রাশিয়ায় গণতন্ত্র-পিরিস্ত্রোইকার ২৫ বছর by মিখাইল গর্বাচভ
১৯৮৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে আমি যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু করেছিলাম, সেই পিরিস্ত্রোইকা তখন থেকেই উত্তপ্ত বিতর্কের বিষয় ছিল। আজ সেই বিতর্ক এক নতুন মাত্রা পেয়েছে, শুধু এ জন্য নয় যে পিরিস্ত্রোইকার পঁচিশ বছর পূর্ণ হচ্ছে, বরং এ কারণেও যে রাশিয়া আবারও পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। এ রকম মুহূর্তে পেছন দিকে ফিরে তাকানো উচিত এবং জরুরি।
আমরা পিরিস্ত্রোইকা শুরু করেছিলাম কারণ আমাদের জনগণ ও দেশের নেতারা উপলব্ধি করেছিলেন, যেভাবে আমরা এত দিন চলেছি সেভাবে আর চলবে না। ব্যাপক উদ্যোগ ও ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা সোভিয়েত ব্যবস্থা আমাদের দেশটিকে পরিণত করেছিল শক্তিশালী শিল্পভিত্তিসম্পন্ন এক প্রধান বিশ্বশক্তিতে। সোভিয়েত ইউনিয়ন শক্তিমত্তা দেখিয়েছে জরুরি, সংকটময় পরিস্থিতিতে। কিন্তু অপেক্ষাকৃত স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রব্যবস্থা আমাদের হীনবল করেছে।
এটা পরিষ্কার হয়েছিল আমার কাছে, সোভিয়েত ইউনিয়নের নতুন প্রজন্মের নেতাদের কাছে, এবং বিপ্লবের আদি নেতাদের কাছেও, যাঁরা দেশটির ভবিষ্যত্ নিয়ে ভাবতেন। ১৯৮৫ সালের মার্চে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির যে প্লেনারি সভায় আমাকে পার্টির নতুন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়, এর কয়েক ঘণ্টা আগে সে সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই গ্রোমিকোর সঙ্গে আলাপের কথা আমার মনে পড়ে। গ্রোমিকো আমার সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছিলেন যে ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন, ঝুঁকি যত বড়ই হোক না কেন।
আমাকে প্রায়শই জিজ্ঞেস করা হয়, আমাদের কী করতে হবে তার সম্পূর্ণটা আমার ও আমার সহযোগী নেতাদের জানা ছিল কি না। এর উত্তর ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ জানা ছিল, কিন্তু সম্পূর্ণভাবে নয়, তাত্ক্ষণিকভাবেও নয়। কী আমাদের ত্যাগ করতে হবে সেটা ছিল বেশ পরিষ্কার। আমাদের কাছে খুব পরিষ্কার ছিল যে অনড় আদর্শবাদী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, পৃথিবীর অবশিষ্ট অংশের সিংহভাগের সঙ্গে যে সংঘাত চলে আসছে, তা আমাদের পরিত্যাগ করতে হবে; এবং যে লাগামহীন অস্ত্র প্রতিযোগিতা আমরা চালিয়ে এসেছি, তা বন্ধ করতে হবে। এসব পরিত্যাগের পক্ষে আমাদের প্রতি জনগণের পরিপূর্ণ সমর্থন ছিল। কট্টর স্তালিনপন্থীদের চুপ মেরে যেতে হয়েছিল, এমনকি মেনে নিতেও হয়েছিল।
কিন্তু এর পরের প্রশ্নটির উত্তর দেওয়া খুব কঠিন: আমাদের লক্ষ্যগুলো কী ছিল? কী আমরা অর্জন করতে চেয়েছিলাম? স্বল্প সময়ে আমরা অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছিলাম: বিদ্যমান পুরোনো ব্যবস্থাটির সংস্কার সাধন থেকে সেটি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলাম খুব অল্প সময়ের মধ্যে। তবু আমি পরিবর্তনটা চেয়েছিলাম ধীরে ধীরে, বৈপ্লবিকভাবে নয়, ক্রমবিকাশের নিয়মে দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, যাতে আমরা দেশের ও জনগণের মেরুদণ্ড ভেঙে না ফেলি, চেয়েছিলাম যেন রক্তপাত না ঘটে।
বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পক্ষে যারা ছিল, তারা আমাদের চাপ দিচ্ছিল আরও দ্রুত এগিয়ে যেতে। আর রক্ষণশীলেরা ল্যাং মারছিল আমাদের পায়ে। পরের দিকে যা কিছু ঘটেছে, এর অধিকাংশের জন্য দায়ী এই দুই পক্ষই। আমার নিজেরও কিছু দায় ছিল এটা আমি মানি। আমরা সংস্কারবাদীরা এমন কিছু ভুল করেছি, যার বড় মাশুল গুনতে হচ্ছে আমাদের।
আমাদের প্রধান ভুল ছিল কমিউনিস্ট পার্টির সংস্কারের উদ্যোগ নিতে বড্ড বেশি দেরি করে ফেলা। পিরিস্ত্রোইকা শুরু করেছিল পার্টিই, কিন্তু অচিরেই আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায় পার্টি। ১৯৯১ সালের আগস্টে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সংগঠক ছিলেন পার্টির শীর্ষস্থানীয় আমলারা; সে অভ্যুত্থান পিরিস্ত্রোইকার আয়ু শেষ করে দেয়।
প্রজাতন্ত্রসমূহের ইউনিয়ন সংস্কারের কাজ শুরু করতেও আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছিলাম। প্রজাতন্ত্রগুলো একসঙ্গে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছিল। তারা একেকটা রাষ্ট্র হয়ে উঠেছিল, তাদের নিজস্ব অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল, তৈরি হয়েছিল নিজস্ব অভিজাত শ্রেণী। একটি কেন্দ্রীয় গণতান্ত্রিক ইউনিয়নের মধ্যেই সার্বভৌম একেকটা রাষ্ট্র হিসেবে প্রজাতন্ত্রগুলোকে ধরে রাখার একটা উপায় আমাদের খুঁজে পাওয়া প্রয়োজন ছিল। ১৯৯১ সালের মার্চে সারা সোভিয়েত ইউনিয়নে অনুষ্ঠিত এক গণভোটে ৭০ শতাংশ ভোটার সমর্থন জানিয়েছিল সার্বভৌম প্রজাতন্ত্রগুলোকে নিয়ে নতুন একটি ইউনিয়ন গঠনের পক্ষে। কিন্তু সে বছরই আগস্ট মাসে অভ্যুত্থানচেষ্টায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমার অবস্থানকে দুর্বল করে দিল, নতুন ইউনিয়ন গঠন অসম্ভব হয়ে পড়ল। বছর শেষে সোভিয়েত ইউনিয়ন বলে আর কোনো দেশের অস্তিত্বই রইল না।
আমাদের আরও কিছু ভুল হয়েছিল। রাজনৈতিক লড়াইয়ের উত্তাপে আমরা অর্থনীতির প্রতি দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেছিলাম। ফলে খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের যে সংকট দেখা দিয়েছিল, এর জন্য জনগণ আমাদের কখনো ক্ষমা করেনি।
এসব সত্ত্বেও পিরিস্ত্রোইকার অর্জন অস্বীকার করার উপায় নেই। মুক্তি ও গণতন্ত্রের পথ খুলে দিয়েছিল পিরিস্ত্রোইকা। আজ বিভিন্ন জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, যাঁরা পিরিস্ত্রোইকা ও তার নেতাদের সমালোচনা করেন, তাঁরাও এর কিছু অর্জনের প্রশংসা করেন। যেমন, পিরিস্ত্রোইকা একাধিপত্যবাদী শাসনব্যবস্থাকে (টোটালিটারিয়ান সিস্টেম) প্রত্যাখ্যান করেছে; মত প্রকাশ, জনসমাবেশ, ধর্ম পালনের স্বাধীনতার স্বীকৃতি মিলেছে পিরিস্ত্রোইকার ফলে; রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বহুমুখিতার (প্লুরালিজম) সুযোগ করে দিয়েছে পিরিস্ত্রোইকা।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়ার নেতারা সংস্কারের যে ধারায় এগোতে থাকলেন, সেটা ছিল বেশি উগ্র। তাঁদের ‘শক থেরাপি’ ছিল অসুখটার চেয়েও খারাপ। অজস্র মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে গেল; আয়বৈষম্য বাড়তে লাগল অবিশ্বাস্যভাবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি মারাত্মক ক্ষতির শিকার হলো। রাশিয়া তার শিল্পভিত্তি হারাতে শুরু করল। তার অর্থনীতি নির্ভরশীল হয়ে পড়তে শুরু করল শুধু তেল আর প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানির ওপর।
শতাব্দীর শুরু নাগাদ দেশটির অবস্থা হলো প্রায়-বিধ্বস্ত; আমরা নৈরাজ্যের মুখোমুখি হলাম। গণতন্ত্র বিপন্ন হলো। ১৯৯৬ সালে প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলিসনের পুনর্নির্বাচন এবং ২০০০ সালে তাঁর পছন্দের উত্তরসূরি ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘটনা ছিল বাহ্যত গণতান্ত্রিক, কার্যত নয়। রাশিয়ায় গণতন্ত্রের ভবিষ্যত্ নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা শুরু হয় তখনই।
আমি বুঝতাম, রাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়ার অস্তিত্বই যখন ঝুঁকির মুখে সে রকম পরিস্থিতিতে সব সময় আইনকানুন মেনে চলা সম্ভব নয়। এ রকম সময়ে দৃঢ়, কঠোর পদক্ষেপের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। এমনকি স্বৈরতান্ত্রিক উপাদানেরও প্রয়োজন হতে পারে। সে কারণেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুতিনের প্রথম মেয়াদে তাঁর নেওয়া পদক্ষেপগুলোর প্রতি আমি সমর্থন জানিয়েছিলাম। শুধু আমি একা নই, সেই দিনগুলোতে দেশের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষের সমর্থন ছিল তাঁর প্রতি।
কিন্তু দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাই একমাত্র বা চূড়ান্ত লক্ষ্য হতে পারে না। পরস্পর নির্ভরশীল এই বিশ্বে অন্যতম নেতৃস্থানীয় জাতি হিসেবে দাঁড়ানোর জন্য রাশিয়ার প্রয়োজন উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন। আমাদের প্রধান রপ্তানিপণ্য তেল ও গ্যাসের দাম বিশ্ববাজারে এক দশক ধরে চড়া, এবং এর ফলে বেশ লাভবান হওয়া সত্ত্বেও গত কয়েক বছরে আমাদের দেশ কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেনি। সাম্প্রতিক বৈশ্বিক মন্দার আঘাত রাশিয়ায় যত তীব্রভাবে এসে লেগেছে, তেমনটি আর কোথাও ঘটেনি এবং এর জন্য দায়ী আমরা নিজেরাই।
রাশিয়া দৃঢ় আস্থার সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারবে, যদি সে গণতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করে। সাম্প্রতিক সময়ে এই ক্ষেত্রে বেশ কিছু নেতিবাচক ব্যাপার লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। যেমন, সব বড় বড় সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এককভাবে নির্বাহী বিভাগ। পার্লামেন্ট শুধু সিল মারার কাজ করছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আমাদের এমন একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা নেই, যেখানে সত্যিকারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমতের প্রতিনিধিত্বকারী দল নির্বাচনে জয়ী হবে, সেই সঙ্গে সংখ্যালঘু জনমতও গুরুত্ব পাবে সক্রিয় বিরোধী দলের অবাধে কাজ করার অধিকারের মধ্য দিয়ে। এমন ধারণা বাড়ছে যে সরকার সিভিল সোসাইটিকে ভয় পায়; এবং সবকিছুর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায়। আমরা এ রকম অবস্থার মধ্যেই ছিলাম। আমরা তো এগুলোই করেছি অতীতে। তাহলে কি আমরা অতীতেই ফিরে যেতে চাই? আমার মনে হয় না কেউ সেটা চায়, নেতারাও চান না।
প্রেসিডেন্ট দিমত্রি মেদভেদেভের কথায় আমি আঁতকে উঠেছি, যখন তিনি বললেন, ‘কাঁচামালভিত্তিক ও ব্যাপক দুর্নীতিগ্রস্ত এক আদিম অর্থনীতিই কি আমাদের ভবিষ্যতের সঙ্গী হবে?’ যে সমাজে ‘সরকার সবচেয়ে বড় চাকরিদাতা, সবচেয়ে বড় প্রকাশক, সবচেয়ে ভালো উত্পাদক, সে সমাজে সরকার নিজেই বিচার বিভাগ...এবং চূড়ান্ত বিচারে সরকার নিজেই যেন গোটা জাতি’, সেখানে মানুষের নিশ্চিত-নির্বিকার স্বভাবের বিষয়েও সতর্কতা উচ্চারণ করেছেন প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভ।
আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একমত। আমি একমত তাঁর আধুনিকায়নের লক্ষ্যের সঙ্গেও। কিন্তু আধুনিকায়ন ঘটবে না, যদি জনগণকে কোণঠাসা করে রাখা হয়, যদি তাদের জিম্মি করে রাখা হয়। প্রত্যেক সাধারণ ব্যক্তি যে নাগরিক, এটা অনুভব করার এবং নাগরিকের মতো কাজ করার উপায় একটাই আছে। তা হলো গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং সরকার ও জনগণের মধ্যে খোলামেলা ও আন্তরিক সংলাপ। আমাদের অবশ্যই এটা অর্জন করতে হবে।
আজকের দিনে রাশিয়ার আছে অনেক মুক্তমনা স্বাধীন চিন্তার মানুষ, যাঁরা দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রস্তুত, গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে প্রস্তুত। কিন্তু অনেক কিছুই নির্ভর করছে সরকার কীভাবে কাজ করতে তার ওপর।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মশিউল আলম
মিখাইল গর্বাচভ: বিলুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট।
এটা পরিষ্কার হয়েছিল আমার কাছে, সোভিয়েত ইউনিয়নের নতুন প্রজন্মের নেতাদের কাছে, এবং বিপ্লবের আদি নেতাদের কাছেও, যাঁরা দেশটির ভবিষ্যত্ নিয়ে ভাবতেন। ১৯৮৫ সালের মার্চে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির যে প্লেনারি সভায় আমাকে পার্টির নতুন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়, এর কয়েক ঘণ্টা আগে সে সময়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেই গ্রোমিকোর সঙ্গে আলাপের কথা আমার মনে পড়ে। গ্রোমিকো আমার সঙ্গে একমত প্রকাশ করেছিলেন যে ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন, ঝুঁকি যত বড়ই হোক না কেন।
আমাকে প্রায়শই জিজ্ঞেস করা হয়, আমাদের কী করতে হবে তার সম্পূর্ণটা আমার ও আমার সহযোগী নেতাদের জানা ছিল কি না। এর উত্তর ‘হ্যাঁ’ এবং ‘না’ জানা ছিল, কিন্তু সম্পূর্ণভাবে নয়, তাত্ক্ষণিকভাবেও নয়। কী আমাদের ত্যাগ করতে হবে সেটা ছিল বেশ পরিষ্কার। আমাদের কাছে খুব পরিষ্কার ছিল যে অনড় আদর্শবাদী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে, পৃথিবীর অবশিষ্ট অংশের সিংহভাগের সঙ্গে যে সংঘাত চলে আসছে, তা আমাদের পরিত্যাগ করতে হবে; এবং যে লাগামহীন অস্ত্র প্রতিযোগিতা আমরা চালিয়ে এসেছি, তা বন্ধ করতে হবে। এসব পরিত্যাগের পক্ষে আমাদের প্রতি জনগণের পরিপূর্ণ সমর্থন ছিল। কট্টর স্তালিনপন্থীদের চুপ মেরে যেতে হয়েছিল, এমনকি মেনে নিতেও হয়েছিল।
কিন্তু এর পরের প্রশ্নটির উত্তর দেওয়া খুব কঠিন: আমাদের লক্ষ্যগুলো কী ছিল? কী আমরা অর্জন করতে চেয়েছিলাম? স্বল্প সময়ে আমরা অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছিলাম: বিদ্যমান পুরোনো ব্যবস্থাটির সংস্কার সাধন থেকে সেটি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিলাম খুব অল্প সময়ের মধ্যে। তবু আমি পরিবর্তনটা চেয়েছিলাম ধীরে ধীরে, বৈপ্লবিকভাবে নয়, ক্রমবিকাশের নিয়মে দৃঢ়তার সঙ্গে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলাম, যাতে আমরা দেশের ও জনগণের মেরুদণ্ড ভেঙে না ফেলি, চেয়েছিলাম যেন রক্তপাত না ঘটে।
বৈপ্লবিক পরিবর্তনের পক্ষে যারা ছিল, তারা আমাদের চাপ দিচ্ছিল আরও দ্রুত এগিয়ে যেতে। আর রক্ষণশীলেরা ল্যাং মারছিল আমাদের পায়ে। পরের দিকে যা কিছু ঘটেছে, এর অধিকাংশের জন্য দায়ী এই দুই পক্ষই। আমার নিজেরও কিছু দায় ছিল এটা আমি মানি। আমরা সংস্কারবাদীরা এমন কিছু ভুল করেছি, যার বড় মাশুল গুনতে হচ্ছে আমাদের।
আমাদের প্রধান ভুল ছিল কমিউনিস্ট পার্টির সংস্কারের উদ্যোগ নিতে বড্ড বেশি দেরি করে ফেলা। পিরিস্ত্রোইকা শুরু করেছিল পার্টিই, কিন্তু অচিরেই আমাদের সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথে একটা বাধা হয়ে দাঁড়ায় পার্টি। ১৯৯১ সালের আগস্টে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের সংগঠক ছিলেন পার্টির শীর্ষস্থানীয় আমলারা; সে অভ্যুত্থান পিরিস্ত্রোইকার আয়ু শেষ করে দেয়।
প্রজাতন্ত্রসমূহের ইউনিয়ন সংস্কারের কাজ শুরু করতেও আমরা অনেক দেরি করে ফেলেছিলাম। প্রজাতন্ত্রগুলো একসঙ্গে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছিল। তারা একেকটা রাষ্ট্র হয়ে উঠেছিল, তাদের নিজস্ব অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল, তৈরি হয়েছিল নিজস্ব অভিজাত শ্রেণী। একটি কেন্দ্রীয় গণতান্ত্রিক ইউনিয়নের মধ্যেই সার্বভৌম একেকটা রাষ্ট্র হিসেবে প্রজাতন্ত্রগুলোকে ধরে রাখার একটা উপায় আমাদের খুঁজে পাওয়া প্রয়োজন ছিল। ১৯৯১ সালের মার্চে সারা সোভিয়েত ইউনিয়নে অনুষ্ঠিত এক গণভোটে ৭০ শতাংশ ভোটার সমর্থন জানিয়েছিল সার্বভৌম প্রজাতন্ত্রগুলোকে নিয়ে নতুন একটি ইউনিয়ন গঠনের পক্ষে। কিন্তু সে বছরই আগস্ট মাসে অভ্যুত্থানচেষ্টায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমার অবস্থানকে দুর্বল করে দিল, নতুন ইউনিয়ন গঠন অসম্ভব হয়ে পড়ল। বছর শেষে সোভিয়েত ইউনিয়ন বলে আর কোনো দেশের অস্তিত্বই রইল না।
আমাদের আরও কিছু ভুল হয়েছিল। রাজনৈতিক লড়াইয়ের উত্তাপে আমরা অর্থনীতির প্রতি দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেছিলাম। ফলে খাদ্যদ্রব্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের যে সংকট দেখা দিয়েছিল, এর জন্য জনগণ আমাদের কখনো ক্ষমা করেনি।
এসব সত্ত্বেও পিরিস্ত্রোইকার অর্জন অস্বীকার করার উপায় নেই। মুক্তি ও গণতন্ত্রের পথ খুলে দিয়েছিল পিরিস্ত্রোইকা। আজ বিভিন্ন জনমত জরিপে দেখা যাচ্ছে, যাঁরা পিরিস্ত্রোইকা ও তার নেতাদের সমালোচনা করেন, তাঁরাও এর কিছু অর্জনের প্রশংসা করেন। যেমন, পিরিস্ত্রোইকা একাধিপত্যবাদী শাসনব্যবস্থাকে (টোটালিটারিয়ান সিস্টেম) প্রত্যাখ্যান করেছে; মত প্রকাশ, জনসমাবেশ, ধর্ম পালনের স্বাধীনতার স্বীকৃতি মিলেছে পিরিস্ত্রোইকার ফলে; রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বহুমুখিতার (প্লুরালিজম) সুযোগ করে দিয়েছে পিরিস্ত্রোইকা।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর রাশিয়ার নেতারা সংস্কারের যে ধারায় এগোতে থাকলেন, সেটা ছিল বেশি উগ্র। তাঁদের ‘শক থেরাপি’ ছিল অসুখটার চেয়েও খারাপ। অজস্র মানুষ দারিদ্র্যের মধ্যে পড়ে গেল; আয়বৈষম্য বাড়তে লাগল অবিশ্বাস্যভাবে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি মারাত্মক ক্ষতির শিকার হলো। রাশিয়া তার শিল্পভিত্তি হারাতে শুরু করল। তার অর্থনীতি নির্ভরশীল হয়ে পড়তে শুরু করল শুধু তেল আর প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানির ওপর।
শতাব্দীর শুরু নাগাদ দেশটির অবস্থা হলো প্রায়-বিধ্বস্ত; আমরা নৈরাজ্যের মুখোমুখি হলাম। গণতন্ত্র বিপন্ন হলো। ১৯৯৬ সালে প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলিসনের পুনর্নির্বাচন এবং ২০০০ সালে তাঁর পছন্দের উত্তরসূরি ভ্লাদিমির পুতিনের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের ঘটনা ছিল বাহ্যত গণতান্ত্রিক, কার্যত নয়। রাশিয়ায় গণতন্ত্রের ভবিষ্যত্ নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা শুরু হয় তখনই।
আমি বুঝতাম, রাষ্ট্র হিসেবে রাশিয়ার অস্তিত্বই যখন ঝুঁকির মুখে সে রকম পরিস্থিতিতে সব সময় আইনকানুন মেনে চলা সম্ভব নয়। এ রকম সময়ে দৃঢ়, কঠোর পদক্ষেপের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। এমনকি স্বৈরতান্ত্রিক উপাদানেরও প্রয়োজন হতে পারে। সে কারণেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুতিনের প্রথম মেয়াদে তাঁর নেওয়া পদক্ষেপগুলোর প্রতি আমি সমর্থন জানিয়েছিলাম। শুধু আমি একা নই, সেই দিনগুলোতে দেশের ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ মানুষের সমর্থন ছিল তাঁর প্রতি।
কিন্তু দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনাই একমাত্র বা চূড়ান্ত লক্ষ্য হতে পারে না। পরস্পর নির্ভরশীল এই বিশ্বে অন্যতম নেতৃস্থানীয় জাতি হিসেবে দাঁড়ানোর জন্য রাশিয়ার প্রয়োজন উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন। আমাদের প্রধান রপ্তানিপণ্য তেল ও গ্যাসের দাম বিশ্ববাজারে এক দশক ধরে চড়া, এবং এর ফলে বেশ লাভবান হওয়া সত্ত্বেও গত কয়েক বছরে আমাদের দেশ কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন ও আধুনিকায়নের ধারেকাছেও পৌঁছাতে পারেনি। সাম্প্রতিক বৈশ্বিক মন্দার আঘাত রাশিয়ায় যত তীব্রভাবে এসে লেগেছে, তেমনটি আর কোথাও ঘটেনি এবং এর জন্য দায়ী আমরা নিজেরাই।
রাশিয়া দৃঢ় আস্থার সঙ্গে এগিয়ে যেতে পারবে, যদি সে গণতান্ত্রিক পথ অনুসরণ করে। সাম্প্রতিক সময়ে এই ক্ষেত্রে বেশ কিছু নেতিবাচক ব্যাপার লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। যেমন, সব বড় বড় সিদ্ধান্ত নিচ্ছে এককভাবে নির্বাহী বিভাগ। পার্লামেন্ট শুধু সিল মারার কাজ করছে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। আমাদের এমন একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা নেই, যেখানে সত্যিকারের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনমতের প্রতিনিধিত্বকারী দল নির্বাচনে জয়ী হবে, সেই সঙ্গে সংখ্যালঘু জনমতও গুরুত্ব পাবে সক্রিয় বিরোধী দলের অবাধে কাজ করার অধিকারের মধ্য দিয়ে। এমন ধারণা বাড়ছে যে সরকার সিভিল সোসাইটিকে ভয় পায়; এবং সবকিছুর ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে চায়। আমরা এ রকম অবস্থার মধ্যেই ছিলাম। আমরা তো এগুলোই করেছি অতীতে। তাহলে কি আমরা অতীতেই ফিরে যেতে চাই? আমার মনে হয় না কেউ সেটা চায়, নেতারাও চান না।
প্রেসিডেন্ট দিমত্রি মেদভেদেভের কথায় আমি আঁতকে উঠেছি, যখন তিনি বললেন, ‘কাঁচামালভিত্তিক ও ব্যাপক দুর্নীতিগ্রস্ত এক আদিম অর্থনীতিই কি আমাদের ভবিষ্যতের সঙ্গী হবে?’ যে সমাজে ‘সরকার সবচেয়ে বড় চাকরিদাতা, সবচেয়ে বড় প্রকাশক, সবচেয়ে ভালো উত্পাদক, সে সমাজে সরকার নিজেই বিচার বিভাগ...এবং চূড়ান্ত বিচারে সরকার নিজেই যেন গোটা জাতি’, সেখানে মানুষের নিশ্চিত-নির্বিকার স্বভাবের বিষয়েও সতর্কতা উচ্চারণ করেছেন প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভ।
আমি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে একমত। আমি একমত তাঁর আধুনিকায়নের লক্ষ্যের সঙ্গেও। কিন্তু আধুনিকায়ন ঘটবে না, যদি জনগণকে কোণঠাসা করে রাখা হয়, যদি তাদের জিম্মি করে রাখা হয়। প্রত্যেক সাধারণ ব্যক্তি যে নাগরিক, এটা অনুভব করার এবং নাগরিকের মতো কাজ করার উপায় একটাই আছে। তা হলো গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং সরকার ও জনগণের মধ্যে খোলামেলা ও আন্তরিক সংলাপ। আমাদের অবশ্যই এটা অর্জন করতে হবে।
আজকের দিনে রাশিয়ার আছে অনেক মুক্তমনা স্বাধীন চিন্তার মানুষ, যাঁরা দায়িত্ব নেওয়ার জন্য প্রস্তুত, গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে প্রস্তুত। কিন্তু অনেক কিছুই নির্ভর করছে সরকার কীভাবে কাজ করতে তার ওপর।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মশিউল আলম
মিখাইল গর্বাচভ: বিলুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বশেষ প্রেসিডেন্ট।
No comments