মাতৃভূমিতে হুমায়ূন আহমেদ

প্রায় আট মাস পর দেশে ফিরলেন। আট মাস খুব বেশি সময় হয়তো নয়। তবু কারো কারো জন্য তা-ই হয়ে ওঠে আট শ বছর। কারণ এ যে অপেক্ষার কাল। আর অপেক্ষার প্রহর চলে অতি ধীরে। একেকটা দিন কখনো কখনো বছর দশকের সমান হয়ে ওঠে।


মাতৃভূমিতে ফেরার জন্য চাতকের মতো অপেক্ষায় ছিলেন নন্দিত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদ। অপেক্ষায় ছিলেন তাঁর অগণিত পাঠক, ভক্ত। তাঁর অপেক্ষায় বিমানবন্দরে শেষ রাতেও ছিল সংবাদকর্মীদের ভিড়।
বিমানবন্দরে সংবাদকর্মীদের মুখোমুখি হতেই জানিয়ে দিলেন, 'আমি ভালো আছি।' গেয়ে উঠলেন রজনীকান্ত সেনের গান- 'আমি অকৃতী অধম তাই বলে মোরে কম করে কিছু দাওনি।'
নিউ ইয়র্ক থেকে কুয়েত এয়ারলাইন্সের একটি বিমানে করে গতকাল শুক্রবার ভোর পৌনে ৫টায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান হুমায়ূন আহমেদ। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন, আর দুই ছেলে নিষাদ ও নিনিত।
ওখানে দেশের কোন জিনিসগুলোর অভাব বোধ (মিস) করেছেন- এ প্রশ্নের জবাবে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, 'সবচেয়ে বেশি যেটা মিস করেছি সেটা হলো নুহাশ পল্লী। সেখানে যে বাগানটা আছে, যে গাছগুলো আছে, ওগুলো মিস করেছি। এর পর মিস করেছি আমার বন্ধুদের। মিস করেছি আমার মা আর আত্মীয়-স্বজনকে। এদের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্যই এ ফিরে আসা।'
নুহাশ পল্লীর খুব অভাব বোধ করেছেন বলেই হয়তো বিমানবন্দর থেকে সরাসরি চলে যান গাজীপুরের নুহাশ পল্লীতে। সেখানে পরিবার ও স্বজনদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন। আর ১৯ দিন পরই আবার তাঁকে পাড়ি জমাতে হবে নিউ ইয়র্কের উদ্দেশে, ক্যান্সারের অস্ত্রোপচারের জন্য। হ্যাঁ, দুঃখ ভরা মনে দিনের এই হিসাবও রাখছেন হুমায়ূন আহমেদ- 'যদি পুরোপুরি ফিরে আসতাম, তাহলে বলতাম, খুবই আনন্দ পাচ্ছি। দেশে পা দেওয়া মাত্রই মনে হলো, ২০ দিনের মধ্যে একটা দিন চলে গেল। হাতে আছে আর মাত্র ১৯ দিন।'
সকাল সাড়ে ৮টার দিকে নুহাশ পল্লীতে পৌঁছান হুমায়ূন আহমেদ। গিয়েই দেখা পান মা আয়শা ফয়েজের। অনেক দিন পর ছেলেকে কাছে পেয়ে দারুণ খুশি মা। আয়শা ফয়েজ সাংবাদিকদের বলেন, 'হুমায়ূনরা নিউ ইয়র্কে যাওয়ার পর থেকে টেলিফোনে কথা হতো। এখন ছেলের সঙ্গে সামনাসামনি কথা বলতে পেরে ভালো লাগছে। আল্লাহ যেন আমার জীবনের বিনিময়ে হলেও ছেলেটাকে সুস্থ করে দেন।'
অতি প্রিয় নুহাশ পল্লীতে হুমায়ূন সঙ্গ পাচ্ছেন প্রিয় মানুষদেরও। মা আয়েশা ফয়েজ ছাড়াও রয়েছেন বোন সুফিয়া হায়দার ও মমতাজ শহীদ, শাশুড়ি তহুরা আলী, বন্ধু স্থপতি ফজলুল করিম এবং ব্যক্তিগত চিকিৎসক এম এ করিম।
হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রী মেহের আফরোজ শাওন জানান, দুই পর্যায়ের কেমোথেরাপিতে ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে চিকিৎসকরা এখন অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এটা সফল হলে সুস্থ হয়ে হুমায়ূন আহমেদ অচিরেই স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে আসবেন।
ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য গত বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্ক যান হুমায়ূন আহমেদ। বিশ্বখ্যাত মেমোরিয়াল স্লোয়ান কেটারিং হাসপাতালে ২৪ সেপ্টেম্বর শুরু হয় তাঁর চিকিৎসা। দুই পর্বে ১২টি কেমোথেরাপি নেওয়ার পর গত সপ্তাহে তাঁর এমআরআই করা হয়। এর প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে অস্ত্রোপচারের সিদ্ধান্ত দেন চিকিৎসকরা। এর আগে প্রিয় দেশে ঘুরে যাওয়ার প্রবল ইচ্ছা পূরণে গতকাল দেশে ফেরেন।
বিমানবন্দরে তাঁকে স্বাগত জানান শাশুড়ি তহুরা আলী এমপি, স্থপতি ও নাট্যকার শাকুর মজিদ, অবসর প্রকাশনা সংস্থার স্বত্বাধিকারী আলমগীর রহমান, অন্যপ্রকাশের স্বত্বাধিকারী মাজহারুল ইসলাম, অভিনেতা মাহফুজ আহমেদ, হুমায়ূনের প্রযোজনা সংস্থা নুহাশ চলচ্চিত্রের প্রধান সহকারী পরিচালক জুয়েল রানা প্রমুখ।
শাকুর মজিদ কালের কণ্ঠকে জানান, বিমানবন্দরে হুমায়ূন আহমেদকে দেখে অসুস্থ মনেই হয়নি। তিনি খুবই উৎফুল্ল ছিলেন। হাসিঠাট্টায় ব্যস্ত ছিলেন। ভিআইপি লাউঞ্জে প্রায় দেড় ঘণ্টা অবস্থানকালে তিনি দেশের রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন। আইপডে দাবা খেলেন, তাতে কম্পিউটারকে হারিয়েও দেন। অন্যদের সিগারেট খাওয়া দেখে তিনি আফসোস করে বলেন, 'তোমরা লাকি, তোমরা সিগারেট খাচ্ছ, আমি পারছি না।'

No comments

Powered by Blogger.