ও মা-জোকার

যে বয়সে তাঁর আঁচলতলে থেকে বায়না করার কথা সে বয়সে ‘মা’ হয়েছেন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে মা জন্ম দিয়েছেন প্রথম সন্তানের। ১১ মাসের মাথায় জন্ম দ্বিতীয় সন্তানের। নিজের হারানো শৈশব হয়তো তখনো তাঁকে হাতছানি দিয়ে ডাকত। তাই বুঝি, মেঘলা দিনে অথবা বৃষ্টিঝরা বাদল দিনের মধ্য দুপুরে মা আমাদের সঙ্গে পুতুল,


কখনো বা রান্না পাতিল নিয়ে খেলতে বসতেন। নিজের হাতে খড়-কাপড়-তুলা দিয়ে বানিয়ে দিতেন নাক-মুখ-চোখওয়ালা নাদুসনুদুস পুতুল। কাজল পেনসিলের নিপুণ আঁকে ফুটিয়ে তোলা সেই পুতুল ছিল আমাদের দুই বোনের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। দুপুরে মায়ের দুই পাশে দুই হাতে মাথা রেখে আমরা ঘুমাতাম, মানে ঘুমাতে বাধ্য হতাম। তখন এমনকি রাতেও আমাদের বিছানার কাছ ছাড়া হতো না শখের সেই পুতুল।
মায়ের কারণেই পাড়ায় খেলার আসরে আমাদের দুই বোনকে আলাদা করে চিনত সবাই। মায়ের হাতে সেলাই করা ঘটিহাতা লম্বা বেল্টের গোল টাইপের ফ্রক আর হাতে কাজ করা ফতুয়ার কল্যাণে আমাদের দুই বোনের লুক নাকি ছিল দারুণ নান্দনিক। অথচ রাত জেগে কতক্ষণে সেলাই শেষ করে আমাদের সেই পোশাক পরাবেন, মায়ের সেই তাড়া আমরা মোটেই আমলে দিতাম না। ‘সায়েরা বানু’ খ্যাত আমার মায়ের রূপে-গুণে মুগ্ধ আমরা ছিলাম বাধ্য সন্তান। পুতুল বানানোর ক্যারিশমার পর মায়ের প্রতি আমাদের মুগ্ধতা বিস্ময়ে রূপ নেয়। আর ওই পুতুলের কল্যাণে ছোট্টদের খেলার আসরে বহু দিনই আমাদের দুই বোনের পুতুল ছিল সবার মধ্যমণি।
বৈশাখ মাসের তপ্ত দুপুরে রাজকাপুর অভিনীত বিখ্যাত চলচ্চিত্র মেরা নাম জোকার-এর বিখ্যাত সেই জোকারের আদলে নেচেগেয়ে অ্যাকটিং করে মায়ের আমাদের ঘুম পাড়ানো আরেক অনবদ্য ঘটনা। ২০-২১ বছর বয়সী আমার তরুণী মা গোসল-খাওয়া শেষে পিঠের ওপর লম্বা চুল ছড়িয়ে বাবার পোশাকে জোকারের পাট নিতে তৈরি হলেও তা জমেনি। কারণ, ওই পোশাকে মাকে দেখে ছোট্ট আমি একেবারে দিশেহারা। খেলব কি...আমি তখন হাপুস নয়নে কাঁদছি। আর বলছি, ‘এই মা ভালো না।’ মা আমার এক মুহূর্ত দেরি না করে দ্রুত পোশাক পাল্টে আমাকে শান্ত করেছেন। আমার মুখের আধো আধো বোলেই মা যেন বুঝেছেন, বাবার পোশাকে আমি আমার চিরচেনা মাকে খুঁজে না পেয়েই কেঁদেছি। তাই সেদিনের পর আর কখনোই মাকে জোকার সাজতে দেখিনি। সংসারের সব দিক সামলে সময়মতো খাবার জোগান দেওয়া, অসুস্থতায় সেবা করা সন্তানের লেখাপড়ার তদারকিসহ সবাইকে নির্মল বিনোদন দেওয়াও ছিল আমার মায়ের কাজ। অদ্ভুত দক্ষতা, পরম মমতা আর কী এক জাদুবলে সবাইকে একই সুতোয় রেখে যেন বিনা সুতোয় মালা গেঁথেছেন। পাশে থেকে শক্তি আর সাহস দিয়ে আমাদের সবাইকে এগিয়ে দিয়েছেন যার যার পথে।
এই সেদিন রিমোট হাতে স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেলের কল্যাণে রাজকাপুরের মেরা নাম জোকার দেখে বহু দিন পর আবেগে ভাসলাম। ২৮-৩০ বছর আগের স্মৃতিতে ফিরে গিয়ে দেখলাম, দুধে আলতা গোলাপি গড়নের গৌরী প্রতিমার মতো আমার মাকে। হঠাৎই উপলব্ধি করলাম সন্তানবৎসল-উচ্ছল-অতিথিপরায়ণ সব সময়ের হাসিখুশি বহু গুণের অধিকারী আমার তরুণী মা এখন অ..নে..ক পরিণত। কিছুটা হলেও প্রাচীন হয়েছে তাঁর শরীর। হারিয়েছে তাঁর রূপের জ্যোৎস্না। ৩৯ বছর বয়সী তাঁর সংসারের মতোই বয়স হয়েছে মায়ের শরীর এবং মনেরও।
কান্না লুকাতে মায়ের পাশ ছেড়ে উঠলাম। মনে মনে বললাম, মাগো, আমি তোমার বিবর্ণ এই রূপের আড়ালের রূপটাই খুঁজি। ফিরে পেতে চাই বাবার পোশাকে দেখা তোমার গোলাপি আভায় দারুণ উদ্ভাসিত ঝলমলে সজীব সেদিনের রূপ। জোকারের মতো সদা হাস্যময় থেকে তোমার সন্তানসহ আর সবাইকে নির্মল আনন্দ দেওয়ার সেই উদ্যমই ফিরে পেতে চাই তোমার মাঝে।
জান্নাতুল বাকেয়া
সিনিয়র রিপোর্টার
চ্যানেল আই।

No comments

Powered by Blogger.