সময়ের প্রতিবিম্ব-আওয়ামী লীগে জয়ের যাত্রাধ্বনি by এবিএম মূসা
অনেকগুলো লেখার বিষয় জমে গেছে। কয়েক সপ্তাহ এই কলামে ‘সময়ের প্রতিবিম্বে’ সমসাময়িক তথা সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এবং সাধারণ্যে ব্যাপক ও সাময়িক আলোচিত কতিপয় ঘটনা সম্পর্কে আমার কোনো মন্তব্য প্রকাশিত হয়নি। লেখা বন্ধ ছিল, তাই বলে টেলিফোন, ই-মেইল আর ডাকবার্তা থেমে থাকেনি।
বেশ কয়েকটি ভালো-মন্দ ঘটনা নিয়ে এসবের মাধ্যমে অনেকে আমার মন্তব্য জানতে চেয়েছেন। আমি সাধারণত সদ্যঘটিত কোনো ঘটনা নিয়ে সাপ্তাহিক কলামটি লিখে থাকি। এখন গত তিন সপ্তাহের না লেখা ঘটনাবলি মাথার ভেতর কিলবিল করছে। সেই কারণে আজকে অলিখিত সব বিষয় নিয়ে স্থানাভাবে বিস্তারিত লিখতে না পারলেও একটু করে ছুঁয়ে যাব। তবে একটি বিষয় নিয়ে পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করব। তা হলো, ‘আওয়ামী লীগে জয়ের পদধ্বনি অথবা কর্মী-সমর্থকদের জয়-ধ্বনি।’ আশা করছি, কামনাও করছি, পরবর্তী কোনো একসময়ে হয়তো আমার প্রতিবেদনের শিরোনাম হবে ‘জয়ের জয়যাত্রা।’ শুভ পদার্পণ বলার সেই দিনটি কবে আসবে বা আদৌ আসবে কি না, তা এখনই বলতে পারছি না। কারণ, একসময়ে বিএনপির রাজনীতিতে ‘তারেক জিয়ার’ পদার্পণকে শুভাগমন বলে এখনো সমালোচিত হচ্ছি। এর কারণ, আগমনটি শুভ হলেও যাত্রাপথটি এখন যেকোনো কারণেই হোক হয়েছে অতিবিতর্কিত ও পঙ্কিল।
আলোচ্য ও অনালোচ্য বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করছি। এক. আওয়ামী লীগে বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের আগমনবার্তা। দুই. স্থান ও প্রতিষ্ঠানের নাম বদলের পালা, বস্তুত পাল্টাপাল্টি নামকরণ। তিন. জাতীয় সংসদে তথা জাতির মঙ্গলামঙ্গলের কথা বলার স্থানটিতে তাদের মুখপাত্রদের বিজাতীয় আচরণ, তাদের মুখনিঃসৃত আপত্তিকর উচ্চারণ অযোগ্য বক্তব্যগুলো। চার. সর্বশেষ একজন প্রতিমন্ত্রীর একটি আচরণ, যা ক্ষমতার দাপট বলে সর্বসাধারণ্যে আলোচিত হয়েছে। গত এক বছরের অধিক কাল সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি দলের কতিপয় ‘প্রভাবশালীর’ প্রভাবের এ ধরনের দাপটের বিচ্ছিন্ন ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, জনসাধারণ্যে গুঞ্জরিত হয়েছে। সাংবাদিক পেটানো, জমি দখল, সরকারি কর্মচারীকে হুমকি, শিক্ষাঙ্গনে শুধু লাঠি পেটাপেটি নয়, খুনোখুনি পত্রিকায় নিত্যদিনের সংবাদ। এ ছাড়া রয়েছে পূর্বসূরি সরকারের নেতা-কর্মী ও ছাত্র-যুবকদের অনুসরণে বিরোধী দলের সমর্থকদের প্রতি বৈরী আচরণ। এসবই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তাই ঘটনাবলির সামান্য বুদ্বুদ তুলেই আবার মিলিয়ে গেছে। এবার ব্যাংক কর্মকর্তা বনাম প্রতিমন্ত্রীর সম্পর্কিত খবরে ভিন্নতা রয়েছে। কারণ কর্মকর্তার বক্তব্য পত্রিকায় এসেছে। প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য পুরোপুরি জানা যায়নি। তাই একতরফা মন্তব্য করতে চাই না।
যাই হোক, আমার আজকের মূল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে সজীব ওয়াজেদ জয়ের দেশের মাটিতে পুনঃপদার্পণের বার্তা ও প্রতিক্রিয়া। এবার শুধু দেশে ঘুরে যাওয়া নয়, আওয়ামী লীগের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তাঁর বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্থায়ী আসন পেতে বসার খবরে নাকি দলের কর্মী মহলে উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে। একটুখানি ব্যতিক্রম হচ্ছে, কোনো বিশেষ মহল এরই মধ্যে অসামঞ্জস্যপূর্ণ মতামত দিয়ে তারেক জিয়ার বিএনপিতে অনুপ্রবেশ ও জয়ের আগমনী পদধ্বনির তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। তারেক জিয়াকে নিয়ে বিএনপিতে আলোচনা এখনো সোচ্চার। জয়ের আগমনধ্বনি মনে হচ্ছে কেন জানি অনেকখানি স্তিমিত হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের তরুণ প্রজন্ম জয়ের বাংলাদেশে স্থিতিলাভের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছে না। হয়তো তাই তাঁরা আপাতত চুপ মেরে গেছে। তবে জয় রাজনীতিতে আসছেন, সেই জল্পনার ইতি ঘটেনি। সম্ভাবনা দূর হয়েছে, এমনটিও বলা যাচ্ছে না। আমার কিন্তু মনে হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও জয়ের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারিত্বের প্রভাব কতখানি দলের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক হবে সে সম্পর্কে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছেন না। কর্ত্রীর ইচ্ছায় কর্ম, সেই ইচ্ছাটি পুরোপুরি অনুধাবন করা যাচ্ছে না বলেই কর্মীদের জয়-ধ্বনি আপাতত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে না।
জয়ের আগমনধ্বনি নিয়ে আলোচনা তারেক-জয় প্রসঙ্গটি নিয়ে শুরু করতে হচ্ছে। তারেক জিয়াকে যখন বিএনপির রাজনীতির সম্মুখসারিতে নিয়ে আসা হয়, তখন আমি বেগম খালেদা জিয়ার পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছিলাম। তবে তাঁর সরাসরি উল্লম্ফন বা আরোহণপদ্ধতি নিয়ে, একলাফে একেবারে শীর্ষ অবস্থানে অধিষ্ঠিত হওয়া নিয়ে একটুখানি সমালোচনাও করেছি। তখন বিএনপির রাজনীতিতে স্থবিরতা নিয়ে আলোচনায় নেতৃত্বের শিরা-উপশিরায় নতুন রক্ত সঞ্চালনের ইতিবাচক পদক্ষেপ বলেছিলাম। এর বাইরে শুধু বিএনপিতে নয়, আওয়ামী লীগেও শুধু রক্তের সঞ্চালন নয়, দলীয় আদর্শের রাজনীতির ধারাবাহিকতায় উত্তরাধিকারের সমস্যাটি উল্লেখ করেছিলাম। আমার সেই প্রতিবেদনটি পড়ে দুই অনুজ সাংবাদিক আবেদ খান ও বর্তমানে প্রয়াত সাংবাদিক ওয়াহিদুল হক দুটি প্রতিবেদনে আমাকে তুলোধুনো করেছিলেন। অবশ্য তাঁদের বক্তব্য ছিল ভিন্ন ধরনের। তাঁরা আমার সমালোচনায় তারেকের আগমনের অশুভ ও উত্তরাধিকারের নেতিবাচক রাজনীতির বিষয়টিকে সামনে এনেছিলেন।
এবার জয়-যাত্রা প্রসঙ্গ আলোচনায়ও ‘উত্তরাধিকারের রাজনীতি’ আলোচিত হবে বইকি। তবে দুইয়ের উত্তরাধিকারের চরিত্র বিচার এক হতে পারে না। তারেকের উত্তরাধিকার ছিল সামরিক অতীত, জয়ের রয়েছে উত্তরাধিকারে রাজনৈতিক ধারাপ্রবাহ। তাই তুলনামূলক আলোচনাটি ভিন্ন ধরনেরই হবে বইকি। তুলনামূলক আলোচনায় বছর পাঁচ-ছয় আগে ইতিপূর্বে জয়ের স্বদেশ আগমনকে কেন্দ্র করে লিখেছিলাম, ‘জয়কে আসতে হলে এখনই আসতে হবে।’ অর্থাত্ সময়ের আবর্তন অনুসরণে তাঁকে বিদেশের শেকড় উপড়ে স্বদেশে প্রোথিত হয়ে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করতে হবে। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উড়ে এসে জুড়ে বসে এ দেশে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া দুরূহ। সেই সময়ে জয়ের বাংলাদেশের রাজনীতিতে আশু অবস্থান গ্রহণের প্রসঙ্গটি চাপা পড়ে গিয়েছিল।
এবারের ডামাডোলে পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গড়াবে, তা নিয়ে ভাবনা গভীরতর হতে হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্বে নানা কারণে স্থবিরতা এসেছে। জয়ের নবীন, নতুন ও বিশুদ্ধ রক্ত হয়তো আওয়ামী লীগের শিরা-উপশিরায় সঞ্চালনের সূচনা করবে। মনে পড়ছে, একসময়ে সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী বা সালাম খান-কফিলউদ্দিন চৌধুরীদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছিল না, তখন মুজিব-তাজউদ্দীনদের আবির্ভাব অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। তবে সেই ধারাটি আপত্কালে রোগীকে জরুরি রক্ত সঞ্চালন ছিল না। পুরোনো নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে শেখ মুজিব-তাজউদ্দীনদের দলের সামনের কাতারে নিয়ে এসেছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে রক্ত সঞ্চালনের পাশাপাশি বিশুদ্ধকরণেরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সোজা কথায়, শুধু নতুন উদ্যমী নয়, দখলবাজি, চাঁদাবাজি ও খুনোখুনির নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার দায়িত্ব নিতে হবে জয়কে, আওয়ামী লীগকে ঢেলে সাজিয়ে। উত্তরাধিকারের সুযোগ নেওয়ার জন্য নয়। তবে ফ্লাই পলিটিকস, ‘আসিলাম-চলিলাম’ রাজনৈতিক কার্যক্রম নয়, স্থায়ী পরিকল্পনা নিয়েই জয়-যাত্রার পরিকল্পনা করতে হবে। কম্পিউটারের ডিজিটালে নয়, মাঠঘাটের রাজনীতি দিয়েই হতে হবে ‘জয়-যুগের’ সূচনা। তাই প্রায় এক দশক আগে যা বলেছিলাম, সে কথাই বলছি, ‘জয়কে আসলে এখনই আসতে হবে অথবা এসেছেনই যখন গেঁড়ে বসতে হবে। পুরোনো গদিতে বসে পড়া নয়, আসনের কুশনটি ঝেড়েঝুড়ে নিতে হবে। সব ধাপ একলাফে পেরিয়ে শীর্ষে আরোহণ করার ধারণা গ্রহণযোগ্য হবে না। তারেক তা করেছিলেন বলেই নিচের দিকে তাকাননি। সহজভাবে বলছি, জয়কে তাঁর মাতামহের অনুসরণে তৃণমূল পর্যায়ের ‘চোঙ্গা-ফোঁকা’ কর্মী হয়ে শুরু করতে হবে।
নানা কারণেই জয়ের রাজনীতিতে পুরোপুরি প্রবেশের আনুষঙ্গিক আলোচনা করেছি। আওয়ামী তথা দেশীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে জয়ের প্রবেশের কার্যক্রম, শেখ হাসিনা অনেক আগে শুরু করলে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতেন। বেগম জিয়ার তারেককে অভিষেক স্বীয় বিবেচনায় অথবা কোনো বিশেষ মহলের পরামর্শে ‘আকস্মিক’ হয়েছিল বলেই সঠিক হয়নি। তিনি ও দলের অনেকেই তা এখন বুঝতে পেরেছেন। তারেককে আগে থেকেই রাজনীতির প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাতেখড়ি দেওয়া উচিত ছিল। তা করেননি বলেই পরবর্তী সময়ে তারেকের শিরায় সঞ্চালিত রক্ত দূষিত হয়ে তাঁর দলকে ও পরবর্তী সময়ে সরকারকে বিপর্যয়ে ফেলেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বলছি, সজীব ওয়াজেদ জয়ের রাজনীতিতে প্রবেশ নিয়ে শেখ হাসিনার সত্যিই কোনো চিন্তাভাবনা থাকলে তিনি যেন তাঁকে ক্রেন দিয়ে তুলে দলের শীর্ষে অধিষ্ঠিত করে বেগম জিয়ার ভুল পথটি অনুসরণ না করেন।
আমার উপরিউক্ত প্রতিবেদনে সংগত কারণে তারেক ও জয়ের উত্তরাধিকারের রাজনীতিকে সমর্থন জানিয়েছি। কারণটি হচ্ছে, আমাদের রাজনৈতিক ধারায় গণতন্ত্রের ক্রমিক পর্যায়ের স্বাভাবিক স্রোতধারা সঠিক পথে প্রবাহিত হয়নি। তাই সব দলেরই সমর্থক, কর্মী, নেতা ও শুভানুধ্যায়ীদের আপত্কালে বিপাকে পড়তে হয়েছে। ‘আফটার মুজিব হু’ অথবা ‘জিয়ার পরে কী’ সেই ভাবনাটি দলের বিদ্যমান নেতৃত্ব সময়ে ভাবেননি। তাই জাতির ক্রান্তিকালে অথবা দলীয় নেতৃত্ব সংকট মোচনে অভ্যন্তরীণ নেতৃত্ব কেউ কারও ওপর ভরসা করতে পারেননি। তাত্ক্ষণিক সংকট মোকাবিলায় একজনকে নির্বাসন থেকে দেশে ফিরিয়েছেন, অন্যজনকে অন্দরমহল থেকে বাইরে এনেছেন। শেষ পর্যন্ত সমভাবে ‘ক্যারিশমা’ অথবা আমাদের অবদমিত ব্যক্তিপূজার মানসিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে সংকট মোচনের পথ খুঁজেছেন। একই ধারাবাহিকতায় বর্তমানেও তারেক-পূজা করে ও জয়-বার্তা শুনিয়ে অমুকের পর কী হবে, আফটার হার হু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হচ্ছে।
সর্বশেষ বক্তব্য হচ্ছে, জয়ের বিশুদ্ধ রক্ত সঞ্চালনে শেখ হাসিনাকে একটি বিষয়ে হুঁশিয়ার থাকতে হবে। রক্ত যেন শেষ পর্যন্ত বিশুদ্ধই থাকে। দলে বর্তমান রক্তপ্রবাহে সঞ্চালিত জীবাণুর পদার্থের মিশ্রণে যেন একসময়ে দূষিত না হয়। তাঁকে বুঝতে হবে, বেগম জিয়া যদি হুঁশিয়ার থাকতেন, তবে পরবর্তী সময়ে তারেকের রক্তে দূষিত জীবাণুর মিশ্রণ ঘটত না। বেগম জিয়া তারেককে রাজনীতিতে এনে দলের শীর্ষস্থানীয়, অভিজ্ঞ রাজনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন প্রবীণ পোড়খাওয়া নেতাদের কাছে শিক্ষানবিশি করার সুযোগ দেননি। তাই তারেক দলের ও মায়ের আশপাশের তোষামোদী এবং সুযোগসন্ধানীদের চিনে নেওয়ার সময় ও সুযোগ পাননি। সত্ ও অসৎসঙ্গের পার্থক্য বুঝতে পারেননি। সেই কারণে বিএনপির তথাকথিত নতুন নেতৃত্বে ‘রক্ত পরিবর্তন’ বুমেরাং হয়েছে। এখন তারেক দেশে ফিরে এলেও তাঁর মাধ্যমে কৃত কর্মগুলোর রেশ দলের রাজনীতিতে রয়ে যাবে। একই কারণে আশা করব, আওয়ামী লীগে যাঁরা জয়-ধ্বনি করছেন, তাঁরা তারেকের আগমন ও সাময়িক নির্গমনের কারণটি পর্যালোচনা করবেন। আওয়ামী লীগের সভানেত্রীকেও ভাবতে হবে, জয়কে সরাসরি রাজনীতির উচ্চাসনে বসাবেন, নাকি কিছুকাল শিক্ষানবিশ হয়ে সব ‘বুঝে নেওয়ার আর শিখে নেওয়ার’ সুযোগ দেবেন।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
আলোচ্য ও অনালোচ্য বিষয়গুলো ধারাবাহিকভাবে উল্লেখ করছি। এক. আওয়ামী লীগে বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের আগমনবার্তা। দুই. স্থান ও প্রতিষ্ঠানের নাম বদলের পালা, বস্তুত পাল্টাপাল্টি নামকরণ। তিন. জাতীয় সংসদে তথা জাতির মঙ্গলামঙ্গলের কথা বলার স্থানটিতে তাদের মুখপাত্রদের বিজাতীয় আচরণ, তাদের মুখনিঃসৃত আপত্তিকর উচ্চারণ অযোগ্য বক্তব্যগুলো। চার. সর্বশেষ একজন প্রতিমন্ত্রীর একটি আচরণ, যা ক্ষমতার দাপট বলে সর্বসাধারণ্যে আলোচিত হয়েছে। গত এক বছরের অধিক কাল সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারি দলের কতিপয় ‘প্রভাবশালীর’ প্রভাবের এ ধরনের দাপটের বিচ্ছিন্ন ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, জনসাধারণ্যে গুঞ্জরিত হয়েছে। সাংবাদিক পেটানো, জমি দখল, সরকারি কর্মচারীকে হুমকি, শিক্ষাঙ্গনে শুধু লাঠি পেটাপেটি নয়, খুনোখুনি পত্রিকায় নিত্যদিনের সংবাদ। এ ছাড়া রয়েছে পূর্বসূরি সরকারের নেতা-কর্মী ও ছাত্র-যুবকদের অনুসরণে বিরোধী দলের সমর্থকদের প্রতি বৈরী আচরণ। এসবই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে প্রতীয়মান হয়েছে। তাই ঘটনাবলির সামান্য বুদ্বুদ তুলেই আবার মিলিয়ে গেছে। এবার ব্যাংক কর্মকর্তা বনাম প্রতিমন্ত্রীর সম্পর্কিত খবরে ভিন্নতা রয়েছে। কারণ কর্মকর্তার বক্তব্য পত্রিকায় এসেছে। প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য পুরোপুরি জানা যায়নি। তাই একতরফা মন্তব্য করতে চাই না।
যাই হোক, আমার আজকের মূল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে সজীব ওয়াজেদ জয়ের দেশের মাটিতে পুনঃপদার্পণের বার্তা ও প্রতিক্রিয়া। এবার শুধু দেশে ঘুরে যাওয়া নয়, আওয়ামী লীগের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তাঁর বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্থায়ী আসন পেতে বসার খবরে নাকি দলের কর্মী মহলে উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে। একটুখানি ব্যতিক্রম হচ্ছে, কোনো বিশেষ মহল এরই মধ্যে অসামঞ্জস্যপূর্ণ মতামত দিয়ে তারেক জিয়ার বিএনপিতে অনুপ্রবেশ ও জয়ের আগমনী পদধ্বনির তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। তারেক জিয়াকে নিয়ে বিএনপিতে আলোচনা এখনো সোচ্চার। জয়ের আগমনধ্বনি মনে হচ্ছে কেন জানি অনেকখানি স্তিমিত হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের তরুণ প্রজন্ম জয়ের বাংলাদেশে স্থিতিলাভের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছে না। হয়তো তাই তাঁরা আপাতত চুপ মেরে গেছে। তবে জয় রাজনীতিতে আসছেন, সেই জল্পনার ইতি ঘটেনি। সম্ভাবনা দূর হয়েছে, এমনটিও বলা যাচ্ছে না। আমার কিন্তু মনে হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেও জয়ের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারিত্বের প্রভাব কতখানি দলের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য ইতিবাচক হবে সে সম্পর্কে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারছেন না। কর্ত্রীর ইচ্ছায় কর্ম, সেই ইচ্ছাটি পুরোপুরি অনুধাবন করা যাচ্ছে না বলেই কর্মীদের জয়-ধ্বনি আপাতত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে না।
জয়ের আগমনধ্বনি নিয়ে আলোচনা তারেক-জয় প্রসঙ্গটি নিয়ে শুরু করতে হচ্ছে। তারেক জিয়াকে যখন বিএনপির রাজনীতির সম্মুখসারিতে নিয়ে আসা হয়, তখন আমি বেগম খালেদা জিয়ার পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছিলাম। তবে তাঁর সরাসরি উল্লম্ফন বা আরোহণপদ্ধতি নিয়ে, একলাফে একেবারে শীর্ষ অবস্থানে অধিষ্ঠিত হওয়া নিয়ে একটুখানি সমালোচনাও করেছি। তখন বিএনপির রাজনীতিতে স্থবিরতা নিয়ে আলোচনায় নেতৃত্বের শিরা-উপশিরায় নতুন রক্ত সঞ্চালনের ইতিবাচক পদক্ষেপ বলেছিলাম। এর বাইরে শুধু বিএনপিতে নয়, আওয়ামী লীগেও শুধু রক্তের সঞ্চালন নয়, দলীয় আদর্শের রাজনীতির ধারাবাহিকতায় উত্তরাধিকারের সমস্যাটি উল্লেখ করেছিলাম। আমার সেই প্রতিবেদনটি পড়ে দুই অনুজ সাংবাদিক আবেদ খান ও বর্তমানে প্রয়াত সাংবাদিক ওয়াহিদুল হক দুটি প্রতিবেদনে আমাকে তুলোধুনো করেছিলেন। অবশ্য তাঁদের বক্তব্য ছিল ভিন্ন ধরনের। তাঁরা আমার সমালোচনায় তারেকের আগমনের অশুভ ও উত্তরাধিকারের নেতিবাচক রাজনীতির বিষয়টিকে সামনে এনেছিলেন।
এবার জয়-যাত্রা প্রসঙ্গ আলোচনায়ও ‘উত্তরাধিকারের রাজনীতি’ আলোচিত হবে বইকি। তবে দুইয়ের উত্তরাধিকারের চরিত্র বিচার এক হতে পারে না। তারেকের উত্তরাধিকার ছিল সামরিক অতীত, জয়ের রয়েছে উত্তরাধিকারে রাজনৈতিক ধারাপ্রবাহ। তাই তুলনামূলক আলোচনাটি ভিন্ন ধরনেরই হবে বইকি। তুলনামূলক আলোচনায় বছর পাঁচ-ছয় আগে ইতিপূর্বে জয়ের স্বদেশ আগমনকে কেন্দ্র করে লিখেছিলাম, ‘জয়কে আসতে হলে এখনই আসতে হবে।’ অর্থাত্ সময়ের আবর্তন অনুসরণে তাঁকে বিদেশের শেকড় উপড়ে স্বদেশে প্রোথিত হয়ে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করতে হবে। বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উড়ে এসে জুড়ে বসে এ দেশে রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া দুরূহ। সেই সময়ে জয়ের বাংলাদেশের রাজনীতিতে আশু অবস্থান গ্রহণের প্রসঙ্গটি চাপা পড়ে গিয়েছিল।
এবারের ডামাডোলে পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গড়াবে, তা নিয়ে ভাবনা গভীরতর হতে হবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আওয়ামী লীগের বর্তমান নেতৃত্বে নানা কারণে স্থবিরতা এসেছে। জয়ের নবীন, নতুন ও বিশুদ্ধ রক্ত হয়তো আওয়ামী লীগের শিরা-উপশিরায় সঞ্চালনের সূচনা করবে। মনে পড়ছে, একসময়ে সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী বা সালাম খান-কফিলউদ্দিন চৌধুরীদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যখন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছিল না, তখন মুজিব-তাজউদ্দীনদের আবির্ভাব অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। তবে সেই ধারাটি আপত্কালে রোগীকে জরুরি রক্ত সঞ্চালন ছিল না। পুরোনো নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে শেখ মুজিব-তাজউদ্দীনদের দলের সামনের কাতারে নিয়ে এসেছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে রক্ত সঞ্চালনের পাশাপাশি বিশুদ্ধকরণেরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সোজা কথায়, শুধু নতুন উদ্যমী নয়, দখলবাজি, চাঁদাবাজি ও খুনোখুনির নেতৃত্বে পরিবর্তন আনার দায়িত্ব নিতে হবে জয়কে, আওয়ামী লীগকে ঢেলে সাজিয়ে। উত্তরাধিকারের সুযোগ নেওয়ার জন্য নয়। তবে ফ্লাই পলিটিকস, ‘আসিলাম-চলিলাম’ রাজনৈতিক কার্যক্রম নয়, স্থায়ী পরিকল্পনা নিয়েই জয়-যাত্রার পরিকল্পনা করতে হবে। কম্পিউটারের ডিজিটালে নয়, মাঠঘাটের রাজনীতি দিয়েই হতে হবে ‘জয়-যুগের’ সূচনা। তাই প্রায় এক দশক আগে যা বলেছিলাম, সে কথাই বলছি, ‘জয়কে আসলে এখনই আসতে হবে অথবা এসেছেনই যখন গেঁড়ে বসতে হবে। পুরোনো গদিতে বসে পড়া নয়, আসনের কুশনটি ঝেড়েঝুড়ে নিতে হবে। সব ধাপ একলাফে পেরিয়ে শীর্ষে আরোহণ করার ধারণা গ্রহণযোগ্য হবে না। তারেক তা করেছিলেন বলেই নিচের দিকে তাকাননি। সহজভাবে বলছি, জয়কে তাঁর মাতামহের অনুসরণে তৃণমূল পর্যায়ের ‘চোঙ্গা-ফোঁকা’ কর্মী হয়ে শুরু করতে হবে।
নানা কারণেই জয়ের রাজনীতিতে পুরোপুরি প্রবেশের আনুষঙ্গিক আলোচনা করেছি। আওয়ামী তথা দেশীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে জয়ের প্রবেশের কার্যক্রম, শেখ হাসিনা অনেক আগে শুরু করলে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতেন। বেগম জিয়ার তারেককে অভিষেক স্বীয় বিবেচনায় অথবা কোনো বিশেষ মহলের পরামর্শে ‘আকস্মিক’ হয়েছিল বলেই সঠিক হয়নি। তিনি ও দলের অনেকেই তা এখন বুঝতে পেরেছেন। তারেককে আগে থেকেই রাজনীতির প্রাথমিক বিদ্যালয়ে হাতেখড়ি দেওয়া উচিত ছিল। তা করেননি বলেই পরবর্তী সময়ে তারেকের শিরায় সঞ্চালিত রক্ত দূষিত হয়ে তাঁর দলকে ও পরবর্তী সময়ে সরকারকে বিপর্যয়ে ফেলেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বলছি, সজীব ওয়াজেদ জয়ের রাজনীতিতে প্রবেশ নিয়ে শেখ হাসিনার সত্যিই কোনো চিন্তাভাবনা থাকলে তিনি যেন তাঁকে ক্রেন দিয়ে তুলে দলের শীর্ষে অধিষ্ঠিত করে বেগম জিয়ার ভুল পথটি অনুসরণ না করেন।
আমার উপরিউক্ত প্রতিবেদনে সংগত কারণে তারেক ও জয়ের উত্তরাধিকারের রাজনীতিকে সমর্থন জানিয়েছি। কারণটি হচ্ছে, আমাদের রাজনৈতিক ধারায় গণতন্ত্রের ক্রমিক পর্যায়ের স্বাভাবিক স্রোতধারা সঠিক পথে প্রবাহিত হয়নি। তাই সব দলেরই সমর্থক, কর্মী, নেতা ও শুভানুধ্যায়ীদের আপত্কালে বিপাকে পড়তে হয়েছে। ‘আফটার মুজিব হু’ অথবা ‘জিয়ার পরে কী’ সেই ভাবনাটি দলের বিদ্যমান নেতৃত্ব সময়ে ভাবেননি। তাই জাতির ক্রান্তিকালে অথবা দলীয় নেতৃত্ব সংকট মোচনে অভ্যন্তরীণ নেতৃত্ব কেউ কারও ওপর ভরসা করতে পারেননি। তাত্ক্ষণিক সংকট মোকাবিলায় একজনকে নির্বাসন থেকে দেশে ফিরিয়েছেন, অন্যজনকে অন্দরমহল থেকে বাইরে এনেছেন। শেষ পর্যন্ত সমভাবে ‘ক্যারিশমা’ অথবা আমাদের অবদমিত ব্যক্তিপূজার মানসিকতাকে প্রাধান্য দিয়ে সংকট মোচনের পথ খুঁজেছেন। একই ধারাবাহিকতায় বর্তমানেও তারেক-পূজা করে ও জয়-বার্তা শুনিয়ে অমুকের পর কী হবে, আফটার হার হু প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হচ্ছে।
সর্বশেষ বক্তব্য হচ্ছে, জয়ের বিশুদ্ধ রক্ত সঞ্চালনে শেখ হাসিনাকে একটি বিষয়ে হুঁশিয়ার থাকতে হবে। রক্ত যেন শেষ পর্যন্ত বিশুদ্ধই থাকে। দলে বর্তমান রক্তপ্রবাহে সঞ্চালিত জীবাণুর পদার্থের মিশ্রণে যেন একসময়ে দূষিত না হয়। তাঁকে বুঝতে হবে, বেগম জিয়া যদি হুঁশিয়ার থাকতেন, তবে পরবর্তী সময়ে তারেকের রক্তে দূষিত জীবাণুর মিশ্রণ ঘটত না। বেগম জিয়া তারেককে রাজনীতিতে এনে দলের শীর্ষস্থানীয়, অভিজ্ঞ রাজনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন প্রবীণ পোড়খাওয়া নেতাদের কাছে শিক্ষানবিশি করার সুযোগ দেননি। তাই তারেক দলের ও মায়ের আশপাশের তোষামোদী এবং সুযোগসন্ধানীদের চিনে নেওয়ার সময় ও সুযোগ পাননি। সত্ ও অসৎসঙ্গের পার্থক্য বুঝতে পারেননি। সেই কারণে বিএনপির তথাকথিত নতুন নেতৃত্বে ‘রক্ত পরিবর্তন’ বুমেরাং হয়েছে। এখন তারেক দেশে ফিরে এলেও তাঁর মাধ্যমে কৃত কর্মগুলোর রেশ দলের রাজনীতিতে রয়ে যাবে। একই কারণে আশা করব, আওয়ামী লীগে যাঁরা জয়-ধ্বনি করছেন, তাঁরা তারেকের আগমন ও সাময়িক নির্গমনের কারণটি পর্যালোচনা করবেন। আওয়ামী লীগের সভানেত্রীকেও ভাবতে হবে, জয়কে সরাসরি রাজনীতির উচ্চাসনে বসাবেন, নাকি কিছুকাল শিক্ষানবিশ হয়ে সব ‘বুঝে নেওয়ার আর শিখে নেওয়ার’ সুযোগ দেবেন।
এবিএম মূসা: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
No comments