স্মরণ-স্মৃতিতে অমর আবুল মনসুর আহমদ
উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদের ৩১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ ১৮ মার্চ। এ উপলক্ষে আবুল মনসুর আহমদ স্মৃতি সংসদ ঢাকা ও ময়মনসিংহের ধানীখোলায় তাঁর পৈতৃক বাসভবনে এক দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্রুপাত্মক রচয়িতা আবুল মনসুর আহমদ ছিলেন একাধারে একজন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, আইনজ্ঞ ও সাংবাদিক। তিনি কৃষক ও নবযুগ পত্রিকায় কাজ করেছেন এবং ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত বাংলার কলকাতা থেকে প্রকাশিত ইত্তেহাদ-এর সম্পাদক ছিলেন। তিনি ছিলেন আধুনিক ও প্রগতিশীল সাংবাদিকতার এক অগ্রপথিক।
অত্যন্ত সফল রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন এবং ১৯৫৭ সালে প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আওয়ামী লীগ সরকারের ছিলেন কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী। পূর্ব বাংলার স্বার্থের সপক্ষে শক্ত অবস্থান ও নানাবিধ উদ্যোগের জন্য, বিশেষ করে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে তাঁর সুনাম রয়েছে।
আবুল মনসুর আহমদের রচনাসম্ভারের মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত বিদ্রুপাত্মক গ্রন্থাবলি—আয়না, আসমানী পর্দা, গালিভারের সফরনামা ও ফুড কনফারেন্স। আরও রয়েছে বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের ওপর বিখ্যাত রচনাবলি। তাঁর আত্মজীবনীমূলক দুটি গ্রন্থ হচ্ছে—আত্মকথা ও আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর।
আবুল মনসুর আহমদ চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকজুড়ে সব সময় ধর্মনিরপেক্ষতার সপক্ষে যে প্রচার চালিয়েছেন, তার তুলনা হয় না। পাকিস্তানের প্রথম দিকে বিরোধীদলীয় আন্দোলনে তাঁর অবদান ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রথম দিকের একজন নেতা।
চল্লিশের দশকের প্রথম থেকেই তিনি ভাষা বিষয়ে লিখে আসছিলেন এবং ইত্তেহাদ-এর সম্পাদক হিসেবে ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখেন। তিনি ছিলেন ১৯৫৪-এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের (আমাদের রাজনীতির তিন জাঁদরেল ব্যক্তিত্ব শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মহাসমন্বয়) মেনিফেস্টো ‘একুশ দফা’র রচয়িতা, যে নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ক্ষমতা থেকে উত্খাত করা হয়।
একুশ দফা ছিল তদানীন্তন পাকিস্তানের পূর্বাংশের বাঙালিদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দাবির প্রথম পূর্ণাঙ্গ উপস্থাপন। রাজনৈতিক কার্যকারণে আবুল মনসুর আহমদকে পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে ও ষাটের দশকের প্রথম দিকে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে বেশ কয়েকবার কারাবরণ করতে হয়।
বাংলা একাডেমী সম্প্রতি আবুল মনসুর আহমদ রচনাসমগ্র-এর তিন খণ্ড প্রকাশ করেছে। আরও তিন খণ্ড প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
বিচক্ষণ এই মনীষীর সাংবাদিক হওয়াবিষয়ক স্মৃতি তুলে ধরা হলো তাঁর আত্মকথা বই থেকে: “১৯৪১ সালের অক্টোবর মাসে হক সাহেব ‘নবযুগ’ বাহির করেন। আমি ইহার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করি। কিন্তু উহাতে সম্পাদকরূপে আমার নাম দিতে রাযী হই নাই। ইহার একাধিক কারণ ছিল। প্রথমতঃ যদিও আমি সাংবাদিকতাকে প্রফেশন হিসাবে গ্রহণ করিয়া ব্যক্তিগত মতামত নিরপেক্ষভাবে যে কোন মতের কাগযে চাকুরি নিতে সাংবাদিক বন্ধুদেরে উপদেশ দিতাম। কিন্তু আমি নিজে তা করিতে রাযী ছিলাম না। কারণ আমার নিজের একটা রাজনীতিক জীবন ছিল। সেটা নষ্ট করিতে আমি প্রস্তুত ছিলাম না। দ্বিতীয়তঃ যে উদ্দেশ্য প্রচারের জন্য হক সাহেব ‘নবযুগ’ বাহির করিলেন, সে উদ্দেশ্যের সহিত আমার পূর্ণ সহানুভূতি থাকিলেও হক সাহেবের মতের স্থিরতায় আমার আস্থা ছিল না। মুসলিম লীগ নেতৃত্বের সাথে বিশেষতঃ জিন্নাহ সাহেবের সহিত হক সাহেবের বিরোধের মূল কথা আমি জানিতাম। মুসলিম বাংলার স্বার্থ জিন্নাহ নেতৃত্বের হাতে নিরাপদ নয় বলিয়াই হক সাহেব জিন্নাহ সাহেবের সাথে কলহ করিতেছেন, হক সাহেবের একথা আমি বিশ্বাস করিতাম। ‘নবযুগ’ বাহির হইবার মাসাধিক কাল আগে হইতেই হক সাহেব তাঁর উদ্দেশ্যের কথা আমাকে বলেন এবং আমার সহযোগিতা দাবি করেন। আমার কলমের উপর হক সাহেবের আস্থা ছিল। তিনি মুসলিম লীগে থাকিয়া মুসলিম লীগ প্রধানমন্ত্রী হিসাবেই ‘নবযুগ’ বাহির করিতেছেন। অথচ শেষ পর্যন্ত মুসলিম লীগ হইতে তিনি বাহির হইয়া আসিবেন। এসব ব্যাপারে তাঁর ধারণা ছিল সুস্পষ্ট। এ অবস্থায় ‘নবযুগে’র সম্পাদকীয় নীতি পরিচালনার দায়িত্ব তিনি আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে দিয়া বিশ্বাস পাইতেছেন না, হক সাহেবের এসব কথাও আমি বিশ্বাস করিয়াছিলাম। দাম্ভিকতা ও অহংকার না করিয়াও আমি বলিতে পারি, আমার মত উকিল-সম্পাদক ছাড়া আর কারও পক্ষে এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে হক সাহেবের পসন্দ-মত কাগয চালানো সম্ভব ছিল না। এ অবস্থায় আমি সর্বশক্তি দিয়া হক সাহেবকে সমর্থন করিতে প্রস্তুত ছিলাম। এর উপর আমার বিশেষ অন্তরংগ শ্রদ্ধেয় বন্ধু সৈয়দ বদরুদ্দোজা আমাকে বুঝাইলেন যে মুসলিম বাংলার স্বার্থে হক নেতৃত্বের পিছনে দাঁড়াইতে তাঁর মত বহু মুসলিম লীগার প্রস্তুত। আসল কারণ তাঁরাও বিশ্বাস করেন যে হক সাহেব জিন্নাহ সাহেবের নিকট পরাজিত হইলে অথবা হক সাহেবের রাজনৈতিক অপমৃত্যু ঘটিলে মুসলিম বাংলার ভবিষ্যত্ নাই। সুতরাং হক সাহেবের ‘নবযুগে’ যোগ দেওয়া সম্বন্ধে আমার মনে কোনো দ্বিধা থাকিল না।”
অত্যন্ত সফল রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের যুক্তফ্রন্ট সরকারের প্রাদেশিক শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন এবং ১৯৫৭ সালে প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আওয়ামী লীগ সরকারের ছিলেন কেন্দ্রীয় বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী। পূর্ব বাংলার স্বার্থের সপক্ষে শক্ত অবস্থান ও নানাবিধ উদ্যোগের জন্য, বিশেষ করে শিল্পায়নের ক্ষেত্রে তাঁর সুনাম রয়েছে।
আবুল মনসুর আহমদের রচনাসম্ভারের মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত বিদ্রুপাত্মক গ্রন্থাবলি—আয়না, আসমানী পর্দা, গালিভারের সফরনামা ও ফুড কনফারেন্স। আরও রয়েছে বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের ওপর বিখ্যাত রচনাবলি। তাঁর আত্মজীবনীমূলক দুটি গ্রন্থ হচ্ছে—আত্মকথা ও আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর।
আবুল মনসুর আহমদ চল্লিশ, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকজুড়ে সব সময় ধর্মনিরপেক্ষতার সপক্ষে যে প্রচার চালিয়েছেন, তার তুলনা হয় না। পাকিস্তানের প্রথম দিকে বিরোধীদলীয় আন্দোলনে তাঁর অবদান ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি ছিলেন আওয়ামী লীগের প্রথম দিকের একজন নেতা।
চল্লিশের দশকের প্রথম থেকেই তিনি ভাষা বিষয়ে লিখে আসছিলেন এবং ইত্তেহাদ-এর সম্পাদক হিসেবে ভাষা আন্দোলনে অবদান রাখেন। তিনি ছিলেন ১৯৫৪-এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের (আমাদের রাজনীতির তিন জাঁদরেল ব্যক্তিত্ব শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মহাসমন্বয়) মেনিফেস্টো ‘একুশ দফা’র রচয়িতা, যে নির্বাচনে মুসলিম লীগকে ক্ষমতা থেকে উত্খাত করা হয়।
একুশ দফা ছিল তদানীন্তন পাকিস্তানের পূর্বাংশের বাঙালিদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দাবির প্রথম পূর্ণাঙ্গ উপস্থাপন। রাজনৈতিক কার্যকারণে আবুল মনসুর আহমদকে পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে ও ষাটের দশকের প্রথম দিকে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে বেশ কয়েকবার কারাবরণ করতে হয়।
বাংলা একাডেমী সম্প্রতি আবুল মনসুর আহমদ রচনাসমগ্র-এর তিন খণ্ড প্রকাশ করেছে। আরও তিন খণ্ড প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
বিচক্ষণ এই মনীষীর সাংবাদিক হওয়াবিষয়ক স্মৃতি তুলে ধরা হলো তাঁর আত্মকথা বই থেকে: “১৯৪১ সালের অক্টোবর মাসে হক সাহেব ‘নবযুগ’ বাহির করেন। আমি ইহার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করি। কিন্তু উহাতে সম্পাদকরূপে আমার নাম দিতে রাযী হই নাই। ইহার একাধিক কারণ ছিল। প্রথমতঃ যদিও আমি সাংবাদিকতাকে প্রফেশন হিসাবে গ্রহণ করিয়া ব্যক্তিগত মতামত নিরপেক্ষভাবে যে কোন মতের কাগযে চাকুরি নিতে সাংবাদিক বন্ধুদেরে উপদেশ দিতাম। কিন্তু আমি নিজে তা করিতে রাযী ছিলাম না। কারণ আমার নিজের একটা রাজনীতিক জীবন ছিল। সেটা নষ্ট করিতে আমি প্রস্তুত ছিলাম না। দ্বিতীয়তঃ যে উদ্দেশ্য প্রচারের জন্য হক সাহেব ‘নবযুগ’ বাহির করিলেন, সে উদ্দেশ্যের সহিত আমার পূর্ণ সহানুভূতি থাকিলেও হক সাহেবের মতের স্থিরতায় আমার আস্থা ছিল না। মুসলিম লীগ নেতৃত্বের সাথে বিশেষতঃ জিন্নাহ সাহেবের সহিত হক সাহেবের বিরোধের মূল কথা আমি জানিতাম। মুসলিম বাংলার স্বার্থ জিন্নাহ নেতৃত্বের হাতে নিরাপদ নয় বলিয়াই হক সাহেব জিন্নাহ সাহেবের সাথে কলহ করিতেছেন, হক সাহেবের একথা আমি বিশ্বাস করিতাম। ‘নবযুগ’ বাহির হইবার মাসাধিক কাল আগে হইতেই হক সাহেব তাঁর উদ্দেশ্যের কথা আমাকে বলেন এবং আমার সহযোগিতা দাবি করেন। আমার কলমের উপর হক সাহেবের আস্থা ছিল। তিনি মুসলিম লীগে থাকিয়া মুসলিম লীগ প্রধানমন্ত্রী হিসাবেই ‘নবযুগ’ বাহির করিতেছেন। অথচ শেষ পর্যন্ত মুসলিম লীগ হইতে তিনি বাহির হইয়া আসিবেন। এসব ব্যাপারে তাঁর ধারণা ছিল সুস্পষ্ট। এ অবস্থায় ‘নবযুগে’র সম্পাদকীয় নীতি পরিচালনার দায়িত্ব তিনি আমাকে ছাড়া অন্য কাউকে দিয়া বিশ্বাস পাইতেছেন না, হক সাহেবের এসব কথাও আমি বিশ্বাস করিয়াছিলাম। দাম্ভিকতা ও অহংকার না করিয়াও আমি বলিতে পারি, আমার মত উকিল-সম্পাদক ছাড়া আর কারও পক্ষে এই সংকটজনক পরিস্থিতিতে হক সাহেবের পসন্দ-মত কাগয চালানো সম্ভব ছিল না। এ অবস্থায় আমি সর্বশক্তি দিয়া হক সাহেবকে সমর্থন করিতে প্রস্তুত ছিলাম। এর উপর আমার বিশেষ অন্তরংগ শ্রদ্ধেয় বন্ধু সৈয়দ বদরুদ্দোজা আমাকে বুঝাইলেন যে মুসলিম বাংলার স্বার্থে হক নেতৃত্বের পিছনে দাঁড়াইতে তাঁর মত বহু মুসলিম লীগার প্রস্তুত। আসল কারণ তাঁরাও বিশ্বাস করেন যে হক সাহেব জিন্নাহ সাহেবের নিকট পরাজিত হইলে অথবা হক সাহেবের রাজনৈতিক অপমৃত্যু ঘটিলে মুসলিম বাংলার ভবিষ্যত্ নাই। সুতরাং হক সাহেবের ‘নবযুগে’ যোগ দেওয়া সম্বন্ধে আমার মনে কোনো দ্বিধা থাকিল না।”
No comments