে দেওয়ার অভিযোগ তুলে টার্মিনেশন বেনিফিট দাবি করে কিছু এনজিও বা ফেডারেশনের মাধ্যমে শ্রম আদালতে মামলা দায়ের করে।'
গ্রুপ বীমা চালু : ২০০৬ সালের শ্রম আইনে বলা আছে, কোনো প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে ২০০ স্থায়ী শ্রমিক কর্মরত থাকলে সেখানে সরকার বিধি মোতাবেক নির্ধারিত পদ্ধতিতে গ্রুপ বীমা চালু করতে পারবে। সংশোধিত আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, এই গ্রুপ বীমা চালু করবে মালিকপক্ষ। আর শ্রমিক মারা গেলে বীমার অর্থ আদায় মালিকেরই দায়িত্ব হবে। মালিক বীমা দাবি থেকে আদায় করা অর্থ মৃত শ্রমিকের পোষ্যদের সরাসরি দেবেন, না হয় শ্রম আদালতে পাঠাবেন। বিজিএমইএ খসড়ার প্রস্তাব না মেনে আগেরটিই বহাল রাখার সুপারিশ করেছে।
এ ছাড়া শ্রম আইন অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠানের মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণে ব্যয় করার বিধান বাতিলের সুপারিশ করে বিজিএমইএ বলেছে, কারখানার ওপর অতিরিক্ত চাপে শ্রম অসন্তোষের সৃষ্টি হবে। তাই লাভের ৫ শতাংশ অর্থ দেওয়ার পরিবর্তে শ্রমিকপ্রতি বার্ষিক ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত নির্দিষ্ট অঙ্ক ধার্য করা যেতে পারে। পোশাক মালিকদের ওই সংগঠন আরো বলেছে, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে মালিকদের সমান অর্থ সরকারকেও দিতে হবে। পরে এসব অর্থ দিয়ে শ্রমিকদের জন্য হাসপাতাল, আবাসন এবং স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা নির্মাণ করা যেতে পারে। আর কম্পানির মুনাফায় শ্রমিকদের যে ৫ শতাংশ ভোগের অধিকার আইনে রয়েছে, তা রপ্তানিমুখী শিল্প বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করা যাবে না।
কর্মঘণ্টা, ওভারটাইম : বিদ্যমান আইনের ১০৮ ধারা মতে, অতিরিক্ত কাজের জন্য শ্রমিক তাঁর মূল মজুরি ও মহার্ঘভাতা এবং অ্যাডহক বা অন্তর্বর্তী মজুরির সাধারণ হারের দ্বিগুণ হারে ভাতা পাবেন। খসড়াতেও এখানে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। তবে বিজিএমইএ বলছে, সাধারণ মজুরি নয়, মূল মজুরির দ্বিগুণ হারে ভাতা দেওয়া হবে। সংগঠনটি বলছে, সোয়েটার কারখানায় পিস রেট হিসেবে শ্রমিকরা কাজ করেন। চুক্তিমূল্যে প্রতি পিসের শ্রমমূল্য ১০ টাকা ধরা হলে প্রথম আট ঘণ্টায় কোনো শ্রমিক ৩০ পিস উৎপাদন করে ৩০০ টাকা রোজগার করলেন। সেখানে দ্বিগুণ হারে অতিরিক্ত সময়ের মজুরি দিতে গেলে পিসপ্রতি শ্রমমূল্য ২০ টাকা হারে দিতে হবে, যা বাস্তবসম্মত নয়।
সংশোধিত শ্রম আইনে একটি নতুন ধারা (১০০) যোগ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ধারায় বলা হয়েছে, কোনো প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিক কোনো প্রতিষ্ঠানে সাধারণত বিরতি ও আহারের সময়সহ দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি সময় কাজ করবেন না বা তাঁকে দিয়ে কাজ করানো যাবে না। তবে ওভারটাইম ভাতা দেওয়া হলে একজন শ্রমিককে দৈনিক ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করানো যাবে। বিজিএমইএ এ ক্ষেত্রে দৈনিক সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে। বিজিএমইএ বলেছে, দৈনিক ১০ ঘণ্টার বদলে ১২ ঘণ্টা করা হলে পোশাক শিল্পের রপ্তানি অনেক বাড়বে।
শ্রম আইনে নতুন করে আরেকটি ধারা (১০২) যোগ করতে চায় সরকার। এতে রয়েছে, একজন শ্রমিককে সপ্তাহে ৬০ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না। খসড়ার নতুন আরেকটি ধারায় (১০৫) রয়েছে, ওভারটাইম দেওয়া হলেও একজন শ্রমিককে আহার ও বিশ্রামের বিরতিসহ দৈনিক ১১ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না। আর বিজিএমইএ চাইছে, আহার ও বিশ্রামের বিরতি বাদেই যেন দৈনিক ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করানো যায়।
খসড়ায় নতুন আরেক ধারায় (১১৮) বলা হয়, প্রত্যেক শ্রমিককে প্রতি পঞ্জিকা বছরে মজুরিসহ ১১ দিনের উৎসব ছুটি দিতে হবে। কোনো শ্রমিককে উৎসব ছুটির দিনে কাজ করতে বলা যাবে, তবে এ জন্য দুদিনের মজুরিসহ ক্ষতিপূরণ ছুটি ও একটি বিকল্প ছুটি দিতে হবে। বিজিএমইএ দুদিনের মজুরির সঙ্গে একটি বিকল্প ছুটি দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। তারা ক্ষতিপূরণ ছুটি দিতে রাজি নয়।
ভবিষ্যৎ তহবিল গঠন : ২০০৬ সালের আইনে শ্রমিকদের জন্য ভবিষ্যৎ তহবিল গঠনে মালিকদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল না। খসড়ায় বলা হয়েছে, বেসরকারি খাতের কোনো প্রতিষ্ঠান চালুর দুই বছরের মধ্যে এ তহবিল গঠন করতে বাধ্য থাকবে। এ তহবিলের অর্থ ট্রাস্টি বোর্ড নির্ধারিত তহবিলে বিনিয়োগ করা যাবে। বিজিএমইএ বলেছে, ওই প্রতিষ্ঠানের চার ভাগের তিন ভাগ শ্রমিক লিখিত ও সরকার অনুমোদিত বিনিয়োগযোগ্য কোনো আবেদন করলে প্রতিষ্ঠান চালুর তিন বছরের মধ্যে ভবিষ্যৎ তহবিল গঠন করবে। তবে ওই তহবিলে শ্রমিকদের মজুরির ১ থেকে ২ শতাংশ হারে জমা দিতে হবে। মালিকও একই হারে দেবেন।
'আমরা ঠকাতে চাই না' : যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি মো. ফজলুল হক গতকাল শুক্রবার কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁরা মালিকদের আপত্তির কথা গত সপ্তাহে লিখিতভাবে মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন। তিনি বলেন, 'আমরা মালিকদের অসুবিধার কথা প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও সচিবকে বলেছি। জানিয়েছি খসড়া আইন মালিকদের পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব না। তবে আমরা শ্রমিকদেরও ঠকাতে চাই না। এমন সহনীয় আইন করতে হবে, যাতে সব খাতের মালিকরাই তা বাস্তবায়ন করতে পারেন।'
বিজিএমইএর সভাপতি মো. সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, 'সরকার শ্রম আইনে শ্রমিকদের সুবিধা নিয়ে আমাদের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলছে যেন আইয়ুব খান আর শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। এমনিতেই গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই। লোকসান গুনে মালিকরা কারখানা চালিয়ে রাখছেন। এ অবস্থায় শ্রমিকদের সুবিধা দ্বিগুণ করা হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প মালিকদের পক্ষে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।'
তবে মালিকদের এসব আপত্তি আমলে নেবেন না শ্রমমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মালিকরা জুজুর ভয় করছে। শ্রম আইন যুগোপযোগী করা সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার। প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ সব সময়ই শ্রমিকবান্ধব।' বিজিএমইএর আপত্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বিজিএমইএর প্রস্তাব আমি এখনো দেখিনি। তবে আপত্তি না করলে মানুষ তো বুঝবে যে তারা বিজিএমইএ।'
« পূর্ববর্তী সংবাদ
মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি মো. ফজলুল হক ও এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি এ কে আজাদ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বলেন, তাঁরা এ আইন সংশোধনের বিপক্ষে। এমন কোনো আইন করা ঠিক হবে না, যা সব মালিকের পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। একাধিক মন্ত্রীর কাছেও তাঁরা বলেছেন একই কথা। গত সপ্তাহে এমপ্লয়ার্স ফেডারেশন শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে তাদের মতামত দেয় বলে জানিয়েছেন সংগঠনটির সভাপতি। আর গার্মেন্ট মালিকদের বড় সংগঠন বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি- বিজিএমইএ খসড়া আইনের বিরোধিতা করে মতামত জমা দেয় তারও আগে। খসড়া আইনের চাকরিবিধিতে শ্রমিকদের যেসব সুবিধা দেওয়ার কথা বলেছে সরকার, তার সব কিছুতেই বাগড়া দিয়ে বিজিএমইএ বলেছে, এসব সুযোগ দেওয়া হলে পোশাক খাত ধ্বংস হয়ে যাবে।
বিজিএমইএ সভাপতি সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'সরকার শ্রম আইনে শ্রমিকদের সুবিধা নিয়ে আমাদের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলছে যেন আইয়ুব খান আর শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে।' বিজিএমইএর আপত্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে শ্রমমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, 'কোনো জিনিসে আপত্তি না জানালে তো বোঝা যাবে না যে তারা বিজিএমইএ।'
সাধারণ কর্মঘণ্টা : ২০০৬ সালের আইনে বলা ছিল দুপুরের আহার ও বিশ্রামের (টিফিন) সময় বাদে আট ঘণ্টা হবে শ্রমিকের কর্মঘণ্টা। সংশোধনী আইনের খসড়ায় আহার ও বিশ্রামসহ কর্মঘণ্টা আট ঘণ্টা করার পক্ষে সরকার। এ ক্ষেত্রে শ্রমিক কাজ করবে মোট সাত ঘণ্টা। এতে আপত্তি জানিয়ে বিজিএমইএ বলছে, দেশের মোট শ্রমিক শ্রেণীর উৎপাদনকাজ এক ঘণ্টা কমলে ঘণ্টায় যদি ২০ টাকাও গড় উৎপাদন ধরা হয়, বছরে উৎপাদন ঘাটতি হবে আনুমানিক প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার।
এ ধরনের বিষয় সস্তা আবেগ দিয়ে নয়, ঠাণ্ডা মাথায় অর্থনীতি ও গণিতের মেধা দিয়ে বিশ্লেষণ করতে হবে- এ মত দিয়ে বিজিএমইএ বলেছে, আইনে এ ধরনের সংশোধনী আনা হলে পোশাক শিল্পে দৈনিক প্রায় ৪০ লাখ কর্মঘণ্টা কমবে। তাতে শুধু রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পে দৈনিক প্রায় ১১ কোটি ৫৩ লাখ ৮৫ হাজার টাকার উৎপাদন কম হবে এবং বছর হিসাবে অঙ্কটি দাঁড়ায় প্রায় তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা। 'এ সংশোধন কোনো রকমেই বাঞ্ছনীয় নয়' মন্তব্য করে বিজিএমই আরো বলেছে, এ ধরনের সংশোধনীর ফলে রপ্তানি অর্ডার বাতিল হবে, স্টকলট বাড়বে। ধস নামবে জিডিপিতে।
গ্র্যাচুইটি : ২০০৬ সালের আইনে আছে, কোনো শ্রমিকের প্রতি পূর্ণ বছর চাকরি বা ছয় মাসের অতিরিক্ত সময়ের চাকরির জন্য চাকরি অবসানের সময় কমপক্ষে ৩০ দিনের বেতন শ্রমিককে গ্র্যাচুইটি হিসেবে মালিক পরিশোধ করবেন। এটি এ আইনের অধীন শ্রমিকের বিভিন্নভাবে চাকরি অবসানজনিত কারণে মালিকের দেওয়া ক্ষতিপূরণ বা নোটিশের পরিবর্তে দেওয়া মজুরি বা ভাতার অতিরিক্ত হবে। সংশোধিত আইনে শ্রমিকদের গ্র্যাচুইটি সুবিধা ৩০ দিনের মজুরির বদলে ৬০ দিনের মজুরির কথা বলেছে সরকার। এ সংশ্লিষ্ট ধারায় আরো যোগ করা হয়, বেসরকারি খাতের কোনো প্রতিষ্ঠানের তিন-চতুর্থাংশ শ্রমিক লিখিতভাবে আবেদন করলে প্রতিষ্ঠানটি তার শ্রমিকদের সুবিধার জন্য গ্র্যাচুইটি স্কিম গঠন করতে বাধ্য থাকবে। তবে এ সংশোধনীরও বিরোধিতা করেছে বিজিএমইএ।
বিজিএমইএ আগের ধারা বহাল রাখার দাবি জানিয়ে বলেছে, বিদ্যমান আইনে গ্র্যাচুইটি হলো ৩০ দিনের মজুরি এবং তা মালিকরা ইচ্ছা করলে দিতে পারেন, নাও পারেন। এখন তা বাড়িয়ে বছরে ৬০ দিনের মজুরি নির্ধারণ করাসহ তা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। বিজিএমইএ উদ্যোগটির সমালোচনা করে বলেছে, 'এ সুবিধার কিছু কিছু জাতীয়করণকৃত রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিভিন্ন করপোরেশনের অধীন কল-কারখানায় বিদ্যমান। রাষ্ট্রায়ত্ত সব কল-কারখানা 'আদমজী জুট মিল' হয়েছে অথবা হওয়ার পর্যায়ে আছে। প্রায় সব পাটকল বন্ধ হয়েছে এবং অনেক পাটকল-বস্ত্রকল অত্যন্ত নিম্নমানের। বন্ধ মিলগুলোর জমিতে ঘুঘু চরছে।'
এ ধারার বিরোধিতা করে বিজিএমইএ আরো বলেছে, 'যেসব অযৌক্তিক সুবিধা, অনাচার, অব্যবস্থাপনা, দায়িত্বহীনতা, জবাবদিহিতার অভাব ওই সব রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা ধ্বংস করেছে, আমরা আমাদের উদ্যোগ, মেধা, শ্রম ঘামে, ঘরবাড়ি বন্ধকের সঙ্গে তিল তিল করে গড়ে তোলা ব্যক্তি উদ্যোগের কল-কারখানা প্রতিষ্ঠানকে তার মুখোমুখি করতে চাই না। তৈরি পোশাক শিল্পসহ এসব ব্যক্তি উদ্যোগ ধ্বংস করে জাতির কী লাভ, আমরা বুঝি না। প্রচলিত বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এর অতিরিক্ত কোনো অযৌক্তিক বিধান করার যেকোনো অপচেষ্টা ধ্বংসাত্মক হবে বলে মনে করি।'
মৃত্যুর ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ : ২০০৬ সালের আইনে বলা হয়েছে, শ্রমিক তিন বছরের বেশি সময় চাকরির পর কর্মরত থাকা অবস্থায় মারা গেলে মালিকপক্ষ ওই শ্রমিকের মনোনীত ব্যক্তি বা পোষ্যকে প্রতি পূর্ণ বছর বা তার ছয় মাসের বেশি সময় চাকরির জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৩০ দিনের মজুরি বা গ্র্যাচুইটি, যা অধিক হবে, তা পরিশোধ করবে। সংশোধিত আইনের খসড়ায় বলা হয়, ৬০ দিনের মজুরি বা গ্র্যাচুইটি, যা বেশি হবে, তাই পরিশোধ করবে। বিজিএমইএ আগের ধারাটিই বহাল রাখার প্রস্তাব করে বলেছে, মৃত্যুজনিত সুবিধা ন্যূনতম হিসাবে রাখা উচিত, যাতে সব প্রতিষ্ঠান দিতে সক্ষম হয়। নতুন সংশোধনী বাস্তবায়িত হলে মালিকরা ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হবেন।
২০০৬ সালের আইনের ১ ধারায় বলা আছে, দুর্ঘটনার কারণে মৃত্যু হলে ক্ষতিপূরণ এক লাখ টাকা এবং স্থায়ীভাবে সম্পূর্ণ অক্ষমতার কারণে এক লাখ ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। সংশোধিত খসড়ায় দুর্ঘটনার কারণে মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ বাড়িয়ে দুই লাখ টাকা এবং স্থায়ীভাবে সম্পূর্ণ অক্ষমতার কারণে ক্ষতিপূরণ আড়াই লাখ টাকার প্রস্তাব করা হয়েছে। বিজিএমইএ এখনকার আইনটিই বহাল রাখার সুপারিশ করেছে।
ছাঁটাইয়ের ক্ষতিপূরণ : শ্রম আইন ২০০৬-এর ধারা ২০-এর (২) (গ) অনুযায়ী, ছাঁটাই করা শ্রমিককে ক্ষতিপূরণ বাবদ তার প্রত্যেক বছর চাকরির জন্য ৩০ দিনের মজুরি বা গ্র্যাচুইটির মধ্যে যেটি বেশি হবে, তা পরিশোধ করতে হবে। সংশোধিত খসড়ায় ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৬০ দিনের মজুরি বা গ্র্যাচুইটির মধ্যে যেটি বেশি হবে তা পরিশোধের কথা বলা হয়েছে। আর বিজিএমইএ তাদের প্রস্তাবে বলেছে, শ্রমিকের চাকরি কোনো প্রতিষ্ঠানে পাঁচ বছর পূর্ণ হলে প্রতিবছর চাকরির জন্য ১৫ দিনের মজুরি, আর ১০ বছর চাকরি করলে প্রতিবছরে ৩০ দিনের মজুরি বা গ্র্যাচুইটির মধ্যে যেটি বেশি হবে, সেটি তারা পরিশোধ করবে। বিজিএমইএ সরকারের প্রস্তাবের বিরোধিতা করে বলেছে, শ্রম আইন সংশোধন করে হঠাৎ কোনো ক্ষতিপূরণ দ্বিগুণ করা হলে অনেক প্রতিষ্ঠানের মালিক কারখানা চালাতে না পেরে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন।
অপসারণ হলে : বিদ্যমান আইনে বলা আছে, নিবন্ধন চিকিৎসক কোনো শ্রমিককে শারীরিক বা মানসিক অসক্ষম বললে শ্রমিককে চাকরি থেকে অপসারণ করা যাবে। এ ক্ষেত্রে বরখাস্ত হওয়া শ্রমিক কমপক্ষে এক বছর অবিচ্ছিন্ন চাকরি সম্পূর্ণ করলে তার প্রতিবছর চাকরির জন্য মালিক ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৩০ দিনের মজুরি বা গ্র্যাচুইটির মধ্যে যেটি বেশি হবে, তা পরিশোধ করবেন। সংশোধিত আইনের খসড়ায় প্রতিবছর চাকরির জন্য ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৬০ দিনের মজুরি বা গ্র্যাচুইটির মধ্যে যেটি বেশি, তা পরিশোধের কথা বলা হয়েছে। তবে শ্রমিকদের এই সুবিধাও বাড়ানোর বিপক্ষে বিজিএমইএ। তারা বলছে, ৩০ দিনের মজুরি বা গ্র্যাচুইটি পেতে হলে বরখাস্ত হওয়া শ্রমিককে ওই কারখানায় কমপক্ষে তিন বছর অবিচ্ছিন্নভাবে চাকরি করতে হবে।
অন্য কোনো কারণে বরখাস্ত করা প্রসঙ্গে বিদ্যমান আইনে বলা আছে, মালিক শ্রমিককে তার প্রত্যেক পূর্ণ বছরের চাকরির জন্য ক্ষতিপূরণ বাবদ ৩০ দিনের মজুরি বা গ্র্যাচুইটির মধ্যে যা বেশি হবে, তা পরিশোধ করবেন। খসড়া প্রতিবছর চাকরির জন্য ৬০ দিনের মজুরির কথা বলা হলেও বিজিএমইএ ৩০ দিনের মজুরি দেওয়ার বিষয়টি বহাল রাখতে বলেছে। বিজিএমইএর মতামত হলো- নতুন সংশোধনী যোগ করা হলে অবাধ্য শ্রমিকরা অহেতুক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে টার্মিনেশন বেনিফিট (চাকরি অবসানজনিত সুবিধা) গ্রহণে উৎসাহিত হবে। শ্রমিকদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার প্রবণতা বৃদ্ধিসহ মালিক-শ্রমিক সুসম্পর্কেরও অবনতি ঘটবে। মালিকরা অতিরিক্ত অর্থ দিতে বাধ্য হয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
মন্ত্রণালয়কে বিজিএমইএ আরো বলেছে, 'পাকিস্তানি, ভারতীয় নাগরিক বিভিন্ন বেনামে বা ছদ্মনামে এ দেশের পোশাক শিল্পে কাজ করছে বলে প্রমাণ রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন উগ্রপন্থী এনজিও, শ্রমিক নেতা নামধারীর অপতৎপরতার কারণে এ শিল্পে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা চালানোর চেষ্টা করে আসছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিক নামধারী একটি সংঘবদ্ধ দল অনাহূত কিছু কারণ দেখিয়ে কারখানায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি করার পাঁয়তারায় লিপ্ত। এরা এক কারখানা থেকে ক্ষতিপূরণসহ সুবিধা আদায় করে দলবেঁধে অন্য কারখানায় যোগদান করে।'
চাকরি ছেড়ে দেওয়া : ২০০৬ সালের আইনে বলা আছে, কোনো শ্রমিক ৬০ দিনের লিখিত নোটিশ দিয়ে চাকরি থেকে ইস্তফা দিতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে অস্থায়ী কিন্তু মাসিক মজুরির ভিত্তিতে নিয়োজিত শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ৩০ দিনের ও অন্য শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ১৪ দিনের মজুরি মালিক পরিশোধ করবেন। আর কোনো স্থায়ী শ্রমিক নিজে চাকরি থেকে ইস্তফা দিলে তিনি পাঁচ বছর থেকে ১০ বছরের কম সময় পর্যন্ত চাকরি করলে প্রতিবছরের জন্য ১৪ দিনের মজুুরি আর ১০ বছরের বেশি সময় চাকরি করলে প্রতিবছরের জন্য ৩০ দিনের মজুরির সমান অর্থ পাবেন। সংশোধিত আইনে বলা হয়েছে, পাঁচ বছরের বেশি ও ১০ বছরের কম চাকরির জন্য প্রতিবছরের জন্য ৩০ দিনের এবং ১০ বছর বা এর বেশি সময় চাকরি করলে প্রতিবছরের জন্য ৬০ দিনের মজুরি পরিশোধ করতে হবে। বিজিএমইএ এ সুবিধায় বাগড়া দিয়ে বলেছে, 'স্বার্থলোভী কিছু শ্রমিক আছে এক কারখানায় চাকরিরত অবস্থায় মজুরি গ্রহণ করে অন্য কারখানায় বাড়তি মজুরিতে যোগদান করে। পরে আগের কারখানার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বের করে দেওয়ার অভিযোগ তুলে টার্মিনেশন বেনিফিট দাবি করে কিছু এনজিও বা ফেডারেশনের মাধ্যমে শ্রম আদালতে মামলা দায়ের করে।'
গ্রুপ বীমা চালু : ২০০৬ সালের শ্রম আইনে বলা আছে, কোনো প্রতিষ্ঠানে কমপক্ষে ২০০ স্থায়ী শ্রমিক কর্মরত থাকলে সেখানে সরকার বিধি মোতাবেক নির্ধারিত পদ্ধতিতে গ্রুপ বীমা চালু করতে পারবে। সংশোধিত আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, এই গ্রুপ বীমা চালু করবে মালিকপক্ষ। আর শ্রমিক মারা গেলে বীমার অর্থ আদায় মালিকেরই দায়িত্ব হবে। মালিক বীমা দাবি থেকে আদায় করা অর্থ মৃত শ্রমিকের পোষ্যদের সরাসরি দেবেন, না হয় শ্রম আদালতে পাঠাবেন। বিজিএমইএ খসড়ার প্রস্তাব না মেনে আগেরটিই বহাল রাখার সুপারিশ করেছে।
এ ছাড়া শ্রম আইন অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠানের মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিক কল্যাণে ব্যয় করার বিধান বাতিলের সুপারিশ করে বিজিএমইএ বলেছে, কারখানার ওপর অতিরিক্ত চাপে শ্রম অসন্তোষের সৃষ্টি হবে। তাই লাভের ৫ শতাংশ অর্থ দেওয়ার পরিবর্তে শ্রমিকপ্রতি বার্ষিক ৫০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত নির্দিষ্ট অঙ্ক ধার্য করা যেতে পারে। পোশাক মালিকদের ওই সংগঠন আরো বলেছে, শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে মালিকদের সমান অর্থ সরকারকেও দিতে হবে। পরে এসব অর্থ দিয়ে শ্রমিকদের জন্য হাসপাতাল, আবাসন এবং স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসা নির্মাণ করা যেতে পারে। আর কম্পানির মুনাফায় শ্রমিকদের যে ৫ শতাংশ ভোগের অধিকার আইনে রয়েছে, তা রপ্তানিমুখী শিল্প বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করা যাবে না।
কর্মঘণ্টা, ওভারটাইম : বিদ্যমান আইনের ১০৮ ধারা মতে, অতিরিক্ত কাজের জন্য শ্রমিক তাঁর মূল মজুরি ও মহার্ঘভাতা এবং অ্যাডহক বা অন্তর্বর্তী মজুরির সাধারণ হারের দ্বিগুণ হারে ভাতা পাবেন। খসড়াতেও এখানে কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। তবে বিজিএমইএ বলছে, সাধারণ মজুরি নয়, মূল মজুরির দ্বিগুণ হারে ভাতা দেওয়া হবে। সংগঠনটি বলছে, সোয়েটার কারখানায় পিস রেট হিসেবে শ্রমিকরা কাজ করেন। চুক্তিমূল্যে প্রতি পিসের শ্রমমূল্য ১০ টাকা ধরা হলে প্রথম আট ঘণ্টায় কোনো শ্রমিক ৩০ পিস উৎপাদন করে ৩০০ টাকা রোজগার করলেন। সেখানে দ্বিগুণ হারে অতিরিক্ত সময়ের মজুরি দিতে গেলে পিসপ্রতি শ্রমমূল্য ২০ টাকা হারে দিতে হবে, যা বাস্তবসম্মত নয়।
সংশোধিত শ্রম আইনে একটি নতুন ধারা (১০০) যোগ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ধারায় বলা হয়েছে, কোনো প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিক কোনো প্রতিষ্ঠানে সাধারণত বিরতি ও আহারের সময়সহ দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি সময় কাজ করবেন না বা তাঁকে দিয়ে কাজ করানো যাবে না। তবে ওভারটাইম ভাতা দেওয়া হলে একজন শ্রমিককে দৈনিক ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করানো যাবে। বিজিএমইএ এ ক্ষেত্রে দৈনিক সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টা নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে। বিজিএমইএ বলেছে, দৈনিক ১০ ঘণ্টার বদলে ১২ ঘণ্টা করা হলে পোশাক শিল্পের রপ্তানি অনেক বাড়বে।
শ্রম আইনে নতুন করে আরেকটি ধারা (১০২) যোগ করতে চায় সরকার। এতে রয়েছে, একজন শ্রমিককে সপ্তাহে ৬০ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না। খসড়ার নতুন আরেকটি ধারায় (১০৫) রয়েছে, ওভারটাইম দেওয়া হলেও একজন শ্রমিককে আহার ও বিশ্রামের বিরতিসহ দৈনিক ১১ ঘণ্টার বেশি কাজ করানো যাবে না। আর বিজিএমইএ চাইছে, আহার ও বিশ্রামের বিরতি বাদেই যেন দৈনিক ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করানো যায়।
খসড়ায় নতুন আরেক ধারায় (১১৮) বলা হয়, প্রত্যেক শ্রমিককে প্রতি পঞ্জিকা বছরে মজুরিসহ ১১ দিনের উৎসব ছুটি দিতে হবে। কোনো শ্রমিককে উৎসব ছুটির দিনে কাজ করতে বলা যাবে, তবে এ জন্য দুদিনের মজুরিসহ ক্ষতিপূরণ ছুটি ও একটি বিকল্প ছুটি দিতে হবে। বিজিএমইএ দুদিনের মজুরির সঙ্গে একটি বিকল্প ছুটি দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। তারা ক্ষতিপূরণ ছুটি দিতে রাজি নয়।
ভবিষ্যৎ তহবিল গঠন : ২০০৬ সালের আইনে শ্রমিকদের জন্য ভবিষ্যৎ তহবিল গঠনে মালিকদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল না। খসড়ায় বলা হয়েছে, বেসরকারি খাতের কোনো প্রতিষ্ঠান চালুর দুই বছরের মধ্যে এ তহবিল গঠন করতে বাধ্য থাকবে। এ তহবিলের অর্থ ট্রাস্টি বোর্ড নির্ধারিত তহবিলে বিনিয়োগ করা যাবে। বিজিএমইএ বলেছে, ওই প্রতিষ্ঠানের চার ভাগের তিন ভাগ শ্রমিক লিখিত ও সরকার অনুমোদিত বিনিয়োগযোগ্য কোনো আবেদন করলে প্রতিষ্ঠান চালুর তিন বছরের মধ্যে ভবিষ্যৎ তহবিল গঠন করবে। তবে ওই তহবিলে শ্রমিকদের মজুরির ১ থেকে ২ শতাংশ হারে জমা দিতে হবে। মালিকও একই হারে দেবেন।
'আমরা ঠকাতে চাই না' : যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ এমপ্লয়ার্স ফেডারেশনের সভাপতি মো. ফজলুল হক গতকাল শুক্রবার কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁরা মালিকদের আপত্তির কথা গত সপ্তাহে লিখিতভাবে মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন। তিনি বলেন, 'আমরা মালিকদের অসুবিধার কথা প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী ও সচিবকে বলেছি। জানিয়েছি খসড়া আইন মালিকদের পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব না। তবে আমরা শ্রমিকদেরও ঠকাতে চাই না। এমন সহনীয় আইন করতে হবে, যাতে সব খাতের মালিকরাই তা বাস্তবায়ন করতে পারেন।'
বিজিএমইএর সভাপতি মো. সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, 'সরকার শ্রম আইনে শ্রমিকদের সুবিধা নিয়ে আমাদের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলছে যেন আইয়ুব খান আর শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। এমনিতেই গ্যাস নেই, বিদ্যুৎ নেই। লোকসান গুনে মালিকরা কারখানা চালিয়ে রাখছেন। এ অবস্থায় শ্রমিকদের সুবিধা দ্বিগুণ করা হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প মালিকদের পক্ষে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।'
তবে মালিকদের এসব আপত্তি আমলে নেবেন না শ্রমমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'মালিকরা জুজুর ভয় করছে। শ্রম আইন যুগোপযোগী করা সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার। প্রধানমন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগ সব সময়ই শ্রমিকবান্ধব।' বিজিএমইএর আপত্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বিজিএমইএর প্রস্তাব আমি এখনো দেখিনি। তবে আপত্তি না করলে মানুষ তো বুঝবে যে তারা বিজিএমইএ।'
« পূর্ববর্তী সংবাদ
No comments