বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়-প্রস্তাবিত আইনের ব্যাপারে কিছু সুপারিশ by শাহানা রহমান
উন্নত বিশ্বের প্রথম ১০টি টপ র্যাঙ্কিং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। সারা বিশ্বে প্রথম ১০টি টপ র্যাঙ্কিং বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড, কানাডার ম্যাকগিল ও যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড এবং ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যেগুলো বেসরকারি।
বাংলাদেশেও হয়তো ভবিষ্যতে টপ র্যাঙ্কিং পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশই হবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। তবে সে জন্য কত দিন অপেক্ষা করতে হবে, সেটি এখন বিবেচ্য।
প্রস্তাবিত আইনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল’ গঠনের কথা বলা হয়েছে। লক্ষ করার বিষয়, অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল যদি শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিরূপণ করে, সে ক্ষেত্রে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান কে নিরূপণ করবে, সে বিষয়ে অদ্যাবধি সরকারি কোনো নির্দেশনা নেই। সুতরাং ওই ধারাটি সংশোধন করে সরকারি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে আলাদাভাবে চিহ্নিত না করে ‘বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল’ গঠনের কথা বলা যেতে পারে। তারাই সাধারণভাবে শিক্ষার মাপকাঠি নিরূপণ করতে সক্ষম হবে।
আইন বলেছে, কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে দূরশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করতে পারবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যখন এ পর্যন্ত শৈশব পেরোতে পারেনি, সেখানে এ ধরনের বিধান রাখলে তা আগের মতো অপপ্রয়োগের আশঙ্কা রয়েছে। যেখানে দূরশিক্ষণ কোর্স পরিচালনার জন্য বাংলাদেশে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, সেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে দূরশিক্ষণ কোর্সে উত্সাহিত করাটা আপাতত যুক্তিযুক্ত মনে হয় না। সুতরাং ধারাটি প্রস্তাবিত আইনে রাখা উচিত কি না সেটি বিচার্য।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য অন্যূন পাঁচ কোটি টাকার জামানত রাখার বিধান রাখা হয়েছে। অর্থাত্ উদ্যোক্তাকে কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শুরু করতে হলে আনুমানিক ১০ কোটি টাকা (জামানত পাঁচ কোটি ও অন্যান্য খরচ পাঁচ কোটি) বিনিয়োগ করতে হবে, যা শুধু কোনো ব্যবসায়ীর পক্ষে সম্ভব। এত বিপুল মূলধন নিয়ে কোনোভাবেই একজন শিক্ষাবিদের পক্ষে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা সম্ভব নয়। সুতরাং প্রকৃত শিক্ষাবিদদের উত্সাহিত করার জন্য সরকার বিশেষ ছাড় যেমন জামানতের পরিমাণ কমানো, কম সুদে ঋণ, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কর অবকাশ ইত্যাদি সুবিধা দিতে পারে।
আইনে স্থায়ী সনদপত্র পাওয়ার যে শর্তাবলির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য হল/ছাত্রাবাস এবং শিক্ষক-কর্মচারীদের আবাসনের শর্ত আরোপ করা হয়নি। সুতরাং শিক্ষক-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের এই ন্যূনতম মৌলিক চাহিদার বিষয়টি শর্তে আরোপ করা যেতে পারে। এ ছাড়া অন্যূন নয় সদস্যবিশিষ্ট একটি বোর্ড অব ট্রাস্টিজ গঠনের কথা বলা হয়েছে। বোর্ডের সদস্যদের মধ্যে থেকে মনোনীত একজন সদস্য বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতির দায়িত্ব পালনের কথা উল্লেখ থাকলেও কীভাবে সভাপতি নির্বাচিত হবেন এবং তার মেয়াদকাল কত দিন হবে তার উল্লেখ নেই। সভাপতি নির্বাচন পদ্ধতি এবং মেয়াদকাল নির্দিষ্ট না থাকলে উদ্যোক্তা বা তাদের পক্ষে অনভিপ্রেত প্রভাব খাটানোর আশঙ্কা থেকে যাবে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক মনোনীত একজন শিক্ষানুরাগী বা শিক্ষাবিদ এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক মনোনীত একজন প্রতিনিধির কথা বলা হয়েছে। স্থায়ী সনদপত্র পাওয়ার আগে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে থাকে, যাতে পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা অবনতির মতো ঘটনা ঘটে থাকে। তাই স্থায়ী সনদপত্র পাওয়ার আগ পর্যন্ত পুলিশ কমিশনার বা উপযুক্ত পদমর্যাদাসম্পন্ন কাউকে মনোনায়ন দেওয়ার বিধান আনা যেতে পারে।
স্থায়ী সনদপত্র পাওয়ার যথাযথ শর্ত পালনে ব্যর্থ হলে সরকার সাময়িক সনদপত্র বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করতে পারে। তবে এর ফলে অনেক সুচতুর উদ্যোক্তা উচ্চ আদালত থেকে সরকারের আদেশের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার সুযোগ পাবে, যা আইনের দৃষ্টিতে সঠিক হলেও অনৈতিক। তাই স্থায়ী সনদপত্র পাওয়ার আগে সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ওই ধরনের সাময়িক সনদপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যাতে আদালতে যেতে না পারে, সে জন্য উপযুক্ত রক্ষাকবচ তৈরি করতে হবে।
আইনে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদনক্রমে এক বা একাধিক ইনস্টিটিউট স্থাপনের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এর অবস্থান মূল ক্যাম্পাস যে শহরে অবস্থিত সেখানে নাকি বাংলাদেশের যেকোনো স্থানে স্থাপন করা যাবে সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। তবে বাংলাদেশের যেকোনো স্থানে ইনস্টিটিউট স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হলে সাময়িক সনদপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয় আগের মতো ‘আউটার ক্যাম্পাস’ খুলে প্রতারণা করতে পারে। সুতরাং এই ধারার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন।
একাধিক ক্যাম্পাস ও পাঠক্রম অনুমোদনের ব্যাপারেও আইনে বলা আছে। আবেদনপ্রাপ্তির ৯০ দিনের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক কোনো সিদ্ধান্ত প্রদত্ত না হলে সংশ্লিষ্ট আবেদনটি অনুমোদিত হিসেবে বিবেচিত হবে। এই ধারা দুটি আরও স্পষ্ট করার প্রয়োজন আছে। কারণ এখানেও সেই অনিয়মের আশঙ্কা থেকে যায়। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ৯০ দিনের মধ্যে আবেদনটির অনুমোদন প্রদানে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক উল্লিখিত আবেদনটি অনুমোদিত না হলে, ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা চ্যান্সেলর বরাবর আপিল করা যাবে কি না সে বিষয়েও কোনো নির্দেশনা নেই। এটা স্পষ্ট করতে হবে।
আইনে প্রতারণামূলক ধারা লঙ্ঘন করলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে কি না তা মোটেই স্পষ্ট নয়। অন্যদিকে আইনে বলা আছে, কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক এ অধ্যাদেশের বিধানাবলি লঙ্ঘিত হলে এতদুদ্দেশ্যে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তার লিখিত অভিযোগ ব্যতীত কোনো আদালত মামলা আমলে নিতে পারবেন না। কিন্তু ‘ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা’ কে বা কারা সেটি এ অধ্যাদেশে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি।
যেহেতু ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ (আপাতদৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন) ব্যতিরেকে এই অধ্যাদেশের বিধান লঙ্ঘনের কারণে কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না, সেহেতু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতারণা বা গুরুতর অনিয়মের কারণে কোনো শিক্ষার্থী/ অভিভাবক/অন্য কেউ সংক্ষুব্ধ হলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বরাবর অভিযোগ করা যাবে কি না সে বিষয়ে এই আইনে কোনো নির্দেশনা নেই। বিষয়টি প্রস্তাবিত আইনে সংযোজন করা যেতে পারে।
ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি আইনের ৪৭(১) ধারার বিধানাবলি লঙ্ঘনের কারণে ফৌজদারি মামলা থানায় বা আদালতে রুজু করতে পারেন, কিন্তু মামলাটি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন নাকি পুলিশ তদন্ত করবে সে বিষয়টির উল্লেখ থাকতে হবে।
শিক্ষকদের নিয়োগ ও পদোন্নতি দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে একটি সমন্বিত নীতিমালা থাকা উচিত। নিয়োগ ও পদোন্নতি নীতিমালাটি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে অনুমোদনের বাধ্যবাধকতায় আনা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের অনুমোদিত প্রাইভেট বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য যেকোনো দেশি, বিদেশি বা ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে ইকুইভেলেন্স সার্টিফিকেট নেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতায় না আনলে একটা বিরাট প্রতারণার আশঙ্কা থেকেই যায়। সে কারণে বিষয়টি প্রস্তাবিত আইনে সংযোজন হওয়া উচিত।
বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মতো মুনাফা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠান না হয়ে জনহিতকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠুক, সেটি আমাদের সবারই কাম্য। আমরা সেই সুদিনের অপেক্ষায় রইলাম।
শাহানা রহমান: গবেষক।
প্রস্তাবিত আইনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল’ গঠনের কথা বলা হয়েছে। লক্ষ করার বিষয়, অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল যদি শুধু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিরূপণ করে, সে ক্ষেত্রে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান কে নিরূপণ করবে, সে বিষয়ে অদ্যাবধি সরকারি কোনো নির্দেশনা নেই। সুতরাং ওই ধারাটি সংশোধন করে সরকারি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে আলাদাভাবে চিহ্নিত না করে ‘বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল’ গঠনের কথা বলা যেতে পারে। তারাই সাধারণভাবে শিক্ষার মাপকাঠি নিরূপণ করতে সক্ষম হবে।
আইন বলেছে, কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে দূরশিক্ষণ কোর্স পরিচালনা করতে পারবে। বাংলাদেশের অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় যখন এ পর্যন্ত শৈশব পেরোতে পারেনি, সেখানে এ ধরনের বিধান রাখলে তা আগের মতো অপপ্রয়োগের আশঙ্কা রয়েছে। যেখানে দূরশিক্ষণ কোর্স পরিচালনার জন্য বাংলাদেশে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, সেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে দূরশিক্ষণ কোর্সে উত্সাহিত করাটা আপাতত যুক্তিযুক্ত মনে হয় না। সুতরাং ধারাটি প্রস্তাবিত আইনে রাখা উচিত কি না সেটি বিচার্য।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য অন্যূন পাঁচ কোটি টাকার জামানত রাখার বিধান রাখা হয়েছে। অর্থাত্ উদ্যোক্তাকে কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শুরু করতে হলে আনুমানিক ১০ কোটি টাকা (জামানত পাঁচ কোটি ও অন্যান্য খরচ পাঁচ কোটি) বিনিয়োগ করতে হবে, যা শুধু কোনো ব্যবসায়ীর পক্ষে সম্ভব। এত বিপুল মূলধন নিয়ে কোনোভাবেই একজন শিক্ষাবিদের পক্ষে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা সম্ভব নয়। সুতরাং প্রকৃত শিক্ষাবিদদের উত্সাহিত করার জন্য সরকার বিশেষ ছাড় যেমন জামানতের পরিমাণ কমানো, কম সুদে ঋণ, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কর অবকাশ ইত্যাদি সুবিধা দিতে পারে।
আইনে স্থায়ী সনদপত্র পাওয়ার যে শর্তাবলির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য হল/ছাত্রাবাস এবং শিক্ষক-কর্মচারীদের আবাসনের শর্ত আরোপ করা হয়নি। সুতরাং শিক্ষক-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের এই ন্যূনতম মৌলিক চাহিদার বিষয়টি শর্তে আরোপ করা যেতে পারে। এ ছাড়া অন্যূন নয় সদস্যবিশিষ্ট একটি বোর্ড অব ট্রাস্টিজ গঠনের কথা বলা হয়েছে। বোর্ডের সদস্যদের মধ্যে থেকে মনোনীত একজন সদস্য বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সভাপতির দায়িত্ব পালনের কথা উল্লেখ থাকলেও কীভাবে সভাপতি নির্বাচিত হবেন এবং তার মেয়াদকাল কত দিন হবে তার উল্লেখ নেই। সভাপতি নির্বাচন পদ্ধতি এবং মেয়াদকাল নির্দিষ্ট না থাকলে উদ্যোক্তা বা তাদের পক্ষে অনভিপ্রেত প্রভাব খাটানোর আশঙ্কা থেকে যাবে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনার লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক মনোনীত একজন শিক্ষানুরাগী বা শিক্ষাবিদ এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক মনোনীত একজন প্রতিনিধির কথা বলা হয়েছে। স্থায়ী সনদপত্র পাওয়ার আগে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে থাকে, যাতে পরবর্তী সময়ে আইনশৃঙ্খলা অবনতির মতো ঘটনা ঘটে থাকে। তাই স্থায়ী সনদপত্র পাওয়ার আগ পর্যন্ত পুলিশ কমিশনার বা উপযুক্ত পদমর্যাদাসম্পন্ন কাউকে মনোনায়ন দেওয়ার বিধান আনা যেতে পারে।
স্থায়ী সনদপত্র পাওয়ার যথাযথ শর্ত পালনে ব্যর্থ হলে সরকার সাময়িক সনদপত্র বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করতে পারে। তবে এর ফলে অনেক সুচতুর উদ্যোক্তা উচ্চ আদালত থেকে সরকারের আদেশের বিরুদ্ধে স্থগিতাদেশ এনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার সুযোগ পাবে, যা আইনের দৃষ্টিতে সঠিক হলেও অনৈতিক। তাই স্থায়ী সনদপত্র পাওয়ার আগে সরকারের কোনো সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ওই ধরনের সাময়িক সনদপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যাতে আদালতে যেতে না পারে, সে জন্য উপযুক্ত রক্ষাকবচ তৈরি করতে হবে।
আইনে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদনক্রমে এক বা একাধিক ইনস্টিটিউট স্থাপনের উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এর অবস্থান মূল ক্যাম্পাস যে শহরে অবস্থিত সেখানে নাকি বাংলাদেশের যেকোনো স্থানে স্থাপন করা যাবে সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। তবে বাংলাদেশের যেকোনো স্থানে ইনস্টিটিউট স্থাপনের অনুমতি দেওয়া হলে সাময়িক সনদপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয় আগের মতো ‘আউটার ক্যাম্পাস’ খুলে প্রতারণা করতে পারে। সুতরাং এই ধারার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকা প্রয়োজন।
একাধিক ক্যাম্পাস ও পাঠক্রম অনুমোদনের ব্যাপারেও আইনে বলা আছে। আবেদনপ্রাপ্তির ৯০ দিনের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক কোনো সিদ্ধান্ত প্রদত্ত না হলে সংশ্লিষ্ট আবেদনটি অনুমোদিত হিসেবে বিবেচিত হবে। এই ধারা দুটি আরও স্পষ্ট করার প্রয়োজন আছে। কারণ এখানেও সেই অনিয়মের আশঙ্কা থেকে যায়। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ৯০ দিনের মধ্যে আবেদনটির অনুমোদন প্রদানে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক উল্লিখিত আবেদনটি অনুমোদিত না হলে, ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা চ্যান্সেলর বরাবর আপিল করা যাবে কি না সে বিষয়েও কোনো নির্দেশনা নেই। এটা স্পষ্ট করতে হবে।
আইনে প্রতারণামূলক ধারা লঙ্ঘন করলে তা অপরাধ বলে গণ্য হবে কি না তা মোটেই স্পষ্ট নয়। অন্যদিকে আইনে বলা আছে, কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক এ অধ্যাদেশের বিধানাবলি লঙ্ঘিত হলে এতদুদ্দেশ্যে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তার লিখিত অভিযোগ ব্যতীত কোনো আদালত মামলা আমলে নিতে পারবেন না। কিন্তু ‘ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তা’ কে বা কারা সেটি এ অধ্যাদেশে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি।
যেহেতু ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ (আপাতদৃষ্টিতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন) ব্যতিরেকে এই অধ্যাদেশের বিধান লঙ্ঘনের কারণে কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে না, সেহেতু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতারণা বা গুরুতর অনিয়মের কারণে কোনো শিক্ষার্থী/ অভিভাবক/অন্য কেউ সংক্ষুব্ধ হলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বরাবর অভিযোগ করা যাবে কি না সে বিষয়ে এই আইনে কোনো নির্দেশনা নেই। বিষয়টি প্রস্তাবিত আইনে সংযোজন করা যেতে পারে।
ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি আইনের ৪৭(১) ধারার বিধানাবলি লঙ্ঘনের কারণে ফৌজদারি মামলা থানায় বা আদালতে রুজু করতে পারেন, কিন্তু মামলাটি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন নাকি পুলিশ তদন্ত করবে সে বিষয়টির উল্লেখ থাকতে হবে।
শিক্ষকদের নিয়োগ ও পদোন্নতি দেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে একটি সমন্বিত নীতিমালা থাকা উচিত। নিয়োগ ও পদোন্নতি নীতিমালাটি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে অনুমোদনের বাধ্যবাধকতায় আনা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের অনুমোদিত প্রাইভেট বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য যেকোনো দেশি, বিদেশি বা ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে ইকুইভেলেন্স সার্টিফিকেট নেওয়ার আইনি বাধ্যবাধকতায় না আনলে একটা বিরাট প্রতারণার আশঙ্কা থেকেই যায়। সে কারণে বিষয়টি প্রস্তাবিত আইনে সংযোজন হওয়া উচিত।
বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অন্যান্য ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মতো মুনাফা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠান না হয়ে জনহিতকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠুক, সেটি আমাদের সবারই কাম্য। আমরা সেই সুদিনের অপেক্ষায় রইলাম।
শাহানা রহমান: গবেষক।
No comments