আদিবাসী বনাম উপজাতি-পরিচিতি নির্ধারণের রাজনীতি by জোবাইদা নাসরীন

গত ২৮ জানুয়ারি পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে উপসচিব (সমন্বয়-২) মো. মজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত একটি চিঠি স্বরাষ্ট্রসচিব, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার (রাঙামাটি, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি) জেলা প্রশাসককে পাঠানো হয়। ‘গোপনীয়’ এই চিঠিটির বিষয়বস্তু ছিল—‘“উপজাতীয়” সম্প্রদায়গুলোকে “আদিবাসী” হিসেবে অভিহিত করার তত্পরতা প্রসঙ্গে’।


চিঠিটিতে বলা হয়, ‘কতিপয় উপজাতীয় নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী, পাহাড়ে বসবাসরত শিক্ষিত ব্যক্তিবর্গ, এমনকি সাংবাদিকরাও ইদানীং উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলোকে উপজাতি না বলে আদিবাসী হিসেবে অভিহিত করতে দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন এনজিও, বিদেশী সংবাদমাধ্যম, জাতিসংঘের আড়ালে থাকা খ্রিষ্টান রাষ্ট্রসমূহ ওই ব্যক্তিবর্গের সহযোগিতায় পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় একটি পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সহায়তা চালিয়ে যাচ্ছে।’ আরও উল্লেখ করা হয় যে, দেশের সংবিধান, পার্বত্য জেলা এবং আঞ্চলিক পরিষদ আইন এবং ১৯৯৭ সালের করা পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তিতে উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলোকে উপজাতি হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। এই চিঠির সঙ্গে একটি গোপন প্রতিবেদনও পাঠানো হয়। তবে এর আগে একই বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও আরেকটি গোপন চিঠি পাঠানো হয়েছিল বলে চিঠিটিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এই চিঠি পাওয়ার পর জেলা প্রশাসকেরা সংশ্লিষ্ট সবাইকে ‘আদিবাসী’ শব্দটি পরিহার করে ‘উপজাতি’ শব্দটি ব্যবহার করার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।
এই বিষয়ে সরকারকে মনে করিয়ে দিতে চাই, জোট সরকারের প্রধান দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতিহার ২০০৮ এর ১৮(১) এবং (২) ধারায় ‘সংখ্যালঘু নৃগোষ্ঠী’ এবং ‘আদিবাসী’ শব্দ দুটি ব্যবহার করা হয়েছে। এ ছাড়া ৯ আগস্ট বিশ্ব আদিবাসী দিবসে প্রকাশিত সাময়িকী সংহতির শুভেচ্ছা বাণীতে বাংলাদেশের বর্তমান এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী উভয়েই ‘আদিবাসী’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। যদি চিঠির ভাষা সরকারের নিজের কথা হয়, স্বভাবতই মনে হবে, তাহলে আওয়ামী লীগ এবং খোদ প্রধানমন্ত্রীও এত দিন ধরে এই ‘আদিবাসী হিসেবে অভিহিত করার তত্পরতা’র (চিঠির ভাষ্য অনুযায়ী) অংশ ছিলেন। হঠাত্ করে এমন কী হলো, যার কারণে সরকার এই ধরনের একটি চিঠি পাঠাল? সরকারের হঠাত্ কাছে পাওয়া এই মিত্রটি কে, যিনি প্রধানমন্ত্রীর এত দিনকার বোধ এবং আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতিহারে ব্যবহূত শব্দ পর্যন্ত অস্বীকার করছেন?
ঔপনিবেশিককালে তৈরি হওয়া ‘উপজাতি’ নামকরণ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিরোধিতা করেছে বাংলাদেশে বসবাসরত প্রায় ষাটেরও অধিক (যদিও সরকারিভাবে বাঙালি ছাড়া কয়টি জাতির মানুষ রয়েছে, তার পরিসংখ্যান আজও নেই) জাতির মানুষেরা। ‘উপজাতি’ শব্দটি দিয়ে স্পষ্টতই ব্রিটিশরা তাদের বুঝিয়ে দিয়েছিল, তারা জাতি নয়, কোনো জাতির অধস্তন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি যদি সেই বোধেই নিজেকে আটকে রাখে, তাহলে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের প্রতি তার ঝোঁকই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
তবে এই পরিচয় নির্ধারণের রাজনীতি নিয়ে একটি প্রসঙ্গ উত্থাপন জরুরি। ইংরেজি ‘ইনডিজেনাস’, ‘এবোরিজিনাল’ ও ‘এথনিক গ্রুপ’—এই তিনটি ইংরেজি শব্দগুচ্ছই আমাদের এখানে অনুবাদ করা হয় ‘আদিবাসী’ হিসেবে। যদিও এই তিনটি শব্দ একই অর্থ প্রকাশ করে না এবং এগুলোর ঐতিহাসিকতাও এক নয়। বিশেষ করে এথনিক গ্রুপের নির্মাণ এক এক জায়গায় এক এক ধরনের (যেমন লন্ডনের কোনো কোনো জায়গায় বাঙালি অভিবাসী জনগোষ্ঠীকেও এথনিক গ্রুপ বলা হয়)। আবার এবোরিজিনালের ইতিহাসও একেবারে আলাদা। কিন্তু বাংলাদেশে এসে এ ক্ষেত্রে অনুবাদজনিত সমস্যা তৈরি হয়েছে। তবে অনেকেই আবার এই মানুষদের পরিচয় দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী’ বলছেন, যা আসলে ভুল শব্দ। ‘নৃ’ মানেই হলো মানুষ। তাই এটি এখানে ব্যবহার করা চলে না।
অনেকের কাছেই ‘আদিবাসী’ বিষয়টি কে আগে এসেছে এবং কে পরে এসেছে—এই বোধের জানান দেয় মাত্র। আসলে এটি কোনোভাবেই এত সরলভাবে দেখার মতো বিষয় নয়। এটি একটি রাজনৈতিক শ্রেণীকরণ।
জাতিসংঘ ব্যবস্থা আদিবাসী শব্দটির মাধ্যমে বোঝায় সেসব মানুষ বা জনগোষ্ঠীকে, যারা আদিবাসী হিসেবে নিজেদের চিহ্নিত করে; যারা উপনিবেশপূর্ব বা সেটেলার-পূর্ব সমাজের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখে; চারপাশের প্রাকৃতিক সম্পদ ও এলাকার সঙ্গে যাদের শক্তিশালী যোগসূত্র আছে; স্বতন্ত্র সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা আছে; স্বতন্ত্র ভাষা, সংস্কৃতি ও বিশ্বাস আছে; যা সমাজের অ-অধিপতি গোষ্ঠী; স্বতন্ত্র জনগোষ্ঠী হিসেবে পূর্ব প্রজন্মের পরিবেশ ও ব্যবস্থাগুলো যারা পুনরুত্পাদন করে চলে।
এসব বিবেচনায় পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি ভিন্ন অন্য জাতিদের আদিবাসী বলতে আপত্তি থাকার কথা নয়। বেশ কিছু সময় ধরেই বাংলাদেশে বসবাসরত বাঙালি বাদে বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষেরা নিজেদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন বা দিতে চান। অতীতেও তাদের আদিবাসী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন ১৯০০, আয়কর এবং ফরেস্ট অ্যাক্ট ১৯২৭. স্টেট একুইজিশন এবং টেনান্সি অ্যাক্ট ২০০৪ এ ‘ইনডিজেনাস’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
ইনডিজেনাস শব্দটি স্বীকার করে নিলে সরকারকে আইএলও কনভেনশন পুরোপুরি মানতে হবে, ঐতিহ্যগত ভূমি অধিকারসহ অনেক অধিকার স্বীকার করে নিতে হবে। এসব অধিকার থেকে বঞ্চিত করতেই কি সরকার আবার তাদের ‘উপজাতি’ বলতে এতটা তত্পর?
জাতি, সমপ্রদায়, উপজাতি, আদিবাসী—এগুলোর সংজ্ঞায়িত করতে সরকারের আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। কারও কোনো চিঠির ওপর ভর করে এই শব্দগুলো ইচ্ছে করলেই পাল্টানো যায় না, কিংবা একটির বিপরীতে আরেকটি বসানো যায় না। প্রয়োজন সেই বিষয়ে জানাশোনা এবং স্পষ্ট অবস্থান।
আমরা জানতে চাই, সরকারের এই চিঠির উদ্দেশ্য কী? যখন সংবিধানে বাঙালির বাইরে অন্যান্য সংস্কৃতির মানুষদের স্বীকৃতির প্রশ্ন জোরালো হচ্ছে, তখন এই ধরনের চিঠি একটি প্রশ্ন তৈরি করে—সরকার কি তাহলে এই স্বীকৃতির বিপক্ষে?
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
zobaidanasreen@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.