চারদিক-হাতের মুঠোয় প্রাণ আর কত দিন! by নেয়ামতউল্যাহ
২০১০ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার। মাগরিবের আজান হয়ে গেছে। দুর্গন্ধে ঘেরা বুড়িগঙ্গার তীরে সদরঘাট। সারি সারি লঞ্চ যাত্রী তুলছে। নানা শব্দ-সুর যেন ব্যান্ডের অপূর্ব সংগীত। উপকূল অঞ্চলের যাকেই জিজ্ঞেস করবেন, লঞ্চের যাত্রা কেমন? সবার সহজ উত্তর, বেশ আরামদায়ক।
কিন্তু ভোলাবাসী এই প্রশ্নের সঙ্গে আরেকটি উত্তর দেয়, ‘জন্ম আমার আজন্ম পাপ’! ঠেকে ওঠে লঞ্চে। লঞ্চ ছাড়া যে আর কোনো যান নেই!
সন্ধ্যা সাতটায় লঞ্চ ছাড়ল এমভি লালী। হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে প্রায় ৬০০ যাত্রী লঞ্চে চলেছে। ভোলার উদ্দেশে। লঞ্চে ইচ্ছেমতো যাত্রী তোলা হয়েছে। তার ওপরে মাল। ফিটনেসবিহীন দোতলা লঞ্চ চারতলা করে ইচ্ছেমতো চলছেই। কোনো নীতিমালার ধার ধারে না।
লঞ্চের হোটেলে বাসি ভাজা মাছের ঝোল, অতিরিক্ত দাম, নদীর পানিতে ফিটকারি, ডেকের যাত্রীর সঙ্গে কুকুর-বিড়ালের মতো আচরণ চলছেই। ভোলার অনেক স্বনামখ্যাত মানুষ লঞ্চের ব্যবসা করেন আয়েশ করে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই নতুন লঞ্চ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু রোটেশন-পদ্ধতি বন্ধ হচ্ছে না।
এমভি লালী লঞ্চটি চলছে। নদীর দুপাশে আলোঝিকিমিকি। কিন্তু লঞ্চের সার্চলাইট নেই। যেন মনে হচ্ছে, আলো-আঁধারির মধ্যে চোখকানা ভয়াল অজগর এঁকেবেঁকে চলছে। প্রশাসনের চোখ যখন অন্ধ হয়, তখন অনেকের চোখ অন্ধ হয়ে যায়। বুড়িগঙ্গা সেতুটি পার হতেই সার্চলাইটবিহীন লালী লঞ্চকে ধাক্কা দেয় আরেক অন্ধ কার্গো জাহাজ (তারও সার্চলাইট নেই)। ব্যস, কার্গোটি গেল ডুবে। ডুবতে ডুবতে কার্গোর চার-পাঁচজন সাঁতরে নদীর তীরে উঠল। কার্গো যখন লঞ্চটিকে ধাক্কা দিল, তখন পুরো লঞ্চের যাত্রীরা গড়িয়ে পড়ল এর-ওর শরীরে। কেবিনে যারা ছিল, তারা পড়ল নিচে। পুরো লঞ্চে আতঙ্ক। লঞ্চ একটু টাল সামলে আবার ভোলার উদ্দেশে চলা শুরু করল। কিন্তু যাত্রীদের দৃঢ় বিশ্বাস, লঞ্চের তলা ফুটো হয়ে গেছে, তারা বাধা দিল লঞ্চ চালাতে। লঞ্চ তীরে ভিড়িয়ে পরীক্ষা করার জন্য যাত্রীরা হইচই, চিত্কার-চেঁচামেচি শুরু করল। লঞ্চ চলছেই। এক সময় হাতাহাতি শুরু কর্মচারীদের সঙ্গে। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ইটভাটার কাছে যাওয়ার পরে লঞ্চ থামিয়ে পরীক্ষা করলে দেখা যায়, যাত্রীদের ধারণা সঠিক। লঞ্চ ফেটে পানি উঠছে। লঞ্চ কর্মচারীরা চটের বস্তা দিয়ে ফুটোর মুখ বন্ধ করে আবার চালাতে শুরু করল। যাত্রীদের কোনো বাধা তারা মানছে না। লঞ্চ কর্তৃপক্ষ বলছে, এটা কোনো সমস্যা না, এই সামান্য ত্রুটি নিয়ে অনায়াসেই ভোলায় পৌঁছানো যাবে। কিন্তু যাত্রীরা লঞ্চ সদরঘাটে ফেরত নিতে চাপাচাপি করছে।
লঞ্চে পানি ওঠা শুরু করেছে। লঞ্চ চলছে। কর্তৃপক্ষ বলল পেছনে যেতে। কারণ সামনের ভাগ উঁচু না হলে ওই ফুটো দিয়ে পানি উঠবে। যাত্রীরা হুড়মুড় করে লঞ্চের পেছনে যেতে শুরু করল। এখন লঞ্চের পেছন দিক ডুবতে শুরু করছে। লঞ্চ চলছে। মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত যাত্রীরা চিত্কার করে কাঁদছে। কেউ কাঁদতে কাঁদতে মোবাইলে ফোন করছে আত্মীয়ের কাছে। ‘মাপ কইর্যা দিয়েন, লঞ্চে পানি ওডা শুরু করছে।’ কেউ উদভ্রান্তের মতো দৌড়াচ্ছে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। লঞ্চের যাত্রী জনকণ্ঠ-এর জেলা সংবাদদাতা হাসিব রহমান জানান, যাত্রীদের মধ্যে মৃত্যুর আতঙ্কে অনেকে বেহুঁশ-বেসামাল হয়ে পড়ছে। লঞ্চ কর্মচারীদের যখন কোনোভাবেই বোঝানো গেল না, তখন ভোলা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে বিষয়টি জানানো হলো। তাঁরাও লঞ্চের কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলতে ব্যর্থ হলেন। বাধ্য হয়ে নারায়ণগঞ্জ পুলিশের সঙ্গে কথা বললেন ভোলা পুলিশ সুপার। রাত সাড়ে নয়টার সময় পুলিশ এসে লঞ্চ থামাল। বাধ্য করল সদরঘাটে পুনরায় ফিরিয়ে নিতে। রাত ১১টায় এমভি লালী লঞ্চটি পুনরায় সদরঘাটে পৌঁছাল। বেঁচে গেল ছয় শতাধিক যাত্রী। হয়তো ওই রাতে অনেকেই ঘরে ফিরতে পারেনি, তবু প্রাণে বেঁচে গেছে।
২০০৩ সালের ৮ জুলাই রাত পৌনে ১১টার সময় পদ্মা-ডাকাতিয়া-মেঘনার মোহনায় এমভি নাসরিন ঝড়ে বাঁ দিকে কাত হয়ে ডুবে যায়। ওই লঞ্চে যাত্রীর ধারণক্ষমতা ছিল ৪৪৯ জন। যাত্রী উঠিয়েছে আট শতাধিক। মালামাল ছিল কয়েক শ মণ। এত ওজন লঞ্চটি সহ্য করতে পারেনি। তাই নিজের সঙ্গে চার শতাধিক যাত্রীর প্রাণহানী ঘটিয়েছে। তখন দাবি করা হয়েছিল, ফিটনেসবিহীন লঞ্চ যেন না থাকে। কিন্তু তা আর হয়নি।
ফলে আবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ২০০৯ সালের ২৭ নভেম্বর সকাল সাড়ে নয়টায় এমভি কোকো-৪ লঞ্চটি তিন সহস্রাধিক যাত্রী নিয়ে ভোলা-লালমোহনের উদ্দেশে ছেড়ে আসে। ওই লঞ্চও সদরঘাট থেকে ছাড়ার পরে দুপাশ দিয়ে পানি ওঠা শুরু করে। এ অবস্থা দেখে লঞ্চটি কূলে ভেড়াতে অনুরোধ করেছিল। তখন লঞ্চ কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের নিষেধ উপেক্ষা করে চালাতে থাকে। অবশেষে লালমোহন নাজিরপুর লঞ্চঘাটে এসে রাত পৌনে ১১টার সময় যাত্রীদের ভিড়ে বাঁ দিকে কাত হয়ে ডুবে যায়। জীবন হারায় ৮০ জনের অধিক। যদি লঞ্চ মাঝনদীতে ডুবে যেত, তাহলে হয়তো আরও বেশি প্রাণহানী ঘটত।
লালীর যাত্রীরা বলেছেন, গত শুক্রবার পুলিশের হস্তক্ষেপে যদি সদরঘাটে ফেরত না যেত, তাহলে ভোলার লঞ্চে আরেকটি ট্র্যাজেডি ঘটত। আবার হয়তো ভোলার বুকে ক্রন্দনের রোল উঠত। নাসরিন ও কোকো-৪ ডুবে যাওয়ায় ১৭৬টি পরিবার তাদের একমাত্র আয়ের মানুষটি হারিয়ে বর্তমানে মানবেতর জীবন অতিবাহিত করছে। এভাবে চলবে কত দিন?
সন্ধ্যা সাতটায় লঞ্চ ছাড়ল এমভি লালী। হাতের মুঠোয় প্রাণ নিয়ে প্রায় ৬০০ যাত্রী লঞ্চে চলেছে। ভোলার উদ্দেশে। লঞ্চে ইচ্ছেমতো যাত্রী তোলা হয়েছে। তার ওপরে মাল। ফিটনেসবিহীন দোতলা লঞ্চ চারতলা করে ইচ্ছেমতো চলছেই। কোনো নীতিমালার ধার ধারে না।
লঞ্চের হোটেলে বাসি ভাজা মাছের ঝোল, অতিরিক্ত দাম, নদীর পানিতে ফিটকারি, ডেকের যাত্রীর সঙ্গে কুকুর-বিড়ালের মতো আচরণ চলছেই। ভোলার অনেক স্বনামখ্যাত মানুষ লঞ্চের ব্যবসা করেন আয়েশ করে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই নতুন লঞ্চ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু রোটেশন-পদ্ধতি বন্ধ হচ্ছে না।
এমভি লালী লঞ্চটি চলছে। নদীর দুপাশে আলোঝিকিমিকি। কিন্তু লঞ্চের সার্চলাইট নেই। যেন মনে হচ্ছে, আলো-আঁধারির মধ্যে চোখকানা ভয়াল অজগর এঁকেবেঁকে চলছে। প্রশাসনের চোখ যখন অন্ধ হয়, তখন অনেকের চোখ অন্ধ হয়ে যায়। বুড়িগঙ্গা সেতুটি পার হতেই সার্চলাইটবিহীন লালী লঞ্চকে ধাক্কা দেয় আরেক অন্ধ কার্গো জাহাজ (তারও সার্চলাইট নেই)। ব্যস, কার্গোটি গেল ডুবে। ডুবতে ডুবতে কার্গোর চার-পাঁচজন সাঁতরে নদীর তীরে উঠল। কার্গো যখন লঞ্চটিকে ধাক্কা দিল, তখন পুরো লঞ্চের যাত্রীরা গড়িয়ে পড়ল এর-ওর শরীরে। কেবিনে যারা ছিল, তারা পড়ল নিচে। পুরো লঞ্চে আতঙ্ক। লঞ্চ একটু টাল সামলে আবার ভোলার উদ্দেশে চলা শুরু করল। কিন্তু যাত্রীদের দৃঢ় বিশ্বাস, লঞ্চের তলা ফুটো হয়ে গেছে, তারা বাধা দিল লঞ্চ চালাতে। লঞ্চ তীরে ভিড়িয়ে পরীক্ষা করার জন্য যাত্রীরা হইচই, চিত্কার-চেঁচামেচি শুরু করল। লঞ্চ চলছেই। এক সময় হাতাহাতি শুরু কর্মচারীদের সঙ্গে। নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় ইটভাটার কাছে যাওয়ার পরে লঞ্চ থামিয়ে পরীক্ষা করলে দেখা যায়, যাত্রীদের ধারণা সঠিক। লঞ্চ ফেটে পানি উঠছে। লঞ্চ কর্মচারীরা চটের বস্তা দিয়ে ফুটোর মুখ বন্ধ করে আবার চালাতে শুরু করল। যাত্রীদের কোনো বাধা তারা মানছে না। লঞ্চ কর্তৃপক্ষ বলছে, এটা কোনো সমস্যা না, এই সামান্য ত্রুটি নিয়ে অনায়াসেই ভোলায় পৌঁছানো যাবে। কিন্তু যাত্রীরা লঞ্চ সদরঘাটে ফেরত নিতে চাপাচাপি করছে।
লঞ্চে পানি ওঠা শুরু করেছে। লঞ্চ চলছে। কর্তৃপক্ষ বলল পেছনে যেতে। কারণ সামনের ভাগ উঁচু না হলে ওই ফুটো দিয়ে পানি উঠবে। যাত্রীরা হুড়মুড় করে লঞ্চের পেছনে যেতে শুরু করল। এখন লঞ্চের পেছন দিক ডুবতে শুরু করছে। লঞ্চ চলছে। মৃত্যুভয়ে আতঙ্কিত যাত্রীরা চিত্কার করে কাঁদছে। কেউ কাঁদতে কাঁদতে মোবাইলে ফোন করছে আত্মীয়ের কাছে। ‘মাপ কইর্যা দিয়েন, লঞ্চে পানি ওডা শুরু করছে।’ কেউ উদভ্রান্তের মতো দৌড়াচ্ছে। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। লঞ্চের যাত্রী জনকণ্ঠ-এর জেলা সংবাদদাতা হাসিব রহমান জানান, যাত্রীদের মধ্যে মৃত্যুর আতঙ্কে অনেকে বেহুঁশ-বেসামাল হয়ে পড়ছে। লঞ্চ কর্মচারীদের যখন কোনোভাবেই বোঝানো গেল না, তখন ভোলা জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারকে বিষয়টি জানানো হলো। তাঁরাও লঞ্চের কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলতে ব্যর্থ হলেন। বাধ্য হয়ে নারায়ণগঞ্জ পুলিশের সঙ্গে কথা বললেন ভোলা পুলিশ সুপার। রাত সাড়ে নয়টার সময় পুলিশ এসে লঞ্চ থামাল। বাধ্য করল সদরঘাটে পুনরায় ফিরিয়ে নিতে। রাত ১১টায় এমভি লালী লঞ্চটি পুনরায় সদরঘাটে পৌঁছাল। বেঁচে গেল ছয় শতাধিক যাত্রী। হয়তো ওই রাতে অনেকেই ঘরে ফিরতে পারেনি, তবু প্রাণে বেঁচে গেছে।
২০০৩ সালের ৮ জুলাই রাত পৌনে ১১টার সময় পদ্মা-ডাকাতিয়া-মেঘনার মোহনায় এমভি নাসরিন ঝড়ে বাঁ দিকে কাত হয়ে ডুবে যায়। ওই লঞ্চে যাত্রীর ধারণক্ষমতা ছিল ৪৪৯ জন। যাত্রী উঠিয়েছে আট শতাধিক। মালামাল ছিল কয়েক শ মণ। এত ওজন লঞ্চটি সহ্য করতে পারেনি। তাই নিজের সঙ্গে চার শতাধিক যাত্রীর প্রাণহানী ঘটিয়েছে। তখন দাবি করা হয়েছিল, ফিটনেসবিহীন লঞ্চ যেন না থাকে। কিন্তু তা আর হয়নি।
ফলে আবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ২০০৯ সালের ২৭ নভেম্বর সকাল সাড়ে নয়টায় এমভি কোকো-৪ লঞ্চটি তিন সহস্রাধিক যাত্রী নিয়ে ভোলা-লালমোহনের উদ্দেশে ছেড়ে আসে। ওই লঞ্চও সদরঘাট থেকে ছাড়ার পরে দুপাশ দিয়ে পানি ওঠা শুরু করে। এ অবস্থা দেখে লঞ্চটি কূলে ভেড়াতে অনুরোধ করেছিল। তখন লঞ্চ কর্তৃপক্ষ যাত্রীদের নিষেধ উপেক্ষা করে চালাতে থাকে। অবশেষে লালমোহন নাজিরপুর লঞ্চঘাটে এসে রাত পৌনে ১১টার সময় যাত্রীদের ভিড়ে বাঁ দিকে কাত হয়ে ডুবে যায়। জীবন হারায় ৮০ জনের অধিক। যদি লঞ্চ মাঝনদীতে ডুবে যেত, তাহলে হয়তো আরও বেশি প্রাণহানী ঘটত।
লালীর যাত্রীরা বলেছেন, গত শুক্রবার পুলিশের হস্তক্ষেপে যদি সদরঘাটে ফেরত না যেত, তাহলে ভোলার লঞ্চে আরেকটি ট্র্যাজেডি ঘটত। আবার হয়তো ভোলার বুকে ক্রন্দনের রোল উঠত। নাসরিন ও কোকো-৪ ডুবে যাওয়ায় ১৭৬টি পরিবার তাদের একমাত্র আয়ের মানুষটি হারিয়ে বর্তমানে মানবেতর জীবন অতিবাহিত করছে। এভাবে চলবে কত দিন?
No comments