শ্রদ্ধাঞ্জলি-চলে গেলেন কে জি মুস্তাফা by জাহীদ রেজা নূর

সকালে এবিসি রেডিওর খবরে প্রথম শুনলাম, কে জি মুস্তাফা আর নেই। সঙ্গে সঙ্গে একটা অপরাধবোধ চেপে ধরল আমাকে। যুগান্তরের সহকারী সম্পাদক হাসান মামুন আর আমি কত দিন ভেবেছি, তাঁকে একনজর দেখে আসব, কিন্তু হয়ে উঠল কই? মুক্তকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করার সময় তিনি ছিলেন আমাদের সম্পাদক।


এ রকম রাশভারী চেহারার, দরাজকণ্ঠের অধিকারী মানুষটিকে খুব কাছে থেকে না জানলে চেনা হয়ে উঠত না।
শৈশবের একটি স্মৃতি এখনো মনে জ্বলজ্বল করে। আমার বাবা দৈনিক ইত্তেফাকের তত্কালীন কার্যনির্বাহী ও বার্তা সম্পাদক সিরাজুদ্দীন হোসেনের সঙ্গে অসাধারণ বন্ধুত্ব ছিল তাঁর। একাত্তরে বাবাকে হত্যা করল পাকিস্তানি ও আলবদররা মিলে। স্বাধীনতার পর বৈরুতের রাষ্ট্রদূত হিসেবে দেশত্যাগের আগে তিনি আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। আট সন্তান নিয়ে মা তখন অথৈ সাগরে। কে জি কাকা আমাদের অভয় দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধু সিরাজের কথা ভুলবে না। মনে আছে, বিদায়ের আগে আমার ছোট ভাইয়ের হাতে একটি ১০০ টাকার নোট গুঁজে দিয়েছিলেন।
তাঁর অধীনে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, একসময় প্রচণ্ডরকম বকাঝকা করছেন, আবার পরক্ষণেই রাগ পড়ে গেলে কাছে ডেকে বোঝাচ্ছেন। কোমলে-কঠোরে মিলে ছিল তাঁর মনটা।
ইসলামিয়া কলেজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সিরাজুদ্দীন হোসেন, খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস (কেজি মুস্তাফার অগ্রজ), আসফউদ্দৌলা রেজা, কাজী গোলাম মাহবুব, শামসুদ্দীন মোল্লা ছিলেন সহপাঠী। কে জি মুস্তাফা ছিলেন একটু জুনিয়র। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হওয়ার পরও আজাদ পত্রিকাটি ছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। কিছুকাল পরে পত্রিকাটি চলে আসে ঢাকায়।
কে জি মুস্তাফা কাজ করতেন আজাদে। ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় এসে কে জি মুস্তাফা ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং পুনরায় চাকরি নেন আজাদ পত্রিকায়। কিন্তু তিন মাসের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ধর্মঘটের সঙ্গে সহযোগিতা করার কারণে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের তৃতীয় আহ্বায়ক হিসেবে গ্রেপ্তার হন। জেলফেরত কে জি মুস্তাফা চাকরিতে জ্যেষ্ঠতা পাননি।
কেজি মুস্তাফার সঙ্গে ছিল বামপন্থী রাজনীতির যোগ। ১৯৫১ সালে যুবলীগ প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি ছিলেন কমিটির সদস্য। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় কাজ করতেন সংবাদে। ২১ ফেব্রুয়ারির ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল ২২ ফেব্রুয়ারি, তাতে সাধারণ ছাত্র ও জনগণের ভাবনার প্রকাশ ছিল না। সে সময় সংবাদ ছিল ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের মুখপত্র। খায়রুল কবীর ছিলেন সম্পাদক। কাজ করতেন জহুর হোসেন চৌধুরী, সৈয়দ নুরুদ্দীন, তসদ্দুক হোসেন, কে জি মুস্তাফা, সরদার জয়েনুদ্দীন, কাজী মহম্মদ ইদ্রিস প্রমুখ। কে জি মুস্তাফা, সৈয়দ নুরুদ্দীনরা বলেছিলেন, সংবাদ মুসলিম লীগের কথামতো চললে তাঁরা ধর্মঘটে যাবেন। কর্তৃপক্ষ আশ্বস্ত করেছিল, সত্য খবরই ছাপা হবে। এ সময় কে জি মুস্তাফা ধর্মঘটে না যাওয়া নিয়ে বলেছিলেন, ‘ধর্মঘট করলে জনসাধারণ খবর পাবে না, কাজেই সত্য ঘটনার রিপোর্ট দিয়ে কাগজ বের করাই উচিত।’ কিন্তু প্রতিবেদন তৈরি করার পর তার কিছুটা পরিবর্তন করে ছাপা হয়, ফলে সংবাদের এই ভূমিকায় ক্ষুব্ধ জনগণ সংবাদের ওপর চড়াও হয়।
এ সময় রাজনৈতিক তত্পরতা বেড়ে গেলে ১৯৫৩ সালের প্রথম দিকে সংবাদপত্র থেকে বিদায় নেন কে জি মুস্তাফা। ১৯৫৫ সালের অক্টোবরে কে জি মুস্তাফার ওপর থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা প্রত্যাহার করা হলে তিনি আবার ফিরে আসেন সংবাদে। কিন্তু নভেম্বরেই ধর্মঘটের সময় আবার গ্রেপ্তার হন। ১৯৫৬ সালের জুনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাঁকে যখন পাবনা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তখন ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে ইত্তেফাকের জেনারেল ম্যানেজার আবদুল ওয়াদুদ আইবির লোকদের প্রতিবাদ উপেক্ষা করে সেখানে উপস্থিত হয়ে বলেন, ‘মানিক ভাই (ইত্তেফাকের সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন) একটা মেসেজ পাঠিয়েছেন তোমাকে। তোমাকে পাবনায় খুব সম্ভব নজরবন্দী করা হবে। কিন্তু তুমি ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে সাত দিনের জন্য হলেও ঢাকায় চলে আসার চেষ্টা করো। এখানে তোমার ইত্তেফাকে যোগ দেওয়ার সব ব্যবস্থাই মানিক ভাই করে রেখেছেন। নজরবন্দীও থাকতে হবে না বেশি দিন। আবু হোসেন সরকারের সরকার এক মাসের বেশি টিকবে না।’
১৯৫৬ সালের ২৮ জুন পাবনা কারাগার থেকে নজরবন্দীর হুকুমনামাসহ তিনি দেখা করলেন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আলী আহমদের সঙ্গে। তিনি অনুমতি দিলেন ঢাকা যাওয়ার। ঢাকায় এসেই কে জি মুস্তাফা বিয়ে করলেন তত্কালীন বেতার ও মঞ্চের প্রথম সারির অভিনেত্রী সাবেরা খাতুনকে। সেই বিয়েতে মানিক মিয়ার পাঠানো দুই ভাড় মিষ্টি নিয়ে উপস্থিত ছিলেন আবদুল ওয়াদুদ। তিনি কানে কানে কে জি মুস্তাফাকে বললেন, ‘কালই একবার ইত্তেফাকে কথা পাকাপাকি করতে চলে এসো’। ১৯৫৮ সালে ন্যাপ-আওয়ামী লীগ ঝগড়ার পরিপ্রেক্ষিতে মানিক মিয়া বললেন, কে জি সাহেব, আর তো একসঙ্গে কাজ করা চলে না, অনেকেই আপত্তি করছেন।’ কে জি মুস্তাফার ওপরও চাপ ছিল। তিনি সংবাদের বার্তা সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলেন। ১৯৫৮ সালে ইসকান্দর মির্জাকে শিখণ্ডি রেখে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করলে রাজনীতি ও সাংবাদিকতার ওপর খড়্গ নেমে আসে। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান অবজারভারে কর্মরত থাকার সময় তিনি আবার গ্রেপ্তার হন।
একটি বিষয়ের উল্লেখ এখানে না করলেই নয়। ১৯৬৭ সালের জুন মাসে পাকিস্তানের তথ্য ও বেতারমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দীন জাতীয় পরিষদে ঘোষণা করেন যে, বেতার ও টেলিভিশন থেকে পাকিস্তানবিরোধী রবীন্দ্রসংগীতের প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ নিয়ে যে অস্বস্তিকর অবস্থা সৃষ্টি করেছিল সরকার, তার বিরুদ্ধে দেশের শিল্পীসমাজের পাশাপাশি সাংবাদিকেরাও ছিলেন সোচ্চার। এই সাংবাদিকদের মধ্যে ছিলেন কে জি মুস্তাফাও।
বহু পত্রিকায় কাজ করেছেন কে জি মুস্তাফা। মাঝে কিছু দিন দেশের বাইরের পত্রিকায়ও কাজ করেছেন। ছিলেন রাষ্ট্রদূত। ১৯৯৮ সালে মুক্তকণ্ঠে কাজ করার সময় প্রত্যক্ষভাবে প্রথম তাঁর সংস্পর্শে এসেছিলাম। পেয়েছি তাঁর স্নেহাস্পর্শ। তাই তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে অসহায় বোধ করি, চোখে আসে জল।

No comments

Powered by Blogger.