সরল গরল-জনসংখ্যার অনুপাতে বিচারকের সংখ্যা by মিজানুর রহমান খান
জনসংখ্যার অনুপাতে নিম্ম আদালতের বিচারকের সংখ্যা ঠিক করা হয়। অথচ ১৫ কোটি মানুষের এই দেশের শাসক ও নাগরিক সমাজ এ বিষয়ে উদাসীন। তারা কখনো এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করেছে বলেও জানা যায় না। এর ফল দাঁড়িয়েছে বিচারবঞ্চনা। সবার জন্য দ্রুত বিচার দূরের কথা।
পরিসংখ্যান সাক্ষ্য দিচ্ছে, লাখ লাখ বাঙালির জীবনে বিচারকের কোনো ভূমিকা নেই। প্রতি ১০ লাখে এখন ১০ জন বিচারকও নেই। কিন্তু এদিকে কোনো মনোযোগ না দিয়ে ক্রমাগতভাবে উচ্চ আদালতের বিচারকের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।
সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারক নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাই শেষ কথা। বিচারকসংখ্যা ঠিক করার চাবিকাঠিও তাঁর হাতে। বিচারকের সংখ্যার সঙ্গে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সম্পর্ক আছে। এটা আমরা এত দিন বোঝার চেষ্টা করিনি। তবে এবার সম্ভবত বুঝতে হবে। কারণ, সরকার বিচারক নিয়োগে এখন জোট সরকারকে টেক্কা দিতে চাইছে।
সংবিধানপ্রণেতারা আপিল বিভাগের বিচারকসংখ্যা নির্দিষ্ট করেছিলেন। সংখ্যাটি ছিল ৪। ৯৪ অনুচ্ছেদে এটা মুদ্রিতও হয়েছিল। কিন্তু পরে বাদ পড়ে। সংবিধানে এখন লেখা আছে, রাষ্ট্রপতি ‘যেরূপসংখ্যক বিচারক নিয়োগের প্রয়োজন বোধ’ করবেন, তেমনসংখ্যক বিচারক নিয়ে দুই বিভাগ চলবে।
যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানে আইন দ্বারা উচ্চ আদালতের বিচারকসংখ্যা নির্ধারিত। এই সংখ্যা নির্ধারণ মূলত সংসদের কাজ। বেশির ভাগ লিখিত সংবিধানেই লেখা থাকে, এটা আইন দ্বারা নির্দিষ্ট হতে হবে। ভারত ও পাকিস্তানেও আইন আছে। ১৯৫৬ সালে অবিভক্ত পাকিস্তানের মূল সংবিধানেও কিন্তু এটা লেখা ছিল। এর ৪৯ অনুচ্ছেদে বলা ছিল, এটা আইন দ্বারা নির্ধারিত না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি সংখ্যা স্থির করবেন। এভাবে আমরা দেখি, বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে সংসদের এখতিয়ার। কিন্তু বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী দীর্ঘকাল আইন ছাড়াই বিচারকের সংখ্যা ঠিক করেছে। ১৯৭২ থেকে এ পর্যন্ত কখনোই হাইকোর্টের বিচারকসংখ্যায় কোনো শৃঙ্খলা দেখা যায় না। যার যেমন খুশি তেমন সংখ্যায় তাঁরা বিচারক নিয়োগ দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারই এবার প্রথম আকস্মিকভাবে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করল। সংশ্লিষ্ট কাউকে কিছু জানানো হলো না। সুপ্রিম কোর্ট বারকে জিজ্ঞেস করা হয়নি। এর নেতারা অবশ্য এ বিষয়ে মাথা ঘামাতে উত্সুক ছিলেন, তাও নয়। সুতরাং নিঃশব্দে প্রজ্ঞাপন জারি হলো। আপিল বিভাগের বিচারকসংখ্যা হবে ১১। দীর্ঘকাল এখানে পাঁচজন বসেছেন। জোট সরকারের আমলে সাতজন দিয়ে চলল। এই মুহূর্তে দুই বিভাগে ৮২ জন বিচারক রয়েছেন। ১১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ আপিল বিভাগ অল্প দিনই সক্রিয় থেকেছে। বেশ কিছুদিন হলো সাতজন দিয়ে চলছে আপিল বিভাগ। কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই শূন্যতা চলছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। প্রতীয়মান হচ্ছে, সরকারের মাথায় নানা হিসাব-নিকাশ, যার সঙ্গে বিচার বিভাগের ভালো-মন্দের যোগসূত্রটাই সবচেয়ে আলগা।
শুনতে পাই, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শুনানি সামনে রেখে সরকার আপিল বিভাগে নতুন চারজন বিচারক নিয়োগে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। সেই প্রস্তাবে বিস্ময়করভাবে ‘লাখো’ মামলা পেন্ডিং থাকার দোহাই দেওয়া হয়েছিল। তখন সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দেন যে লাখ নয়, আপিল বিভাগে মাত্র কয়েক হাজার মামলা পেন্ডিং রয়েছে। তা ছাড়া অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার দিকেও সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গুলি নির্দেশ করেন। জানা যায়, এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতি প্রজ্ঞাপন জারি করেন। এই তথ্য সত্য হলে ধরে নিতে হয় যে এখানে একটা অগ্রহণযোগ্য কৌশলগত ব্যাপার ছিল। কারণ, রাষ্ট্রপতি আইন করে দিলে সুপ্রিম কোর্টের কিছু বলার থাকে না। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এত দিন ১১ জনের ছিল। চারজন অবসরে যাওয়ার পর আর নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। এখন রাষ্ট্রপতি কেন মনে করছেন যে ১১ জনের কাজ সাতজন দিয়েই চলে? এত দিন আইন ছিল না, কিন্তু আইন করার পরও ‘প্রয়োজন বোধ’ না করার তো সুযোগ নেই। এখন ওই আইন মানতে রাষ্ট্রপতিও বাধ্য।
কোনো এক বা একাধিক বিশেষ মামলা পরিচালনা বা বিশেষ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কী করতে হবে, সে বিষয়ে সংবিধানের স্কিম খুবই স্পষ্ট। আপিল বিভাগে অস্থায়ী বিচারক ও হাইকোর্টে অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগের বিধান সে কারণেই রাখা। নির্বাহী বিভাগ মামলা স্তূপের যুক্তি দিতে পারেন। জনগণকে দ্রুত বিচার প্রদানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা বলতে পারেন। কিন্তু তাঁদের সে যুক্তি ধোপে টেকে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন।
আপিল বিভাগের চারটি পদ কেন এখন শূন্য রাখা হচ্ছে? হাইকোর্ট বিভাগে কেন এখনই বিচারক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না? তার কারণ বিচারিক, না রাজনৈতিক? সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন আসন্ন। এর আগ পর্যন্ত নিয়োগ ঝুলতে পারে। তবে হাইকোর্টে আরও ৫০ জন নতুন বিচারক নিয়োগের ইঙ্গিত রয়েছে। এই সংখ্যা কিসের ভিত্তিতে ঠিক করা হয়েছে? যদি ‘বিএনপিপন্থী’ বিচারকদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার কোনো প্রবণতা থাকে, তাহলে তার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে?
লেখকের সঙ্গে আলোচনায় অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ ১০ মার্চ বলেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবে জনসংখ্যা ও মামলার অনুপাতে বিচারকসংখ্যা নির্ধারণের সূচক বেশ স্বীকৃত।’ ১৯৮৭ সালে ভারতের আইন কমিশন একটি প্রতিবেদনে বলেছিল, ভারতে প্রতি ১০ লাখ লোকের জন্য বিচারকসংখ্যা ১০ দশমিক ০৫ জন। অথচ ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে এই হার যথাক্রমে ৫০ দশমিক ০৯, ৫৭ দশমিক ০৭, ৭৫ দশমিক ০২ ও ১০৭ জন।
আমরা ১৫ কোটি মানুষ। এক মাস আগেও নিম্ন আদালতে বিচারকসংখ্যা ছিল এক হাজার ১৭৫। সম্প্রতি ২০৭ জন নবীন বিচারক যোগ দিয়েছেন। এখন সংখ্যাটা এক হাজার ৩৮২। ১৫ কোটি মানুষের জন্য এক হাজার ৩৮২ জন বিচারক। অর্থাত্ আমরা ১৯৮৭ সালের ভারতের অবস্থানে রয়েছি। অবশ্য বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার আগে বিচারক (ক্যাডারভুক্ত) সংখ্যা ছিল ৮০০-র নিচে। তার মানে প্রায় ১৭ লাখ লোকের জন্য একজন বিচারক ছিল। অল ইন্ডিয়া জাজেস অ্যাসোসিয়েশন মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দেন, সেটাই আমাদের অলোচিত মাসদার হোসেন মামলার মূলমন্ত্র।
অল ইন্ডিয়া জাজেস মামলার তৃতীয় পর্বের রায় মেলে ২০০২ সালে। ভারতীয় আইন কমিশন ১৯৮৭ সালে পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতি ১০ লাখে অন্তত ৫০ জন বিচারক নিয়োগের পরামর্শ দেয়। ১৫ বছর পর ২০০২ সালে অল ইন্ডিয়া জাজেস মামলায় ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট মুখ খোলেন। তাঁরা আইন কমিশনকে সমর্থন করে নিম্ন আদালতের বিচারকসংখ্যা পাঁচ গুণ বৃদ্ধির সুপারিশ করেন। ভারতের প্রধান বিচারপতি ও আইনবিদেরা ক্রমাগত এ বিষয়ে তাগিদ দিচ্ছেন। বাংলাদেশে এ বিষয়ে যে নীরবতা চলছে, সেটা ভাঙতে হবে। তবে এখানে একটা কথা বলা দরকার। জনসংখ্যা, নাকি মামলাসংখ্যা বিচারে নিম্ন আদালতে বিচারকসংখ্যা বাড়ানো হবে, তা নিয়ে ভারত সরকারের মনে দ্বন্দ্ব ছিল। সেই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটান বর্তমান অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি। তিনি তখন রাজ্যসভার সদস্য। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। ২০০১ সালের ডিসেম্বরে ওই কমিটি তাঁর ৮৫তম রিপোর্টের ৩৭তম অনুচ্ছেদে উল্লেখ করে, ‘কমিটি জনসংখ্যার অনুপাতে বিচারকসংখ্যা বাড়াতে আইন কমিশনের মত সমর্থন করছে।’
বাংলাদেশের সমস্যা আরও জটিল। জনসংখ্যার অনুপাতে নিম্ন আদালতে বিচারকদের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনা নেই। সুপ্রিম কোর্টেরও নেই। পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি ইফতেখার আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটি সম্প্রতি এক অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। শুধু বিচারপতিদের নিয়ে গঠিত ওই কমিটি ‘জাতীয় বিচারিক নীতি’ ঘোষণা করেছে। পাকিস্তানে এখন ১৬ লাখ মামলা বিচারাধীন। এক লাখ ৪০ হাজার উচ্চ আদালতে। নয়া বিচারনীতিতে পেন্ডিং মামলা নিষ্পত্তিতে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। জেলা জজরা বছরে ৫০ শতাংশ পুরোনো ও ৫০ শতাংশ নতুন মামলা শুনবেন। বিচারকের সংখ্যা বাড়ানোর সঙ্গে যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সম্পর্ক রয়েছে, তার প্রমাণ আমরা পাকিস্তানের অভিজ্ঞতায় দেখতে পাই। জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থায় অর্থবিল পাসের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকসংখ্যা বাড়ান। ছিল ১৭, করেন ২৯। ৩১ জুলাই, ২০০৯ পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট ২৯ সংখ্যা বৃদ্ধিকে অবৈধ ঘোষণা করেন। ১২ জন বিচারপতি ঘরে ফেরেন। বর্তমানে আগের মতোই ১৭ জন নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট চলছে।
বাংলাদেশের বিচার বিভাগের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ নিম্ন আদালতকে কাজ করতে দেওয়া। মানুষ যাতে বিচারিক আদালতকেই প্রধান আশ্রয়স্থল ভাবে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ২০০৮ সালে সুপ্রিম কোর্টে ছয় হাজার ২৫৭টি দেওয়ানি, ৩৪ হাজার ৪৯২টি ফৌজদারি, ১১ হাজার রিট ও ৮৮২টি অরিজিনাল মামলা হয়েছে। এক বছরে এই যে ৫০ হাজার মামলা ঢুকল, তার একটা বড় অংশই কিন্তু বিচারিক আদালতে নিষ্পন্ন হওয়ার কথা। ২০১০ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত কেবল বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল তিন লাখ ২৭ হাজার ৭৪০। পাকিস্তানের উচ্চ আদালতে এর চেয়ে অর্ধেকের কম মামলা বিচারাধীন রয়েছে। সেখানে চারটি হাইকোর্টে আইন দ্বারা নির্দিষ্ট বিচারকসংখ্যা ১০৫। বাস্তবে অনেক পদ শূন্য।
বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন নিম্ন আদালতের বিচারক নিয়োগ দিয়ে থাকে। এ কমিশনের নিয়োগপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা সন্তোষজনক। আমরা প্রশংসাও করেছি। কিন্তু একটি নতুন তথ্য জানলাম। একটু খটকা লাগল। বিদায়ী প্রধান বিচারপতি তাফাজ্জাল ইসলাম আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. আবদুল মতিনকে সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান পদে আইন অনুযায়ী সুপারিশ করেছিলেন। সেটা নিশ্চয়ই রদ হতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি কোনো লিখিত কারণ না দেখিয়ে তা অগ্রাহ্য করেছেন। এটা সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ, এটাই ভবিষ্যতে রেওয়াজ বা নজিরে পরিণত হবে।
বিচারক নিয়োগে নির্বাহী বিভাগকে রুখতে হলে সুপ্রিম কোর্টকে নেতৃত্ব দিতে হবে। ভারত ও পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা নিয়মিত সম্মেলন করেন, বৈঠক করেন। বাংলাদেশকেও এই ধারায় আসতে হবে। তবে তার লক্ষণ দেখি না। সুপ্রিম কোর্টের বারের নির্বাচনে বিচার বিভাগ সংস্কারের কোনো এজেন্ডা নেই। নিম্ন আদালতের জন্য অমর্যাদাকর, তার সাংবিধানিক এখতিয়ার খর্ব বা ম্লান করে এমন অনেক জামিন, আগাম জামিন, স্টে-সংক্রান্ত অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ আমরা দেখি। এই বিচারব্যবস্থা সংবিধানের অচেনা। কিন্তু এটা বদলানোর কোনো স্লোগান সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে নেই, বরং কদমবুসি নিয়ে বার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার কথা শুনতে পাই।
১৯৭২ সালে হাইকোর্টের বিচারকসংখ্যা ছিল ১০। ২০০৫ সালে জোট সরকার এটা ৭২-এ উন্নীত করে। ২০০৯ সালে ৭৮ জনে পৌঁছায়। এর পরের সংখ্যা কত, কারা আসবেন? তাঁদের যোগ্যতা কী?
জোট সরকারের আমলের ‘অযোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত বিচারকদের সম্পর্কে বারের রেজুলেশন সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নীরব। অনেকে এই নীরবতাকে নতুন প্রলয়ের পূর্ববর্তী থমথমে অবস্থার সঙ্গে তুলনা করেন।
‘আগের মতোই চুপিসারে হাইকোর্টে বিচারক নিয়োগ ঘটতে যাচ্ছে, সংসদে কিছু বলছেন না কেন?’ আমি প্রশ্ন করি টেলিফোনে। ‘আমরা ভুল করেছিলাম। আওয়ামী লীগও ভুল করতে যাচ্ছে। তারা কত অধ্যাদেশ পাস করল, কিন্তু সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল অধ্যাদেশটি বাদ দিল।’ প্রশ্নের জবাবে এ কথা আমাকে যিনি বলেন, তিনি মওদুদ আহমদ। ৭ মার্চ তিনি বললেন, হ্যাঁ, নতুন বিচারক নিয়োগে একটা নতুন আইন হওয়া উচিত। বললাম, আপনি একটি বিল আনুন। বেসরকারি বিল। হোক পণ্ডশ্রম। তবু আনুন। মওদুদ আহমদ কথা দিলেন। বললেন, ‘আমি এ নিয়ে অবশ্যই ভাবব। একটি বিল আনা সত্যিই অপরিহার্য।’ আমাদের দাবি হলো, সংসদে বিচারকসংখ্যা ঠিক হোক। আইন হোক। তত দিন হাইকোর্টে বিচারক নিয়োগ বন্ধ থাকুক।
পুনশ্চ: এই লেখা শেষ করার পর জানলাম, সংবিধানের ৯৫(২)গ অনুচ্ছেদ মতে, একটি আইনের খসড়া তৈরি করে ফেলেছে সংসদীয় উপকমিটি। এ কমিটির সভাপতি সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু। গতকাল তিনি আমাকে বলেন, ‘এতে শুধু যোগ্যতা নির্ধারণের দিকটি এসেছে। বিলুপ্ত অধ্যাদেশের মতো নিয়োগ কমিশন ধরনের নয়।’ তার পরও বলব, এটি একটি অগ্রগতি। হাইকোটে নতুন নিয়োগ যদি দিতেই হয়, তাহলে তা অন্তত এই আইনের আওতায় হোক।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের বিচারক নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাই শেষ কথা। বিচারকসংখ্যা ঠিক করার চাবিকাঠিও তাঁর হাতে। বিচারকের সংখ্যার সঙ্গে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সম্পর্ক আছে। এটা আমরা এত দিন বোঝার চেষ্টা করিনি। তবে এবার সম্ভবত বুঝতে হবে। কারণ, সরকার বিচারক নিয়োগে এখন জোট সরকারকে টেক্কা দিতে চাইছে।
সংবিধানপ্রণেতারা আপিল বিভাগের বিচারকসংখ্যা নির্দিষ্ট করেছিলেন। সংখ্যাটি ছিল ৪। ৯৪ অনুচ্ছেদে এটা মুদ্রিতও হয়েছিল। কিন্তু পরে বাদ পড়ে। সংবিধানে এখন লেখা আছে, রাষ্ট্রপতি ‘যেরূপসংখ্যক বিচারক নিয়োগের প্রয়োজন বোধ’ করবেন, তেমনসংখ্যক বিচারক নিয়ে দুই বিভাগ চলবে।
যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানে আইন দ্বারা উচ্চ আদালতের বিচারকসংখ্যা নির্ধারিত। এই সংখ্যা নির্ধারণ মূলত সংসদের কাজ। বেশির ভাগ লিখিত সংবিধানেই লেখা থাকে, এটা আইন দ্বারা নির্দিষ্ট হতে হবে। ভারত ও পাকিস্তানেও আইন আছে। ১৯৫৬ সালে অবিভক্ত পাকিস্তানের মূল সংবিধানেও কিন্তু এটা লেখা ছিল। এর ৪৯ অনুচ্ছেদে বলা ছিল, এটা আইন দ্বারা নির্ধারিত না হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি সংখ্যা স্থির করবেন। এভাবে আমরা দেখি, বিষয়টি ঐতিহাসিকভাবে সংসদের এখতিয়ার। কিন্তু বাংলাদেশের শাসকগোষ্ঠী দীর্ঘকাল আইন ছাড়াই বিচারকের সংখ্যা ঠিক করেছে। ১৯৭২ থেকে এ পর্যন্ত কখনোই হাইকোর্টের বিচারকসংখ্যায় কোনো শৃঙ্খলা দেখা যায় না। যার যেমন খুশি তেমন সংখ্যায় তাঁরা বিচারক নিয়োগ দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগ সরকারই এবার প্রথম আকস্মিকভাবে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করল। সংশ্লিষ্ট কাউকে কিছু জানানো হলো না। সুপ্রিম কোর্ট বারকে জিজ্ঞেস করা হয়নি। এর নেতারা অবশ্য এ বিষয়ে মাথা ঘামাতে উত্সুক ছিলেন, তাও নয়। সুতরাং নিঃশব্দে প্রজ্ঞাপন জারি হলো। আপিল বিভাগের বিচারকসংখ্যা হবে ১১। দীর্ঘকাল এখানে পাঁচজন বসেছেন। জোট সরকারের আমলে সাতজন দিয়ে চলল। এই মুহূর্তে দুই বিভাগে ৮২ জন বিচারক রয়েছেন। ১১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ আপিল বিভাগ অল্প দিনই সক্রিয় থেকেছে। বেশ কিছুদিন হলো সাতজন দিয়ে চলছে আপিল বিভাগ। কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়াই শূন্যতা চলছে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। প্রতীয়মান হচ্ছে, সরকারের মাথায় নানা হিসাব-নিকাশ, যার সঙ্গে বিচার বিভাগের ভালো-মন্দের যোগসূত্রটাই সবচেয়ে আলগা।
শুনতে পাই, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শুনানি সামনে রেখে সরকার আপিল বিভাগে নতুন চারজন বিচারক নিয়োগে প্রস্তাব পাঠিয়েছিল। সেই প্রস্তাবে বিস্ময়করভাবে ‘লাখো’ মামলা পেন্ডিং থাকার দোহাই দেওয়া হয়েছিল। তখন সুপ্রিম কোর্ট জানিয়ে দেন যে লাখ নয়, আপিল বিভাগে মাত্র কয়েক হাজার মামলা পেন্ডিং রয়েছে। তা ছাড়া অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার দিকেও সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গুলি নির্দেশ করেন। জানা যায়, এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রপতি প্রজ্ঞাপন জারি করেন। এই তথ্য সত্য হলে ধরে নিতে হয় যে এখানে একটা অগ্রহণযোগ্য কৌশলগত ব্যাপার ছিল। কারণ, রাষ্ট্রপতি আইন করে দিলে সুপ্রিম কোর্টের কিছু বলার থাকে না। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ এত দিন ১১ জনের ছিল। চারজন অবসরে যাওয়ার পর আর নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। এখন রাষ্ট্রপতি কেন মনে করছেন যে ১১ জনের কাজ সাতজন দিয়েই চলে? এত দিন আইন ছিল না, কিন্তু আইন করার পরও ‘প্রয়োজন বোধ’ না করার তো সুযোগ নেই। এখন ওই আইন মানতে রাষ্ট্রপতিও বাধ্য।
কোনো এক বা একাধিক বিশেষ মামলা পরিচালনা বা বিশেষ পরিস্থিতি মোকাবিলায় কী করতে হবে, সে বিষয়ে সংবিধানের স্কিম খুবই স্পষ্ট। আপিল বিভাগে অস্থায়ী বিচারক ও হাইকোর্টে অতিরিক্ত বিচারক নিয়োগের বিধান সে কারণেই রাখা। নির্বাহী বিভাগ মামলা স্তূপের যুক্তি দিতে পারেন। জনগণকে দ্রুত বিচার প্রদানের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা বলতে পারেন। কিন্তু তাঁদের সে যুক্তি ধোপে টেকে কি না, সেটাই বড় প্রশ্ন।
আপিল বিভাগের চারটি পদ কেন এখন শূন্য রাখা হচ্ছে? হাইকোর্ট বিভাগে কেন এখনই বিচারক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না? তার কারণ বিচারিক, না রাজনৈতিক? সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন আসন্ন। এর আগ পর্যন্ত নিয়োগ ঝুলতে পারে। তবে হাইকোর্টে আরও ৫০ জন নতুন বিচারক নিয়োগের ইঙ্গিত রয়েছে। এই সংখ্যা কিসের ভিত্তিতে ঠিক করা হয়েছে? যদি ‘বিএনপিপন্থী’ বিচারকদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার কোনো প্রবণতা থাকে, তাহলে তার চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আর কী হতে পারে?
লেখকের সঙ্গে আলোচনায় অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ ১০ মার্চ বলেন, ‘আন্তর্জাতিকভাবে জনসংখ্যা ও মামলার অনুপাতে বিচারকসংখ্যা নির্ধারণের সূচক বেশ স্বীকৃত।’ ১৯৮৭ সালে ভারতের আইন কমিশন একটি প্রতিবেদনে বলেছিল, ভারতে প্রতি ১০ লাখ লোকের জন্য বিচারকসংখ্যা ১০ দশমিক ০৫ জন। অথচ ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে এই হার যথাক্রমে ৫০ দশমিক ০৯, ৫৭ দশমিক ০৭, ৭৫ দশমিক ০২ ও ১০৭ জন।
আমরা ১৫ কোটি মানুষ। এক মাস আগেও নিম্ন আদালতে বিচারকসংখ্যা ছিল এক হাজার ১৭৫। সম্প্রতি ২০৭ জন নবীন বিচারক যোগ দিয়েছেন। এখন সংখ্যাটা এক হাজার ৩৮২। ১৫ কোটি মানুষের জন্য এক হাজার ৩৮২ জন বিচারক। অর্থাত্ আমরা ১৯৮৭ সালের ভারতের অবস্থানে রয়েছি। অবশ্য বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার আগে বিচারক (ক্যাডারভুক্ত) সংখ্যা ছিল ৮০০-র নিচে। তার মানে প্রায় ১৭ লাখ লোকের জন্য একজন বিচারক ছিল। অল ইন্ডিয়া জাজেস অ্যাসোসিয়েশন মামলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দেন, সেটাই আমাদের অলোচিত মাসদার হোসেন মামলার মূলমন্ত্র।
অল ইন্ডিয়া জাজেস মামলার তৃতীয় পর্বের রায় মেলে ২০০২ সালে। ভারতীয় আইন কমিশন ১৯৮৭ সালে পাঁচ বছরের মধ্যে প্রতি ১০ লাখে অন্তত ৫০ জন বিচারক নিয়োগের পরামর্শ দেয়। ১৫ বছর পর ২০০২ সালে অল ইন্ডিয়া জাজেস মামলায় ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট মুখ খোলেন। তাঁরা আইন কমিশনকে সমর্থন করে নিম্ন আদালতের বিচারকসংখ্যা পাঁচ গুণ বৃদ্ধির সুপারিশ করেন। ভারতের প্রধান বিচারপতি ও আইনবিদেরা ক্রমাগত এ বিষয়ে তাগিদ দিচ্ছেন। বাংলাদেশে এ বিষয়ে যে নীরবতা চলছে, সেটা ভাঙতে হবে। তবে এখানে একটা কথা বলা দরকার। জনসংখ্যা, নাকি মামলাসংখ্যা বিচারে নিম্ন আদালতে বিচারকসংখ্যা বাড়ানো হবে, তা নিয়ে ভারত সরকারের মনে দ্বন্দ্ব ছিল। সেই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটান বর্তমান অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি। তিনি তখন রাজ্যসভার সদস্য। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। ২০০১ সালের ডিসেম্বরে ওই কমিটি তাঁর ৮৫তম রিপোর্টের ৩৭তম অনুচ্ছেদে উল্লেখ করে, ‘কমিটি জনসংখ্যার অনুপাতে বিচারকসংখ্যা বাড়াতে আইন কমিশনের মত সমর্থন করছে।’
বাংলাদেশের সমস্যা আরও জটিল। জনসংখ্যার অনুপাতে নিম্ন আদালতে বিচারকদের সংখ্যা বৃদ্ধির বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনা নেই। সুপ্রিম কোর্টেরও নেই। পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি ইফতেখার আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত একটি কমিটি সম্প্রতি এক অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। শুধু বিচারপতিদের নিয়ে গঠিত ওই কমিটি ‘জাতীয় বিচারিক নীতি’ ঘোষণা করেছে। পাকিস্তানে এখন ১৬ লাখ মামলা বিচারাধীন। এক লাখ ৪০ হাজার উচ্চ আদালতে। নয়া বিচারনীতিতে পেন্ডিং মামলা নিষ্পত্তিতে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। জেলা জজরা বছরে ৫০ শতাংশ পুরোনো ও ৫০ শতাংশ নতুন মামলা শুনবেন। বিচারকের সংখ্যা বাড়ানোর সঙ্গে যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সম্পর্ক রয়েছে, তার প্রমাণ আমরা পাকিস্তানের অভিজ্ঞতায় দেখতে পাই। জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থায় অর্থবিল পাসের সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের বিচারকসংখ্যা বাড়ান। ছিল ১৭, করেন ২৯। ৩১ জুলাই, ২০০৯ পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট ২৯ সংখ্যা বৃদ্ধিকে অবৈধ ঘোষণা করেন। ১২ জন বিচারপতি ঘরে ফেরেন। বর্তমানে আগের মতোই ১৭ জন নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট চলছে।
বাংলাদেশের বিচার বিভাগের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ নিম্ন আদালতকে কাজ করতে দেওয়া। মানুষ যাতে বিচারিক আদালতকেই প্রধান আশ্রয়স্থল ভাবে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। ২০০৮ সালে সুপ্রিম কোর্টে ছয় হাজার ২৫৭টি দেওয়ানি, ৩৪ হাজার ৪৯২টি ফৌজদারি, ১১ হাজার রিট ও ৮৮২টি অরিজিনাল মামলা হয়েছে। এক বছরে এই যে ৫০ হাজার মামলা ঢুকল, তার একটা বড় অংশই কিন্তু বিচারিক আদালতে নিষ্পন্ন হওয়ার কথা। ২০১০ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত কেবল বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল তিন লাখ ২৭ হাজার ৭৪০। পাকিস্তানের উচ্চ আদালতে এর চেয়ে অর্ধেকের কম মামলা বিচারাধীন রয়েছে। সেখানে চারটি হাইকোর্টে আইন দ্বারা নির্দিষ্ট বিচারকসংখ্যা ১০৫। বাস্তবে অনেক পদ শূন্য।
বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন নিম্ন আদালতের বিচারক নিয়োগ দিয়ে থাকে। এ কমিশনের নিয়োগপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা সন্তোষজনক। আমরা প্রশংসাও করেছি। কিন্তু একটি নতুন তথ্য জানলাম। একটু খটকা লাগল। বিদায়ী প্রধান বিচারপতি তাফাজ্জাল ইসলাম আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. আবদুল মতিনকে সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান পদে আইন অনুযায়ী সুপারিশ করেছিলেন। সেটা নিশ্চয়ই রদ হতে পারে। কিন্তু রাষ্ট্রপতি কোনো লিখিত কারণ না দেখিয়ে তা অগ্রাহ্য করেছেন। এটা সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ, এটাই ভবিষ্যতে রেওয়াজ বা নজিরে পরিণত হবে।
বিচারক নিয়োগে নির্বাহী বিভাগকে রুখতে হলে সুপ্রিম কোর্টকে নেতৃত্ব দিতে হবে। ভারত ও পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা নিয়মিত সম্মেলন করেন, বৈঠক করেন। বাংলাদেশকেও এই ধারায় আসতে হবে। তবে তার লক্ষণ দেখি না। সুপ্রিম কোর্টের বারের নির্বাচনে বিচার বিভাগ সংস্কারের কোনো এজেন্ডা নেই। নিম্ন আদালতের জন্য অমর্যাদাকর, তার সাংবিধানিক এখতিয়ার খর্ব বা ম্লান করে এমন অনেক জামিন, আগাম জামিন, স্টে-সংক্রান্ত অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ আমরা দেখি। এই বিচারব্যবস্থা সংবিধানের অচেনা। কিন্তু এটা বদলানোর কোনো স্লোগান সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে নেই, বরং কদমবুসি নিয়ে বার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার কথা শুনতে পাই।
১৯৭২ সালে হাইকোর্টের বিচারকসংখ্যা ছিল ১০। ২০০৫ সালে জোট সরকার এটা ৭২-এ উন্নীত করে। ২০০৯ সালে ৭৮ জনে পৌঁছায়। এর পরের সংখ্যা কত, কারা আসবেন? তাঁদের যোগ্যতা কী?
জোট সরকারের আমলের ‘অযোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত বিচারকদের সম্পর্কে বারের রেজুলেশন সম্পর্কে আওয়ামী লীগ নীরব। অনেকে এই নীরবতাকে নতুন প্রলয়ের পূর্ববর্তী থমথমে অবস্থার সঙ্গে তুলনা করেন।
‘আগের মতোই চুপিসারে হাইকোর্টে বিচারক নিয়োগ ঘটতে যাচ্ছে, সংসদে কিছু বলছেন না কেন?’ আমি প্রশ্ন করি টেলিফোনে। ‘আমরা ভুল করেছিলাম। আওয়ামী লীগও ভুল করতে যাচ্ছে। তারা কত অধ্যাদেশ পাস করল, কিন্তু সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল অধ্যাদেশটি বাদ দিল।’ প্রশ্নের জবাবে এ কথা আমাকে যিনি বলেন, তিনি মওদুদ আহমদ। ৭ মার্চ তিনি বললেন, হ্যাঁ, নতুন বিচারক নিয়োগে একটা নতুন আইন হওয়া উচিত। বললাম, আপনি একটি বিল আনুন। বেসরকারি বিল। হোক পণ্ডশ্রম। তবু আনুন। মওদুদ আহমদ কথা দিলেন। বললেন, ‘আমি এ নিয়ে অবশ্যই ভাবব। একটি বিল আনা সত্যিই অপরিহার্য।’ আমাদের দাবি হলো, সংসদে বিচারকসংখ্যা ঠিক হোক। আইন হোক। তত দিন হাইকোর্টে বিচারক নিয়োগ বন্ধ থাকুক।
পুনশ্চ: এই লেখা শেষ করার পর জানলাম, সংবিধানের ৯৫(২)গ অনুচ্ছেদ মতে, একটি আইনের খসড়া তৈরি করে ফেলেছে সংসদীয় উপকমিটি। এ কমিটির সভাপতি সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু। গতকাল তিনি আমাকে বলেন, ‘এতে শুধু যোগ্যতা নির্ধারণের দিকটি এসেছে। বিলুপ্ত অধ্যাদেশের মতো নিয়োগ কমিশন ধরনের নয়।’ তার পরও বলব, এটি একটি অগ্রগতি। হাইকোটে নতুন নিয়োগ যদি দিতেই হয়, তাহলে তা অন্তত এই আইনের আওতায় হোক।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com
No comments