প্রত্নসম্পদ-প্রত্নঢিবি খনন এখনই জরুরি by সাইফুদ্দীন চৌধুরী
নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকের কথা। তখন আমি দেশের প্রাচীনতম সংগ্রহশালা রাজশাহীর বরেন্দ্র জাদুঘরের পরিচালকের দায়িত্বে নিযুক্ত ছিলাম। হঠাৎ একদিন টেলিফোন পেলাম রাজশাহীর তানোর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার। ভদ্রলোক আমার পূর্বপরিচিত।
সজ্জন ব্যক্তি, লেখক মানুষ ওই ইউএনও সাহেব। তাঁর কর্মস্থলে যাওয়া আমার নাকি খুবই জরুরি।
ইউএনওর গাড়িতে করেই তানোরে গেলাম। তিনি তৈরিই ছিলেন। গাড়িতে উঠে পড়লেন আমাদের সঙ্গে। আমাদের নিয়ে গেলেন ধানোরা নামক প্রায় জনমানবশূন্য এক জায়গায়। বাঁশঝাড় আর লতাগুল্মে আচ্ছাদিত স্থান। সেখানে রয়েছে উঁচু দুটি ঢিবি। স্থানীয় লোকেরা বড় ঢিবিকে বলে রাজবাড়ী আর ছোটটিকে বলে বুরুজ। সেখানে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মৃত্ফলকের ভগ্নাংশ, খণ্ডিত ইট ইত্যাদি। ঢিবি দুটি যে দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল তা সহজে অনুমান করা যায়। অতি সম্প্রতি যে এখানকার ভগ্নদশাগ্রস্ত দেয়াল থেকে ইট খুলে নিয়ে গেছে লোকজন, তা স্পষ্ট বোঝা যায়। জায়গাটির দখলদার, ধানোরার জনৈক কৃষক ঢিবি দুটি কেটে ফেলে কৃষিজমিতে রূপান্তরের কাজ শুরু করেছেন। এটি সরেজমিন দেখে গিয়েই ইউএনও আমাকে স্মরণ করেছেন।
জায়গাটি আদতে প্রত্নতত্ত্বের একটি সংরক্ষিত এলাকা। ব্রিটিশ আমলেই ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ এটি প্রাচীন বৌদ্ধবিহার হিসেবে তাদের ‘প্রটেকটেড মনুমেন্ট’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। সপ্তম শতক এই প্রত্নস্থলটির সময়কাল বলে তারা তাদের বার্ষিক কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করে। ইউএনও সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করায় আপাতত নির্ঘাৎ ধ্বংসের হাত থেকে প্রত্নস্থলটি বেঁচে যায়।
দেশজুড়ে অসংখ্য এ ধরনের প্রত্নপীঠ বা প্রত্নঢিবি রয়েছে। আমার জানা মতে, বৃহত্তর রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর জেলায়ই এর সংখ্যা শতাধিক হবে। আমি বর্তমান রাজশাহী ও নওগাঁ জেলার বেশকিছু এ ধরনের প্রত্নপীঠের কথা জানি। যার মধ্যে অন্তত ডজন-দুয়েক প্রত্নপীঠ তার গৌরব হারিয়ে কৃষিজমিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
রাজশাহী জেলা সদর থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার উত্তর-দক্ষিণে গোদাগাড়ী উপজেলার মাণ্ডৈল গ্রাম। বেশকিছু পুরাকীর্তি এখান তকে উদ্ধার করা হয় গত শতকের গোড়ার দিকে। রাজশাহীর ‘বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি’র কর্মকর্তা শরৎ কুমার রায়, ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় প্রমুখ কৃতবিদ্য ব্যক্তি প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানে গিয়ে এখান থেকে বিরল কিছু প্রত্নবস্তু সংগ্রহ করেন। এর মধ্যে ছিল বঙ্গীয় শিল্পকলার অনন্য নিদর্শন পুরাবস্তু ব্রোঞ্জ নির্মিত একটি জৈনমূর্তি। এ ছাড়া ওই অনুসন্ধানী দল এখান থেকে কালো পাথরের নির্মিত বিষ্ণু, বুদ্ধ এবং হর গৌরী মূর্তিসহ আরও বেশকিছু নিদর্শন সংগ্রহ করে। দশম-একাদশ শতকের এই পুরাকীর্তিগুলো গবেষণা ও সাধারণের প্রদর্শনের জন্য তাঁরা বরেন্দ্র জাদুঘরে নিয়ে যান। প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম ১৮৯৭-৮০ সালে প্রকাশিত ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন, এই প্রত্নস্থলটি খনন করা হলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুরাকীর্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, স্থানটির প্রায় পুরোটাই এখন কৃষিজমির সঙ্গে মিশে গেছে। বোঝার উপায় নেই যে এখানেই একসময় ইতিহাসের এক অনন্য সাক্ষ্য ছিল।
নওগাঁর ধামইরহাটের ঐতিহাসিক গুরুত্ববহ স্থান মাহিসন্তোষ। খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতক থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত প্রায় চার বছর স্থানটি মুসলমান শাসকদের সামরিক ও প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে। এখানে ছিল সুলতান বারবাক শাহের বারবাকাবাদ টাঁকশাল। এখানেই ছিল শায়খ শরফুদ্দীন ইয়াহিয়া মানেরীর বাবা ইয়াহিয়া মানেরীর ওস্তাদ প্রখ্যাত আলেম মাওলানা তাকীউদ্দীন আল-আরাবির মাদ্রাসা। মাত্র দুই দশক আগেও ওই টাঁকশাল ও মাদ্রাসার কিছু স্থাপত্য-চিহ্ন দেখা যেত। এখন তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। হয়তো ধর্মীয় কারণেই শুধু মওলানা তাকীউদ্দীন আল-আরাবির মাজারটি টিকিয়ে রাখা হয়েছে। সাত থেকে আট কিলোমিটার বিস্তৃত এই প্রত্নভূমিতে গেলে শুধু চোখে পড়ে বদলিবৃক্ষের সারি।
একই দৃশ্য চোখে পড়বে, রামাবতীখ্যাত পাল শাসকদের রাজধানী(?) নওগাঁর পত্নীতলার আমাইরে গেলে। অনুরূপ অবস্থা রাজশাহীর রোহনপুরের নওদাবুরুজেও। প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুমান, এখানে ছিল প্রাচীন বৌদ্ধবিহার। এখান থেকে প্রস্তরে নির্মিত বেশ কয়েকটি বিষ্ণু, সূর্য, গণেশ ও শিবের ভাস্কর্য সংগ্রহ করে জাদুঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য, এসব সংগ্রহ কলকাতা জাদুঘরে চলে গেছে। অনুমান করা হয়, এখানকার নওদা, পিরপুর, ভাগলপুর, রোহনপুর, গুনার, প্রাসাদপুর এবং কসবা—গ্রামগুলো ঘিরে একসময় বিশাল প্রাচীন নগরী ছিল। নগরীর অভ্যন্তরে ছিল বৌদ্ধবিহার। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ভগ্ন ইট, প্রস্তরখণ্ড, মৃত্পাত্রের ভগ্নাংশ সেই প্রাচীনতার সাক্ষ্য বহন করে। বেশ কয়েকটি প্রাচীন ঢিবি এখানে রয়েছে। বোঝাই যায়, এর অভ্যন্তরে মন্দির বা স্তূপ জাতীয় কোনো অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ লুকিয়ে আছে। কেউ কেউ ধারণা করেন, প্রখ্যাত মুসলিম ঐতিহাসিক মীনহাজ-ই-সিরাজের নওদীহ (নওদা) শহর ছিল এটিই। এখান থেকেই নৌপথে সেন রাজা লক্ষ্মণ সেন পুনর্ভবা ও মহানন্দা নদী হয়ে সুলতানগঞ্জের কাছে পদ্মা নদীপথে বিক্রমপুর পালিয়ে গিয়েছিলেন।
স্বাধীনতার পর চার দশক পেরুচ্ছে। দেশের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার দাবি দেশবাসীর। আর এই ইতিহাস রচনা করতে গেলে তাকাতে হবে অতীতের দিকে। যেখানে থরে থরে সংরক্ষিত আছে রাজনীতি, ধর্ম, ভাষা, সাহিত্য, শিল্পকলা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি প্রভৃতি বিবর্তনের সব তথ্য। আগে সেগুলো খুঁজে বের করা দরকার। নরসিংদীর উয়ারি-বটেশ্বরী প্রত্নপীঠের উত্খননে অজ্ঞাত এক জনপদের কাহিনী আবিষ্কৃত হয়েছে। এমন অনেক অজ্ঞাত কাহিনীর অধ্যায় হয়তো লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে আছে। ইতিহাসের আকর উপাত্তের উত্স এসব প্রত্নঢিবি এখনো যদি বিজ্ঞানভিত্তিতে উত্খনন করা যায়, অনেক তথ্য-উপাত্তের সন্ধান পাওয়া যাবে, যা আমাদের জাতীয় ইতিহাস পুনর্গঠনে মৌল উপাদান হিসেবে ব্যবহূত হবে। দক্ষিণ এশিয়ার এই গাঙ্গেয় ভূভাগে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সঠিক, পূর্ণাঙ্গ এবং নির্ভরযোগ্য ইতিহাস রচনা তখনই হয়তো সম্ভব হবে। ঐতিহাসিক আর জি কলিংউডের ভাষায়—এখনই হবে ‘রি এনাক্টমেন্ট অব পাস্ট এক্সপেরিয়েন্স’ রচনা।
প্রাচীন বাংলা আর বাঙালিত্বের সব গৌরব-অহঙ্কার আবিষ্কারের স্বার্থে, একটি ঐতিহাসিক জাতি হিসেবে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে আমরা সরকারকে বিষয়টির ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানাই। আর যেন পুরাকীর্তির উত্স ওই সব প্রত্নপীঠের ক্ষতিসাধন না করা হয়। ধ্বংস হওয়ার আগেই সেসব জায়গায় খননকাজ সম্পন্ন করে পুরাকীর্তি উদ্ধার-প্রক্রিয়া শুরু করা অত্যন্ত জরুরি।
ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী: অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
ইউএনওর গাড়িতে করেই তানোরে গেলাম। তিনি তৈরিই ছিলেন। গাড়িতে উঠে পড়লেন আমাদের সঙ্গে। আমাদের নিয়ে গেলেন ধানোরা নামক প্রায় জনমানবশূন্য এক জায়গায়। বাঁশঝাড় আর লতাগুল্মে আচ্ছাদিত স্থান। সেখানে রয়েছে উঁচু দুটি ঢিবি। স্থানীয় লোকেরা বড় ঢিবিকে বলে রাজবাড়ী আর ছোটটিকে বলে বুরুজ। সেখানে চারদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে মৃত্ফলকের ভগ্নাংশ, খণ্ডিত ইট ইত্যাদি। ঢিবি দুটি যে দেয়াল দিয়ে ঘেরা ছিল তা সহজে অনুমান করা যায়। অতি সম্প্রতি যে এখানকার ভগ্নদশাগ্রস্ত দেয়াল থেকে ইট খুলে নিয়ে গেছে লোকজন, তা স্পষ্ট বোঝা যায়। জায়গাটির দখলদার, ধানোরার জনৈক কৃষক ঢিবি দুটি কেটে ফেলে কৃষিজমিতে রূপান্তরের কাজ শুরু করেছেন। এটি সরেজমিন দেখে গিয়েই ইউএনও আমাকে স্মরণ করেছেন।
জায়গাটি আদতে প্রত্নতত্ত্বের একটি সংরক্ষিত এলাকা। ব্রিটিশ আমলেই ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ এটি প্রাচীন বৌদ্ধবিহার হিসেবে তাদের ‘প্রটেকটেড মনুমেন্ট’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। সপ্তম শতক এই প্রত্নস্থলটির সময়কাল বলে তারা তাদের বার্ষিক কার্যবিবরণীতে উল্লেখ করে। ইউএনও সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করায় আপাতত নির্ঘাৎ ধ্বংসের হাত থেকে প্রত্নস্থলটি বেঁচে যায়।
দেশজুড়ে অসংখ্য এ ধরনের প্রত্নপীঠ বা প্রত্নঢিবি রয়েছে। আমার জানা মতে, বৃহত্তর রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর জেলায়ই এর সংখ্যা শতাধিক হবে। আমি বর্তমান রাজশাহী ও নওগাঁ জেলার বেশকিছু এ ধরনের প্রত্নপীঠের কথা জানি। যার মধ্যে অন্তত ডজন-দুয়েক প্রত্নপীঠ তার গৌরব হারিয়ে কৃষিজমিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
রাজশাহী জেলা সদর থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার উত্তর-দক্ষিণে গোদাগাড়ী উপজেলার মাণ্ডৈল গ্রাম। বেশকিছু পুরাকীর্তি এখান তকে উদ্ধার করা হয় গত শতকের গোড়ার দিকে। রাজশাহীর ‘বরেন্দ্র অনুসন্ধান সমিতি’র কর্মকর্তা শরৎ কুমার রায়, ঐতিহাসিক অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় প্রমুখ কৃতবিদ্য ব্যক্তি প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানে গিয়ে এখান থেকে বিরল কিছু প্রত্নবস্তু সংগ্রহ করেন। এর মধ্যে ছিল বঙ্গীয় শিল্পকলার অনন্য নিদর্শন পুরাবস্তু ব্রোঞ্জ নির্মিত একটি জৈনমূর্তি। এ ছাড়া ওই অনুসন্ধানী দল এখান থেকে কালো পাথরের নির্মিত বিষ্ণু, বুদ্ধ এবং হর গৌরী মূর্তিসহ আরও বেশকিছু নিদর্শন সংগ্রহ করে। দশম-একাদশ শতকের এই পুরাকীর্তিগুলো গবেষণা ও সাধারণের প্রদর্শনের জন্য তাঁরা বরেন্দ্র জাদুঘরে নিয়ে যান। প্রত্নতত্ত্ববিদ স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম ১৮৯৭-৮০ সালে প্রকাশিত ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন, এই প্রত্নস্থলটি খনন করা হলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুরাকীর্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, স্থানটির প্রায় পুরোটাই এখন কৃষিজমির সঙ্গে মিশে গেছে। বোঝার উপায় নেই যে এখানেই একসময় ইতিহাসের এক অনন্য সাক্ষ্য ছিল।
নওগাঁর ধামইরহাটের ঐতিহাসিক গুরুত্ববহ স্থান মাহিসন্তোষ। খ্রিষ্টীয় ত্রয়োদশ শতক থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত প্রায় চার বছর স্থানটি মুসলমান শাসকদের সামরিক ও প্রশাসনিক ইউনিট হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে। এখানে ছিল সুলতান বারবাক শাহের বারবাকাবাদ টাঁকশাল। এখানেই ছিল শায়খ শরফুদ্দীন ইয়াহিয়া মানেরীর বাবা ইয়াহিয়া মানেরীর ওস্তাদ প্রখ্যাত আলেম মাওলানা তাকীউদ্দীন আল-আরাবির মাদ্রাসা। মাত্র দুই দশক আগেও ওই টাঁকশাল ও মাদ্রাসার কিছু স্থাপত্য-চিহ্ন দেখা যেত। এখন তার কিছুই অবশিষ্ট নেই। হয়তো ধর্মীয় কারণেই শুধু মওলানা তাকীউদ্দীন আল-আরাবির মাজারটি টিকিয়ে রাখা হয়েছে। সাত থেকে আট কিলোমিটার বিস্তৃত এই প্রত্নভূমিতে গেলে শুধু চোখে পড়ে বদলিবৃক্ষের সারি।
একই দৃশ্য চোখে পড়বে, রামাবতীখ্যাত পাল শাসকদের রাজধানী(?) নওগাঁর পত্নীতলার আমাইরে গেলে। অনুরূপ অবস্থা রাজশাহীর রোহনপুরের নওদাবুরুজেও। প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুমান, এখানে ছিল প্রাচীন বৌদ্ধবিহার। এখান থেকে প্রস্তরে নির্মিত বেশ কয়েকটি বিষ্ণু, সূর্য, গণেশ ও শিবের ভাস্কর্য সংগ্রহ করে জাদুঘরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বলা বাহুল্য, এসব সংগ্রহ কলকাতা জাদুঘরে চলে গেছে। অনুমান করা হয়, এখানকার নওদা, পিরপুর, ভাগলপুর, রোহনপুর, গুনার, প্রাসাদপুর এবং কসবা—গ্রামগুলো ঘিরে একসময় বিশাল প্রাচীন নগরী ছিল। নগরীর অভ্যন্তরে ছিল বৌদ্ধবিহার। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ভগ্ন ইট, প্রস্তরখণ্ড, মৃত্পাত্রের ভগ্নাংশ সেই প্রাচীনতার সাক্ষ্য বহন করে। বেশ কয়েকটি প্রাচীন ঢিবি এখানে রয়েছে। বোঝাই যায়, এর অভ্যন্তরে মন্দির বা স্তূপ জাতীয় কোনো অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ লুকিয়ে আছে। কেউ কেউ ধারণা করেন, প্রখ্যাত মুসলিম ঐতিহাসিক মীনহাজ-ই-সিরাজের নওদীহ (নওদা) শহর ছিল এটিই। এখান থেকেই নৌপথে সেন রাজা লক্ষ্মণ সেন পুনর্ভবা ও মহানন্দা নদী হয়ে সুলতানগঞ্জের কাছে পদ্মা নদীপথে বিক্রমপুর পালিয়ে গিয়েছিলেন।
স্বাধীনতার পর চার দশক পেরুচ্ছে। দেশের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার দাবি দেশবাসীর। আর এই ইতিহাস রচনা করতে গেলে তাকাতে হবে অতীতের দিকে। যেখানে থরে থরে সংরক্ষিত আছে রাজনীতি, ধর্ম, ভাষা, সাহিত্য, শিল্পকলা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি প্রভৃতি বিবর্তনের সব তথ্য। আগে সেগুলো খুঁজে বের করা দরকার। নরসিংদীর উয়ারি-বটেশ্বরী প্রত্নপীঠের উত্খননে অজ্ঞাত এক জনপদের কাহিনী আবিষ্কৃত হয়েছে। এমন অনেক অজ্ঞাত কাহিনীর অধ্যায় হয়তো লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে আছে। ইতিহাসের আকর উপাত্তের উত্স এসব প্রত্নঢিবি এখনো যদি বিজ্ঞানভিত্তিতে উত্খনন করা যায়, অনেক তথ্য-উপাত্তের সন্ধান পাওয়া যাবে, যা আমাদের জাতীয় ইতিহাস পুনর্গঠনে মৌল উপাদান হিসেবে ব্যবহূত হবে। দক্ষিণ এশিয়ার এই গাঙ্গেয় ভূভাগে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর সঠিক, পূর্ণাঙ্গ এবং নির্ভরযোগ্য ইতিহাস রচনা তখনই হয়তো সম্ভব হবে। ঐতিহাসিক আর জি কলিংউডের ভাষায়—এখনই হবে ‘রি এনাক্টমেন্ট অব পাস্ট এক্সপেরিয়েন্স’ রচনা।
প্রাচীন বাংলা আর বাঙালিত্বের সব গৌরব-অহঙ্কার আবিষ্কারের স্বার্থে, একটি ঐতিহাসিক জাতি হিসেবে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে আমরা সরকারকে বিষয়টির ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানাই। আর যেন পুরাকীর্তির উত্স ওই সব প্রত্নপীঠের ক্ষতিসাধন না করা হয়। ধ্বংস হওয়ার আগেই সেসব জায়গায় খননকাজ সম্পন্ন করে পুরাকীর্তি উদ্ধার-প্রক্রিয়া শুরু করা অত্যন্ত জরুরি।
ড. সাইফুদ্দীন চৌধুরী: অধ্যাপক, ফোকলোর বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments