ভিন্নমত-‘আমাদের অতি প্রিয় বেগুনকে দূষিত করবেন না’ by শাকিল আহমেদ খান

গত ১৫ ফাল্গুন ১৪১৬ সংখ্যায় নারীনেত্রী ফরিদা আখতারের নিবন্ধ ‘আমাদের অতি প্রিয় বেগুনকে দূষিত করবেন না’ বিষয়টি নিয়ে একটু আলোকপাতের প্রয়োজন আছে বলে মনে করছি। নারীনেত্রী হিসেবে ফরিদা আখতার বাংলাদেশে বেশ পরিচিত একটি নাম।


পত্রিকায় তাঁর প্রকাশিত লেখা আমি সাধারণত পড়ে থাকি। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সঙ্গে আমার কোনো পরিচয় নেই। তাঁর লেখা পড়ে আমার সব সময় যেটা মনে হয় সেটা হচ্ছে, তিনি এ দেশ ও এ দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য একজন অতি নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিত্ব। এই অতি নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিত্ব হওয়ার কারণেই বোধ হয় তাঁর কোনো কোনো লেখা কিছুটা অতিরঞ্জিত হয়ে পড়ে বলে আমার ধারণা। বেগুন-সংক্রান্ত তাঁর সাম্প্রতিক লেখাটি আমার কাছে কিছুটা অতিরঞ্জিত, কিছুটা ভুল ব্যাখ্যাত ও খাদ্যদ্রব্যে জিন টেকনোলজির ব্যবহার বিষয়ে অতিরিক্ত রকমের নেতিবাচক বলে মনে হয়েছে।
প্রথমেই আসা যাক দেশি এবং উচ্চফলনশীল জাতগুলোর কথায়। প্রত্যেক জাতেরই নিজস্ব স্বাদ, বর্ণ, আকার ইত্যাদি থাকে। এদের মধ্যে আবার ভিটামিন ও মিনারেলসের পার্থক্যও থাকতে পারে। তবে দেশি জাতের সঙ্গে বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত জাতের সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো ফলনশীলতা। বাংলাদেশের বাজারে এখন যেসব বেগুন আমরা পাই, তার কোনোটিই কিন্তু জেনিটিক্যালি মডিফায়েড (জিএম) নয়। বেগুনের এ জাতগুলো দেশীয় বিভিন্ন জাতের মধ্যে সংমিশ্রণের ফলে তৈরি। তার কোনোটি কৃষকের হাতে আবার কোনোটি বিজ্ঞানীর উদ্ভাবিত। প্রশ্ন হচ্ছে, এত জাতের বেগুন থাকতে আমাদের কৃষকবন্ধুরা কেন অন্য বেগুনের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন? সব জাতের বেগুন কি সব জায়গায় লাভজনকভাবে চাষযোগ্য? যদি তা না হয়, তাহলে কৃষক অন্য লাভজনক জাতের প্রতি মনোযোগ দেবেই!! তবে দেশি বেগুন বা অন্য ফলমূলের বিভিন্ন জাত যাতে হারিয়ে না যায়, তার জন্য জরুরি ব্যবস্থা নেওয়া অত্যাবশ্যক। যেকোনো ফলমূলের বাণিজ্যিক চাষের সঙ্গে কীটপতঙ্গের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা একটি অবিচ্ছেদ্য বিষয়। প্রশ্ন হচ্ছে, কীটপতঙ্গের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা যথেচ্ছভাবে হচ্ছে, না কি বিজ্ঞাননির্ভর পরিমার্জিতরূপে হচ্ছে? কীটনাশক ছাড়া অন্য কোনো পরিবেশবান্ধব নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা নিশ্চিতভাবেই উত্তম। কীটনাশকের পরিবর্তে পৃথিবীর অনেক দেশে এখন কিছু নির্দিষ্ট কীটপতঙ্গের নিয়ন্ত্রণের জন্য রেডিয়েশন বা তেজরশ্মি ব্যবহার করে (Sterile Insect Technique, SIT) চমত্কার ফল পাওয়া যাচ্ছে। এই ব্যবস্থাপনা পরিবেশের দিক থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ একটি বালাই দমন পদ্ধতি। অবশ্য শুধু SIT পদ্ধতি এককভাবে ব্যবহার কিছুটা ব্যয়বহুল, তবে এই পদ্ধতির সঙ্গে অন্যান্য পদ্ধতি যেমন পরজীবীর ব্যবহার, ফেরোমন ট্র্যাপিং ইত্যাদি অত্যন্ত ফলদায়ক এবং লম্বা সময় ধরে এই সমন্বিত বালাই দমনব্যবস্থা অর্থনেতিক দিক থেকেও লাভজনক বলে বিভিন্ন দেশে পরিবেশবান্ধব বালাই দমনব্যবস্থাপনা ক্রমান্বয়ে জনপ্রিয় ও প্রসার লাভ করছে। এখানে বলা দরকার, SIT পদ্ধতি সব ধরনের কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ফসলের কিছু কিছু ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ, ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন দেশে জিন টেকনোলজির সাহায্যে জেনিটিক্যালি মডিফায়েড প্লান্ট উদ্ভাবন করা হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই অঙ্গরাজ্য থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেইনল্যান্ডে জিএম পেঁপে রপ্তানি করা হয়। এখন পর্যন্ত এসব জিএম পেঁপে খেয়ে কেউ অসুস্থ হয়েছে বলে জানা যায়নি। এই জিএম পেঁপে ও সাধারণ পেঁপের স্বাদের মধ্যেও কোনো পার্থক্য নেই। হাওয়াইর জিএম পেঁপে ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অব এগ্রিকালচার (ইউএসডিএ), ফেডারেল ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) ছাড়পত্র পাওয়ার পরই কেবল তা বাজারজাত করা হয়েছে। আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন তাদের রিপোর্টে এই জিএম শস্য সম্বন্ধে বলেছে, এতে কোনো অতিরিক্ত স্বাস্থ্য ঝুঁকি নেই। তারা এও বলেছে, যদি কোনো ঝুঁকি থেকেও থাকে তা স্বাভাবিক ব্রিডিং পদ্ধতির মাধ্যমে উদ্ভাবিত জাতের বেশি নয়। এত সব পজিটিভ রিপোর্ট এবং কোনো খারাপ কিছুর অস্তিত্ব না থাকা সত্ত্বেও হাওয়াইয়ের কিছু অতিসংবেদনশীল ব্যক্তি ও অর্গানিক কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন কিছু কৃষককে নিয়ে জিএম পেঁপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও করেছিল। জিএম পেঁপেতে আসলে কী করা হয়েছিল? পেঁপের রিং স্পট ভাইরাস থেকে পেঁপে গাছকে বাঁচাতে ভাইরাসের একটি অংশকে পেঁপে গাছের ডিএনএতে সংযোজন করা হয়েছিল, যা কিনা ওয়াইল্ড ভাইরাসকে মোকাবেলা করতে পারে। এই রিং স্পট ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব এতটাই মারাত্মক ছিল যে হাওয়াইয়ের ওহায়ো দ্বীপের একজন কৃষক মন্তব্য করেছেন, জেনেটিক মডিফিকেশন না করা হলে তিনি হয়তো পেঁপে ব্যবসা থেকে ছিটকে পড়তেন। হাওয়াই জিএম পেঁপে উদ্ভাবকদের অন্যতম ডেনিস গনজালভেস। তাঁর মতে, দ্রুততার সঙ্গে জিএম পেঁপে উদ্ভাবন করার কারণে হাওয়াই অঙ্গরাজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পেঁপে ইন্ডাস্ট্রি রক্ষা পেয়েছে।
যা হোক, এখন আমি ফরিদা আখতারের লেখায় ফিরে আসছি। তিনি লিখেছেন, বেগুনের জিনোমে ব্যাকটেরিয়ার বিটি জিন প্রবেশ করে যে বিটি বেগুনের জিএম জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে, তাতে পুরো গাছটিকেই বিষাক্ত করে তোলা হয়েছে। তিনি আরও লিখেছেন, যে বেগুন পোকারও খাওয়ার উপযুক্ত নয়, তা মানুষ কীভাবে খাবে? ফরিদা আখতার বিটি বেগুন-সংক্রান্ত উপরোক্ত বক্তব্য ও বিটি প্রোটিন কীভাবে কাজ করে তার যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তা একেবারেই সঠিক নয়। বিটি প্রোটিন আসলে কী? ব্যাকটেরিয়ার Bacillus জেনাসের একটি প্রজাতির (Bacills thuringiensis) কিছু ভ্যারাইটির মধ্যে যেমন, Bacillus thuringiensis, B. thuringiensis kurstaki, ইত্যাদির ক্রাই নামে কিছু জিন আছে সেগুলো যে প্রোটিন তৈরি করে থাকে, সেগুলোকে বিটি প্রোটিন বলে অভিহিত করা হয়। এই প্রোটিনের কোনোটিই এখন পর্যন্ত মানবদেহে কোনো ক্ষতি করেছে, তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। পক্ষান্তরে Bacillus anthracis নামে যে প্রজাতিটি আছে তা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত মারাত্মক। তবে আজকে আমরা শুধু বিটি জিন ও বিটি প্রোটিন নিয়েই আলাপ করব। মানবদেহের জন্য বিটি প্রোটিনের এখন পর্যন্ত কোনো খারাপ প্রভাবের কথা জানা না গেলেও কীটপতঙ্গের শরীরে এই প্রোটিনের বিষক্রিয়া সুবিদিত। বিটি জিন থেকে উত্পন্ন বিটি প্রোটিন প্রকৃতপক্ষে একটি অকার্যকর প্রোটিন হিসেবে থাকে। এই প্রোটিন কোনোভাবে কীটপতঙ্গের পারিপাকতন্ত্রে প্রবেশ করলে সেখানকার high alkaline pH condition-এ অকার্যকর প্রোটিনটি ভেঙে কার্যকর প্রোটিনে রূপান্তরিত হয়। অতঃপর এই কার্যকর প্রোটিনটি কীটপতঙ্গের গাট ওয়ালে থাকা নির্দিষ্ট রিসেপ্টরে আটকে যায় এবং গাট ওয়ালটিকে ফুটো করে ফেলে, ফলে কীটপতঙ্গ মারা যায়। এখানে উল্লেখ্য, বিটি প্রোটিন অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট, Bacillus-এর এক ভ্যারাইটির বিটি প্রোটিন, যা সব কীটপতঙ্গের জন্য সমানভাবে কার্যকর নয়। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, বিটি প্রোটিনের কার্যকারিতার জন্য প্রয়োজনীয় সুনির্দিষ্ট রিসেপ্টরের তারতম্য। মানবদেহে বিটি রিসেপ্টর থাকার প্রমাণ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। উপরন্তু মানবদেহের পরিপাকতন্ত্রের pH alkaline নয়, বরং অ্যাসিডিক। এ ছাড়াও এ পর্যন্ত জিএম বেগুন দিয়ে কিছু স্তন্যপায়ী প্রাণী যেমন ইঁদুর, খরগোশ, ছাগলের ওপর যে স্বল্পমাত্রার কাজ হয়েছে, তাতেও বিটি প্রোটিনের কোনো ক্ষতিকর প্রভাব লক্ষ করা যায়নি। তাহলে আমরা কী বিটি প্রোটিন দ্বারা ক্ষতির অজানা আশংকাকে বেশি প্রাধান্য দেব, নাকি জেনেশুনে কীটনাশকের মতো বিষ পান করতেই থাকব? বরঞ্চ কীভাবে এই ক্ষতিকর কীটনাশকের ভয়াল থাবা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আধুনিক প্রযুক্তি দ্বারা উদ্ভাবিত বিকল্প ব্যবস্থাগুলোকে কাজে লাগিয়ে আমাদের খাদ্য ও পরিবেশ আরও নিরাপদ করা যায়, সেদিকেই আমাদের বেশি দৃষ্টি দেওয়া উচিত। মনে রাখা দরকার, আমাদের দেশটি খুব ছোট আর এখানে জনসংখ্যার চাপও প্রচণ্ড, ফলে প্রতিনিয়ত আমাদের আবাদযোগ্য জমি কমছে। উপরন্তু আবহাওয়াগত কারণে এখানে কীটপতঙ্গের আক্রমণও বেশি। বিভিন্ন রিপোর্টে দেখা যায়, এ দেশে শুধু কীটপতঙ্গের আক্রমণে কমপক্ষে ৩০ শতাংশ কৃষিপণ্য নষ্ট হয় প্রতিবছর (কোনো বালাই দমনব্যবস্থা নেওয়া না হলে এই ক্ষতি যে আরও ভয়াবহ হবে তা বলাই বাহুল্য!)। কাজেই আমরা যদি কীটপতঙ্গের আক্রমণজনিত ক্ষতি, বিষাক্ত কীটনাশকের ক্ষতি, জনসংখ্যার চাপ, আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ আশংকাজনকভাবে ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়া, বিরূপ আবহাওয়াজনিত ক্ষতি যেমন বন্যা, খরা, মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি ইত্যাদিকে সামগ্রিকভাবে দেখি, তাহলে উচ্চফলনশীল জাত, পরিবেশবান্ধব বালাই দমনব্যবস্থাপনা, বন্যা, খরা বা লবণসহিষ্ণু কৃষিপণ্যের জাত উদ্ভাবন ছাড়া আমাদের কী আর কোনো বিকল্প আছে? এইসব জাত উদ্ভাবনের জন্য জিন টেকনোলজি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে আমি বিদেশ থেকে জিএম শস্য এনে এদেশে চাষের বিপক্ষে।
আমার আশঙ্কা, এতে আমরা অন্য দেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ব এবং সঠিক সময়ে আমরা কোনো কারণে যদি এসব পণ্যের বীজ বা চারা না পাই, তাহলে বড় ধরনের বিপদে পড়ে যেতে পারি। তা ছাড়া বিদেশ থেকে এই পণ্য আনলে তা খরচান্তও বটে! এ ক্ষেত্রে নিজেদের দেশেই ব্যাপকভাবে গবেষণা করা দরকার (প্রয়োজনে বিদেশের ল্যাবরেটরির সহায়তা নেওয়াটা আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে)। জিএম শস্য ল্যাবরেটরি থেকে মাঠ পর্যায়ে আনতে হলে কী কী সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়, সে সম্পর্কে আমাদের বিজ্ঞানীদের যথেষ্ট ভালো ধারণা আছে বলেই আমার ধারণা।
ড. শাকিল আহমেদ খান: মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা,কীট জীবপ্রযুক্তি বিভাগ, খাদ্য ও বিকিরণ জীববিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন।
shakil_shafat@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.