জলবায়ু পরিবর্তন-নানান প্রচার বিভ্রান্ত আমজনতা by নাইর ইকবাল

জলবায়ু পরিবর্তনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে গোটা বিশ্ব এখন তটস্থ। চারদিকে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। গত ডিসেম্বরে কোপেনহেগেনে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন গোটা বিশ্বের মনোযোগ কেড়ে ছিল। বিশ্বের তাবত্ সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানেরা পৃথিবীর ভবিষ্যত্ নিয়ে ভেবে ভেবে ডিসেম্বর মাসজুড়েই কাটিয়েছেন কিছু নির্ঘুম রাত।


পরিবেশবাদীরা উত্কণ্ঠার সঙ্গে অপেক্ষা করেছেন জলবায়ু সম্মেলনের সিদ্ধান্তের জন্য। সব মিলিয়ে গোটা পৃথিবীতেই জলবায়ু পরিবর্তন আর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ হিসেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীদের গবেষণালব্ধ ফলাফল খুব সম্ভবত সবচেয়ে আলোচিত বিষয়।
অনেক আগে থেকেই ‘গ্রিনহাউস এফেক্ট’ অনেকের কাছেই খুব পরিচিত বাক্য। পৃথিবী গ্রিনহাউসের প্রভাবে প্রতিনিয়ত উষ্ণ হচ্ছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে ইত্যাদি মতবাদের সঙ্গে আমরা অনেক আগে থেকেই পরিচিত। কিন্তু বিতর্কটা শুরু হয়েছে এই জলবায়ু পরিবর্তনের সত্যিকার প্রভাব নিয়ে। এতে নানা মুনির নানা মত সত্যিকার অর্থেই আমজনতাকে ফেলে দিয়েছে দারুণ দ্বিধায়। অপেক্ষকৃত অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য উন্নত বিশ্বকে দায়ী করে মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দাবি করে বসে থাকলেও আসলে এই ক্ষতিপূরণটা কিসের ভিত্তিতে হবে, আর এর পরিমাপকই বা কী হবে, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা ও বিভ্রান্তির অন্ত নেই।
জলবায়ু যে পরিবর্তিত হচ্ছে, এ বিষয়ে সবাই একমত। এটা সত্যি যে পৃথিবীর উষ্ণতা আগের চেয়ে অনেকটা বেড়েছে। দেশে দেশে অতিরিক্ত শীত কিংবা গরমের প্রকোপ, বন্যা, অতিবৃষ্টি এর প্রভাবেই হচ্ছে বলে সবার ধারণা। কিন্তু এই জলবায়ু পরিবর্তনটা কেন হচ্ছে, আর এ জন্য দায়ী কে, এ নিয়েই তৈরি হয়েছে আসল বিভ্রান্তি। উন্নত দেশগুলোতে ব্যাপক শিল্পায়নের ফলে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহারও অনেক বেশি। আর জলবায়ু পরিবর্তনের অন্যতম কারণ হিসেবে অতিরিক্ত কার্বন উদিগরণের কথা বলা হলেও এটি কোন দেশ বেশি উদিগরণ করছে, এ নিয়ে চলছে দুরন্ত রাজনীতি। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন; অন্যদিকে উদীয়মান অর্থনীতির দেশ চীন, ব্রাজিল আর ভারত। প্রতিটি দেশই জলবায়ু পরিবর্তনের দোষ একে অন্যের ঘাড়ে চাপাতে ব্যস্ত। কে দায়ী, কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল—এই বিতর্কে চাপা পড়ে গেছে জলবায়ু পরিবর্তনের অনেক কিছু।
জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে পৃথিবী এখন মোটামুটি দুই ভাগে বিভক্ত। এক দল জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এর প্রভাব নিয়ে বিশ্ববাসীকে সতর্ক করছে, আরেক দল সতর্ককারীদের বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ভুল প্রমাণ করতে ব্যস্ত। তারাও তাদের মতো করে তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে প্রমাণ করে দিতে ব্যস্ত যে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে পৃথিবীব্যাপী যে আলোচনা, এর কোনো ভিত্তি নেই। সতর্ককারী দলের অন্যতম সোচ্চার ব্যক্তি হচ্ছেন সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর। তিনি অনেক জায়গাতেই বিভিন্ন উপস্থাপনায় সবাইকে বুঝিয়েছেন, ধীরে ধীরে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বিশ্ব এক বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে চলেছে। বিভিন্ন উপাত্তের ভিত্তিতে তিনি জানিয়েছেন, গত এক হাজার বছরে পৃথিবীর তাপমাত্রা আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। তিনি উত্তর গোলার্ধের বরফ গলে যাওয়ার যে তথ্য দিয়েছেন, তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করেছেন অনেকেই। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বড় নামটি হচ্ছে স্টিভ ম্যাককেইন। এই সাবেক খনি-ব্যবসায়ী সত্যিকার অর্থে জলবায়ু-বিশেষজ্ঞ না হলেও এ-সংক্রান্ত অল্প পড়াশোনা দিয়ে তিনি কয়েক দিনের মধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন। তিনি তাঁর উপস্থাপিত তত্ত্বে বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিভিন্ন কারণ সম্পর্কে যেসব তত্ত্ব বিশ্ববাসীকে জানানো হয়েছে, তা পৃথিবীর সাধারণ প্রক্রিয়া। এটা অনেকটা একটা পদার্থের জীবনচক্রের মতো। একটা আলমারি যখন নতুন কেনা হয়, তা দেখতে সুন্দর থাকে; কিন্তু ধীরে ধীরে এর ঔজ্জ্বল্য নষ্ট হতে থাকে। পৃথিবীর ব্যাপারটাও অনেকটা ওই রকম। এ ছাড়া তিনি উত্তর গোলার্ধের বরফ গলে যাওয়ার ব্যাপারে আল গোরের তত্ত্বেও শঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু নেই বলে জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত আন্তদেশীয় সরকারের প্যানেলও (আইপিসিসি) আল গোরের তত্ত্বকেই নিজেদের তত্ত্ব হিসেবে মানছে। বেশ কিছুদিন ধরে এই আইপিসিসির তত্ত্বও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। সমালোচকেরা আইপিসিসির তথ্য-উপাত্তের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যেসব গবেষণা চলছে, সেগুলো কতটা বাস্তবসম্মত তা নিয়ে বিতর্কের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত জাতিসংঘের গবেষণা-প্রতিষ্ঠানের প্রধান ফিল জোনসের পদত্যাগের ঘটনাও ঘটেছে। আইপিসিসির প্রধান রাজেন্দ্র পাচৌরি সমালোচিত হয়েছেন শুধু জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত বিজ্ঞানকে পেছনে ফেলে এই পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে অতিরিক্ত মাথা ঘামানোর জন্য। অনেকে বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যতটা না পৃথিবীর ক্ষতি হয়েছে, এর চেয়ে অনেক বেশি করে বাড়িয়ে বলে একে একটি আতঙ্কে পরিণত করা হয়েছে।
খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই মানুষের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। ২০০৮ সালের এপ্রিলে একটি জনমত জরিপে দেখা যায় শতকরা ৪৭ ভাগ মার্কিনি জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মনুষ্যসৃষ্ট কারণকে দায়ী করেছিলেন। অপরদিকে ৩৪ শতাংশ মার্কিন বলেছিলেন, জলবায়ু পরিবর্তন একটি সাধারণ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। এই জরিপটিই উল্টে গিয়েছে সাম্প্রতিক রাসমুসেন প্রতিবেদনে—এখন ৪৭ শতাংশ মানুষ প্রাকৃতিক কারণ ও ৩৪ শতাংশ মানুষ মনুষ্যসৃষ্ট কারণের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। এ রকম একটি বিভ্রান্তিমূলক পরিস্থিতির জন্য যাঁরা এই ‘জলবায়ু চর্চা’ করছেন, তাঁরাই এ জন্য মূলত দায়ী বলে মত দিয়েছেন অনেকে। জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন তথ্য ও তত্ত্বে একমত হতে না পারা এ অবস্থার সৃষ্টি করেছে বলে অনেকে মনে করেন।
জলবায়ু পরিবর্তনকে একেকজন একেকভাবে ব্যাখ্যা করছে। নিজ নিজ স্বার্থের অনুকূলে এ ব্যাপারটি নিয়ে যাওয়ার এক অসুস্থ প্রতিযোগিতাও রয়েছে। বিশ্বের তামাক বা তামাকজাতীয় দ্রব্যের প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এই জলবায়ু পরিবর্তনের বিতর্ক থেকে নিজেদের নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রেখেছে সুকৌশলে। কারণ বৈশ্বিক উষ্ণতার পেছনে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি বড় অবদান রয়েছে, এমন অভিযোগ করেছেন তামাকজাতীয় দ্রব্যের ব্যবহারবিরোধীরা। এখানেও ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থ বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে। বড় শক্তিগুলো ব্যস্ত জলবায়ু ইস্যুকে ব্যবহার করে একে অন্যের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ফায়দা তুলতে। কূটনীতি-বিশ্লেষকেরা অনেকেই বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বেশি খড়্গহস্ত উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে। যুক্তরাষ্ট্র এক অর্থে উঠেপড়ে লেগেছে ক্ষতিকর কার্বন নিঃসরণের পুরো দায়ভার চীনের ওপর চাপিয়ে দিতে। কারণ এখানে জড়িত আছে অনেক সুদূরপ্রসারী কূটনৈতিক উদ্দেশ্য। কারণ বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চীনের প্রভাব ব্যাপক। যুক্তরাষ্ট্র এই প্রভাব হ্রাস করতে চায় নানা অজুহাতে।
সবমিলিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। শেষ পর্যন্ত জলবায়ু বিষয়ে জল কোথায় গড়ায়, তা দেখার অপেক্ষায় এখন সবাই। কিন্তু তত দিনে হয়তো ক্ষতি অনেকটাই হয়ে যাবে।

No comments

Powered by Blogger.