জাতিগত সহিংসতা-আগুনে পোড়ে পাহাড়ি আর বাঙালি মানুষ by আনু মুহাম্মদ
জাতিগত নিপীড়নবিরোধী লড়াইয়ের আন্তর্জাতিক স্মারক হয়ে ওঠা একুশে ফেব্রুয়ারির ঠিক আগের কয়েক ঘণ্টায় পাহাড়ে সংখ্যালঘু জাতির মানুষেরা হত্যা আর অগ্নিকাণ্ডের শিকার হলো। আর নারী শ্রমিকদের গড়ে তোলা আন্তর্জাতিক নারী দিবসের শতবর্ষ পূর্তির কয়েক দিন আগে আগুনে পুড়ে ঢাকায় নিহত হলেন বর্তমান বাংলাদেশের বাঙালি নারী শ্রমিকেরা।
উদ্যাপন আর বাস্তবতার কী নির্মম বৈপরীত্য! দেশের দুই প্রান্তে আক্রান্ত দুই জাতির মানুষের যোগসূত্র পাওয়া কঠিন নয়। পাহাড়ের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আয়োজিত সাজেক ভূমি রক্ষা কমিটির অনুষ্ঠানে অংগ্য মারমা তাই ঠিকই বলেন, ‘পাহাড়ের আর ঢাকার আগুনের পার্থক্য নেই। অবহেলায় অধিকারবঞ্চিত করার ফল এটা।’ (প্রথম আলো, ১০ মার্চ, ২০১০)
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় হত্যা, অগ্নিকাণ্ডসহ যেসব হিংসাত্মক ঘটনা গত কিছুদিনে ঘটেছে তার ক্ষেত্র বহু দিনে সৃষ্ট, বহুবার ঘটা ঘটনার সর্বশেষ এগুলো। পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাত ও নির্মমতার যে বিবরণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, তা পুরোনো ক্ষত আর প্রশ্নগুলোকেই সামনে এনেছে। এই সর্বশেষ ঘটনাবলিতে এটাও স্পষ্ট হয়েছে, জাতিগত নিপীড়নের দায় থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র এখনো মুক্ত হতে ইচ্ছুক নয়।
কয়েক দশক ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে রক্তপাত, সহিংসতা, অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হচ্ছে বারবার, তার উত্স সন্ধান করলে মোটা দাগে তিনটি কারণ পাওয়া যায়। প্রথমত, উন্নয়ন প্রকল্প; যা মানুষ ও প্রকৃতির ওপর দীর্ঘ মেয়াদে বিষফল বিবেচনায় না এনে প্রণীত। দ্বিতীয়ত, জাতিগত ভিন্ন অস্তিত্বের প্রতি অস্বীকৃতি; আপেক্ষিকভাবে দুর্বল সংখ্যালঘু জাতিসত্তার প্রতি উপনিবেশ-ধরনের সংস্কৃতি ও রাজনীতি। এবং তৃতীয়ত, দখল-তত্পরতা।
ষাটের দশকে বিদেশি ঋণ ও উপদেষ্টা সহযোগে বিদ্যুত্ উত্পাদনের লোভনীয় লক্ষ্য সামনে রেখে কাপ্তাই জলবিদ্যুত্ প্রকল্প করা হয়েছিল। পাকিস্তানি স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খানের কথিত উন্নয়ন দশকের এটি ছিল একটি বড় অবলম্বন। সেই প্রকল্প অনুযায়ী বাঁধ নির্মিত হলো, সেই বাঁধের কারণে সৃষ্টি হলো কাপ্তাই লেক, ভেসে গেল রাঙামাটির রাজবাড়িসহ বৃহত্ জনবসতি। সেই অঞ্চলের সবাই, লক্ষাধিক মানুষ উদ্বাস্তু হলো, যারা সবাই সংখ্যালঘু জাতি, ভাষা ও ধর্মের মানুষ। উন্নয়ন এবং তার লাভ-ক্ষতি পরিমাপে একচোখা হিসাবের কী পরিণতি হয় এবং তার জন্য কত খেসারত দিতে হয় মানুষকে, এটি তার একটি নমুনা। উদ্বাস্তু মানুষদের ক্ষতিপূরণ আর পুনর্বাসন নিয়ে অনেক রঙিন গল্প ছিল, কিন্তু বাস্তবে তা এখনো অমীমাংসিত। একটি অংশ এখনো উদ্বাস্তু। যে বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য ভাসিয়ে দেওয়া হলো লাখো মানুষ, সেই বিদ্যুত্ উত্পাদনও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী হয়নি। পরে বরং এর আরও অবনতি হয়েছে, এখন বলা হচ্ছে আগের পরিকল্পনায় বিদ্যুত্ উত্পাদন করতে গেলে আরেকটি বাঁধ দিতে হবে! এখনো উন্নয়ন নামে নানা প্রকল্পের আয়োজন চলছে।
জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। কিন্তু উদ্ভবের পর ১৯৭২ সালেই এই দেশের সংখ্যালঘু জাতিসত্তার জন্য ‘উন্নয়ন’-সৃষ্ট সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয় জাতিগত অস্বীকৃতি। সংবিধান অস্বীকার করল যে বাংলাদেশে শুধু বাঙালি নয়, অন্যান্য জাতিও আছে। অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র অস্তিত্বের এই অস্বীকৃতির মধ্য দিয়ে আগের জমে থাকা ক্ষোভ আরও বৃদ্ধি পেল। সংঘাত, অবিশ্বাস ও নিপীড়নের নতুন পর্ব শুরু হলো। এম এন লারমা প্রতিবাদ করলেন, প্রত্যুত্তরে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসল সেনানিবাস। শুরু হলো সশস্ত্র প্রতিবাদ, প্রত্যুত্তরে আরও সেনানিবাস।
এভাবেই বাংলাদেশের সব মানুষ সামরিক শাসনের অধীনে আসার আগেই পার্বত্য চট্টগ্রামে শুরু হয়েছে সামরিক শাসন। বাংলাদেশের সব মানুষ যখন সামরিক শাসনের অধীনে, তখন এই অঞ্চল বাড়তি সামরিক শাসনের আওতায়। আর এই শাসনকালে, আড়ালে, সামরিক-বেসামরিক ক্ষমতাবানদের হাতে জমি গেছে, সম্পদও গেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘকাল স্বাভাবিকভাবেই বাঙালিরা গেছে, বসতি গেড়েছে। বাঙালি-পাহাড়ি সহাবস্থানে কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু সত্তরের দশকের শেষে জাতিগত শাসনের পদ্ধতির অংশ হিসেবে যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গরিব বাঙালিদের অর্থ, জমি ও কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়া হতে থাকল, তখনই জটিলতার শুরু। গরিব বাঙালিদের ঢাল সৃষ্টির মধ্য দিয়ে শুরু হলো নিপীড়ন, সহিংসতা ও জাতিগত বিদ্বেষের বর্তমান অধ্যায়।
রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এভাবে বাঙালি ‘সেটলার’দের সংখ্যা বেড়েছে, ক্রমে কোথাও কোথাও তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। জাতিগত নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাবলি ক্রমে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে দূরত্ব, অবিশ্বাস, সংঘাত ও সহিংসতা বৃদ্ধি করেছে। অন্যদিকে নিরাপত্তা রক্ষার নামে পাহাড় উজাড় হয়েছে। রেশন, উন্নয়ন বাজেট, নির্মাণ, স্থাপনা ইত্যাদি ধরে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে; উন্নয়ন ও নিরাপত্তার অজুহাতে পাহাড় লিজ হচ্ছে ব্যক্তির নামে।
এগুলো ঘিরে বিশেষ স্বার্থগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে, যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত। এদের মধ্যে অধিকাংশ বাঙালি হলেও নতুন সুবিধাভোগী কিছু পাহাড়িও আছে। এদের নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তি অর্থাত্ সামরিকীকরণ অর্থাত্ অব্যাহত সহিংসতা উত্তেজনা অবিশ্বাস দরকার। এর শিকার প্রথমত সংখ্যালঘু জাতির মানুষেরা, কিন্তু এর শিকার অবশ্যই টেনে নিয়ে যাওয়া দরিদ্র বাঙালিরাও। ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে মূল সমস্যাগুলো অনিষ্পন্ন রেখেই কিংবা জাতিগত স্বীকৃতি, বসতি-পুনর্বাসন ও উন্নয়ন দর্শনের সমস্যা বিষয়ে যথেষ্ট দৃষ্টি না দিয়েই।
জাতিগত নিপীড়ন, বিদ্বেষ এবং এর সামরিক সমাধানের চেষ্টা পৃথিবীর কোথাও সফল হয়নি। শুধু দক্ষিণ এশিয়ার কথাই যদি বিবেচনা করি, এ কারণেই পাকিস্তান ভেঙেছে, এ কারণেই ভারতের এক-তৃতীয়াংশ এখন সামরিক শাসনের অধীনে, নিপীড়ন হত্যাকাণ্ড এবং সহিংসতা সেখানে বাড়ছেই, শ্রীলঙ্কা চির অশান্তির মধ্যে আছে এখনো। আর বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে ক্রমান্বয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে মানুষের, রক্তক্ষরণ হচ্ছে সমাজ ও অর্থনীতির।
গত দুই দশকে সারা দেশে দখলদার দুর্বৃত্তদের দাপট তৈরি হয়েছে; উন্নয়ন আর প্রবৃদ্ধির গল্পের আড়ালে নদীনালা, খালবিল, বনজঙ্গল সবকিছু দখলে নেওয়ার জন্য তারা মরিয়া, তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল ভূমি ও সম্পদ তাদের আওতার বাইরে কী করে থাকে? এই দখল-তত্পরতা জাতিগত সংঘাত আর নিরাপত্তাকে ব্যবহার করছে খুব জুতসই একটি অজুহাত হিসেবে। আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এতগুলো হত্যাকাণ্ড আর অগ্নিসংযোগের ঘটনা, কোনোটিরই তাই যথাযথ তদন্ত বা বিচার হয়নি। এবারও হওয়ার সম্ভাবনা দেখি না।
প্রাথমিক কয়েকটি কথা আমাদের মাথায় গেঁথে নেওয়া দরকার যে বাংলাদেশ প্রধানত বাঙালি-অধ্যুষিত দেশ হলেও কেবল বাঙালির বাসভূমি নয়; বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও কেবল মুসলমানের বাসভূমি নয়; এই বহুজাতিক, বহুধর্মীয়, বহুভাষিক বৈচিত্র্য আমাদের সম্পদ—কোনোভাবেই সমস্যা নয়, তা আমাদের ঐশ্বর্য। সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অংশ, এই রাষ্ট্রের উপনিবেশ নয়।
সম্পদকে সংকটে পরিণত করছে যে মতাদর্শ, রাজনীতি ও উন্নয়ন দর্শন তাকে জাতি ধর্ম ভাষা নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করা ছাড়া কোনো পথ নেই। কেননা দখল-নিপীড়নে বাঙালি জাতির কোনো স্বার্থ নেই, আছে কতিপয়ের। একটি শক্তিশালী সুবিধাভোগী গোষ্ঠী এই নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতেই সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। এই সূত্র ধরে দেশি-বিদেশি নানা ফাঁদ বা অজুহাত সৃষ্টি হওয়াও খুবই সম্ভব। আবার বলি, এসবের ফলে লাভবান কিছু ব্যক্তি, শ্রেণী বা গোষ্ঠী; কিন্তু এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত সমগ্র বাংলাদেশ, সঙ্গে বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষও।
(এই লেখা যখন শেষ করছি, তখনই পাহাড় থেকে লেখক গবেষক অদিতি ফাল্গুনী এসএমএস করে জানাচ্ছেন, ‘অবিশ্বাস্য! পাহাড়গুলো একবারে পোড়া ছাইয়ের মতো হয়ে আছে। ঘটনার প্রায় ২০ দিন পরও পাহাড়ের নারী-পুরুষ এখনো খোলা আকাশের নিচে দিনরাত কাটাচ্ছে।’ তবে কী করল সরকার এত দিন? আর ঢাকার পোড়া বাঙালি নারী শ্রমিকেরা? তদন্ত কমিটি? অপরাধীদের শাস্তি? প্রশ্নও যেন অর্থহীন!!)
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় হত্যা, অগ্নিকাণ্ডসহ যেসব হিংসাত্মক ঘটনা গত কিছুদিনে ঘটেছে তার ক্ষেত্র বহু দিনে সৃষ্ট, বহুবার ঘটা ঘটনার সর্বশেষ এগুলো। পাহাড়ি-বাঙালি সংঘাত ও নির্মমতার যে বিবরণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, তা পুরোনো ক্ষত আর প্রশ্নগুলোকেই সামনে এনেছে। এই সর্বশেষ ঘটনাবলিতে এটাও স্পষ্ট হয়েছে, জাতিগত নিপীড়নের দায় থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র এখনো মুক্ত হতে ইচ্ছুক নয়।
কয়েক দশক ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে যে রক্তপাত, সহিংসতা, অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তার সৃষ্টি হচ্ছে বারবার, তার উত্স সন্ধান করলে মোটা দাগে তিনটি কারণ পাওয়া যায়। প্রথমত, উন্নয়ন প্রকল্প; যা মানুষ ও প্রকৃতির ওপর দীর্ঘ মেয়াদে বিষফল বিবেচনায় না এনে প্রণীত। দ্বিতীয়ত, জাতিগত ভিন্ন অস্তিত্বের প্রতি অস্বীকৃতি; আপেক্ষিকভাবে দুর্বল সংখ্যালঘু জাতিসত্তার প্রতি উপনিবেশ-ধরনের সংস্কৃতি ও রাজনীতি। এবং তৃতীয়ত, দখল-তত্পরতা।
ষাটের দশকে বিদেশি ঋণ ও উপদেষ্টা সহযোগে বিদ্যুত্ উত্পাদনের লোভনীয় লক্ষ্য সামনে রেখে কাপ্তাই জলবিদ্যুত্ প্রকল্প করা হয়েছিল। পাকিস্তানি স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খানের কথিত উন্নয়ন দশকের এটি ছিল একটি বড় অবলম্বন। সেই প্রকল্প অনুযায়ী বাঁধ নির্মিত হলো, সেই বাঁধের কারণে সৃষ্টি হলো কাপ্তাই লেক, ভেসে গেল রাঙামাটির রাজবাড়িসহ বৃহত্ জনবসতি। সেই অঞ্চলের সবাই, লক্ষাধিক মানুষ উদ্বাস্তু হলো, যারা সবাই সংখ্যালঘু জাতি, ভাষা ও ধর্মের মানুষ। উন্নয়ন এবং তার লাভ-ক্ষতি পরিমাপে একচোখা হিসাবের কী পরিণতি হয় এবং তার জন্য কত খেসারত দিতে হয় মানুষকে, এটি তার একটি নমুনা। উদ্বাস্তু মানুষদের ক্ষতিপূরণ আর পুনর্বাসন নিয়ে অনেক রঙিন গল্প ছিল, কিন্তু বাস্তবে তা এখনো অমীমাংসিত। একটি অংশ এখনো উদ্বাস্তু। যে বিদ্যুত্ উত্পাদনের জন্য ভাসিয়ে দেওয়া হলো লাখো মানুষ, সেই বিদ্যুত্ উত্পাদনও লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী হয়নি। পরে বরং এর আরও অবনতি হয়েছে, এখন বলা হচ্ছে আগের পরিকল্পনায় বিদ্যুত্ উত্পাদন করতে গেলে আরেকটি বাঁধ দিতে হবে! এখনো উন্নয়ন নামে নানা প্রকল্পের আয়োজন চলছে।
জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। কিন্তু উদ্ভবের পর ১৯৭২ সালেই এই দেশের সংখ্যালঘু জাতিসত্তার জন্য ‘উন্নয়ন’-সৃষ্ট সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয় জাতিগত অস্বীকৃতি। সংবিধান অস্বীকার করল যে বাংলাদেশে শুধু বাঙালি নয়, অন্যান্য জাতিও আছে। অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র অস্তিত্বের এই অস্বীকৃতির মধ্য দিয়ে আগের জমে থাকা ক্ষোভ আরও বৃদ্ধি পেল। সংঘাত, অবিশ্বাস ও নিপীড়নের নতুন পর্ব শুরু হলো। এম এন লারমা প্রতিবাদ করলেন, প্রত্যুত্তরে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসল সেনানিবাস। শুরু হলো সশস্ত্র প্রতিবাদ, প্রত্যুত্তরে আরও সেনানিবাস।
এভাবেই বাংলাদেশের সব মানুষ সামরিক শাসনের অধীনে আসার আগেই পার্বত্য চট্টগ্রামে শুরু হয়েছে সামরিক শাসন। বাংলাদেশের সব মানুষ যখন সামরিক শাসনের অধীনে, তখন এই অঞ্চল বাড়তি সামরিক শাসনের আওতায়। আর এই শাসনকালে, আড়ালে, সামরিক-বেসামরিক ক্ষমতাবানদের হাতে জমি গেছে, সম্পদও গেছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘকাল স্বাভাবিকভাবেই বাঙালিরা গেছে, বসতি গেড়েছে। বাঙালি-পাহাড়ি সহাবস্থানে কোনো সমস্যা হয়নি। কিন্তু সত্তরের দশকের শেষে জাতিগত শাসনের পদ্ধতির অংশ হিসেবে যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গরিব বাঙালিদের অর্থ, জমি ও কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে যাওয়া হতে থাকল, তখনই জটিলতার শুরু। গরিব বাঙালিদের ঢাল সৃষ্টির মধ্য দিয়ে শুরু হলো নিপীড়ন, সহিংসতা ও জাতিগত বিদ্বেষের বর্তমান অধ্যায়।
রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এভাবে বাঙালি ‘সেটলার’দের সংখ্যা বেড়েছে, ক্রমে কোথাও কোথাও তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। জাতিগত নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক ব্যবস্থাবলি ক্রমে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে দূরত্ব, অবিশ্বাস, সংঘাত ও সহিংসতা বৃদ্ধি করেছে। অন্যদিকে নিরাপত্তা রক্ষার নামে পাহাড় উজাড় হয়েছে। রেশন, উন্নয়ন বাজেট, নির্মাণ, স্থাপনা ইত্যাদি ধরে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে; উন্নয়ন ও নিরাপত্তার অজুহাতে পাহাড় লিজ হচ্ছে ব্যক্তির নামে।
এগুলো ঘিরে বিশেষ স্বার্থগোষ্ঠী গড়ে উঠেছে, যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সঙ্গে নানাভাবে যুক্ত। এদের মধ্যে অধিকাংশ বাঙালি হলেও নতুন সুবিধাভোগী কিছু পাহাড়িও আছে। এদের নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তি অর্থাত্ সামরিকীকরণ অর্থাত্ অব্যাহত সহিংসতা উত্তেজনা অবিশ্বাস দরকার। এর শিকার প্রথমত সংখ্যালঘু জাতির মানুষেরা, কিন্তু এর শিকার অবশ্যই টেনে নিয়ে যাওয়া দরিদ্র বাঙালিরাও। ১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে মূল সমস্যাগুলো অনিষ্পন্ন রেখেই কিংবা জাতিগত স্বীকৃতি, বসতি-পুনর্বাসন ও উন্নয়ন দর্শনের সমস্যা বিষয়ে যথেষ্ট দৃষ্টি না দিয়েই।
জাতিগত নিপীড়ন, বিদ্বেষ এবং এর সামরিক সমাধানের চেষ্টা পৃথিবীর কোথাও সফল হয়নি। শুধু দক্ষিণ এশিয়ার কথাই যদি বিবেচনা করি, এ কারণেই পাকিস্তান ভেঙেছে, এ কারণেই ভারতের এক-তৃতীয়াংশ এখন সামরিক শাসনের অধীনে, নিপীড়ন হত্যাকাণ্ড এবং সহিংসতা সেখানে বাড়ছেই, শ্রীলঙ্কা চির অশান্তির মধ্যে আছে এখনো। আর বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে ক্রমান্বয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে মানুষের, রক্তক্ষরণ হচ্ছে সমাজ ও অর্থনীতির।
গত দুই দশকে সারা দেশে দখলদার দুর্বৃত্তদের দাপট তৈরি হয়েছে; উন্নয়ন আর প্রবৃদ্ধির গল্পের আড়ালে নদীনালা, খালবিল, বনজঙ্গল সবকিছু দখলে নেওয়ার জন্য তারা মরিয়া, তাদের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশাল ভূমি ও সম্পদ তাদের আওতার বাইরে কী করে থাকে? এই দখল-তত্পরতা জাতিগত সংঘাত আর নিরাপত্তাকে ব্যবহার করছে খুব জুতসই একটি অজুহাত হিসেবে। আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। এতগুলো হত্যাকাণ্ড আর অগ্নিসংযোগের ঘটনা, কোনোটিরই তাই যথাযথ তদন্ত বা বিচার হয়নি। এবারও হওয়ার সম্ভাবনা দেখি না।
প্রাথমিক কয়েকটি কথা আমাদের মাথায় গেঁথে নেওয়া দরকার যে বাংলাদেশ প্রধানত বাঙালি-অধ্যুষিত দেশ হলেও কেবল বাঙালির বাসভূমি নয়; বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও কেবল মুসলমানের বাসভূমি নয়; এই বহুজাতিক, বহুধর্মীয়, বহুভাষিক বৈচিত্র্য আমাদের সম্পদ—কোনোভাবেই সমস্যা নয়, তা আমাদের ঐশ্বর্য। সর্বোপরি পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অংশ, এই রাষ্ট্রের উপনিবেশ নয়।
সম্পদকে সংকটে পরিণত করছে যে মতাদর্শ, রাজনীতি ও উন্নয়ন দর্শন তাকে জাতি ধর্ম ভাষা নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করা ছাড়া কোনো পথ নেই। কেননা দখল-নিপীড়নে বাঙালি জাতির কোনো স্বার্থ নেই, আছে কতিপয়ের। একটি শক্তিশালী সুবিধাভোগী গোষ্ঠী এই নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখতেই সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। এই সূত্র ধরে দেশি-বিদেশি নানা ফাঁদ বা অজুহাত সৃষ্টি হওয়াও খুবই সম্ভব। আবার বলি, এসবের ফলে লাভবান কিছু ব্যক্তি, শ্রেণী বা গোষ্ঠী; কিন্তু এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত সমগ্র বাংলাদেশ, সঙ্গে বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষও।
(এই লেখা যখন শেষ করছি, তখনই পাহাড় থেকে লেখক গবেষক অদিতি ফাল্গুনী এসএমএস করে জানাচ্ছেন, ‘অবিশ্বাস্য! পাহাড়গুলো একবারে পোড়া ছাইয়ের মতো হয়ে আছে। ঘটনার প্রায় ২০ দিন পরও পাহাড়ের নারী-পুরুষ এখনো খোলা আকাশের নিচে দিনরাত কাটাচ্ছে।’ তবে কী করল সরকার এত দিন? আর ঢাকার পোড়া বাঙালি নারী শ্রমিকেরা? তদন্ত কমিটি? অপরাধীদের শাস্তি? প্রশ্নও যেন অর্থহীন!!)
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments